বুধবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

দেশে দেশে গোপন কারাগার

সাইফ ইমন

দেশে দেশে গোপন কারাগার

ইরাক

নাইন ইলেভেনে যুক্তরাষ্ট্রে টুইন টাওয়ার ও পেন্টাগনের হামলার পর গোটা বিশ্বের চেহারা বদলে যায়। সন্ত্রাসীদের নিশ্চিহ্ন করতে মধ্যপ্রাচ্যে আগ্রাসী ভূমিকা রাখতে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। যার ফল ভুগতে হয় ইরাককেও। ইরাকে সরকার পতনের পর যুক্তরাষ্ট্র সেখানে সন্ত্রাসী সন্দেহে বহু নাগরিককে বন্দী করে। মার্কিন সেনারা লাখো বন্দীকে ইরাকি কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেয়। এই মানুষগুলোর ভাগ্যে জোটে অমানবিক জীবন। জেলে রেখে তাদের ওপর চালানো হয় নির্মম নির্যাতন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলো ইরাকের গোপন কারাগারের কথা বারবার বলে আসছে। ইরাকের সরকার এ বিষয় এড়িয়ে গেলেও গোপন কারাগারের বন্দীদের দুঃসহ জীবনের কথা গোপন থাকেনি। এসব গোপন কারাগারের খবর সংগ্রহেও রয়েছে বাধা। এসব কারাগারের ঠিকানা পর্যন্ত গোপন রয়ে গেছে বিশ্ববাসীর কাছে।

 

সিরিয়া

গোপন কারাগারের কালিমা রয়েছে সিরিয়াতেও। এসব কারাগারে বন্দীদের তালিকায় সরকারবিরোধী সমর্থক, সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ত রয়েছে এমন অপরাধীরা। মানবাধিকার সংস্থাগুলো গোপন কারাগারের নির্যাতনের অভিযোগ নিয়ে সোচ্চার থাকলেও এসব কারাগারের কথা অস্বীকার করে সিরিয়া। গোপন কারাগারে বন্দীজীবন মানেই নির্যাতন আর বিচার না পাওয়া মানুষের গল্প— এই কথা আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বারবার এসেছে। গোপন কারাগারের ঠিকানা ও তথ্য সংগ্রহে কড়াকড়ি থাকায় সত্যিকারের চিত্রটা কখনোই পরিষ্কার নয়। তবে বিভিন্ন সময় সিরিয়ার গোপন কারাগারে বন্দী থাকা মানুষের ভাষ্য প্রচার করেছে প্রথমসারির মিডিয়াগুলো। সেখানে তারা জিঙ্গাসাবাদের সময় শুধু শারীরিক নয়, মানসিকভাবেও নির্মম নির্যাতনের কথা তুলে ধরেছেন। সিরিয়ার গোপন কারাগারে বন্দী নির্যাতনের পাশাপাশি, হত্যাকাণ্ডের অভিযোগও রয়েছে।

 

চীন

গোপন কারাগারের তথ্য কখনোই সুনিশ্চিতভাবে জানা যায় না। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ও আন্তর্জাতিক মিডিয়া চীনের বেইজিংয়ে গোপন কারাগার রয়েছে এমন অভিযোগ করেছে। আল জাজিরার একটি প্রতিবেদনও এমনটি দাবি করে। যদিও গোপন কারাগার ও সেখানে বন্দী নির্যাতনের বিষয়টি সবসময়ই এড়িয়ে গিয়েছে চীন।

গোপন কারাগার কোথায় এমন প্রশ্নের জবাবও পাওয়া যায় না। অবশ্য কারাগারে নির্যাতন ও সব গোপন কারাগার বন্ধ করে দিতে চীনের প্রতি আহ্বান জানায় জাতিসংঘের একটি পর্যবেক্ষক কমিটি। সেই সঙ্গে দেশটির আইনজীবী ও বিরোধীকর্মীদের নির্বিচারে আটক না করারও আহ্বান জানিয়েছিল জাতিসংঘের ওই কমিটি। চীন সরকারের ঊর্ধ্বতন প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে দুই দিনব্যাপী শুনানির পর কমিটি এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই প্রতিবেদনেই এসব বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হয়েছিল। আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীদের ওপর ধরপাকড় বন্ধেরও আহ্বান জানিয়েছিল জাতিসংঘ। 

 

ইয়েমেন

ইয়েমেনে গড়ে উঠেছে গোপন বন্দীশালা। সংযুক্ত আরব আমিরাতের  ইয়েমেনের এই সব গোপন কারাগারে আটক ব্যক্তিদের সঙ্গে যুদ্ধাপরাধ করছে বলে মন্তব্য করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বরাত দিয়ে এ খবর দিয়েছে আল-জাজিরা টিভি চ্যানেল। সে প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায় যে আরব আমিরাতের মদদপুষ্ট অস্ত্রধারীরা গোপন কারাগারগুলোতে নির্মম নির্যাতনে জড়িত রয়েছে। অবশ্য এর আগে মার্কিন বার্তা সংস্থা এপি জানায়, দক্ষিণ ইয়েমেনে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ১৮টি গোপন কারাগার রয়েছে। আর বন্দীর সংখ্যাটাও জানিয়েছে তারা। তথ্য মতে এই গোপন কারগারগুলোতে দুই হাজারের বেশি বন্দী আটক রয়েছে এবং তাদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হচ্ছে।

সেখানে মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে যা যুদ্ধাপরাধের শামিল।

 

 মেক্সিকোর কারাগারে গোপন সুড়ঙ্গ

কারাগার মানেই যেখানে অপরাধীদের শাস্তি হিসেবে আটকে রাখা হয় শুধরানোর জন্য। কিন্তু সেই কারাগারেই যদি চলে মারাত্মক সব অপরাধ! ঠিক এরকম কয়েকটি ঘটনাই ঘটেছে মেক্সিকোর বিভিন্ন কারাগারে। প্রায়ই এখানে ঘটে কারাগার থেকে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা। গত বছর একটি কারাগারে গোপন সুড়ঙ্গ পাওয়া যায়। যা তোলপাড় করে ফেলে সারাবিশ্বে। সুড়ঙ্গটি তরল মদ, মাদক দ্রব্য ও ধারালো অস্ত্র বোঝাই ছিল। পুলিশের নজরে আসার পরই এর অস্তিত্বের সম্পর্কে প্রথম জানা যায়। টামাউলিপাস রাজ্যে অবস্থিত ওই কারাগারটির নাম রেয়নসা।  মেক্সিকোর টামাউলিপাস রাজ্য পুলিশ জানিয়েছে, ইট দিয়ে সুড়ঙ্গটি আড়াল করে রাখা হয়েছিল। এর গভীরতা পাঁচ মিটারের বেশি। তবে সুড়ঙ্গের কাজ শেষ হয়নি বিধায় এটি ব্যবহার করে কেউ পালাতে পারেনি। জিওথার্মাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভূগর্ভস্থ কার্যক্রম সম্পর্কে জানার  চেষ্টা করার সময় সুড়ঙ্গটির সন্ধান পাওয়া যায় বলে স্থানীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে। মেক্সিকোয় কারাগার থেকে পালাতে আসামিদের সুড়ঙ্গের ব্যবহার নতুন  কোনো ঘটনা নয়। গত বছরের মার্চ মাসে টামাউলিপাস রাজ্যের রাজধানী সিউডাডের কারাগার থেকে একযোগে ২৯ বন্দী সুড়ঙ্গ ব্যবহার করে পলায়ন করে। পালিয়ে যাওয়া ওই ২৯ জনের মধ্যে একজন ছিলেন ২০১২ সালে কারেন আলেজান্দ্রো রদ্রিগুয়েজের অপহরণ ও হত্যা মামলার আসামি। মার্চ মাসেই মেক্সিকোয় জেল ভেঙে পালানোর আরেকটি ঘটনা ঘটে। সিনালোয়া রাজ্যের একটি কারাগার ভেঙে পালিয়ে যায় আরেক মাদক সম্রাট হুয়ান জোস এসপারাগোজার ছেলে মনজন। এসপারাগোজা এক সময়ে এল চাপোর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন। সিনালোয়া রাজ্যে বিশাল মাদক সিন্ডিকেট রয়েছে তার। এদিকে, এর চাপো মেক্সিকান কারাগার থেকে পালিয়ে গিয়েছিল ২০১৫ সালে। পরবর্তীতে ছয়মাস পর তাকে আবার আটক করা হয়। যদিও এর আগে সে আরও কয়েকবার কারাগার থেকে পালিয়েছে।

 

 

সিআইএর কারাগার

দ্য সল্ট পিট

আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের উত্তরাংশে একটি পুরনো ইট ফ্যাক্টরিতে দ্য সল্ট পিট নামের গোপন কারাগার অবস্থিত। ২০০২ সালে সিআইএ দুই লাখ ডলার ব্যয়ে বিনা বিচারে বন্দী আটকের জায়গা হিসেবে এটি তৈরি করে। সে বছর ২০ নভেম্বর একজন হাই প্রোফাইল বন্দী গুল আহমেদ কারাগারে বন্দী অবস্থায় মারা যান। ২০১২ সালে দ্য ডেইলি বিস্ট পত্রিকা সূত্রে জানা যায়, তাকে অমানবিকভাবে পিটানো হয়, উলঙ্গ করে ছিঁড়ে ফেলা হয় শরীরের অনেক অংশ। শীতের রাতে শিকল দিয়ে বেঁধে মেঝেতেও ফেলে রাখা হয়। রিপোর্ট অনুযায়ী এই বন্দীশালাকে সিআইএর সবচেয়ে বেশি নৃশংস নির্যাতনের অন্ধকূপ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। কিন্তু ২০১৪ সালে মার্কিন সরকার সিআইএর আটক এবং জিজ্ঞাসাবাদ কর্মসূচি সম্পর্কে একটি মার্কিন সিনেট রিপোর্ট প্রকাশ করে। তাতে সিআইএর কোনো কর্মকর্তার এমন কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার সত্যতা মেলেনি।

 

ক্যাম্প ঈগল

২০০৫ সালে বসনিয়ার দুজন ব্যক্তি নিহাদ কারসিক ও আলমিন হার্বেউস বসনিয়ার একটি পাবলিক টেলিভিশন চ্যানেলকে একটি সাক্ষাৎকার দেন। সেখানে তারা ক্যাম্প ঈগলে বন্দী থাকার দিনগুলোর কথা তুলে ধরেন। ক্যাম্পটি বসনিয়া সার্বিয়া সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থিত। তাদের কথায় উঠে আসে, বসনিয়ার সেনারা তাদের অপহরণ করে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ দেয়। ক্যাম্প ঈগল ছিল সাবেক যুগোস্লাভিয়ার বিমান ঘাঁটি। সেখানে তাদেরকে মারা হতো। এরপর সাদা পোশাকের কয়েকজন আমেরিকান জিজ্ঞাসাবাদ করে বুঝতে পারে তারা ভুল ব্যক্তিদের আটক করেছে। তাদেরকে মুখ বন্ধ রাখার শর্তে ৫০০ ডলার ক্ষতিপূরণ দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। ২০০৬ সালে বিবিসি প্রচারিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, সুইস তদন্তকারীরা বেশ কয়েকটি দেশে সিআইএর এরকম গোপন কারাগারের সন্ধান পায়। এদের মাঝে রয়েছে ইতালি, সুইডেন, মেসিডনিয়া, স্পেন, তুরস্ক, জার্মানি, সাইপ্রাস, ইংল্যান্ড, পর্তুগাল, আয়ারল্যান্ড, গ্রিস।

 

ডিটেনশন সাইট

ছোট্ট থাইল্যান্ড কখনোই স্বীকার করেনি সে দেশে গোপন কারাগারের অস্তিত্ব আছে। কিন্তু বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে ঠিকই রিপোর্ট প্রকাশ হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, বন্দীশালা ডিটেনশন সাইট রাজধানী ব্যাংকক বা দেশটির উদন থানি প্রদেশের কোথাও অবস্থিত। ২০০৯ সালে গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সিআইএ ৯২টি রেকর্ড নষ্টের কথা স্বীকার করেছে। তাতে বন্দীদের জিজ্ঞাসাবাদের দৃশ্য ও তথ্য ধারণ করা হয়েছিল। ধারণ করা হয়েছিল এগুলো থাইল্যান্ডের কোনো অজ্ঞাত স্থানের। সেই রিপোর্টে আরও বলা হয়, কারাগারটি মূলত বিভিন্ন নতুন পদ্ধতিতে শাস্তি প্রয়োগ করা হতো। এই নির্মম শিকারদের একজন আবু জুবায়েদ। সৌদি এ নাগরিককে ২০০২ সালে পাকিস্তান থেকে আটক করা হয়। রিপোর্ট অনুযায়ী, জুবায়েদকে পানির নিচে মুখ হা করে চুবিয়ে শাস্তি দেওয়া হতো। আবদ আল রাহীম নামে আরেকজনকেও এভাবে শাস্তি দেওয়া হয়, যাকে ইউ এস এস কোল বোমা বিস্ফোরণের মূল পরিকল্পনাকারী বলে ধরা হয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর