রবিবার, ১৭ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা
অ্যান্ড্রু কার্নেগি

বস্তির ছেলে কোটিপতি

তানভীর আহমেদ

বস্তির ছেলে কোটিপতি

সাড়ে বারো টাকা বেতনে তাঁতির মজুর

অ্যান্ড্রু কার্নেগি হলেন এক সময়ের অন্যতম মার্কিন ধনী ব্যক্তি। ১৮৩৫ সালের ২৫ নভেম্বর স্কটল্যান্ডের এক সামান্য পল্লীগ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে তার জš§ হয়। জীবনের প্রথম ১৩টি বছর স্কটল্যান্ডে কাটে পরিবারের সঙ্গে। পরবর্তীতে জীবিকার তাগিদে তার বাবা সপরিবারে আমেরিকায় পাড়ি জমান। আমেরিকাতে তাদের ঠিকানা হয় একটি বস্তিতে। মানুষ চাইলে পারে না এমন কাজ নাকি নেই। অ্যান্ড্রু কার্নেগির জীবনের যেখান থেকে শুরু সেখানে দাঁড়িয়ে ধনকুবের হওয়ার স্বপ্নটা শুধুই সাদামাটা স্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু চাওয়ার কমতি ছিল না কার্নেগির। সেই চাওয়াটা আর কিছু নয়, অনেক অনেক অর্থ রোজগার করার। এই ধনী হওয়ার ইচ্ছেটা তার ছোটবেলার। এ নিয়ে বহুল আলোচিত ঘটনাটি অনেকেই জানেন হয়তো। তবু আরেকবার বলা যেতে পারে। কারণ এ ঘটনাটি যুগের পর যুগ অনুপ্রেরণা হয়ে আছে। কার্নেগির বয়স তখন মাত্র ১৩ বছর। পোশাক-আশাক একেবারেই ভালো ছিল না। একে তো নোংরা তার ওপর বিভিন্ন জায়গায় ছেঁড়া ছিল। এ অবস্থাতেই একদিন খেলার জন্য একটি পাবলিক পার্কে ঢুকতে যাচ্ছিলেন। পার্ক ধনীদের বিশ্রামের জন্য উš§ুক্ত, এমন নোংরা বস্তিবাসীর জন্য নয়। তাই পার্কের দারোয়ান তাকে পার্কের গেটেই আটকে দিলেন। কার্নেগি অনেক অনুনয় করলেও তাকে পার্কের ভিতরে প্রবেশ করতে দেননি। তখন বালক কার্নেগি দারোয়ানকে বলে, সে এই পার্ক কিনেই পার্কের ভিতরে ঢুকবে। সেই থেকে মনে জেদ তার। পার্ক কিনে ফেলতে অনেক টাকা চাই। তাই একটি সুতার কলে মাসে সাড়ে ১২ টাকা বেতনে তাঁতির মজুর হিসেবে যোগ দেন। এটাই তার জীবনের প্রথম রোজগার। এর প্রায় এক বছর পর হঠাৎ একদিন রাস্তা দিয়ে যাওয়ার পথে দেখেন একটি টেলিগ্রাফ অফিসের দরজায় লেখা- ছোকরা পিয়ন চাই। বস্তির ছেলের ভাগ্য আর কি রকম হবে। যেখানে যায় সেখান থেকেই তাকে তাড়িয়ে দেয়। কেউ কোনো কাজ দিতে চায় না। কিন্তু কার্নেগি ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন বড় কোনো কাজ না মিললেও ছোট কোনো কিছুই দিন শুরু করতে হবে। ভালো চাকরি লাভের আশায় কার্নেগি অফিসের ভিতরে যান। কিন্তু পোশাক-আশাক ভালো না হওয়ায় সেই অফিসের কেরানী তাকে বের করে দেন। দরজার বাইরে কার্নেগি দাঁড়িয়ে থাকতেন। তার মনে আশা হয়তো তাকে ডাকবেন বড়কর্তা। বড়কর্তা এসবের কিছুই জানতেন না। কার্নেগি তার পরের দিন আবার সেই অফিসে যান চাকরির আশায়। এবারও সেই কেরানীর কারণে অফিসের বড় সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে পারেননি কার্নেগি। কিন্তু চাকরিটি তার চাই-ই চাই। এই আশায় তিনি তৃতীয় দিন আবার যান সেই অফিসে। এবার আর কেরানী তাকে তাড়িয়ে না দিয়ে বড় সাহেবের কাছে ঘটনাটি খুলে বলেন। বড় সাহেব সব শুনে বললেন, পাঠিয়ে দাও তো দেখি ছোকরা কি চায়। সেদিনই কার্নেগি টেলিগ্রাফ অফিসের কাজে ভর্তি হলেন। সেদিনের সেই পিয়ন ছেলেটি একদিন টেলিবিভাগের বড় সাহেবও হয়েছিলেন। কিন্তু কীভাবে? পিয়নের কাজ করতে করতেই নিজ মেধা দিয়ে টেলিগ্রাফের বিভিন্ন নিয়ম-কানুন সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন কার্নেগি। তারপর পিয়নের চাকরি ছেড়ে যোগ দেন স্থানীয় রেলস্টেশনের টেলিগ্রাফ অপারেটর হিসেবে। এভাবে ধীরে ধীরে টেলিবিভাগের বড় সাহেবের পদটিও অর্জন করেন কার্নেগি।

 

সফলতার শুরু

তাঁতে সাড়ে ১২ টাকা বেতনে রোজগার শুরু করা কার্নেগি পিয়নের চাকরি দিয়ে ভাগ্য বদল করতে চেয়েছিলেন। সেখানে কয়েক বছর কাজ করার পর তার অভিজ্ঞতা তাকে আরেকটু সামনে টেনে নিয়ে গেল। টেলিগ্রাফ পাঠানোর কাজ খুব ভালো করেই রপ্ত করলেন তিনি। টেলিগ্রাফ যন্ত্র পরিচালনায় তার দক্ষতা সবার নজর কেড়েছিল। টেলি বিভাগে দ্রুত তার উন্নতি হতে থাকল। যে বড়কর্তার অধীনে তিনি কাজ করতেন একদিন তার পর্যায়ে পৌঁছে গেলেন নিজ যোগ্যতা বলে। টেলিবিভাগের বড় সাহেব হওয়ার পর চাকরির পাশাপাশি তিনি রেলগাড়ি ও খনির তেলের ব্যবসা শুরু করেন। রেলগাড়ি তখন যোগাযোগের সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম। রেলগাড়ির ব্যবসায় প্রচুর টাকা আসতে থাকল তার হাতে। এ টাকা তিনি অপচয় করলেন না। তেলের ব্যবসায় লাভের টাকা খাটিয়ে আয় আরও বাড়িয়ে নিলেন। খুব অল্পদিনের মধ্যেই এই ব্যবসা থেকে অনেক টাকা লাভ হতে থাকে। লাভের টাকা আরও নতুন নতুন ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে থাকেন কার্নেগি। সব ব্যবসাতেই তিনি একের পর এক সফল হতে থাকেন। এভাবে একে একে সাতটি বড় বড় লোহার কারখানা কিনে ফেলেন কার্নেগি এবং নিজস্ব তত্ত্বাবধানে সেগুলো চালাতে থাকেন। কার্নেগির বয়স তখনো ৩৫-এর কোটায় পৌঁছেনি, এ সময়েই কার্নেগি বিশ্বের নামকরা লোহা ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন।

 

সেই বস্তির ছেলে কিনে নিল গোটা পার্ক

সর্বকালের শীর্ষ ধনকুবেরদের একজন অ্যান্ড্রু কার্নেগি। ২৪ লাখ ৪১ হাজার ২২০ কোটি টাকার মালিক ছিলেন অ্যান্ড্রু কার্নেগি। অ্যান্ড্রু কার্নেগি বস্তির ছেলে ছিলেন। ছোট কুঁড়েঘরে থাকতেন। কৈশোরে তিনি স্থানীয় পাবলিক পার্কে ঢুকতে চেয়েছিলেন। তার ময়লা নোংরা পোশাকের জন্য দারোয়ান তাকে ঢুকতে দেয়নি। সেদিনই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন কোনো দিন টাকা হলে এই পার্ক তিনি কিনে নেবেন। তারপর পরিণত বয়সে ব্যবসা শুরু করেন। লৌহশিল্পে তিনি অভাবনীয় সাফল্যের দেখা পান। স্টিলের ব্যবসা থেকে স্রোতের মতো টাকা আসতে শুরু করে। ৩০ বছর পরে অ্যান্ড্রু কার্নেগি তার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেছিলেন। তিনি সেই পার্কটি কিনেছিলেন। সেখানে একটি নতুন সাইনবোর্ড লাগিয়েছিলেন। সে সাইনবোর্ডে লেখা ছিল- ‘আজ থেকে দিনে বা রাতে, সকালে বা বিকালে, যে কোনো বয়সের, যে কোনো মানুষ, যে কোনো পোশাকে এই পার্কে প্রবেশ করতে পারবে।’

 

টাকার পাহাড়

টাকার পাহাড় গড়েছিলেন এই শিল্পপতি। স্টিল ব্যবসায় কোটি কোটি টাকা কামাই করেন তিনি। তার ব্যবসায় অবসান ঘটে উনিশ শতকের শুরুতে। ১৯০২ সালে তিনি ৪০০ মিলিয়ন ডলারে তার স্টিল কোম্পানি জেপি মরগানের কাছে বিক্রি করে দেন, যার বর্তমান বাজারমূল্য ৩১০ বিলিয়ন ডলার।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর