শনিবার, ২৩ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

সুখী দেশের গল্প

বিশ্বের ১৫৬টি দেশের জনগণের আয়, স্বাধীনতা, বিশ্বাস, গড় আয়ুর সম্ভাব্যতা, সামাজিক সহায়তা এবং উদারতাÑ এ ছয়টি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে সুখী দেশের তালিকা প্রণয়ন করেছে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন সমাধান নেটওয়ার্ক বিভাগ। ২০১৯ সালের জরিপ অনুযায়ী বিশ্বের সব থেকে সুখী দেশের তালিকায় স্থান পেয়েছে ফিনল্যান্ড। বাংলাদেশের অবস্থান সেখানে ১২৫তম। ২০১৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সময়ের বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ শেষে এবারের রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে। বিস্তারিত জানাচ্ছেন- তানিয়া তুষ্টি

সুখী দেশের গল্প

ফিনল্যান্ড - প্রথম

বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশের তালিকায় শীর্ষে নাম এসেছে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ ফিনল্যান্ডের। ২০১৯ সালে ৭.৭ স্কোর গড়ে তারা এ অবস্থান অর্জন করেছে। ২০১৮ সালেও তারা শীর্ষে ছিল; তবে ২০১৭ সালে ফিনল্যান্ডের অবস্থান ছিল ৫ নম্বরে। উত্তর-পশ্চিম ইউরোপে বাল্টিক সাগরের উপকূলে অবস্থিত রাষ্ট্রটি ইউরোপের সবচেয়ে উত্তরে অবস্থিত দেশগুলোর একটি। এর এক-তৃতীয়াংশ এলাকা সুমেরুবৃত্তের উত্তরে অবস্থিত। এখানে ঘন সবুজ অরণ্য ও প্রচুর হ্রদ রয়েছে। প্রাচীরঘেরা প্রাসাদের পাশাপাশি আছে অত্যাধুনিক দালানকোঠা। দেশটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ এর বনভূমি। এগুলোকে ফিনল্যান্ডের ‘সবুজ স্বর্ণ’ নামেও ডাকা হয়। হেলসিঙ্কি ফিনল্যান্ডের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর। ফিনল্যান্ডের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও স্বাতন্ত্র্য সুবিদিত। এখানকার দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ সাউনা তথা ফিনীয় ধাঁচের বাষ্পস্নান বিশ্ববিখ্যাত। ফিনল্যান্ডের রাজনীতি একটি অর্ধ-রাষ্ট্রপতি শাসিত প্রতিনিধিত্বমূলক বহুদলীয় গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কাঠামোয় সংগঠিত। রাষ্ট্রপতি হলেন রাষ্ট্রের প্রধান। শিক্ষা একটি জন্মগত অধিকার ও রাষ্ট্রকর্তৃক প্রদত্ত সেবা হিসেবে বিবেচিত হয় ফিনল্যান্ডে। এখানে ৭ থেকে ১৬ বছর বয়সী ছেলেমেয়ে বিনামূল্যে শিক্ষা লাভ করে। উচ্চশিক্ষায় ফিনল্যান্ড এগিয়ে।

 

ডেনমার্ক - দ্বিতীয়

২০১৮ সালের তালিকায় ডেনমার্কের অবস্থান ছিল তিন নম্বরে। এবার তারা এক ধাপ এগিয়ে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে। সুখী জাতি হিসেবে ডেনিশদের স্কোর ৭.৬। ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিকভাবে ডেনমার্ক স্ক্যান্ডিনেভীয়ার একটি অংশ। দেশটির রাজধানী এবং বৃহত্তম শহর কোপেনহেগেন। ডেনমার্কের আয়তন ৪২ হাজার ৯২৪ বর্গ কিলোমিটার। ভাইকিংয়েরা ১১শ বছর আগে ডেনীয় রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। এটি ইউরোপের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী রাজত্বগুলোর একটি। দেশটি ডেনীয় দ্বীপপুঞ্জের বহু শত দ্বীপ নিয়ন্ত্রণ করে। ডেনমার্কের জলবায়ু তুলনামূলকভাবে বেশ মৃদু। এখানে রয়েছে ঢেউ খেলানো পাহাড়ের সারি। সাজানো-গোছানো খামার এবং বিস্তৃত গ্রামীণ সবুজ চারণভূমি। দেশটির কোনো অংশ থেকেই সাগরের দূরত্ব ৬৪ কিলোমিটারের বেশি নয়। ফলে সমগ্র দেশেই উপকূলীয় আবহাওয়া বিরাজ করে। ডেনমার্ক অত্যন্ত ধনী ও আধুনিক একটি দেশ। এ অবস্থানে আসা সম্ভব হয়েছে সীমিত প্রাকৃতিক সম্পদের সদ্ব্যবহারে চাতুর্য ও দক্ষতার পরিচয়  দেওয়ায়। তাছাড়া ইউরোপের সবচেয়ে প্রাচীন ও ব্যাপক সমাজ কল্যাণমূলক দেশগুলোর একটি ডেনমার্ক।

 

নরওয়ে - তৃতীয়

নিশীথ সূর্যের দেশ নরওয়ে সুখী দেশের তালিকায় তিন নম্বরে অবস্থান করছে। ২০১৮ সালে ছিল দুই নম্বরে আর ২০১৭ সালে ছিল এক নম্বরে। পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে অবস্থিত নরওয়ের প্রাকৃতিক ঘটনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় ২৪ ঘণ্টাব্যাপী সূর্যের আলো বিদ্যমান থাকা। প্রাকৃতিক এ ঘটনাটিকে হোয়াইট নাইট বা শ্বেতরাত্রি বলে উল্লেখ করা হয়। প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক এ পরাবাস্তব দৃশ্য অবলোকন করতে নরওয়েতে আসে। এ ছাড়া দেশটির বিশেষত্ব হিসেবে রয়েছে বিস্ময়কর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য। রূপকথার গল্পের মতো সুন্দর সব সমুদ্রখাত, অরোরা বোরিয়ালিস বা উত্তরের আলো, তুষার ঢাকা বিস্তৃত মালভূমি আর অবিশ্বাস্য সুন্দর সব পর্বতমালা। নরওয়েতে রয়েছে হাজার হাজার নয়নাভিরাম হ্রদ। মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য্যরে পাশাপাশি এসব হ্রদে পাওয়া যায় ইউরোপের সবচেয়ে সুস্বাদু স্যামন মাছ। এখানে দৃষ্টিনন্দন বেলাভূমি থেকে শুরু করে আরও রয়েছে ছবির মতো সুন্দর জেলেদের গ্রাম আর সবুজের সমারোহ। কিছু সূত্র থেকে জানা যায়, এ দ্বীপে ১১ হাজার বছর ধরে জনবসতি রয়েছে; যদিও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ শুধু ৫ হাজার বছরেরই পুরনো বসতির সন্ধান পেয়েছে। লোফোটেন, লৌহ যুগের ধ্বংসাবশেষ ছাড়াও ভাইকিং ইতিহাসের জন্য বিখ্যাত।

 

আইসল্যান্ড - চতুর্থ

২০১৮ সালে এ তালিকার চতুর্থ স্থানে ছিল আইসল্যান্ড। এবারও সে জায়গায় আছে আইরিশরা। তাদের স্কোর ৭.৪। দেশটির নাম শুনলেই মনে হতে পারে বরফে আচ্ছন্ন একটি ভূমি। দেশটির আবহাওয়া গরমও নয় আবার ঠাণ্ডাও নয়। বাস্তবে এটি নৈসর্গিক প্রাকৃতিক রূপে পরিপূর্ণ দেশ বলা যায়। দেশটির মোট জনসংখ্যা ৩ লাখ ৩২ হাজার, এর প্রায় অর্ধেকই রাজধানী রিকজাভিক বা এর আশপাশের এলাকায় থাকে। প্রায় ১ হাজার বছর আগে খ্রিস্টীয় ৯ম শতকে ভাইকিং অভিযানকারীরা আইসল্যান্ডে বসতি স্থাপন করে। ভাইকিং তাদের ঐতিহ্য ও গর্ব। এ দেশের পানি এতটাই নিরাপদ যে কোনো প্রকার বিশুদ্ধকরণ ছাড়াই প্রত্যেক ঘরে সরবরাহ করা হয়। তিমি মাছ প্রদর্শনীতে আইসল্যান্ড বিখ্যাত। এর থেকে সরকারি খাতে মোটা অঙ্কের রাজস্বও যোগ হয়ে থাকে। আইসল্যান্ডের প্রায় ৮৫ শতাংশ শক্তি নবায়নযোগ্য। অর্থাৎ জলবিদ্যুৎ শক্তি বা ভূতাত্ত্বিক জল সংরক্ষণ দ্বারা আইসল্যান্ডের বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ করা হয়। আইসল্যান্ডীয়রা হলো বইপোকা। এক জরিপে বলা হয়েছে, আইসল্যান্ডের ১০ ভাগ মানুষ তাদের জীবনকালে একটি হলেও বই প্রকাশ করে। আইসল্যান্ডে পৃথিবীর সর্বোচ্চ বই এবং পত্রিকা প্রকাশনী রয়েছে। সেখানে অপরাধ খুব কম হয় এবং বড় ধরনের কোনো অপরাধ প্রায় অস্তিত্বহীন। দেশটি এতটাই পরিষ্কার যে সেখানে কোনো মশা বা পোকা-মাকড়ও নেই।

 

নেদারল্যান্ডস - পঞ্চম

এবারের সুখী দেশের তালিকায় পাঁচ নম্বরে উঠে এসেছে নেদারল্যান্ডস। গতবারের থেকে এক ধাপ এগিয়েছে তারা। তাদের স্কোর ৭.৪। এর পূর্ব নাম হল্যান্ড। নেদারল্যান্ডসের স্থলভাগের উচ্চতা সমুদ্রের জলতলের থেকে অনেক নিচু। তাই বাঁধ দিয়ে পুরো দেশটা ঘিরে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া জলতলকে সমান রাখার জন্য গোটা দেশে প্রচুর খাল কাটা আছে। সমুদ্রের সঙ্গে এ খালগুলোর যোগাযোগ আছে নদীর মাধ্যমে। এভাবে ভৌগলিক অসুবিধাগুলোকে এ দেশের মানুষ অনেকটা অতিক্রম করতে পেরেছে। খালগুলোর ওপর রীতিমতো নৌবিহার করা যায়। ফলে, সমগ্র দেশে  জলপথে ভ্রমণ করা যায়। আয়তনে নেদারল্যান্ডস ছোট্ট একটি দেশ হলেও অত্যন্ত সুন্দর সাজানো-গোছানো। নেদারল্যান্ডসের অর্থনীতির মূল ভিত্তি কৃষি। গ্রীষ্মকালে বাইরে এবং শীতকালে তারা গ্রিন হাউস উৎপাদন করে। নেদারল্যান্ডসের কৃষকরা দেশের প্রথম শ্রেণির ধনী। তাদের প্রধান খাদ্য ব্রেড, আলু, সালাদ। আর এ ব্রেডের সঙ্গে অন্তত হাজার রকমের উপকরণ আছে যা মিলিয়ে তারা খেতে পছন্দ করে। ডাচরা খুব পরিশ্রমী। শত শত বছরের পরিশ্রমের ফসল আজকের এ নেদারল্যান্ডস। আর সে জন্য আজ তারা বিশ্বের একটা উন্নত দেশ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এখানে আইন যেমন আছে তেমনি তার যথাযথ প্রয়োগ আছে। অতিরিক্ত জরিমানা দেওয়ার ভয়ে কেউ আইন অমান্য করে না।

 

এক নজরে সুখী ১০ দেশের তালিকা

১. ফিনল্যান্ড

২. ডেনমার্ক

৩. নরওয়ে

৪. আইসল্যান্ড

৫. নেদারল্যান্ডস

৬. সুইজারল্যান্ড

৭. সুইডেন

৮. নিউজিল্যান্ড

৯. কানাডা

১০. অস্ট্রেলিয়া

 

এক নজরে অসুখী ১০ দেশের তালিকা

১. সুদান

২. সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক

৩. আফগানিস্তান

৪. তানজানিয়া

৫. রুয়ান্ডা

৬. ইয়েমেন

৭. মালাবি

৮. সিরিয়া

৯. বতসোয়ানা

১০. হাইতি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর