রবিবার, ২০ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

ধনকুবের নারী ব্যবসায়ী

সাইফ ইমন

ধনকুবের নারী ব্যবসায়ী
উদ্যোক্তা হিসেবে নারীদের সফলতা তো দিন দিন বাড়ছেই। শীর্ষ ধনীদের তালিকায় অনেকেরই নাম আসে যাদের সম্পদের উৎস ব্যবসা। উত্তরাধিকার সূত্রে ধনী না হয়ে বরং নিজ চেষ্টা, মেধা এবং বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে তারা উঠে এসেছেন শীর্ষ ধনীর তালিকায়। গড়ে তুলেছেন নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। নিজ চেষ্টায় সম্পদশালী হয়ে ওঠা এমন কিছু  নারীকে নিয়ে আজকের রকমারি-

 

বিশ্বের কোটি নারীর অনুপ্রেরণা

অপরাহ উইনফ্রে

অপরাহ উইনফ্রের মোট সম্পদের পরিমাণ ৩ বিলিয়ন ডলার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই নারী প্রতিষ্ঠা করেন হারপো প্রোডাকশন।  বস্তিতে জন্মগ্রহণ করেও জীবনযুদ্ধে তিনি এখন এক বিজয়ী সেনাপতি। বিশ্বের কোটি নারীর জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছেন অপরাহ উইনফ্রে। স্কুলে পড়ার সময় অপরাহ উইনফ্রে প্রথম মিডিয়ায় কাজ শুরু করেন। প্রথমে রেডিওর সংবাদ পাঠিকা পরবর্তীতে দুর্দান্ত উপস্থাপিকা।  অপরাহ নিজের প্রোডাকশন কোম্পানি  খোলেন। তার ‘দ্য অপরাহ উইনফ্রে শো’ তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। ১৯৯৮ সালে তিনি ‘অপরাহ’স অ্যানজেল নেটওয়ার্ক’ নামে একটি দাতব্য সংস্থা গড়ে তোলেন। অপরাহ নিজেই ৩০৩ মিলিয়ন ডলার এই প্রতিষ্ঠানে দান করেন। জীবনের কঠিন সময়কে শক্ত হাতে মোকাবিলা করে এই নারী এখন বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের একজন।

 

 

নিজ হাতে সোয়েটার বানিয়ে বিলিয়নিয়ার

জুলিয়ানা বেনেটন

ইতালির নাহরিক জুলিয়ানা বেনেটন বিশ্বখ্যাত ফ্যাশন হাউস বেনেটন গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা। তার সম্পদের পরিমাণ এখন ২.৭ বিলিয়ন। ১৯৪৯ সালে বাবার মৃত্যুর পর মাত্র ১৩ বছর বয়সে জুলিয়ানা শুরু করেন সোয়েটার বানানো। এক বছরের বড় ভাই লুসিয়ানো সেগুলো বিভিন্ন দোকানে বিক্রি করতেন। এর হাত ধরে জুলিয়ানা একুট ক্লথিং স্টোর শুরু করেন। এরপর ধীরে ধীরে ব্যবসা বড় হয়। ১৯৬৫ সালে জুলিয়ানা আর তার ভাই-বোনদের উদ্যোগে শুরু হয় বেনেটন গ্রুপের যাত্রা। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি এই নারী ধনকুবেরকে। ১৯৬৯ সালে প্রথমবারের মতো নিজ দেশের বাইরে যাত্রা শুরু করে বেনেটন গ্রুপ। প্রথমে প্যারিসে এবং ১৯৮০ সালে নিউয়র্কে শোরুম চালু করেন। বর্তমানে বেনেটন গ্রুপের ১২০টি দেশে ৫ হাজারের বেশি স্টোর রয়েছে।

 

যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম শীর্ষ নারী ধনকুবের

অ্যাঞ্জেলা আহরেদস

১৯৬০ সালে ৭ জুন যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করা এই প্রখ্যাত ধনকুবের নারী সফল ব্যবসায়ী হিসেবে গোটাবিশ্বে সুপরিচিত। মাল্টিন্যাশনাল টেকনোলজি কোম্পানি অ্যাপলের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কর্মরত তিনি। অ্যাপলের ২০১৫ সালে দেওয়া এক বিবৃতি অনুযায়ী অ্যাঞ্জেলার বার্ষিক উপার্জন ৭০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি। এর পাশাপাশি এই নারী ধনকুবের কোম্পানিটির ১১ মিলিয়ন ডলার শেয়ারেরও মালিক। এর আগে ২০০৬  থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ফ্যাশন হাউস বারবেরি গ্রুপের সিইও ছিলেন অ্যাঞ্জেলা। ২০১৫ সালের ফোর্বস ম্যাগাজিনে বিশ্বের ধনী নারীর তালিকায় তার নাম ২৫তম স্থানে উঠে আসে। ১৫০ মিলিয়ন সম্পদের মালিক তিনি। যুক্তরাজ্যের শীর্ষ দশ ধনী নারীর তালিকায়ও আছেন এই নারী ধনকুবের।

 

স্বামীর মৃত্যুর পর অর্থ-সম্পদ বাড়িয়ে ভারতের শীর্ষ ধনী

সাবিত্রী দেবী জিনদাল

৬৭ বছর বয়সী সাবিত্রী দেবী জিনদাল ভারতের সেরা ধনী নারী। তার মোট সম্পদের পরিমাণ ৫.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০০৫ সালে সাবিত্রী জিনদালের স্বামী ওপি জিনদালকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি বিধ্বস্ত হলে ওপি জিনদাল মৃত্যুবরণ করেন। এরপর স্বামীর ব্যবসার হাল ধরেন তিনি। তার দূরদর্শী ব্যবসায়িক পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্তের প্রশংসা করছেন বিশ্বসেরা বিশ্লেষকরাও। অল্প দিনেই ভারতের ধনী নারীর তালিকায় সবার উপরে উঠে আসেন। ব্যবসার পাশাপাশি রাজনীতিতে নাম লেখান তিনি। এখানেও পেয়েছেন সাফল্যের দেখা। ২০১৩ সালের ২৯ অক্টোবর থেকে সাবিত্রী জিনদাল হরিয়ানা সরকারের মন্ত্রী হিসেবে কাজ করেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে তিনি তার পদ হারান। বর্তমানে তিনি এমিরিটাস, জিনদাল স্টিল অ্যান্ড পাওয়ার লিমিটেডের চেয়ারম্যান হিসেবে কর্মরত আছেন।

 

৬০ বছর বয়সী এই নারী প্রথম বায়োটেক উদ্যোক্তা

কিরণ মজুমদার শাও

ভারতের নারী জাগরণের জয়জয়কার রচিত হয়েছে যে কজন নারীর হাত ধরে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিরণ মজুমদার শাও। ৬০ বছর বয়সী এই নারী প্রথম বায়োটেক নারী উদ্যোক্তা। তার মোট সম্পদের পরিমাণ ২.৩ বিলিয়ন। বিজ্ঞানের ছাত্রী কিরণ মজুমদার শাও পড়াশোনা করেছেন বেঙ্গালুরু ও মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। পড়াশোনা শেষে এই ধনকুবের নারী প্রতিষ্ঠা করেন বায়োটেকনোলজি কোম্পানি বায়োকন। বায়োকন মূলত কাজ করে ক্রনিক ডিজিজ নিয়ে। এ ধরনের রোগের ব্যয়বহুল চিকিৎসা সুবিধা নামিয়ে এনেছে সাধ্যের মধ্যে। ২০০৪ সালে ইকোনমিক টাইমস অ্যাওয়ার্ড থেকে এই নারী ‘বিজনেস উইমেন অব দ্য ইয়ার’ হিসেবে ভূষিত হন।

 

বেট-৩৬৫ এর অনলাইন প্রতিষ্ঠাতা

ডেনিস কোটস

অনলাইনভিত্তিক জুয়া প্রতিষ্ঠান বেট-৩৬৫ এর প্রতিষ্ঠাতা এবং যুগ্ম সিইও ডেনিস কোটস। তিনি একজন ব্রিটিশ ধনকুবের। প্রযুক্তি শিল্পে ইউরোপের ধনী নারী হিসেবে তিনি নজর কাড়েন গোটা বিশ্বের। ২০০০ সালে তার বাবা প্রথম শুরু করেছিলন বেট-৩৬৫। এই নারী ব্র্যান্ডটিকে যুগোপযোগী করে তুলেছেন সময়ের সঙ্গে। ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠানটি ২.৩ বিলিয়ন ডলার আয় করে। অনলাইন জুয়া ওয়েবসাইটটি তার পরিচালনায় এখন শীর্ষ বেটিং সাইটগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থানীয়। সেই সঙ্গে বাজির রীতিকে আরও জনপ্রিয় ও সহজ করে তুলেছে ডেনিসের অনলাইন  স্পোর্টস প্লাটফর্ম। বেট-৩৬৫ এর বদৌলতেই ৪.৬ বিলিয়ন ডলারের মালিক  ডেনিস কোটস এখন যুক্তরাজ্যের ধনী ব্যবসায়ীর তালিকায় অন্যতম অবস্থানে।

 

সবচেয়ে বড় মিডিয়া প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ ব্যক্তি

ইন্দু জৈন

ইন্দু জৈন ভারতের নারী ধনকুবের হিসেবে বিশ্বজুড়ে পরিচিত। ভারতের সবচেয়ে বড় মিডিয়া প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান তিনি। ২০১৬ সালে ইন্দু জৈন পদ্মভূষণ পুরস্কার লাভ করেন। ইন্দু জৈনের মিডিয়া প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে ১৩টি সংবাদ পত্রিকা ও ১৮টি ম্যাগাজিন। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো টাইমস অব ইন্ডিয়া। এটি পৃথিবীর সর্বাধিক প্রচারিত পত্রিকাগুলোর একটি। ইন্দু জৈন বেনিট, কোলম্যান অ্যান্ড কোং প্রতিষ্ঠানগুলোকে নবজন্ম দেন। একজন দক্ষ ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি সুপরিচিত। তিনি টাইমস ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। এই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে তিনি নানা সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন এবং সরকার ও জনগণের মধ্যে সম্পর্কোন্নয়নে তার অবদান ব্যাপক প্রশংসিত। তার সম্পদের পরিমাণ ৩.২ বিলিয়ন ডলার।

 

চিনিকলের আয় দিয়ে টাকার পাহাড়

বিদ্যা মুরকুম্ভি

মুরকুম্ভির মালিকানায় থাকা সাতটি চিনিকল থেকে ৮.৪ মিলিয়ন টন চিনি উৎপাদন করা হয়। মিষ্টভাষী বিদ্যা মুরকুম্ভি হলেন বিখ্যাত শ্রী রেনুকা সুগার্সের চেয়ারপারসন এবং কো-ফাউন্ডার। তিনি রসায়নে ব্যাচেলর ডিগ্রি অর্জন করে ১৫ বছর ধরে হোলসেল  ট্রেডিং বিজনেস পরিচালনা করেন স্বামীর সঙ্গে মিলে। ১৯৯৮ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন শ্রী রেনুকা সুগার্স লিমিটেড। চিনি কল শ্রমিকদের সঙ্গে নিয়ে শুরু হওয়া প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে ফুলে-ফেঁপে বিশালাকার ধারণ করেছে। এই নারীর প্রতিষ্ঠিত শ্রী রেনুকা সুগার্স ভারতেই শুধু নয়, বরং পৃথিবীজুড়ে সুখ্যাতি পেয়েছে। বিদ্যা মুরকুম্ভির দক্ষ পরিচালনায় ২০০৯ সাল থেকে ব্রাজিলে ব্যবসা শুরু করেছে। বর্তমানে তার মোট সম্পদের পরিমাণ ৪৯০ মিলিয়ন ডলার।

 

প্রথম নারী ধনকুবের [মাদাম সিজে ওয়াকার]

যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সর্বপ্রথম ধনকুবের নারী মাদাম সিজে ওয়াকার। বলছি মিলিয়নিয়ার বনে যাওয়া এক নারীর কথা। নাম তার মাদাম সিজে ওয়াকার। অথচ জীবনের শুরু করেছিলেন মাত্র এক ডলার বেতনে ধোপানির কাজ দিয়ে। ভাগ্য পরিবর্তন করার কথা ভাবতেন সব সময়। ১৮৬৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর জন্ম নেওয়া এই নারী যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের সর্বপ্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী উদ্যোক্তা হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নেন। বিউটি এবং হেয়ার প্রোডাক্টের ব্যবসা শুরু করেন এই নারী। এই ব্যবসা তাকে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বপ্রথম নারী মিলিয়নিয়ারে পরিণত করে। মাত্র ৭ বছর বয়সে এতিম হওয়া এই নারী ১৪ বছর বয়সে বিয়ে করেন। এর ছয় বছরের মাথায় স্বামীকে হারান। এরপরই ধোপানির কাজ শুরু করেন জীবিকার তাগিদে। ১৯০৩ সালে মাদাম সিজে ওয়াকার সেইন্ট লুইসে চলে আসেন। সেখানে একটি আফ্রিকান মার্কিন হেয়ার কেয়ার কোম্পানিতে কাজ শুরু করেন। সে সময় কৃষ্ণাঙ্গদের কাছে চুলের একটি সমস্যা প্রায়ই দেখা যেত তা  হলো শুষ্ক বাতাস চুল ও মাথার ত্বক এর জন্য ক্ষতিকর। এই সমস্যাটি শুধু আফ্রিকান-মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হওয়ায় এটি নিরসনে কোনো পণ্য ছিল না। এর পরিপ্রেক্ষিতেই মাদাম এর সমাধানে রেসিপি তৈরি করে প্রথমে নিজের মাথায় প্রয়োগ করেন। এরপরই আসে তার জীবনে সাফল্য। ১৯০৫ সাল পর্যন্ত মাদাম সিজে ওয়াকার চুলের এই টনিক হাতে তৈরি করে ফেরি করে বিক্রি শুরু করেন। ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠা করেন ‘দ্য মাদাম সিজে ওয়াকার ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি’। এটি যুক্তরাষ্ট্রের কোনো নারী উদ্যোক্তার প্রতিষ্ঠিত প্রথম কোম্পানি। ১৯১৯ সালের ২৫ মে মারা যান ইতিহাসে ধনকুবের হিসেবে স্থান করে নেওয়া যুগান্তকারী নারী উদ্যোক্তা মাদাম সিজে ওয়াকার।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর