শনিবার, ২৬ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

কুখ্যাত জীবন থেকে নতুন পথচলা

তানিয়া তুষ্টি

কুখ্যাত জীবন থেকে নতুন পথচলা

এক সময়ের কুখ্যাত সন্ত্রাসী কিংবা এক দশকের বেশি সময় কারাগারে কাটিয়েছেন। এতেই কি একজনের জীবন হারিয়ে যাবে অন্ধকার চোরাগলিতে! উত্তর আসবে, না। পৃথিবীতে এমন অনেক উদাহরণ আছে; যারা বর্তমানে শীর্ষ পর্যায়ের অনুসরণীয় ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। বিপর্যয়ের পরেও কেবল তাদের ইচ্ছাশক্তি দিয়েছে সুন্দর ও স্বাভাবিক একটি জীবন। এমন কিছু ব্যক্তির জীবনের গল্প নিয়ে আজকের রকমারি।

 

ইসলামের পরশে বদলে গেলেন কুখ্যাত গ্যাংস্টার

একসময় তিনি দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার গ্যাং লিডার ছিলেন। অস্ত্রবাজি আর মাদক ব্যবসা ছিল তার প্রধান কাজ। তাই সুখ্যাতির বদলে অর্জন করেছিলেন কুখ্যাতি। পুলিশের সন্ত্রাসী তালিকায় তিনি ছিলেন অন্যতম। তার দাপট সহজেই ভিন্ন গ্যাংদের চক্ষুশূলে পরিণত করে। অথচ এই মানুষটিই এখন বিশ্বব্যাপী পরিচিত দানশীল, উদার আর সত্যের পথে চলা ইমরান আবদুল সালাম নামে। পালন করছেন বিশুদ্ধ ধর্মীয় জীবন।

১৯৭৫ সালে ইতালিতে জন্মানো ১২ বছরের ভিনস ফোকারেলি পাড়ি জমান অস্ট্রেলিয়ায়। সেখানেই তিনি নিজেকে আবিষ্কার করেন একজন কুখ্যাত মোটরসাইকেল গ্যাং লিডার হিসেবে। সম্প্রতি অ্যাডেলাইডভিত্তিক দৈনিক ‘দ্য অ্যাডভাইজর’-এ প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে নিজের বদলে যাওয়া জীবনের গল্প শুনিয়েছেন দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার এই কুখ্যাত  মোটরসাইকেল গ্যাং প্রধান।

বর্তমানে তিনি অস্ট্রেলিয়া থেকে পালিয়ে মালয়েশিয়ায় এসে সম্পূর্ণ ভিন্ন জীবনধারা বেছে নিয়েছেন। গ্যাংস্টার জীবনে ফোকারেলি প্রায় সব ধরনের জীবননাশি ঝুঁকি পাড়ি দিয়েছেন। তার ওপর ছয়বার চালানো হয় হত্যাচেষ্টা। ২০১২ সালে ভিনস ফোকারেলি একটি গ্যাং শুটিংয়ের ঘটনায় চারবার গুলিবিদ্ধ হন। সে যাত্রায় তিনি বেঁচে যান কিন্তু দুর্ভাগ্যবসত সৎ ছেলে গিওভানিকে চিরতরে হারাতে হয়। শুধু তাই নয়, নানা অপরাধে জড়িত থাকার দায়ে পুলিশ প্রশাসন তাকে কারাগারে পাঠায়। এমনকি, ভিনস ফোকারেলির বিরুদ্ধে আগ্নেয়াস্ত্র ও মাদক মামলা দায়ের করা হয়। কারাজীবনের ১৪ মাস পর ২০১৩ সালের এপ্রিলে তিনি প্যারোলে মুক্তি পান। ততোদিনে জীবন সম্পর্কে তার ধারণা বদলে যায়। না, আর এমন সংকটময় জীবন বয়ে বেড়ানো নয়। এবার অন্ধকার থেকে নিজেকে বের করে আনার পালা। যেই ভাবনা সেই কাজ। এদিকে ভিনসের স্টেপ-৪ ক্যান্সারে আক্রান্ত মা সে বছরই অস্ট্রেলিয়া থেকে মালয়েশিয়ায় চলে আসেন। তাই ভিনস সিদ্ধান্ত নেন মায়ের কাছে চলে আসার। অস্ট্রেলিয়ায় থেকে যায় স্ত্রী ও সৎ মেয়ে। তবে এখানে নিজেকে একটু গুছিয়ে উঠতে পারলে তাদের নিজের কাছে নিয়ে আসবেন।

দ্য অ্যাডভাইজরে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে বলেন, বউ-মেয়েকে অস্ট্রেলিয়ায় রেখে নিজেকে তিনি অসম্পূর্ণ ভাবছেন। স্ত্রী-কন্যাকে কাছে পেলে তার জীবন পরিপূর্ণ হয়ে যাবে।

মালয়েশিয়ায় এসে সদ্যবিধ্বস্ত জীবনকে সাজানোর পরিকল্পনা করেন। ভেবে পান না কী করবেন তিনি। একদিন ফেডারেল টেরিটরিস মুফতির অফিসে যান। মুফতি ভিনসকে উদারভাবে আলিঙ্গন করেন। তার সবকিছু শোনার পর জীবন ও ইসলাম ধর্মের মহত্ত্ব সম্পর্কে বোঝান। এ ছাড়াও পরামর্শ দেন, শিশু ও কিশোরদের সঙ্গে আলাপ করতে। মুফতির এমন উদার আলিঙ্গনে ভিনস যেন শান্তির দেখা পেলেন। ইসলাম ধর্মের এমন অভিভাবকত্ব পেয়ে অনুভব করলেন আল্লাহর মনোনীত দীন ইসলামের মহত্ত্ব। তারপর তিনি আল্লাহর প্রেমে পড়ে গেলেন। ধর্মান্তরিত হয়ে গ্রহণ করলেন ইসলাম। নিজের নাম বদলে রাখলেন ইমরান আবদুল সালাম।

শান্তির ধর্ম ইসলামের পথে তার এই যাত্রা এখন অনেকের অনুপ্রেরণা। তিনি বিপদগ্রস্তদের উৎসাহ দেন পরিকল্পিত ও সুন্দরভাবে জীবন গড়ার। বিশ্বের অনেকে এখন তার একনিষ্ঠ ভক্ত ও অনুসারী। 

২০১৬ সালে তিনি ইসলাম গ্রহণের কথা প্রকাশ্যে আনেন। তারপর ‘লা ফিগ কিউসিনা’ নামের একটি হালাল রেস্টুরেন্ট খোলেন; যা প্রতি সপ্তাহে গৃহহীনকে বিনামূল্যে খাওয়ায়। এছাড়া স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়কে দান করে। শুধু তাই নয়, বিশ্বব্যাপী লা ফিগের সহায়তা ছড়িয়ে দেওয়ার চিন্তাও রয়েছে তার। তার এই প্রজেক্টের অধীনে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া ও ব্রুনাইয়ে ১০০ থেকে ১ হাজারটি সাশ্রয়ী মূল্যের হালাল পণ্য সরবরাহ করা হয়; যা লাখ লাখ নিম্নআয়ের মুসলিমের জীবনযাত্রার খরচ কমাবে। নতুন ধর্মকে তিনি নিজের জীবন ও পরিবারের জন্য অপরাধ থেকে মুক্ত হওয়ার চাবিকাঠি হিসেবে দেখছেন। ভিনস ফোকারেলি বিশ্বাস করেন, ‘তুমি যদি ভালো কিছু করো তবে তোমার জন্য ভালো কিছু ফিরে আসবেই।’

বর্তমানে তিনি একজন সক্রিয় সমাজকর্মী। তিনি মাঝে মাঝেই অনুপ্রেরণামূলক ও উৎসাহী বক্তব্য দিয়ে সবাইকে উজ্জ্বীবিত করেন। সবাইকে শোনান ইসলামের পথে তার যাত্রার কথা। বিশেষ করে ইয়েমেনি উদ্বাস্তুদের জন্য মানবিক সহায়তা ও খাবার সংস্থান করে থাকেন। বর্তমানে তিনি ভাবছেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষের জীবনের উন্নয়নে ইসলামী শরিয়াহ মতে কাজ করার কথা।

 

ছিনতাই ও অপরাধ থেকে বেরিয়ে জননেতা

ম্যালকম এক্স

মাত্র ১৩ বছর বয়সে বাবা মারা যান, মা হন মানসিক রোগী। পালক পরিবারের কাছে থেকে বোস্টন ও নিউইয়র্ক শহরে ছেলেবেলা পার করেন। কিন্তু সেই ছেলেবেলা মোটেও আদর্শ ছিল না। ছিল বেশ্যামি, ছিনতাই ও অন্যান্য অপরাধের সঙ্গে জড়িত। এ কারণে ১৯৪৬ সালে যেতে হয় জেলে। পরবর্তীকালে তিনিই হয়ে ওঠেন একজন আফ্রিকান-মার্কিন মুসলিম রাজনীতিবিদ ও ধর্মীয় নেতা। কৃষ্ণাঙ্গদের মানবাধিকার আদায়ের অন্যতম নেতাও তিনি। তিনি আর কেউ নন, ম্যালকম এক্স। ছেলেবেলায় অন্ধকারে জড়িয়ে যাওয়া জীবনকে নিয়ে আসেন আলোর পথে। ১৯২৫ সালে এক খ্রিস্টান পরিবারে জন্ম নেওয়া ম্যালককম লিটল ২১ বছর বয়সে কারাগারে বসেই নিজের জীবনের ভিন্ন অঙ্ক কষতে থাকেন। গ্রহণ করেন ইসলাম ধর্ম। নামের শেষে যোগ করেন এক্স। ১৯৫২ সালে জেল থেকে বেরিয়ে নেশন অব ইসলামের অন্যতম নেতা ও প্রধান মুখপাত্র হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৬৫ সালে ঘাতকের গুলিতে প্রাণ হারান।

 

বখাটে থেকে বিশ্বখ্যাত সংগঠনের প্রেসিডেন্ট

কিউসি মফিউম

কিউসি মফিউম ছিলেন হাইস্কুল ড্রপআউট একটি ছেলে। শুধু তাই নয়, উচ্ছন্নে যাওয়ার জন্য যা যা করার সবকিছুর সঙ্গেই তিনি জড়িত ছিলেন। কিশোর বয়সেই হন ৫ সন্তানের বাবা। নিয়মিত রুটিন ছিল- রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো, দুষ্টুসঙ্গ রক্ষা এবং মদ্যপান করে মাতলামি করা। শুধু দুষ্টুসঙ্গ নিয়ে চলা নয়, তাদের নেতৃত্বও দিতেন তিনি। কয়েকবার চুরির দায়ে কারাগারে পর্যন্ত থাকতে হয়েছে তাকে। কিন্তু এ জীবন তো রাস্তার বখাটে হয়ে বাঁচার জন্য নয়। সাতপাঁচ ভেবে মনোবল দৃঢ় করলেন, জীবনের মোড় ঘোরাতেই হবে। আবার ভর্তি হলেন স্কুলে। ডিপ্লোমা শেষ করে কলেজে নাম লেখালেন। পরবর্তীকালে এই ছেলেই জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। নেতৃত্বের নেশা তখনো ছাড়েনি, বাল্টিমোর সিটি কাউন্সিলের কংগ্রেস হলেন। পরে বিশ্বখ্যাত সংগঠন ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অব কালারড পিপলের (এনএএসিপি) প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

 

মাদক ব্যবসা থেকে বেরিয়ে নামকরা র‌্যাপার

জে-জেড

জে-জেড নামে পরিচিতি পান সোয়ান কার্টার। বর্তমানের বিখ্যাত র‌্যাপার, ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা, গীতিকার ও সংগীত প্রযোজক জে-জেড একসময় ব্রুকলিনে মার্সি প্রজেক্টের বড় মাপের মাদক ব্যবসায়ী ছিলেন। এমনকি গয়না চুরির সন্দেহে আপন বড় ভাইয়ের কাঁধে গুলিও করেন। অপরাধমূলক নানা কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু পরিবার তাকে কারিগরি শিক্ষার জন্য বিশেষায়িত স্কুলে ভর্তি করে দেয়। তার জীবনে আসে নতুন ছন্দ। নিজেকে আবিষ্কার করেন নামকরা সংগীতশিল্পী হিসেবে। ১৯৬৯ সালের ৪ ডিসেম্বর নিউইয়র্কের ব্রুকলিনে জে-জেডের জন্ম। ছোটবেলায় বাবা অ্যাডনিস রিভিস মারা যাওয়ার পর চার ভাইবোনকে মা গ্লোরিয়া কার্টার বড় করেন। ১৯৯০ সালে তার সংগীত ক্যারিয়ার শুরু হয়। বর্তমানে তিনি ব্রুকলিনের ব্যবসায়ীদের কাছে অত্যন্ত সম্মানীত ও অনুসরণীয় ব্যক্তি। তাকে অবিহিত করা হয় সর্বকালের প্রশংসিত র‌্যাপার হিসেবে। বলা যায়, জীবনের উল্লেখযোগ্য অবস্থানে আছেন তিনি।

 

মাফিয়া ড্রাইভার থেকে শিল্পপতি

জর্জিয়া ডুরান্ট

এক সময় তিনি কোডাক সামার গার্ল হিসেবে পরিচিত ছিলেন। পরবর্তী সময়ে হন নামকরা মডেল। তারপর এক মাফিয়া ডনের সঙ্গে সংসার বেঁধে হয়ে যান গেটওয়ে স্টান্ড ড্রাইভার। ড্রাইভারিতে স্টান্ডবাজি দেখিয়ে মাফিয়া ওয়ার্ল্ডে জজিয়া ডুরান্ট ছিলেন খুবই প্রশংসিত। কিন্তু হঠাৎই তিনি বদলে গেলেন। ‘পারফর্ম্যান্স টু’ নামের নিজের একটি স্টান্ড ড্রাইভিং কোম্পানি দাঁড় করান। এই কোম্পানি কমপক্ষে ১০০ সিনেমার ধারণা দিয়েছে। প্রতিষ্ঠিত এই কোম্পানির মালিক হিসেবে যখন নিজের অটোবায়োগ্রাফি প্রকাশ করেন তখন লুকায়িত এই সত্য সবার সামনে চলে আসে। ১৯৫০ সালে নিউইয়র্কে জন্ম নেওয়া জর্জিয়া স্পাই হার্ড, ক্যাসপার ও রানওয়ে নাইটমেয়ারের সিনেমার জন্য ব্যাপক প্রশংসা কুড়ান।

 

জালিয়াতি থেকে নিরাপত্তা রক্ষক

ফ্রাঙ্ক উইলিয়াম অ্যাবাগনাল

মাত্র ১৬ থেকে ২১ বছর বয়সের কিশোর ফ্রাঙ্ক উইলিয়াম অ্যাবাগনাল প্রায় ২.৫ মিলিয়ন ডলারের চেক জালিয়াতি করেন। এতে তিনি বিভিন্ন সময়ে নিজেকে সফলভাবে উপস্থাপন করেছেন বৈমানিক, ডাক্তার, আইনজীবী এবং কলেজের শিক্ষক হিসেবে। কিন্তু চোরের দশদিন গৃহস্থের একদিন। ধরা পড়ে যান ফরাসি পুলিশের কাছে। কাটাতে হয় ৫ বছরের কারাগার জীবন। তারপর তিনি আমেরিকান সরকারের সঙ্গে কাজ করার শর্তে মুক্তি পান। বলা যায়, তারপরেই অ্যাবাগনালের ভাগ্য খুলে যায়। নিজের করা ‘ওয়েব সাইট’ নামের ফার্ম থেকে আমেরিকার অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান, করপোরেশন, ল এনফোর্সমেন্ট এজেন্সিসহ ১৪ হাজারের বেশি কোম্পানিকে জালিয়াতি থেকে নিরাপত্তাবিষয়ক পরামর্শ দেন।

 

ডাকাতি ছেড়ে অভিনয়ে কেড়েছেন ভক্তহৃদয়

ড্যানি ট্রেজো

কমপক্ষে ২০০ সিনেমায় দুর্দান্ত অভিনয় করে ভক্তদের হৃদয় কেড়েছেন অভিনেতা ড্যানি ট্রেজো। অথচ এই ব্যক্তি জীবনের শুরুর দিকে বারে মাদক সরবারহ ও ডাকাতি পেশায় জড়িত ছিলেন। ১২টি বছর তিনি এই পথে হেঁটেছেন। কিন্তু বর্তমানে তাকে হলিউডি সিনেমার খল চরিত্র হিসেবে সবাই চেনে। টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, হলিউডে আসার প্রথমদিকে এক প্রযোজক ট্রেজোকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি তো অবৈধ কাজের সঙ্গে জড়িত।’ উত্তরে তিনি বলেন, ‘খুব দ্রুতই আমি সবকিছু ছেড়ে দেব।’ অপর সাক্ষাৎকারে ট্রেজো বলেন, ‘ক্যালিফোর্নিয়ায় কোনো ডাকাতি হলেই আমাকে দোষী সাব্যস্ত করা হতো। আমাকে জিজ্ঞেস করা হতো আমি ডাকাতি করেছি কি না।’

সর্বশেষ খবর