শিরোনাম
রবিবার, ৭ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

জাপান সম্রাটের কাহিনি

সাইফ ইমন

জাপান সম্রাটের কাহিনি

ক্ষমতায় ছিলেন সবচেয়ে দীর্ঘ সময়

১৯২৬-১৯৮৯ খ্রি.

জাপানের ইতিহাসে অন্যতম প্রতাপশালী সম্রাট হিরোহিতো জন্মগ্রহণ করেন ১৯০১ সালের ২৯ এপ্রিল। তিনি দীর্ঘস্থায়ী সম্রাট ছিলেন জাপানে এবং ১২৪তম সম্রাট। জাপানের ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী সম্রাট হিসেবে বিবেচিত হয়ে আছেন তিনি। ১৯২৬ সালের ২৫ ডিসেম্বর ক্ষমতায় আরোহণ করেছিলেন তিনি। মৃত্যুবরণ করেন সম্রাট হিসেবেই। ১৯৮৯ সালের ৭ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকাল ও যুদ্ধ-পরবর্তীতে গণতান্ত্রিক জাপানের শাসনামলেও তিনি শাসনকার্য পরিচালনা করেছিলেন। মৃত্যু-পরবর্তীকালে জাপানে আনুষ্ঠানিকভাবে তার নতুন নামকরণ করা হয় সম্রাট শোয়া বা শোয়া সম্রাট। জাপানের সম্রাটরা মৃত্যুর পর নতুন নাম পেয়ে থাকেন। ১৯৯০ সাল থেকে জনগণ তাকে এ নামে ডাকতে শুরু করেন।

 

সম্রাট নিন্তকু ছিলেন প্রজাবৎসল

৩১৩-৩৯৯ খ্রি.

সম্রাট নিন্তকু ছিলেন জাপানের ষোলোতম সম্রাট। তার রাজত্বকাল সম্পর্কে নির্ধারিত সময় জানা যায়নি। তবে ইতিহাসবিদরা ধারণা করছেন তিনি ৩১৩ থেকে ৩৯৯ সাল পর্যন্ত আধিপত্য করেছেন। ঐতিহাসিকদের মতে, নিন্তকু ছিলেন পঞ্চম শতাব্দীর একজন কিংবদন্তি সম্রাট। অন্য সম্রাটদের মতই উপাধি ছিল ‘তেন্ন’। এটা ছিল সুমেরামিকত বা আমেনশিতা; যার মানে হলো মহান রাজা, যিনি স্বর্গের অধীনে আধিপত্য করেন। আবার সম্রাট নিন্তকুকে সাজুর মহান রাজা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সাকাই, অসাকা এ দাইসেন-কফু এখনো জাপানের বৃহত্তম সমাধি হিসেবে পরিচিত। আর এটিই সম্রাট নিন্তকুর চিরনিদ্রার স্থান বলেও বিবেচনা করা হয়। কিন্তু অনেকেই দাবি করেন নিন্তকুর সমাধির প্রকৃত স্থান আসলে অজানা। তিনি ছিলেন প্রজাবৎসল।

 

ক্ষমতা ছেড়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন

১৯৮৯-২০১৯ খ্রি.

সম্রাট আকিহিতো নানা কারণেই পৃথিবীতে আলোচিত হয়েছেন। তার বাবা সম্রাট হিরোহিতোর মৃত্যুর পর তিনি ক্ষমতায় আরোহণ করেন ১৯৮৯ সালে। তখন থেকে তিনিই বিশ্বের একমাত্র সম্রাট। কারণ বিশ্বের আর কোথাও কাউকে সম্রাট বলা হয়নি।

সম্রাট আকিহিতোর কিছুদিন আগেই হৃৎপিণ্ডে অস্ত্রোপচার হয়েছে। এ ছাড়া তিনি ক্যান্সারেরও চিকিৎসা নিচ্ছেন। জাপানের জনপ্রিয় সম্রাট আকিহিতো এ বছরের ৩০ এপ্রিল সিংহাসন ছেড়ে দিচ্ছেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। মৃত্যুর আগে স্বেচ্ছায় সিংহাসন ছাড়ছেন তিনি। জাপানের আইন অনুযায়ী, কেবল সম্রাটের উত্তরসূরি কোনো পুরুষ সদস্যই পরবর্তী সম্রাট হবেন। সে অনুযায়ী আকিহিতোর ছেলে ৫৭ বছর বয়সী যুবরাজ নারুহিতো হচ্ছেন দেশটির পরবর্তী সম্রাট।

 

সম্রাট হানশোকে বলা হয় জাপানের কিংবদন্তি

৪০৬-৪১০ খ্রি.

সম্রাট হানজেই ‘সম্রাট হানশো’ নামে সর্বাধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি ছিলেন জাপানের ১৮তম সম্রাট। তার রাজত্বকালের সময় নির্দিষ্ট করে জানা না গেলেও ধারণা করা হয়ে থাকে তিনি ৪০৬ থেকে ৪১০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। ইতিহাসবিদরা হানজেইকে ৫ম শতকের একজন কিংবদন্তি সম্রাট হিসেবে মনে করেন। হানশো ছিলেন সম্রাট নিন্তকু এবং ইওয়ানোহিমের সন্তান। তিনি সম্রাট রিচুর ভাই ছিলেন। সম্রাট নিন্তকুর মৃত্যুর পর সম্রাট হয়েছিলেন সম্রাট রিচু। তবে সম্রাট হানশোর ক্ষমতারোহণ রিচুর দুই পুত্রকে টপকিয়ে ঘটেছিল। কিন্তু কেন এমনটি হয়েছিল এ বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায়নি। ইতিহাসবিদরা বলছেন, সম্রাটের আমলে দেশে শান্তি বজায় ছিল। আরও জানা যায়, এই সম্রাট নয় ফুটের চেয়েও বেশি লম্বা এবং বিশাল আকৃতির দাঁতের অধিকারী ছিলেন।

 

সম্রাট সাগা ছিলেন শিল্প সাহিত্যের সমঝদার

৮০৯-৮৪২ খ্রি.

সম্রাট সাগা জন্মগ্রহণ করেন ৭৮৬ সালের ৩ অক্টোবর। এই প্রভাবশালী সম্রাট রাজত্ব করেছেন ৩৩ বছর। ৮০৯ সালের অক্টোবরের ৩ তারিখ তিনি ক্ষমতায় আরোহণ করেন। সম্রাট সাগা ছিলেন সম্রাট কানমু এবং ফুজিয়ারার ২য় পুত্র। তাকে পরিবারের সবাই কামিনো নামেই ডাকতেন। এই সম্রাট ছিলেন শিল্প-সাহিত্যের সমঝদার। তিনিই প্রথম রাজকীয় কবিতা প্রতিযোগিতার প্রচলন করেছিলেন। তিনি নিজেও কবিতা লিখেছেন। আরও অনেক দিক থেকেই সম্রাট সাগা ছিলেন আলোচিত। তিনিই জাপানি সম্রাটদের মধ্যে প্রথম চা পান করেছিলেন। তিনি ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে ঘোষিত হন ২১ বছর বয়সে। ইতিহাসবিদরা নানা কারণে সম্রাট সাগাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন। কারণ তার সময়ে তিনি জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসারে প্রচুর কাজ করেছিলেন।

 

সাম্রাজ্যের শুরু যেভাবে

জাপানের স্থানীয় একটি ধর্ম বিশ্বাস শিন্টু। এক সময় এই শিন্টুকেই রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই ধর্মে বিশ্বাসীরা মনে করে জাপান সাম্রাজ্যের সৃষ্টির পেছনে সূর্যদেবীর ইচ্ছা রয়েছে। ২৭শ বছরের পুরনো এ সাম্রাজ্যের ভিত রচনা করেছিলেন সম্রাট জিমো। আর শিন্টু বিশ্বাস অনুযায়ী জিমো ছিলেন সূর্যদেবী আমাতেরাসুর সন্তানের প্রজন্ম। এ কারণেই জাপান সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখার পেছনে আমাতেরাসুর প্রভাব রয়েছে বলে মনে করেছে জাপানিরা। আবার আমাতেরাসুর জন্ম হয়েছিল সরাসরি স্বর্গের দেবতা ইজানেজির বাম চোখ থেকে। এমনটাই বিশ্বাস তাদের। ধারণা করা হয় সম্রাট জিমো ৬৬০ খ্রিস্টপূর্বের ১১ ফেব্রুয়ারিতে এই সাম্রাজ্য স্থাপন করেছিলেন। আর তাই দিনটিকে জাপান গঠনের দিন হিসেবে পালন করা হয়। পালন করা হয় রাষ্ট্রীয় ছুটি। জাপান গঠনের সময়কাল যেমন ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত, তেমনি প্রথম সম্রাট জিমোর জন্ম ও মৃত্যুর দিনটিও অনুমানের ওপর নির্দিষ্ট করা হয়েছে। ধারণা করা হয়, ৭১১ খ্রিস্টপূর্বে ১ জানুয়ারিতে তার জন্ম এবং ৫৮৫ খ্রিস্টপূর্বের ১১ মার্চে মৃত্যু।

 

জাপান সম্রাটের দায়িত্ব

জাপানের সম্রাট হলেন জাপান রাষ্ট্রের প্রধান। ১৯৪৭ সালের সংবিধান অনুযায়ী, তিনি রাষ্ট্র ও জনগণের ঐক্যের প্রতীক এবং তার সরকার সম্পর্কিত কোনো ক্ষমতা নেই।

ঐতিহাসিকভাবে, তিনি শিন্টু ধর্মের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ। জাপানি ভাষায় সম্রাটকে ‘তেন্ন’ বলা হয়। এর অর্থ ‘স্বর্গীয় সার্বভৌম’। ইংরেজিতে আগে মিকাডো শব্দটি ব্যবহার করা হতো, এখন আর তা করা হয় না। ১৯৪৭ সালের যুদ্ধ-পরবর্তী সংবিধান অনুযায়ী জাপান সম্রাটের কোনো রাজনৈতিক ক্ষমতা নেই। কিন্তু দেশটির রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বহু দায়িত্ব সম্রাটকে পালন করতে হয়। প্রধানমন্ত্রী, সাংসদ ও সুপ্রিম কোর্টের প্রেসিডেন্ট মনোনয়নের যাবতীয় আনুষ্ঠানিক নথিপত্র স্বাক্ষর করতে হয় তাকে।

এ ছাড়াও জাপানের প্রটোকলে মুখ্য ভূমিকা পালন করা, সংসদ অধিবেশন উদ্বোধন করা, আইন এবং চুক্তি জারি করা, সম্মাননা পদক প্রদান এবং বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতের কাছ থেকে প্রশংসাপত্র গ্রহণের কাজগুলো সম্রাটকে করতেই হয়।

সম্রাট দম্পতি বছরজুড়ে শত শত অনুষ্ঠান, অভ্যর্থনা, বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, সমাবেশ ও ভোজে অংশ নিয়ে থাকেন। সারা বিশ্বের অনেক রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক ব্যক্তিত্ব, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিসহ রাজপ্রাসাদে অনেক ব্যক্তিকেই অভ্যর্থনা জানান তারা। সম্রাট পরিবারের সদস্যদের কথোপকথনে খুব সাবধানী হতে হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে সঙ্গে সঙ্গে আক্রান্ত ব্যক্তিদের কাছে ছুটে যান সম্রাট। তাদের পাশে থেকে সাহায্য-সহযোগিতা করেন। ২০১১ সালে সুনামির পর থেকে সম্রাট আকিহিতো এ প্রথা চালু করেন।

 

সম্রাটের যুগের নামকরণ

হাত নেড়ে জনগণের অভিনন্দন গ্রহণ করছে সম্রাট পরিবার

 

জাপানের প্রত্যেক সম্রাটের রাজত্বের একটি নাম আছে, যেটি খ্রিস্টীয় বর্ষপঞ্জির পাশাপাশি ব্যবহার করা হয়। কারণ এক সময় জাপানে সম্রাটদের ধর্মীয় প্রধান হিসেবেও দেখা হতো। তাই একেক সম্রাটের শাসনকালকে একেকটি যুগ বলে অবিহিত করা হয়। বর্তমান সম্রাট আকিহিতো ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। সম্রাট পরিবর্তনের পর ১ এপ্রিল নতুন রাজত্বের নাম ঘোষণা করা হয়। জাপানের নতুন সম্রাটের রাজত্বের নাম ঘোষণা করা হয়েছে জাপানি ভাষায় ‘রেইওয়া’। যার বাংলা অর্থ ‘শৃঙ্খলা এবং শান্তি’। এই প্রথমবারের মতো জাপানের একটি প্রাচীন কবিতা থেকে এই নামটি নেওয়া হয়েছে। এর আগে সম্রাট আকিহিতোর যুগের নাম ছিল ‘হেইসেই’। যার অর্থ ‘শান্তি অর্জন’। সম্রাটের যুগের নাম মুদ্রায়, সংবাদপত্রে, ড্রাইভিং লাইসেন্স এবং দাপ্তরিক সব কাগজপত্রে মুদ্রিত হয়। এটি একটি যুগকে নির্দেশ করে। একটি সময়কে ধারণ করে। যেভাবে নব্বই দশক বা ভিক্টোরিয়ান যুগকে বর্ণনা করা হয়ে থাকে। জাপানের সম্রাটকে দেশের সর্বোচ্চ প্রতীক বিবেচিত করা হয়ে থাকে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর