বৃহস্পতিবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

বিশ্বজুড়ে খ্যাতিমান বাংলাদেশি

সাইফ ইমন

বিশ্বজুড়ে খ্যাতিমান বাংলাদেশি

বিশ্বজুড়ে এগিয়ে চলা বাংলাদেশি ও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মানুষগুলো সব সময়ই আপামর জনসাধারণের অনুপ্রেরণার উৎস। পুরস্কার, আবিষ্কার আর সৃজনশীল অবদান রাখা কীর্তিমানদের গল্প আমাদের এগিয়ে চলার শক্তি জোগায়। সেই সঙ্গে আমাদের মেধাকে আরও শানিত করে। বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশিরা অবস্থান করছেন সাফল্যের শিখরে। বিশ্ব রাজনীতি থেকে শুরু করে বিজ্ঞান শিল্পকলা, খেলাধুলা প্রতিটি ক্ষেত্রেই তারা নিজেদের নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। বিশ্বপরিসরে সফল এই রকম কিছু মানুষকে নিয়েই আজকের রকমারি—

 

বিশ শতকের সেরা স্থপতি

ড. এফ আর খান

এফ আর খান বা ফজলুর রহমান খানকে বলা হয় বিশ্বখ্যাত স্থপতি ও পুরকৌশলী। তিনি পৃথিবীর অন্যতম উচ্চ ভবন শিকাগোর সিয়ারস টাওয়ারের নকশা প্রণয়ন করেন। যা বর্তমানে উইওলস টাওয়ার নামে পরিচিত। তাকে বিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রকৌশলী বলা হয়। ২০০৯ সালে কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেওয়ার সময় বলেছিলেন, ‘আমরা শ্রদ্ধা জানাই এক বাঙালি প্রকৌশলীকে। তার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। কারণ আমাদের দেশের সর্বোচ্চ আকাশচুম্বী ভবনটি তারই নকশা করা। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যাকে কৃতজ্ঞ চিত্তে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন তিনি ড. ফজলুর রহমান খান বা এফ আর খান। ফজলুর রহমান খান ১৯২৯ সালের ৩ এপ্রিল মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৪৪ সালে আরমানিটোলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করে কলকাতার শিবপুর বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হন। পরবর্তীতে তৎকালীন আহসানউলাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (বর্তমানে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে বাকি পরীক্ষা সমাপ্ত করেন। তিনি ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয় অ্যাট আরবানা শ্যাম্পেইন থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয়ের অধ্যাপক মির এম আলী তার আর্ট অব দ্য স্কাইস্ক্র্যাপার : দ্য জিনিয়াস অব ফজলুর রহমান খান বইতে উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশি এই বিদ্বানকে বলা হয় ‘আইনস্টাইন অব স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার।’ ফজলুর রহমান খানের নকশায় গড়া সিয়ারস টাওয়ার ১৯৭৪ সালে নির্মিত হয়। এই ভবনটি প্রায় ৩০ বছর ধরে বিশ্বের উচ্চতম ভবন ছিল। আমেরিকার সর্বোচ্চ ভবন ১১০তলা বিশিষ্ট সিয়ারস টাওয়ারের নকশা এঁকেছিলেন বাংলার এই আইনস্টাইন। তার জীবনী সম্পর্কে জানলে আসলেই বোঝা যাবে, তার এই উপাধির সার্থকতা কতটুকু। এফ আর খান বলতেন, ‘মানুষ বাঁচে তার স্বপ্নের জন্য। মানুষ বাঁচে তার স্বপ্ন পূরণের জন্য। নিজের কথার সম্পূর্ণ প্রতিফলন তিনি তার নিজের সমগ্র জীবনে রেখে গিয়েছেন। ১৯৮২ সালের ২৭ মার্চ তিনি মৃত্যু বরণ করেন।

 

 

জাপানে বাঙালি বন্ধু

ড. রাধা বিনোদ পাল

জাপানিদের ইতিহাসে রাধা বিনোদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। জাপানে ইটের গায়ে এখনো লেখা রয়েছে আর বি ডি অর্থাৎ রাধা বিনোদ পাল। মানুষ বেঁচে থাকে নিজের কর্মে। যার মাধ্যমে সে অর্জন করে সুনাম, খ্যাতি ও বিশ্বপরিচয়। কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার সদরপুর ইউনিয়নের নিভৃত পল্লী কাকিলাদহ শৈশব কেটেছে রাধা বিনোদ পালের। জাপানিদের কাছে দেবতুল্য এই মানুষটি ১৮৮৬ সালের ২৭ জানুয়ারি দৌলতপুর উপজেলার মথুুরাপুর ইউনিয়নের মৌজা সালিমপুরের অধীন তারাগুনিয়া গ্রামে মাতুলালয়ে জন্ম গ্রহণ করেন। এলাকাটি এখন জজপাড়া নামে পরিচিত। ড. রাধা বিনোদ পাল ছিলেন একজন আন্তর্জাতিক আদালতের বিচারক। প্রতিভাবান এই ব্যক্তিত্বের সুখ্যাতি শুধু পাকিস্তান-ভারতের সীমানা ছাড়িয়ে পৌঁছে গিয়েছিল বিশ্বের দরবারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ১৯৪৬-৪৮ সাল পর্যন্ত জাপানের রাজধানী টোকিও মহানগরে জাপানকে যুদ্ধাপরাধী সাব্যস্ত করে যে বিশেষ আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার হয়, ড. রাধা বিনোদ পাল ছিলেন সেই আদালতের অন্যতম বিচারপতি। তিনি তার ৮০০ পৃষ্ঠার যৌক্তিক রায় দিয়ে জাপানকে যুদ্ধাপরাধ থেকে মুক্ত করেন। পরবর্তীতে এ রায় বিশ্বনন্দিত ঐতিহাসিক রায়ের মর্যাদা পায়। এরপর তিনি জাপান-বন্ধু ভারতীয় বলে খ্যাতি অর্জন করেন। ড. রাধা বিনোদ পালকে সম্মানসূচক ডিলিট ডিগ্রি প্রদান করা হয় নিহোন বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে ১৯৬৬ সাল। জাপান সম্রাট হিরোহিতোর কাছ থেকে জাপানের সর্বোচ্চ সম্মানীয় পদক ‘কোক্কা কুনশোও’ গ্রহণ করেছিলেন। জাপানের রাজধানী টোকিওতে তার নামে রাস্তা রয়েছে। কিয়োটো শহরে রয়েছে তার নামে জাদুঘর, রাস্তার নামকরণ ও স্ট্যাচ। টোকিও ট্রায়াল টেলিসিরিয়ালটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুদ্ধাপরাধীদের ট্রায়াল নিয়ে নির্মিত হলে তার চরিত্রে অভিনয় করেন ভারতীয় অভিনেতা ইরফান খান। খ্যাতিমান এই বাঙালি ১৯৬৭ সালের ১০ জানুয়ারি কলকাতায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

 

 

ইলেকট্রিক সেন্সর উদ্ভাবন

মুহাম্মদ আশরাফুল আলম

নতুন একটি ‘ইলেকট্রিক সেন্সর’ উদ্ভাবন করেছেন বিজ্ঞানী মুহাম্মদ আশরাফুল আলম। সহযোগী হিসেবে ছিলেন আইদা ইব্রাহিম ও জয় এন গুপ্তা। খাদ্য নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে তাদের এই সেন্সর যুগান্তকারী এক আবিষ্কার। উদ্ভাবিত সেন্সর দিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যেই জীবিত ও মৃত ব্যাকটেরিয়ার কোষ শনাক্ত করা যাবে। ফলে রোগ নির্ণয় হবে আগের চেয়ে অনেক বেশি নির্ভুল। একই সঙ্গে সব ধরনের খাবারের সুরক্ষা নিশ্চিত হবে পুরোপুরিভাবে। ব্যাকটেরিয়া কালচার করার জন্য সনাতন পদ্ধতিতে বেশ সময় লাগে। সেটিকেই চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেওয়া হয়েছিল এ গবেষণার আগে। অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার কীভাবে আরও নির্ভুল করা যায় তা নিয়ে অনেকেই বহুদিন ধরে কাজ করে আসছিলেন। এ ইলেকট্রিক সেন্সরটি সেই কাজগুলোর একটি ভালো উত্তর হতে যাচ্ছে। শতাধিক ইলেকট্রিক সেন্সর থাকছে একটি ইলেকট্রিকে চিপে। প্রতিটি সেন্সর বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়ার পরিচয় আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে সক্ষম হবে। ব্যাকটেরিয়া নির্দিষ্টকরণে এ ধরনের সেন্সরের ওপর ভরসা রাখছেন গবেষকরা। তাদের ভাষায় একেবারেই সুনির্দিষ্টভাবে ব্যাকটেরিয়াকে চিহ্নিত করতে সক্ষম হবে তাদের ইলেকট্রিক সেন্সর। এরই মধ্যে এটি প্রমাণিত হয়েছে, ইলেকট্রিক সেন্সর মৃত এবং জীবিত ব্যাকটেরিয়াকে শতভাগ নির্ভুলভাবে চিহ্নিত করে আলাদা করতে পারছে।

 

 

অলিম্পিয়ান অ্যাথলেট রাজশাহীর মেয়ে

মার্গারিটা মামুন

‘দ্য বেঙ্গল টাইগার’ তার ডাকনাম! বাবা-মা রিতা নামে ডাকেন। কিন্তু পুরো নাম মার্গারিটা মামুন। জন্ম রাশিয়ার রাজধানী শহর মস্কোতে হলেও বাড়ি বাংলাদেশের রাজশাহীতে। বাবা মেরিন ইঞ্জিনিয়ার আবদুল্লাহ আল মামুন রাশিয়ায় পড়তে যান। তখন  থেকেই রাশিয়া থাকে মামুন পরিবার। সে কারণেই বাংলাদেশ রাশিয়ার দ্বৈত নাগরিক মামুন-আন্না দম্পতির সন্তান মার্গারিটা মামুন। এই মার্গারিটা মামুনই এবার রিও অলিম্পিকে রিদমিক জিমন্যাস্টিকসে সোনা জিতে হৈচৈ ফেলে দিয়েছেন। রাশিয়ার হয়ে  সোনা জিতলেও মার্গারিটা বলেছেন, এই অর্জন বাংলাদেশেরও। কেননা জুনিয়র পর্যায়ে একবার বাংলাদেশের হয়েও অংশগ্রহণ করেছেন। ৭৬.৪৮৩ স্কোর করে অলিম্পিক থেকে প্রথম সোনা জিতেছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই মেয়ে। ৭৫.৬০৮  স্কোর করে সিলভার জিতেছেন রাশিয়ার ইয়ানা কুদ্রিয়াসেভা। রিদমিক জিমন্যাস্টিকসের পয়েন্ট বিভাগে দেওয়া হয়ে থাকে- হুপ, বল, ক্লাবস ও রিবন। রিদমিক জিমন্যাস্টিকসে সোনার পদকটা মার্গারিটারই প্রাপ্য ছিল। বর্তমানে এই ইভেন্টে তিনিই বিশ্বসেরা। রিদমিক জিমন্যাস্টিকসে বিশ্ব রেকর্ডটিও তার গড়া। চলতি বছর বাকু বিশ্বকাপে ৭৭.১৫০ স্কোর করেছিলেন। রিদমিক জিমন্যাস্টিকসের বার্ষিক প্রতিযোগিতায় তার স্কোর ছিল ৭৭.১০০। এ ইভেন্টে এর আগে কোনো জিমন্যাস্টিকস ৭৭  স্কোর করতে পারেননি। তারপরও হাতছাড়া হয়ে যেত পারত, কিন্তু শেষ মুহূর্তে সোনার পদকটি হাতছাড়া হয়নি তার।

 

 

বিশ্বখ্যাত জিন বিজ্ঞানী

ড. আবেদ চৌধুরী

ড. আবেদ চৌধুরী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এক জিন বিজ্ঞানী। জন্ম বাংলাদেশের মৌলভীবাজারে। যুক্তরাষ্ট্রে কৃষি বিষয়ে উচ্চশিক্ষা শেষে চাকরি নিয়ে পাড়ি জমিয়ে ছিলেন দ্বীপ মহাদেশ অস্ট্রেলিয়ায়। সেখানকার জাতীয় গবেষণা সংস্থার প্রধান ধান-বিজ্ঞানী হিসেবে ধানের জিন নিয়ে গবেষণা করে কাটিয়ে দিয়েছেন জীবনের ২০টি বছর। এ পর্যন্ত তিনি ৩০০ রকমের নতুন ধান আবিষ্কার করেছেন ড. আবেদ চৌধুরী। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়াতে উচ্চ ফলনশীল ধান উৎপাদন ও ভবিষ্যতের খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ে গবেষণা করছেন। পৃথিবীর প্রথম সারির জীববিজ্ঞান গবেষকদের একজন তিনি। কৃষকদের হাইব্রিড পদ্ধতি শিখিয়ে দেন যাতে তারা বেশি উৎপাদন করতে পারেন। পাশপাশি সনাতন বীজ সংরক্ষণ প্রক্রিয়াকেও টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেন। যাতে একাধিক উপায়ে সংরক্ষণ পদ্ধতি বীজের শর্ত ঠিক রাখে। কৃষকরা যাতে হাইব্রিড বীজ উৎপাদন করতে পারে সে লক্ষ্যে তিনি কাজ করছেন। ড. আবেদ চৌধুরী সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার হাজীপুর গ্রামের সন্তান। তিনি মৌলভীবাজার সরকারি স্কুল থেকে এসএসসি, নটর ডেম কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেন। পরে তিনি হার্ভার্ডসহ বিশ্বের অনেক নামিদামি প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেন এবং সেখানে শিক্ষক-গবেষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

 

 

কৃত্রিম কিডনি উদ্ভাবক

শুভ রায়

বাঙালি বিজ্ঞানী শুভ রায় কিডনি রোগীদের জন্য নিয়ে এসেছেন শুভ বার্তা। তিনি কৃত্রিম কিডনি তৈরি করে চারদিকে রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছেন। আকারে হাতের মুঠোর সমান এবং তুলনামূলক অনেক কম খরচে পাওয়া যাবে কৃত্রিম এই কিডনি। ২০১৯-এর মধ্যেই বাজারে আসার সম্ভাবনা রয়েছে কৃত্রিম কিডনির। শুভ রায় বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক হিসেবে আছেন।

সর্বশেষ খবর