রবিবার, ৩১ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

বিশ্বের কম বয়সী রাষ্ট্রপ্রধান

চলতি ধারণা হলো, রাজনীতিতে পোক্ত হওয়ার পরই রাষ্ট্রপ্রধান হওয়া শোভন। সে কারণে এই অবস্থানে যারা আসতে চান, তারা অনেক সময় নেন। তাই দেখা যায়, যিনি রাষ্ট্রপ্রধান তার বয়সটা একটু ভারীই। কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ‘কাঁচা’ বয়সে রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে চমক সৃষ্টি করেছেন কোনো কোনো রাজনীতিবিদ। আজকের রকমারি তাঁদের নিয়েই।

তানিয়া তুষ্টি

বিশ্বের কম বয়সী রাষ্ট্রপ্রধান

সেবাস্তিয়ান কুর্জ, অস্ট্রিয়া (৩৩ বছর)

বর্তমান সময়ে বিশ্বের কনিষ্ঠতম রাষ্ট্রপ্রধান অস্ট্রিয়ার সেবাস্তিয়ান কুর্জ। কেউ কেউ তাকে উন্ডারউজ্জি বলে ডাকেন। ২০১৭ সালে মাত্র ৩১ বছর বয়সে তিনি দেশটির চ্যান্সেলর হিসেবে শপথ নেন। বর্তমানে তার বয়স ৩৩ বছর। সাধারণ নির্বাচনে কুর্জের দল পিপলস পার্টি ৩১ ভাগ ভোট পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। সেখানে প্রতিপক্ষ ডানপন্থি ফ্রিডম পার্টি পায় ২৭.৪ শতাংশ ভোট আর ২৬.৭ ভাগ ভোট পেয়ে তৃতীয় হয় বামপন্থি সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি অব অস্ট্রিয়া। অস্ট্রিয়ার চ্যান্সেলর হিসেবে শপথ নেওয়ার পর কুর্জ শুধু ইউরোপে নন, গোটা বিশ্বে সবচেয়ে কমবয়সী সরকার প্রধান হিসেবে পরিগণিত হন। ভিয়েনায় ১৯৮৬ সালের ২৭ আগস্ট তার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা দেশটির জেলা শহর মিডলিংয়ে। একটি জিমনেসিয়ামে পড়াশোনা শেষ করে ২০০৪ সালে অবলিগেটরি মিলিটারি সার্ভিসের পর ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। তবে ২০১১ সালে সাত বছর পর কোনো ডিগ্রি না নিয়েই তা বাদ দেন এবং পুরোদমে রাজনীতিতে নামেন। তখন পিপলস পার্টির যুব শাখার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন আইনের ছাত্র কুর্জ। স্মার্ট আর ক্যারিশমাটিক গুণাবলির কারণে অল্প সময়ের মধ্যেই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। ২০১১ সালে সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৩ সালে অস্ট্রিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েই ইতিহাস গড়েছিলেন সেবাস্তিয়ান কুর্জ। ইউরোপের তরুণতম পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে কুর্জ শপথ গ্রহণ করেছিলেন মাত্র ২৭ বছর বয়সে। ২০১৫ সালে ইউরোপের অভিবাসন সমস্যা নিয়ন্ত্রণ কিভাবে আরও জোরদার করা যায় সে ব্যাপারে তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। এ ছাড়াও শিক্ষা, শ্রম ও চাকরির বাজার এবং আইন বিষয়ে ৫০ দফা প্রস্তাব রাখেন। অভিবাসী ও শরণার্থী বিরোধী অবস্থানের কারণে দেশে দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি। সেই জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগান নির্বাচনের সময়। নির্বাচনের এক দিন আগেও সংবাদ মাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কুর্জ বলেছিলেন, ‘আমাদের অবশ্যই অবৈধ অভিবাসন বন্ধ করতে হবে। কারণ এ ছাড়া অস্ট্রিয়ার নিরাপত্তা ও সংহতি রক্ষার কোনো সুযোগ নেই।’ এ ছাড়া তিনি দেশের সীমান্ত সুরক্ষা ও অভিবাসীর সংখ্যা সীমিত করার আশ্বাস দিয়েছিলেন।

 

জোসেফ মাস্কট, মাল্টা [৪৫ বছর]

মাল্টার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জোসেফ মাস্কট। ২০১৩ সালে দায়িত্ব গ্রহণের সময় তার বয়স ছিল ৩৯ বছর। দ্বিতীয় মেয়াদে ২০১৭ সালে আবারও তিনি প্রধানমন্ত্রী হন। বর্তমানে তার বয়স ৪৫ বছর। ২০০৪ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত এই তরুণ নেতা ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সদস্য ছিলেন। মাস্কট প্রগতিশীল ও উদার রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি সুপরিচিত। অর্থনৈতিকভাবে উদার ও সামাজিক উদার নীতি উভয়ের সঙ্গে তিনি যুক্ত। ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত তিনি বিরোধী দলের নেতা হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। এ সময়কালে তিনি জনমনে নিজেদের একটি গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে সক্ষম হন। আর তার প্রতিফলন ঘটে ২০১৩ সালের নির্বাচনে। তিনি বিশেষভাবে অর্থনীতি বিষয়ে পারদর্শী। ইউনিভার্সিটি অব মাল্টা থেকে ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। কর্মজীবন শুরু করেন সাংবাদিকতা দিয়ে। অথচ বর্তমানে তিনি দেশটির প্রধানমন্ত্রী।

 

 

কিম জং উন, উত্তর কোরিয়া [৩৫ বছর]

উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা কিম জং উন। ২০১১ সালে বাবা কিম জং ইলের মৃত্যুর পর দেশটির সর্বোচ্চ নেতা ও প্রেসিডেন্ট হিসেবে আসীন হন কিম জং উন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২৭ বছর। তিনি বর্তমানে উত্তর কোরিয়ার ওয়ার্কার্স পার্টির প্রথম সম্পাদক, উত্তর কোরিয়ার কেন্দ্রীয় সামরিক সংস্থার সভাপতি, উত্তর কোরিয়ার জাতীয় প্রতিরক্ষা সংস্থার সভাপতি, কোরিয়ান পিপলস আর্মির সর্বোচ্চ অধিনায়ক ও কোরিয়ার ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতিমণ্ডলীয় নিয়ন্ত্রণ কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। কিমের জীবন নিয়ে রহস্যের শেষ নেই। ২০১১ সালের ৮ জানুয়ারি এক তরুণ নেতাকে চার তারকা জেনারেল ও দেশটির শীর্ষ নির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবে বরণ করে নিতে দিনটিতে আয়োজন করা হয় নানা অনুষ্ঠানের। সেই তরুণই আজকের  বৈচিত্র্য আর রহস্যে ঘেরা নেতা কিম জং উন।

 

 

তামিম বিন হামাদ আল থানি কাতার [৩৯ বছর]

উপসাগরীয় ক্ষুদ্র তবে ধনী দেশ কাতারের বর্তমান আমির শেখ তামিম বিন হামাদ বিন খলিফা আল থানি। ২৩ জুন ২০১৩ সালে তার বাবা আমির শেখ হামাদ বিন খলিফা আল থানি ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ৩ জুন ১৯৮০ সালে জন্ম নেওয়া বর্তমান আমিরের বয়স ৩৯ বছর। আরব অঞ্চলে কনিষ্ঠতম শাসক হিসেবে অধিকাংশের মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন। ২০০৩ সালে আমির শেখ হামাদ বিন খলিফা ছেলে তামিমকে ‘ক্রাউন প্রিন্স’ অর্থাৎ তার সম্ভাব্য উত্তরাধিকারী ঘোষণা করেন। তখন থেকেই পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত তামিম বিন হামাদ আমিরাত অর্থাৎ দেশের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে থাকেন। আমির হওয়ার আগে তামিম কাতারের সশস্ত্র বাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার ইন চিফ ছিলেন। তিনি ২০৩০ ভিশন প্রকল্পের সভাপতি এবং ‘কাতার ২০২২ সুপ্রিম কমিটি’র প্রধান। এই কমিটি আমিরাতে ‘২০২২ ফিফা বিশ্বকাপ’ অনুষ্ঠান আয়োজনের দায়িত্বে নিয়োজিত।

 

 

জিগমে খেসার নামগিয়েল, ভুটান [৩৯ বছর]

ভুটানের রাজতন্ত্রের শতবর্ষ পূর্তিতে ২০০৮ সালের ১ নভেম্বর ভুটানের পঞ্চম নৃপতি হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন জিগমে খেসার নামগিয়েল ওয়াংচুক। তবে ২০০৬ সালেই বাবা জিগমে সিংহে ওয়াংচুক সরে দাঁড়ালে ভুটানের রাজার দায়িত্ব পান জিগমে খেসার ওয়াংচুক। মাত্র ২৬ বছর বয়সে তিনি এ দায়িত্ব পান। বর্তমানে তার বয়স ৩৯ বছর। রাজার জন্ম ১৯৮০ সালের ২১ ফেব্র“য়ারি। জিগমে খেসার পড়ালেখা করেছেন ভুটান, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে। জ্ঞান অন্বেষণে তিনি গেছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় অবধি। ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে রাজত্ব করা বর্তমান রাজবংশের পঞ্চম রাজা তিনি। তিনি রাজা হওয়ার পর ভুটানের রাজনীতিতে ব্যাপক বিবর্তন ঘটে। আধুনিক গণতন্ত্রের জন্য একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। নির্বাচন হয় এবং নতুন সরকার ক্ষমতায় আসে। ২০১১ সালে জেটসুন পেমাকে বিয়ে করে রানীর আসনে বসান।

 

 

ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ, ফ্রান্স [৪১ বছর]

ফ্রান্সের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ দায়িত্ব গ্রহণ করেন ১৪ মে ২০১৭ সালে। ফ্রান্সের সর্বকনিষ্ঠ প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ৩৯ বছর বয়সী ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। এর মাত্র তিন বছর আগে মূলধারার রাজনীতি শুরু করেন তিনি। বিনিয়োগকারী ব্যাংকার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। অল্প সময়ে কোটিপতিদের তালিকায় নিজের নাম লেখান। ২০১৪ সালে তিনি ফ্রান্সের অর্থমন্ত্রী পদে নিযুক্ত হন। ২০১৬ সালে সে পদ ছেড়ে দিয়ে নামেন প্রেসিডেন্ট হওয়ার লড়াইয়ে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ম্যাক্রোঁ ৬৫.৮ শতাংশ ভোট পান। অন্যদিকে লে পেন পান মাত্র ৩৪.২ শতাংশ। ইউরোপীয় ইউনিয়নপন্থি ম্যাক্রোঁর বিজয়ে ব্যাপক প্রভাব পড়ে গোটা মহাদেশটিতে। বিজয়ের পর ম্যাক্রোঁ বলেন, ফ্রান্সে দীর্ঘ ইতিহাসের একটি নতুন পাতা উন্মোচিত হলো। আশা এবং আস্থা আজ সন্ধ্যায় আবার ফিরে পাওয়া গেছে।

 

 

জুরি রাতাস, এস্তোনিয়া [৪১ বছর]

২০১৬ সালের ২৩ নভেম্বর এস্তোনিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন জুরি রাতাস। তখন তার বয়স ৩৮। বর্তমানে জুরি রাতাসের বয়স ৪১ বছর। তার দলের নাম সেন্টার পার্টি। এর আগে রিজিকগুর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ২০০৭ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত। তার আগে ২০০৫ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত তিনি তাল্লিনের মেয়র ছিলেন। মেয়র থাকাকালে তিনি ইউরোপিয়ান গ্রিন ক্যাপিটাল অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেন। জুরি রাতাসের জন্ম এস্তোনিয়ার রাজধানী শহর তাল্লিনে। তিনি তাল্লিন ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি থেকে বিজনেস ম্যানেজমেন্টে স্নাতক ও ইকনোমিক সায়েন্সে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। বাবার হাত ধরে জুরি রাতাসের সেন্টার পার্টিতে রাজনীতির শুরু। ২০১৯ সালের নির্বাচনেও তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন।

 

 

অ্যালেক্সিস সিপ্রাস, গ্রিস [৪৫ বছর]

২০১৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বর গ্রিসের সিরিজা পার্টির বামপন্থি নেতা অ্যালেক্সিস সিপ্রাস বর্তমান প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দ্বিতীয়বারের মতো শপথ নেন। এর আগে ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। দ্বিতীয় মেয়াদে দলটি ৩৫ শতাংশ ভোট পেয়ে নিজেদের এগিয়ে নেয়। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার সময় তার বয়স ছিল ৪১ বছর। বর্তমানে সিপ্রাসের বয়স ৪৫ বছর। ২০০৯ সাল থেকে তিনি গ্রিক পলিটিক্যাল পার্টি সিরিজার নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। গ্রিক সরকারের ঋণ সংকটকালীন চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী তিনি। ঋণ করে কোনো রাষ্ট্র দেউলিয়া হতে পারে গ্রিস তার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ। ২০০৮ সাল থেকেই এ পরিস্থিতির শুরু। গ্রিসের বাজেট ঘাটতি অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। প্রতিনিয়ত বেকারত্ব ও অন্যান্য ব্যয় বেড়েছে। এমন অবস্থার মধ্য দিয়ে চলা দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন সিপ্রাস। ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েও মাত্র ৯ মাসের মাথায় আবার আস্থা ভোটের আয়োজন করেন। সেবারও অ্যালেক্সিস সিপ্রাসই জনগণের ভালোবাসা অর্জন করতে সক্ষম হন।

সর্বশেষ খবর