রবিবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

অবৈধ পণ্যের সাম্রাজ্য

সাইফ ইমন

অবৈধ পণ্যের সাম্রাজ্য

অবৈধ অস্ত্রের কেনাবেচা...

অবৈধ অস্ত্রের জন্য আছে ব্ল্যাক মার্কেট। সেখানে অবৈধ অস্ত্রের কেনাবেচা চলছে হরহামেশাই। পৃথিবীর সব দেশেই অবৈধ অস্ত্রের ব্ল্যাক মার্কেট রয়েছে। এমনকি রয়েছে ইন্টারন্যাশনাল ব্ল্যাক মার্কেটও। অনেক দেশে আইন করে অস্ত্রের ব্যক্তিগত মালিকানা নিষিদ্ধ বা সীমিত করেছে। কিন্তু অস্ত্রের চাহিদা পূরণে ব্ল্যাক মার্কেট চলছেই। তা ছাড়া বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনও ব্ল্যাক মার্কেট থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে। কোনো দেশ যেখানে অস্ত্র উৎপাদন বৈধ সেখান থেকে সস্তায় কিনে বা চুরি করে চোরাচালানের মাধ্যমে অস্ত্র পৌঁছে যায় কাক্সিক্ষত গ্রাহকের কাছে। আবার রয়েছে অবৈধ অস্ত্র তৈরির কারখানা। সেখান থেকেও অস্ত্রের জোগান দেওয়া হয়।

অথবা ভিতরের লোক দ্বারা দেশের মধ্যে অস্ত্র প্রস্তুতকারক থেকে চুরি করে এই চাহিদা পূরণ করা হয়। চীনের অস্ত্র প্রস্তুতকারক আধা সরকারি প্রতিষ্ঠান নোরিনকো। তাদের থেকে অস্ত্র কেনা খুব কঠিন কিছু নয়। তবে অস্ত্র কিনতে হয় নির্ধারিত কিছু এজেন্টের মাধ্যমে। এসব এজেন্টের মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপনের পর ‘অ্যান্ড ইউজার্স সার্টিফিকেট’ বা ‘ইইউসি’ জমা দিতে হয়। তারপর কারখানা থেকেই প্রয়োজনমতো অস্ত্র ও গোলাবারুদের সরবরাহ করা হয়। এদিকে পাকিস্তানের পেশওয়ারের দারা আদম হয়ে উঠেছে অবৈধ অস্ত্র উৎপাদনের রাজধানী হিসেবে। এ অঞ্চলের অস্ত্র কারিগররা দ্রুততম সময়ে বিশ্বের যেকোনো সমরাস্ত্র নকল করতে সক্ষম। সেখানে প্রকাশ্যেই এসব অস্ত্রের কেনাবেচা হয়। শুধু অবৈধভাবে অস্ত্র তৈরিই নয়, মানব পাচার, মাদক চোরাচালান, চোরাই গাড়ি থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুয়া ডিগ্রি সব পাওয়া যায় এখানে। বর্তমান বিশ্বে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও হয়ে উঠেছে অস্ত্রের বাজার। সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, আফগানিস্তানসহ বিভিন্ন দেশের উগ্রপন্থি সংগঠনগুলো অস্ত্রের কেনাবেচা করছে সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

 

কিডনির কালোবাজার

মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্রয়-বিক্রয় গোটা বিশ্বেই প্রায় নিষিদ্ধ। কিন্তু সারা বিশ্বে বৃক্কসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন রোগ, ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপ মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এর ফলে কিডনির বৈশ্বিক চাহিদা হু হু করে বাড়ছে। সেই তুলনায় কিডনি সরবরাহ যৎ সামান্য। তার ওপর অনেক সংস্কৃতিতে মৃত্যুর পরও কিডনি দানের স্বীকৃতি নেই। সে জন্য স্বেচ্ছায় কিডনিদাতা খুঁজে পাওয়া না গেলে রোগীকে ডায়ালাইসিস মেশিন আঁকড়েই বেঁচে থাকতে হয়, তাও হয়তো দীর্ঘদিন সম্ভব হয় না। কিডনির বৈধ সরবরাহ ও চাহিদার মধ্যে বিস্তর ফারাক থাকাতেই দেহযন্ত্রের জন্য বিশ্বের সর্ববৃহৎ বাজার তা পূরণ করে। যার বিস্তার ভারত, নেপাল, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও ইরান পর্যন্ত। কালোবাজারে সব থেকে বেশি চাহিদা কিডনির। জীবিত মানুষের কিডনি হলে দাম মোটামুটি, ৩৪,১৯,২৯০ টাকা। মৃত মানুষের কিডনি হলে সেই দাম ১০,০৬,৪৪৬ থেকে ১,৬৭,৭৪,১১২ টাকা।

তবে শ্রীলঙ্কা হয়ে উঠেছে কিডনি বিক্রির নেটওয়ার্কের নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র। সেখানেই ঘটে থাকে অধিকাংশ ট্রান্সপ্লান্ট অপারেশন। আমাদের উপমহাদেশে মানব অঙ্গ কেনাবেচার নিষিদ্ধ ব্যবসা ক্রমান্বয়ে আরও ফুলে-ফেঁপে উঠছে। শুধু কিডনি বাবদই বছরে অবৈধ লেনদেন হয় কয়েক কোটি ডলার। একজন কিডনির কালোবাজারি গণমাধ্যমে বলেন, যদি আপনার কাছে পর্যাপ্ত অর্থ থাকে এবং খুব দ্রুতই চান জিনিসটা, তবে আমার কাছে চলে আসুন নির্দ্বিধায়। আমি একজন দাতা খুঁজে দেব এবং নতুন কিডনি নিয়ে আপনি বাড়ি যেতে পারবেন এক মাসের মধ্যেই। টিভি রিপোর্টারের কাছে অবলীলায় এভাবেই বলে যাচ্ছিলেন সেই কালোবাজারি।

 

বন্যপ্রাণী চোরাচালান

ব্যক্তিগতভাবে জীবন্ত বন্যপ্রাণী ধরা এবং পোষ্য হিসেবে বিক্রি করা বিশ্বের সব জায়গায়ই নিষিদ্ধ। কিন্তু এর পরও বিশ্বের অনেক দেশে বন্যপ্রাণীর ক্রয়-বিক্রির ব্যবসা চলছে। এ ছাড়াও বন্যপ্রাণী শিকার ও হত্যা করা হয় তাদের মাংস, চামড়া ও অঙ্গের জন্য যা এবং অন্যান্য পশু অংশ নিয়ে ঐতিহ্যগত ওষুধ তৈরি করার জন্য বিক্রি করা হয়। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই সংখ্যা বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের এক প্রতিবেদনে অনেক দেশের নাম বলা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী বন্যপ্রাণী পাচারের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশের নামও। এই প্রতিবেদনটি যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে উত্থাপন করা হয়। ব্রাজিল, চীন, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মেক্সিকো, দক্ষিণ আফ্রিকা, নাইজেরিয়া, উগাণ্ডা, ভারত ও বাংলাদেশসহ ২৬টি দেশকে বন্যপ্রাণী পাচারের ক্ষেত্রে বিশেষ নজরদারি বা ফোকাস দেশের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

সারা পৃথিবীতে বন্যপ্রাণী নিধন ও পাচার বাণিজ্যের কথা আমরা কম-বেশি জানি। বিভিন্ন বন্যপ্রাণী যেমন সরাসরি পাচার চলছে, তেমনি বাঘ, সিংহ, গণ্ডার, হাতিসহ বৃহৎ সবপ্রাণীকে নৃশংসভাবে হত্যা করে তারা মূল্যবান অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও চামড়া পাচার করা হচ্ছে। বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশে এই চক্রের হোতাদের চিহ্নিত করে গ্রফতারপূর্বক যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে যাতে কেউ এই দেশকে বন্যপ্রাণী পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহার করতে না পারে।

ইতিমধ্যে এ ধরনের অপরাধ দমনের জন্য বন অধিদফতর থেকে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন বিষয়ক একটি আলাদা বিভাগ চালু করা হয়েছে।

 এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার করাও একান্ত আবশ্যক। বিশ্বের সব দেশেই এ বিষয়ে বিশেষভাবে নজর দেওয়া হচ্ছে।

 

আরও যত অবৈধ বাজার

ব্ল্যাক মার্কেট বা কালোবাজার হলো নিষিদ্ধ পণ্য বা সেবার চোরাগোপ্তা বাজার বা লেনদেন। এই অবৈধ লেনদেনের সঙ্গে জড়িতদের বলা হয় কালোবাজারি। মাদক ব্যবসা, পতিতাবৃত্তি, মানব পাচার ইত্যাদি ব্ল্যাক মার্কেটের অন্তর্ভুক্ত। আমেরিকান একটি জনপ্রিয় বিজ্ঞান সাময়িকী যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে প্রাচীন পত্রিকা।

প্রত্রিকাটি ব্ল্যাক মার্কেট সম্পর্কে বলছে কোনো সরকার, কোনো বিশ্বব্যাপী অলাভজনক সংস্থা, কোনো বহুজাতিক সংস্থা গুরুত্ব দিয়ে বলতে পারবে না যে, তারা ১.৮ বিলিয়ন কর্মসংস্থান প্রতিস্থাপন করতে পারবে যা কালোবাজার অর্থনীতি তৈরি করেছে। সত্যি এই যে, সবচেয়ে উদীয়মান অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির জন্য শ্রেষ্ঠ আশা হচ্ছে ব্ল্যাক মার্কেট। আমরা এখন জানব ব্ল্যাক মার্কেটের মাধ্যমে ক্রয়-বিক্রয় হয় এমন কিছু প্রাণী বস্তু সম্পর্কে। এই প্রক্রিয়ার ক্রয়-বিক্রয় হয় জনপ্রিয় কিছু কুকুরছানার জাত।

যেমন ইয়র্কশায়ার কিংবা টেরিয়ার প্রতিটি ২০০০ ইউরোতে বিক্রয় হয়।

কিন্তু ব্ল্যাক মার্কেটে তা বিক্রি হয় মাত্র ১০০ ইউরো করে। পাচারকারীরা আয়ারল্যান্ড, বা পূর্ব ইউরোপের কুকুরছানার মিলগুলো থেকে কুকুরছানা পাচার করে এনে সস্তায় বিক্রি করে। শুধু কুকুরছানাই নয় ব্ল্যাক মার্কেটে ক্রয়-বিক্রয় হয় থিসিস রিপোর্ট পর্যন্ত। যদিও সারা বিশ্বে উচ্চ শিক্ষার জন্য একাডেমিক অনেক কিছুই জালিয়াতি করা হয়। তবুও রাশিয়ার জন্য এটি মহামারী আকার ধারণ করেছে। দুর্বৃত্তরা হ্যাকিং করে নানান সাইট থেকে নানা ধরনের থিসিস রিপোর্ট, গবেষণামূলক তথ্য সরিয়ে নিয়ে পরবর্তীতে সেগুলো চড়া দামে কালোবাজারে তুলে। রাশিয়ার অনেক সরকারি বড় বড় কর্মচারী নিজেদের উচ্চ শিক্ষার প্রমাণ দিতেও সেগুলো কিনেছেন। ব্ল্যাক মার্কেটের একটি আকর্ষণীয় বিষয় হচ্ছে বাঘের অঙ্গ। বাঘের অঙ্গের চাহিদা সব সময়ই রয়েছে। কারণ বিলাসবহুল পণ্য যেমন বাঘের হাড়ের ওয়াইন, চালের ওয়াইনের মধ্যে বাঘের কঙ্কাল ভেজানো হয়। তা ছাড়া শৌখিন ধনবান ব্যক্তিদের কাছে বিশেষ কদর রয়েছে বাঘের চামড়ার।

