পৃথিবী প্রত্যক্ষ করেছে এরকম কিছু মানুষ; যারা ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা। প্রত্যেকেই নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে সফল ছিলেন। পাশাপাশি নিজেদের চোখেই দেখতে পেয়েছিলেন ভবিষ্যৎ। ভয়াবহ আগুনে শহর পুড়ে যাওয়া থেকে শুরু করে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জাহাজ টাইটানিক ডুবে যাওয়া এমনকি চন্দ্র জয় থেকে বর্তমানের ইন্টারনেটের
মাধ্যমে পুরো পৃথিবীর সংযোগ- সবকিছুরই ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল। ইতিহাসে আলোচিত এমন কিছু ভবিষ্যদ্বাণী নিয়ে আজকের রকমারি-
চন্দ্র জয়ের কাহিনী প্রায় হুবহু বর্ণনা করা হয়েছিল
জুল ভার্ন
কালজয়ী কথাসাহিত্যিক জুল ভার্নকে চেনেন না এমন মানুষ খুব কমই রয়েছেন পৃথিবীতে। তার লেখা অন্য একটি ছোট কল্পকাহিনী বইও পরবর্তী সময়ে সত্যি হয়ে যায়। সায়েন্স ফিকশন গল্পটির নাম ‘ফ্রম দ্য আর্থ টু দ্য মুন’। গল্পটিতে মানুষের প্রথম চন্দ্র অভিযানের বিষয়ে অবতারণা করা হয়। এরও প্রায় এক শতাব্দী পরে ১৯৬৯ সালে জুল ভার্নের কল্পনায় দেখা ভবিষ্যৎ বাস্তবে রূপ নেয়। মানুষের পা প্রথমবারের মতো পৃথিবীর বাইরে কোথাও গিয়ে পৌঁছে। অ্যাপোলোর অভিযাত্রীর সংখ্যার সঙ্গে হুবহু মিলে যায় জুল ভার্নের গল্পের অভিযাত্রীর সংখ্যা। দুটি রকেটই ফ্লোরিডা থেকে পৃথিবী ত্যাগ করে। আরও অদ্ভুত আর বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, জুল ভার্নের কল্পনার রকেটে অভিযাত্রীরা মহাশূন্যে ওজনহীন অনুভূতির মধ্য দিয়ে যায়। যা সত্যিই বিস্ময়কর বিজ্ঞানীদের কাছে।
সবই সত্য হয়েছে কালের আবর্তনে
মায়ান ক্যালেন্ডার
মায়ান পঞ্জিকা বিশেষজ্ঞদের মতে, মায়ান পঞ্জিকায় করা ভবিষ্যদ্বাণীগুলো কালের আবর্তে সত্য ঘটনায় পরিণত হয়েছে। পুরাতন সেই মায়ান সভ্যতা ইতিহাসের এক অনুপম সৃষ্টি। সময় এবং সৃষ্টির সুন্দর বিন্যাস সম্পর্কে মায়ানরা অনেক আগেই অবগত ছিল। মায়ানরা মনে করত প্রতিটি জিনিস একেক সময় একেকটি অবস্থানে বিরাজ করছে; যা আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানও বলছে কিন্তু তা বেশি দিন হয়নি। মায়ানদের ছিল ভবিষ্যৎ জানার নান্দনিক ক্ষমতা। তারা জানত যে চাঁদ, শুক্র এবং অন্য গ্রহ-তারা মহাবিশ্বে চক্রাকারে ঘুরছে। সেই সময়েই তারা নিখুঁতভাবে সময় গণনা করতে পারত। তাদের একটি পঞ্জিকা ছিল, যাতে সৌর বছরের প্রতিটি মিনিটের নিখুঁত বর্ণনা ছিল। মায়ানদের কাছে মহাকাশের ওপর ২২টি ভিন্ন ভিন্ন পঞ্জিকা ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ২৫০-৯০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অনেক মায়ান উন্নতির শিখরে পৌঁছে ছিল।
মানুষ ও যন্ত্রের সহাবস্থানের ধারণা
অ্যালান টুরিং
অ্যালান টুরিং যদিও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক আশানুরূপ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ভবিষ্যতে এমন কম্পিউটার প্রোগ্রামিং তৈরি হবে যা পর্দার আড়াল থেকে আলাপচারিতার মাধ্যমে ৩০ শতাংশ মানব বিচারককে ধোঁকা দিতে সক্ষম হবে যে সে আসলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নয়, মানুষ। এ বিষয়ে ১৯৫০ সালে তিনি টুরিং টেস্টের ধারণা দেন। এখন পর্যন্ত চীনের তৈরি সুপার কম্পিউটার টুরিং টেস্টে মানুষের বিপরীতে সর্বাধিক ৩৩ শতাংশ সক্ষমতা দেখাতে পেরেছে। অ্যালান টুরিং, স্টিফেন হকিংসহ অন্য বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন ২০২৯ সাল নাগাদ যন্ত্রের এই ক্ষমতা ১০০ ভাগে গিয়ে পৌঁছবে। মানবজাতির সমকক্ষ হিসেবে সর্বপ্রথম যন্ত্রকে আসন দেওয়ার কথা ভাবেন টুরিং। সৌদি আরব রোবট নারী সোফিয়াকে নাগরিকত্ব দিয়ে বিষয়টিকে আরও বেশি অর্থবহ করে তুলেছে।
প্রথম ধারণা দিয়েছিলেন অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তির
লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি
লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি ছিলেন তার সময় থেকে এগিয়ে থাকা একজন ব্যক্তি। তিনি ভবিষ্যতের নানারকম প্রযুক্তির ডিজাইন তৈরি করে দিয়ে গেছেন; যা তার সময় ভাবা ছিল একেবারেই কল্পনাতীত একটা ব্যাপার। যেমন তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, মানুষ একসময় কোনোরকম নড়াচড়া ছাড়াই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে সক্ষম হবে। তিনি এখনকার ব্যবহৃত আধুনিক যানবাহনের মডেল এঁকেছিলেন। তিনিই প্রথম ধারণা দিয়েছিলেন অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তির। যেমন মানুষের প্যারস্যুটের মাধ্যমে উড়াল দেওয়ার ধারণা তিনিই দেন। এ বিষয়ে তিনি একটি মডেলও তৈরি করেন। এরও ৩০০ বছর পরে মানুষ প্রথম প্যারাস্যুট-জাম্প দেয়। সামরিক বাহিনীর ব্যবহৃত ট্যাংক আবিষ্কারের ৪০০ বছর আগেই তিনি ট্যাংকের মডেল এঁকেছিলেন।
২০১৯ নিয়ে অন্ধ নারীর ভয়ঙ্কর ভবিষ্যদ্বাণী
বাবা ভ্যাঙ্গা
বুলগেরিয়ার বাসিন্দা অন্ধ নারী বাবা ভ্যাঙ্গা থট রিডিং এবং অলৌকিক উপায়ে রোগ নিরাময় ইত্যাদি ক্রিয়ার কারণে খ্যাতি পেয়েছিলেন। ১৯১১ সালে জন্ম ভ্যাঙ্গেলিয়ার। এক দুর্ঘটনায় দৃষ্টিশক্তি হারানোর পর থেকেই তার মধ্যে অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার উদয় হয়। তিনি ভবিষ্যতে ঘটবে এমন ঘটনার কথা অবলীলায় বলতে শুরু করেন। ভ্যাঙ্গা যে ভবিষ্যদ্বাণীগুলো করেছিলেন তার মধ্যে অনেক ঘটনাই মিলে গেছে। ২০১৯ সাল নিয়ে ভ্যাঙ্গা বাবা কয়েকটি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। যেমন ২০১৯ সালে পৃথিবীতে এক মহা সুনামির আশঙ্কা রয়েছে। এ বছর বিশ্ব রাজনীতিতে রাশিয়া এক গুরুত্বপূর্ণ স্থানে উঠে আসতে পারে। ২০২৮ সালে বিশ্বব্যাপী খাদ্যসংকট এবং ২০১৬ সাল থেকে ইউরোপের অবলোপ ঘটবে। ব্রেক্সিটের কথা কিন্তু অস্বীকার করা যাচ্ছে না।
১৯০১ সালেই ওয়াই-ফাই এবং মোবাইলের ধারণা
নিকোলা টেসলা
নিকোলা টেসলা ছিলেন একজন সার্বিয়ান-আমেরিকান উদ্ভাবক। একটি চমকপ্রদ বিষয় হলো তিনি বর্তমানে ব্যবহৃত ওয়াই-ফাইয়ের ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা। ১৯০১ সালেই তিনি বলেছিলেন ভবিষ্যতের পৃথিবীর এক তারবিহীন যোগাযোগ ব্যবস্থার কথা। সেই সময় নিউইয়র্ক টাইমসে নিকোলা টিসলার সাক্ষাৎকারে বর্তমানের ওয়াই-ফাই সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা দিয়ে গেছেন। সেখানে তিনি ভবিষ্যৎ পৃথিবীর প্রযুক্তি কেমন হবে সে সম্পর্কে ধারণা দেন। যাতে বলা হয়, ভবিষ্যতের পৃথিবীতে মানুষ তারবিহীন সংযোগ স্থাপন করে বার্তা আদান-প্রদান করতে পারবে। এমন এক ডিভাইস থাকবে যার মাধ্যমে প্রতিটি মানুষ একে অপরের সঙ্গে কানেকটেড থাকবে।
টাইটানিক ডুবে যাওয়ার আগেই ডুবেছিল টাইটান
মরগান রবার্টসন
১৮৯৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত বই ‘ফুটিলিটি অর দ্য রিক অব দ্য টাইটান’। লেখক ছিলেন সাহিত্যিক মরগান রবার্টসন। বইটিতে বলা হয় ‘এস এস টাইটান’ নামের একটি বিশালাকার জাহাজের কথা। যেটি নর্থ আটলান্টিক সাগরে একটি আইসবার্গের সঙ্গে সংঘর্ষের ফলে ডুবে যায়। এর ঠিক ১৪ বছর পরে ১৯১২ সালে টাইটানিক ডুবে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। ১৫০৩ জন যাত্রী নিয়ে ডুবে যায় জাহাজটি। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, বইটিতে বর্ণিত টাইটান জাহাজের সঙ্গে বাস্তবের টাইটানিক জাহাজের প্রায় হুবহু মিল পাওয়া যায়। আকার এবং গতি একই, এমনকি দুটি জাহাজই ডুবে যায় বছরের এপ্রিল মাসে। দুটি জাহাজেই অর্ধেক সংখ্যক যাত্রী মৃত্যুবরণ করেন।
১৮৯৮ সালের লেখা ইন্টারনেট প্রযুক্তি
মার্ক টোয়েন
সাহিত্যিক মার্ক টোয়েন ১৮৯৮ সালে একটি ছোট গল্প লিখেছিলেন। নাম ছিল ‘ফ্রম দ্য লন্ডন টাইমস হস ১৯০৪’। সেই গল্পে বলা হয়, একটি ইলেকট্রনিকস ডিভাইসের কথা; যার কাল্পনিক নাম ছিল ইলেকট্রস্কোপ। যার মাধ্যমে পৃথিবীর ঘটে যাওয়া প্রতিদিনের ঘটনা সবার সামনে অটোমেটিক্যালি চলে আসত।
আদতে তিনি ইন্টারনেটের কথা ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন।
মার্ক টোয়েন তার মৃত্যুদিন নির্দিষ্টভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন। যা হুবহু মিলে যায়। ১৯০৯ সালে প্রকাশিত তার অটোবায়োগ্রাফিতে তিনি দাবি করেন, তার জন্ম হয়েছিল ১৮৩৫ সালে হ্যালির ধূমকেতুর আগমনের মধ্যদিয়ে, যা আবারও আসবে পরের বছর এবং তিনি বিদায় নেবেন।
গ্রেট ফায়ার অব লন্ডন
মাইক্যাল দে নস্ট্রাদামুস
ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন এমন একজন ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা হলেন মাইক্যাল দে নস্ট্রাদামুস। নানারকম ঐতিহাসিক ঘটনা তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন। যা তার মৃত্যুর পর শত বছর ধরে হুবহু মিলে যাচ্ছে। এমনই একটি ঘটনা হচ্ছে দ্য গ্রেট ফায়ার অব লন্ডন। ১৬৬৬ সালে লন্ডন শহরে এক ভয়াবহ আগনের সূত্রপাত হয়। এর ফলে শহরের ৯০ শতাংশ বাড়িঘর ও স্থাপনা পুরে যায়। মাইক্যাল দে নস্ট্রাদামুস তার বইয়ে লিখেছিলেন, লন্ডন শহর ৬৬ সালে ভয়াবহ আগুনে জ্বলবে। বাস্তবেও ঠিক তাই হয়েছে। রাজা দ্বিতীয় হেনরির মৃত্যু এবং এডলফ হিটলার পরিণতির কথাও তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন; যা মিলে গেছে। ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের কথাও তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন। আবার ১/১১ টুইন টাওয়ার অ্যাটাকের কথাও তিনি বর্ণনা করে গেছেন।
আলেকজান্ডারের সমাধি যেখানে সে দেশ হবে সমৃদ্ধ
অ্যারিস্টান্ডার
আলেকজান্ডারের ইচ্ছা ছিল গ্রিসের আমন শহরে অবস্থিত জিউসের মন্দিরেই যেন তাকে সমাধিস্থ করা হোক। পরাক্রমশালী এই রাজার শবযাত্রা মেসিডোনিয়ায় যাওয়ার পথে আলেকজান্ডারেরই এক ক্ষমতাশালী সেনাপতি টলেমি সোটার সমাধিবাহী গাড়িটা চুরি করে নিয়ে যান মিসরের মেমফিসে। টলেমির এই চুরির কারণ ছিল রাজ জ্যোতিষী অ্যারিস্টান্ডারের ভবিষ্যদ্বাণী। তিনি বলেছিলেন, আলেকজান্ডার যেখানে সমাধিস্থ হবেন, সেই দেশ হবে সমৃদ্ধশালী, অপরাজেয় ও চিরশান্তির এক দেশ। টলেমির উদ্দেশ্য সফল হয়। আলেকজান্ডারকে মমি করে মিসরীয় রীতিতে সমাধিস্থ করা হয়। এর পর থেকেই আশ্চর্যজনকভাবে মিসরের উন্নতি সাধন হতে থাকে। শুধু তাই নয়, টলেমির বংশও দীর্ঘদিন রাজত্ব চালাতে সক্ষম হয়।