মানুকা মধু নিউজিল্যান্ডের মানুকাঝোপের পরাগ আর অস্ট্রেলিয়ার জেলিঝোপ গাছের হয়। এই মধুর রয়েছে ঔষধি গুণ।

ক্ষত সারানোর জন্যও ব্যবহার হয়ে থাকে এই মধু। শুধু দুই জায়গায় মানুকা মধু পাওয়া যায় এর দাম খুব চড়া। পাচারকারীরা এই মধু চুরি করে কালোবাজারে বেশি দামে বিক্রি করে।

জলাতঙ্ক রোগের টিকা : চীনে প্রতি বছর হাজারেরও বেশি মানুষ জলাতঙ্ক রোগে অথবা নানান প্রাণীর কামড়ে মারা যায়। বাজারের নকল প্রতিষেধক এর অন্যতম কারণ।

 বেশি লাভের আশায় ব্ল্যাক মার্কেট থেকে এনে বিক্রি করা হয় ভোক্তাদের কাছে।

ফসিল : ডাইনোসরের ফসিল দুর্লভ জিনিস। ব্যক্তিগতভাবে এই ফসিল কেনাবেচা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

কিন্তু এই ফসিল নিয়েই যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে উঠেছে ব্লাক মার্কেট। অনেকেই পেশা হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে সে ডাইনোসরের ফসিলের চোরাচালান করে আসছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ডাইনোসরের ফসিলের কালোবাজার সম্পর্কে প্রচুর তথ্য পায় পুলিশ।

প্যাঙ্গোলিন : আফ্রিকার সাহারা মরুভূমি উপঅঞ্চলে পাওয়া যায় প্যাঙ্গোলিন। এশিয়াতেও পাওয়া যায়। বাংলায় এদের বলে বনরুই। এদের খোলস দিয়ে ওষুধ এবং কসমেটিক পণ্য তৈরি করা হয়। প্যাঙ্গোলিনের খোলস অনেক দামি হওয়ায় কালোবাজারীরা এই প্রাণীটিকেও ছাড় দেয়নি।

 

নারী ও শিশু পাচার

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ১৯৯৪ সালের অনুষ্ঠিত এক সভায় পাচার বলতে, উন্নয়নশীল ও দ্রুততম অর্থনৈতিক পরিবর্তনশীল দেশসমূহের জাতীয় সীমানার বাইরে পাচারকারী, নিয়োগকারী ও অপরাধচক্র কর্তৃক মুনাফার জন্য নারী ও শিশুদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে এবং জোরপূর্বক অর্থনৈতিক ও যৌন উৎপীড়নমূলক কর্মকাণ্ডে যেমন জোরপূর্বক গৃহভৃত্যের কাজ, বিবাহ, দত্তক এবং গোপন কাজে নিয়োগের জন্য ব্যক্তির অবৈধ গোপনীয় স্থানান্তরকে বোঝায়। আমাদের দেশের দরিদ্র নারী ও শিশুরা পাচারকারী চক্রের হাতে পড়ে যায় সামান্য প্রলোভনে। অথবা তাদের অপহরণ করে পাচার করা হয়। এভাবে তারা স্থানান্তরিত হয়ে একপর্যায়ে দেশ ছাড়া হয়। গ্রামের দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের নারী, যারা চাকরির উদ্দেশ্যে গ্রাম থেকে শহরে আসেন, তারাই মূলত পাচারের শিকার হয়। এ ছাড়াও অবিবাহিত, তালাকপ্রাপ্ত, বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্ত নারী, স্বল্প শিক্ষিত নারী ও শিশু, বাড়ি থেকে পালানো কিশোরীরা পাচারের শিকার হয়। নারী ও শিশুকে আইন-বহির্ভূত উপায়ে লেনদেনের মাধ্যমে সংগ্রহ, স্থানান্তর, আশ্রয়দান ও অর্থের বিনিময়ে গ্রহণ ইত্যাদি যে কোনো কর্মকাণ্ডকে নারী ও শিশু পাচার বলে গণ্য করা হয়। আন্তর্জাতিকভাবে নারী ও শিশু পাচারকে আধুনিক যুগের দাসপ্রথা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। কাজ দেওয়ার নাম করে মেয়েদের লোভ দেখিয়ে বা ভুলিয়ে নিয়ে গিয়ে বেশ্যাবৃত্তির জন্য দালালের কাছে বা বেশ্যালয়ে মালকিনদের কাছে বা সস্তা হোটেলে বা ভাড়া বাড়িতে বিক্রি করে দেওয়া হয়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত নারী ও শিশু পাচারে অন্যতম। পাচারকারীদের অনেকেই শ্রমিক ঠিকাদার যারা শ্রমিকদের কাজে বা পেশায় যুক্ত হওয়ার প্রতিশ্র“তি দেয় বা দায়িত্ব নেয়। কাজ দেওয়ার নামে মেয়েদের ভুলিয়ে নিয়ে এসে পতিতালয়ে বিক্রি করে দেয়। যেসব জায়গায় দরিদ্র জনগোষ্ঠী বেশি সেসব জায়গায়ই পাচারের হার বেশি।

 

কালোজাদুর বাজার

আধুনিক বিজ্ঞান বিষয়টিকে সমর্থন না করলেও কালোজাদু বা ব্ল্যাক ম্যাজিক সভ্যতার উম্মে ষের চাইতেও প্রাচীন এক চর্চা। আদিম সমাজে মানুষ অপশক্তিকে করায়ত্ত করে নিজের কার্যসিদ্ধি করতে চাইত। তাই কালোজাদুর চর্চা গোপন এবং অবশ্যই সমাজ-বহির্ভূত। কালোজাদুর তত্ত্বের প্রধান বিন্দুটিই হলো একজনের অনিষ্ট না করে আর একজনের ভালো করা যায় না। সে কারণে এই কাজকে তেমন ভালো চোখে দেখে না সমাজ। তাই গোড়া থেকেই যুক্তিবাদ যতই সাঁড়াশির মতো চেপে ধরুক না কেন সমাজকে, তার ফাঁক গলে এসব আদিম প্র্যাকটিস ঠিকই বেরিয়ে যায়। আজও বিভিন্ন দেশে ব্ল্যাক ম্যাজিক একটা জীবন্ত বিষয়। ভারতে কালোজাদুর চর্চা আজো বেশ চোখে পড়ার মতো। শহরাঞ্চলে প্রকাশ্যে মারণ, উচাটন, বশীকরণ ইত্যাদির বিজ্ঞাপন হরবখত নজরে আসে। যদিও এগুলো মোটেই বৈধ নয়। গ্রামাঞ্চলে কালোজাদু, ডাকিনীবদ্যা, জ্ঞানগুরু ইত্যাদি নৈমত্তিক ব্যাপার। এসব ব্যাপার অনেক সময়েই বিচ্ছিন্নভাবে উঠে আসে খবরের শিরোনামে। কিন্তু ভারতে এমন কিছু জায়গা রয়েছে যেখানে কালোজাদুর চর্চা বেশ নিয়মিতই হয়। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এসব স্থানে আসেন তাদের মনের ইচ্ছা পূরণের আশায়। গণবিশ্বাসের একটা বিরাট জায়গাজুড়ে রয়েছে এসব স্থান। পশ্চিম আফ্রিকার টোগোর রাজধানী লোমেতে এমন একটি বাজার রয়েছে যেখানে অবাধে বিক্রি হচ্ছে বাঁদরের শুকনো মাথা, হরিণের মাথার খুলি, এমনকি কুমিরের দেহের কাঠামো পর্যন্ত। এই বাজারকেই বলা হচ্ছে বিশ্বের বৃহত্তম তন্ত্রমন্ত্রের বাজার। কালো জাদুর চর্চা হয় এখানে। এখানে বিভিন্ন ধরনের পাখির হাড়ও পাওয়া যায়। আপনারা জেনে অবাক হবেন এখানকার লোকেরা বাঁদরের শুকনো মাথাকে সেক্সের পাওয়ার বৃদ্ধি করার জন্য ক্রয় করে। এ ছাড়া পাইথনের চামড়া, হায়েনার মাথা, জীবিত ঈগলও পাওয়া যায়।

 

রমরমা শুক্রাণু ব্যবসা

অনেকেই হয়তো ভাবছেন শুক্রাণু আবার কেনাবেচা কী। শুক্রাণুর কালোবাজার চর্চা চলছে ইদানীং। এ বিষয়ে মুভিও তৈরি হচ্ছে। এরপরই বিষয়টি উন্নয়নশীল বিশ্বের নজরে আসে। পশ্চিমাবিশ্বে চর্চাটা অনেক আগে থেকেই ছিল কিন্তু সীমিত আকারে। পড়াশোনার ফাঁকে টুপাইস কামানোর জন্য শিক্ষার্থীরা এর সঙ্গে যুক্ত হতো। কিন্তু শুক্রাণু দানের ব্যবসা এখন বেশ রমরমা। একজন শুক্রাণু দাতা মাসে সর্বোচ্চ ১৫০০ ডলারও আয় করতে পারেন। তবে সেক্ষেত্রে ব্যক্তিগত যৌনক্রিয়া থেকে অনেকটাই অনিয়মিত হয়ে যেতে হয় দাতাকে। প্রত্যেক বারের জন্য সাধারণত দাতা ১০০ ডলার পেয়ে থাকেন। প্রতিবার যে পরিমাণ শুক্রাণু পাওয়া যায় তা পাঁচটি বোতলে রাখা যায়, যেগুলোর প্রতিটি ৫০০ থেকে ১০০০ ডলারে বিক্রি করা সম্ভব। আর বেশির ভাগ ক্রেতাই একাধিক বোতল কিনেন। দাতা খুঁজে পাওয়া, পরীক্ষা, পুনঃপরীক্ষা, শুক্রাণু সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণে ভালোই খরচ হয়। যদিও সব খরচ বাদ দিয়েও মুনাফা থাকে ভালোই। এই ব্যবসায় প্রতিযোগিতাও আছে প্রচুর। গ্রাহকদের বাড়তি সুবিধা দিতে অনেক প্রতিষ্ঠানই তাদের ‘পণ্য’ তথা শুক্রাণুর নিরাপত্তার ওপর জোর দিয়ে থাকে। অনেকে আবার নিজেদের ওয়েবসাইটের বিজ্ঞাপন দেন জনপ্রিয় ডেটিং সাইটে। ওয়েবসাইটে ক্রেতারা পছন্দসই বৈশিষ্ট্যের শুক্রাণুও বেছে নিতে পারেন। কারণ শুক্রাণুর ওপর নির্ভর করে আগত সন্তান কেমন বৈশিষ্ট্যের হবে। যেমন চোখের রং, শিক্ষা বা শখ ইত্যাদি বিষয়। দাতার নানাবিধ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী অনেকে শুক্রাণু বেছে নেন। অনেক প্রতিষ্ঠান আবার বেশি অর্থের বিনিময়ে দাতার অতিরিক্ত তথ্য জানার সুযোগ দেয় গ্রাহককে। যেমন, ২৫ ডলার দিয়ে হয়তো দাতার ছোটবেলার ছবি দেখে নিতে পারেন গ্রাহক। কারণ, ধরেই নেওয়া হয়, শুক্রাণু দাতার অনেক বৈশিষ্ট্য পাবে সন্তান। এখনকার ইন্টারনেট শপিংয়ের যুগে এসব বিধিনিষেধ অকার্যকরও। শুক্রাণু দানের ক্ষেত্রে কঠোর নিয়ন্ত্রণমূলক নীতিমালা, অপ্রতুলতা ও উচ্চমূল্যের কারণে গ্রাহকরা শুক্রাণুর অন্য উৎসও খুঁজছেন। এর মধ্যে আছে এক আন্তর্জাতিক কালোবাজার, যা নজরদারির আওতায় নেই।

 

ভার্চুয়াল ব্ল্যাক মার্কেট ডার্কনেট

বাস্তব পৃথিবীর মতো ভার্চুয়াল দুনিয়াতেও আছে এক রহস্যময় জগৎ। এই রহস্যময় জগৎটিকেই বলে ডার্ক নেটওয়ার্ক সংক্ষেপে ডার্কনেট। এটিই বাস্তব জীবনের মতো অনলাইন জগতের ব্ল্যাক মার্কেট। যার কার্যক্রম পরিচালিত হয় ডার্ক নেটের মাধ্যমে। অন্ধকারের এই রাজত্বকে ব্ল্যাক ওয়ার্ল্ড, ডিপ ওয়েব বা ব্ল্যাক নেট বলেও ডাকা হয়। উইকিপিডিয়ার সংজ্ঞা অনুযায়ী, ডার্ক নেট হচ্ছে এমন একটি সম্পর্ক যেখানে বিশ্বস্ত লোকেরা পরস্পরের সঙ্গে গোপনে মিলিত হতে পারে অথবা গোপন তথ্য আদান-প্রদান করতে পারে। সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় ফ্রেন্ডস টু ফ্রেন্ডস সংক্ষেপে এফ টু এফ প্রক্রিয়া বা ফ্রেন্ডস পি টু পি প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একজন ইউজার অতি সহজেই নিজের আইপি এড্রেস গোপন রাখতে পারে। যার ফলে সরকারি বা কনফিডেন্সিয়াল স্থানগুলোতে ভয়হীনভাবে প্রবেশ করে ডেটা হ্যাক করা সম্ভব। এ কারণেই এই জগতটি অনলাইনের অপরাধীদের কাছে এতটা প্রিয়। অনলাইনের এই ব্ল্যাক মার্কেটে প্রতি মুহূর্তে নেশাজাতীয় দ্রব্য থেকে শুরু করে বিভিন্ন নিষিদ্ধ দ্রব্য, বই, পর্নোগ্রাফি, বিভিন্ন মারণাস্ত্র এমনকি নিউক্লিয়াস বোমার যন্ত্রাংশের অবাধ বাণিজ্য চলে। এখানে পণ্য হিসেবে আরও রয়েছে নানা ক্লাসিফাইড তথ্য, চৌকস হ্যাকার বা হ্যাকিং টেকনিক এমনকি কন্ট্রাক্ট কিলারও পাওয়া যায় এখানে। সন্ত্রাসী, মাফিয়া বা স্মাগলার গ্র“প, বিপ্লবী, হ্যাকার, এমনকিই বিভিন্ন দেশের প্রশাসনও এই জগতের সঙ্গে যুক্ত। এখানে গোয়েন্দারা খুব গোপনে নিজেদের ভিতর তথ্য আদান-প্রদান করতে পারে অথবা চুরি যাওয়া তথ্য ফিরে পেতে অপরাধীদের সঙ্গে দর কষাকষি করতে পারে। এ ছাড়াও এই জগতে খুব কম মূল্যে বিক্রি করা হয় নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্য। শুধু তাই নয়, এই অঞ্চলের বণিকেরা বিভিন্ন দামি এবং দুর্লভ সামগ্রী অত্যন্ত স্বল্প মূল্যে বিক্রি করার পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের জাল পাসপোর্ট বা নাগরিকত্ব নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে। এক জরিপে জানা গেছে, দৃশ্যমান বা প্রকাশ্য ওয়েবে যে ডেটা সংরক্ষিত আছে তার চেয়ে প্রায় ১০০০ গুণ বেশি ডেটা সংরক্ষিত আছে অন্ধকার জগতে। সাধারণভাবে চাইলে অবশ্য আপনি এখানে প্রবেশ করতে পারবেন না।

 

সাপের বিষ

বিশ্বের প্রায় সব দেশেই মাদকাসক্ত লোক রয়েছে। তাদের কড়া নেশা দরকার। তাই তাদের মাদকে এখন মেশানো হচ্ছে সাপের বিষ। সাপের বিষের ব্যবসা অসম্ভব লাভজনক। বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি টাকার সাপের বিষ পাচার হচ্ছে। এ মুহূর্তে এক লিটার সাপের বিষের বাজার দাম প্রায় চার কোটি টাকারও বেশি। বিষ নিষ্কাশনের জন্য ধরা হয় প্রধানত গোখরা, রাসেল ভাইপার, পিট ভাইপার এবং শাখামুটে ইত্যাদি।

সাপের বিষ নিষ্কাশনের পর প্রথমে তা রাখা হয় খুব কম তাপমাত্রার আধারে। কিছুদিন পর তরল বিষ শুকিয়ে দানা বেঁধে গেলে তা গুঁড়ো করা হয়। তারপর তা মেশানো হয় মদ বা অন্যসব মাদকে।

সাধারণত ১০০ লিটার মদে ১০ গ্রাম সাপের বিষের গুঁড়ো মেশানো হয়। সোনার চেয়েও সাপের বিষের দাম বেশি এখন বাজারে। সাপের বিষের চাহিদা বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। ফুলে-ফেঁপে উঠছে ড্রাগ সিন্ডিকেটের অবৈধ ব্যবসা। সাপের বিষের ব্যবসা অসম্ভব লাভজনক। দেশে দেশে চোরাকারবারীদের নারকটিক সিন্ডিকেটের নেটওয়ার্ক ব্যাপক। কিন্তু তাদের ধরা সম্ভব হচ্ছে না। দক্ষিণ আফ্রিকার সোমালিয়া উপকূলে একটি জাহাজ ডুবে যায়।

জাহাজে ছিল বিপুল পরিমাণ সাপের বিষ। জাহাজ ডোবার আগে আফ্রিকা উপকূলের কুখ্যাত জলদস্যুরা সেই বিষ লুট করে। তাদের কাছ থেকে লুটকৃত বিষ কিনে নেয় এক ব্যবসায়ী। একই বছরের ডিসেম্বরে মালদ্বীপে সেই সাপের বিষ নিলামে ওঠে। চোরাকারবারিরা দাবি করে, সেখান থেকে হাত ঘুরতে ঘুরতে সেই বিষ চলে আসে বাংলাদেশে। এই সাপের বিষের পেছনে আন্তর্জাতিক চক্র রয়েছে। গোয়েন্দাদের দাবি, চীনের চোরাবাজারে সাপের বিষের অনেক দাম। প্রতি বছর কয়েক’শ কোটি টাকার সাপের বিষ পাচার হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারে। ইউরোপের নানা দেশ থেকে ভারত ও বাংলাদেশ ঘুরে চীন ও জাপানে যাচ্ছে বিষ। বাংলাদেশ থেকে সোমালিয়ার বিভিন্ন চক্র সংগ্রহ করে এই বিষ। সেখান থেকে যায় চীনে। ২০১৩ সালে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিল এমনই একটা চক্র।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর