রবিবার, ২ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

শচীন টেন্ডুলকার লিটল মাস্টার

তানভীর আহমেদ

শচীন টেন্ডুলকার লিটল মাস্টার

১৬ বছরের সেই শচীন

ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ মানেই বাড়তি উত্তেজনা। সেই উত্তেজনায় কেউ ছেড়ে কথা বলবে এমনটা ভাবা ভুল। ১৯৮৯ সালের ঘটনা। ভারত-পাকিস্তানের টেস্ট ম্যাচ। টানটান উত্তেজনার সেই ম্যাচে প্রথম ইনিংসে টসে হেরে ব্যাটিংয়ে পাকিস্তান এবং ইনিংস শেষে সংগ্রহ করে ৪০৯ রান। জবাবে ৪১ রানেই ৪ উইকেট পড়ে যায় ভারতের। বেকায়দায় পড়া ভারতকে সামলাতে মাঠে নামল ১৬ বছরের এক কিশোর। ক্যামেরাম্যান তো বটেই মাঠের সবাই কিছুটা চমকে গেল। ওয়াকার ইউনুসের ক্ষ্যাপাটে বোলিংয়ের সামনে দাঁড়ানো সেই কিশোরের নাম শচীন টেন্ডুলকার। ব্যাটিংয়ে নেমেই ওয়াকার ইউনুসের বল গিয়ে লাগল মাথায়। লুটিয়ে পড়েছিলেন শচীন। কিন্তু মাঠ ছাড়লেন না। লড়াই করতে এসে এসবে পাত্তা দিলে তার চলবে? ১৬ বছরের টগবগে কিশোর শেষ পর্যন্ত ২৪ বলে  খেলেছিলেন ১৫ রানের ইনিংস। আউট হয়ে সাজঘরে ফেরার পথে সবাইকে মনে করিয়ে দিয়ে যান কারও বাউন্সারে হার মানতে আসেননি তিনি। ২৪ বছর দীর্ঘ আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে শচীন হয়ে ওঠেন ব্যাটিং ঈশ্বর! অনেকে বলেন, লিটল মাস্টার।

 

শচীন-কাম্বলির ৬৬৪ রানের সেই পার্টনারশিপ

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আলো ছড়ানোর আগের গল্পটা অনেকেরই জানা নেই। শচীনের বয়স তখন ১৪ বছর। খেলা চলছিল লর্ড হ্যারিস শিল্ড আন্তস্কুল প্রতিযোগিতায় সেন্ট  জেভিয়ার্স হাইস্কুলের বিরুদ্ধে। তার বন্ধু বিনোদ কাম্বলির সঙ্গে ৬৬৪ রানের রেকর্ড পার্টনারশিপ করে শচীন গণমাধ্যমের খবর হয়ে ওঠেন। সেই পার্টনারশিপে ৩২৬ রান করেছিলেন শচীন টেন্ডুলকার। এর ঠিক এক বছর পরেই ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে অভিষেকেই সেঞ্চুরি করেন শচীন। এরই ফলাফল হিসেবে এক বছর পরেই আন্তর্জাতিকের দরজা খুলে যায় শচীনের। আর রেকর্ড বুকে নাম তোলেন সর্বকনিষ্ঠ  টেস্ট ক্রিকেটার হিসেবে। ২০১১ সালে বিশ্বকাপ জয়ী ভারতীয় দলে ছিলেন শচীন। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে তিনি মোট ছয়টি বিশ্বকাপে খেলেছেন। শেষ ম্যাচটি খেলেছেন ২০১৩ সালের ১৬ নভেম্বর।

 

সুরকার শচীন দেব বর্মণের সঙ্গে মিলিয়ে তার নাম

১৯৭৩ সালে মুম্বাইয়ে জন্ম শচীন টেন্ডুলকারের। একেবারে মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান ছিলেন। তার বাবা ছিলেন অধ্যাপক, লেখক মানুষ। শখ করে সন্তানের নাম রাখলেন প্রখ্যাত সুরকার শচীন দেব বর্মণের সঙ্গে মিলিয়ে। বাবা রমেশ টেন্ডুলকার, তার সন্তান শচীন রমেশ টেন্ডুলকার। ছোটবেলায় শচীন জন ম্যাকেনরোকে আদর্শ করে টেনিস   খেলার প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। ক্রিকেটের সঙ্গে তাকে জড়িয়েছিলেন তার বড় বোন।

তখন শচীনের বয়স মাত্র ১১ বছর। তখন তাকে একটি ক্রিকেট ব্যাট উপহার দেন তার বড় বোন। সেই ব্যাট নিয়ে মাঠে খেলতে যেতেন শচীন। বড় ভাই অজিত টেন্ডুলকার ১১ বছর বয়সেই ছোট ভাইকে নিয়ে যান শিবাজি পার্কে। সেখানে শ্রী রমাকান্ত আচরেকারের অধীনে ক্রিকেট প্র্যাক্টিস শুরু করেন শচীন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেখানে প্র্যাকটিস করতে শুরু করেন শচীন। প্রতিবার শচীন নেটে যাওয়ার আগে স্টাম্পে একটি কয়েন রাখতেন গুরু রমাকান্ত। শর্ত ছিল এরকম যে, একমাত্র আউট না হলেই সেই কয়েন পাবেন শচীন। আপনি কি জানেন, শচীন গুরুদেবের ১৩টি কয়েন নিজের কাছে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন!

 

যেভাবে শচীনের উত্থান

১৯৯৪ সালে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে শচীন ওয়ানডে ক্রিকেটে প্রথম উদ্বোধনে নামেন। ওই ম্যাচেন ৪৯ বলে ৮২ রান করে সবার নজর কাড়েন। সে বছরই সেপ্টেম্বর শ্রীলঙ্কায় অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে জীবনের প্রথম ওয়ানডে আন্তর্জাতিক শতরান করে ধীরে ধীরে মেলে ধরতে শুরু করেন শচীন। ১৯৯৬ ক্রিকেট বিশ্বকাপে দুটি শতরান করে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হলে ক্রিকেট বিশ্বে শচীনের আধিপত্য শুরু হয়। ১৯৯৮ সালে অস্ট্রেলিয়া ভারত সফরে আসে। সফরের প্রস্তুতি ম্যাচে রঞ্জি ট্রফি বিজয়ী মুম্বাই ক্রিকেট দলের হয়ে এক তিন দিনের ম্যাচে শচীন শেন ওয়ার্নের মতো বিশ্বসেরা স্পিনারকে সামাল দিয়ে তুলে নেন অপরাজিত ২০৪। এই প্রতিযোগিতায় শচীন দুটি টেস্ট শতরান, একদিনের ক্রিকেটে কানপুরে শতরান করে ভারতীয় ক্রিকেটে পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন। ১৯৯৮ সালে শারজাতে ত্রিদেশীয় কোকা কোলা কাপ টুর্নামেন্টে দুটি সেঞ্চুরি করেন শচীন। তার দুর্দান্ত পারফরম্যান্স ভারতকে কাপ জেতাতে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। শচীন হয়ে ওঠেন ভারতের ব্যাটিং স্তম্ভে সবচেয়ে মারকুটে, নির্ভরযোগ্য নাম।

১৯৮৭ বিশ্বকাপে ছিলেন বলবয়

ক্রিকেটে ট্রেনিং চলাকালীন বেশ কয়েকটি ম্যাচে নেমেছিলেন। মুম্বাইয়ের কঙ্গ লীগ প্রতিযোগিতায় জন ব্রাইট ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে খেলেছিলেন শচীন। এরপর খেলেছেন ক্রিকেট ক্লাব অব ইন্ডিয়ার হয়ে। ১৯৮৭ সালে শচীন প্রথমবারের মতো তার ব্যাটিং প্রতিভার কথা জানতে পারেন। তখন তার বয়স ১৪ বছর। মাদ্রাজে এমআরএফ পেস ফাউন্ডেশনে ফাস্ট বোলিং করার প্রশিক্ষণ নিতে গেলে শচীনকে দেখে এগিয়ে আসেন অস্ট্রেলিয়ার কিংবদন্তি ফাস্ট বোলার ডেনিস লিলি। ডেনিস লিলি শচীনকে বলেন, তুমি ব্যাটিংয়ে মন দাও। সে কথা শুনেছিলেন শচীন। অবশ্য সে বছরই দারুণ এক অভিজ্ঞতা হয় শচীনের। মুম্বাইয়ের ব্রেবোর্ন স্টেডিয়ামে ক্রিকেট ক্লাব অব ইন্ডিয়ার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে এক প্রদর্শনী ম্যাচে শচীন পরিবর্তিত খেলোয়াড় হিসেবে খেলার সুযোগ পেয়ে যান। ১৯৮৭ ক্রিকেট বিশ্বকাপে ভারত ও ইংল্যান্ডের মধ্যে খেলায় শচীন ছিলেন বলবয়।

 

শচীন শোয়েবের সেই রেষারেষি

১৯৯৯ সালে কলকাতার ইডেন গার্ডেনে খেলা চলছিল ভারত-পাকিস্তানের। একপর্যায়ে রান নিতে দৌড় দিলে  শোয়েব আখতারের সঙ্গে ধাক্কা লেগে রান আউট হন শচীন। এই ঘটনায় দর্শকরা ক্ষোভে ফেটে পড়ে। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে খেলা বন্ধ করে দেয় আম্পায়াররা। একটু পর শচীনের আবেদনে দর্শকেরা শান্ত হলে খেলা আবার শুরু হয়। ঘটনা এখানেই শেষ নয়। খেলার মাঠের উত্তেজনা ছড়িয়ে যায় রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে, ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রকট হয়ে ওঠে।

 

ঘরোয়া ক্রিকেটে শচীন ম্যাজিক

১৯৮৭ সালের শেষ দিকে রঞ্জি ট্রফি প্রতিযোগিতায় মুম্বাই ক্রিকেট দলের হয়ে শচীন খেলার সুযোগ পান কিন্তু মাঠে নামতে পারেননি। প্রথম একাদশে না থাকায় আর খেলা হয়নি তার। এদিকে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট দল ভারত সফরে আসে। ওয়াংখেড় স্টেডিয়ামে  নেটে প্রশিক্ষণরত কিংবদন্তি কপিল দেবের বলের বিরুদ্ধে ব্যাট করার সুযোগ পেয়েছিলেন শচীন। তার খেলার ধরন সবার নজর কাড়ে। কপিল দেবের বলের বিরুদ্ধে তার সাবলীল ব্যাটিং স্টাইল দেখে মুম্বাই ক্রিকেট দলের অধিনায়ক দিলীপ বেঙ্গসরকার তাকে মুম্বাই দলে প্রথম একাদশে সুযোগ দিয়েছিলেন। ১৯৮৮ সালে মাত্র পনেরো বছর বয়সে শচীন ঘরোয়া প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলতে নামেন। মুম্বাই ক্রিকেট দলের হয়ে গুজরাট ক্রিকেট দলের বিরুদ্ধে খেলার সুযোগ পেয়ে অপরাজিত ১০০ রান করে ভারতের কনিষ্ঠতম ক্রিকেটার হিসেবে অভিষেকে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলায় শতরানের রেকর্ড করেন। ১৯৮৮-৮৯  মৌসুমে শচীন মুম্বাইয়ের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হন। ১৯৮৮ ও ১৯৮৯ সালে শচীন দুবার ইংল্যান্ড সফর করেন। ১৯৯৮ সালে ভারত সফরে আসা অস্ট্রেলিয়া জাতীয় ক্রিকেট দলের বিরুদ্ধে মুম্বাই ক্রিকেট দলের হয়ে প্রথম দ্বি-শতরান (২০৪) করেন। ২০০০ সালে রঞ্জি ট্রফির সেমিফাইনালে তামিলনাড়ু ক্রিকেট দলের বিরুদ্ধে অপরাজিত ২৩৩ রান করেন।

রেকর্ডের ঝুড়ি

২০০৪ সালে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ২৪১ রানের একটি অপরাজিত ইনিংস খেলেন শচীন টেন্ডুলকার। ২০০৮ সালের অক্টোবরে ব্রায়ান লারার ১১ হাজার ৯৫৩ টেস্ট রানের  রেকর্ড ভাঙেন শচীন। ১০০ ইন্টারন্যাশনাল সেঞ্চুরির মালিক এই ক্রিকেটার তার শততম সেঞ্চুরি করেছিলেন বাংলাদেশের বিপক্ষে। ৫১ টেস্ট সেঞ্চুরিতে তার টেস্ট ক্রিকেটে রান ছিল ১৫ হাজার ৯২১ রান, ওয়ানডে ক্রিকেটে করেছেন ১৮ হাজার ৪২৬ রান।

 

কত প্রাপ্তি

শচীন টেন্ডুলকারের ক্যারিয়ারের খাতা প্রাপ্তি, অর্জনে ভরা। শেষ ম্যাচ খেলার পরই প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে ভারত রত্ন পাওয়ার ঘোষণা শুনেছিলেন। এ ছাড়াও পেয়েছেন ভারতে ক্রীড়াঙ্গনে সর্বোচ্চ পুরস্কার রাজীব গান্ধী খেল রত্ন অ্যাওয়ার্ড (১৯৯৭), পদ্মশ্রী ও পদ্মবিভূষণ সম্মাননা।

 

তার রেকর্ডবুকে যা সেরা

টেস্টে ১৫ হাজার ৯২১ রান : টেস্ট ক্রিকেটে শচীন টেন্ডুলকারের মোট সংগ্রহ ১৫ হাজার ৯২১ রান। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংগ্রহ অস্ট্রেলিয়ার রিকি পন্টিংয়ের ১৩ হাজার ৩৭৮ রান।

ওয়ানডে ১৮ হাজার ৪২৬ রান : ওয়ানডে ক্রিকেটে ব্যাটিং জিনিয়াসের মোট সংগ্রহ ১৮ হাজার ৪২৬ রান। আর কোনো ব্যাটসম্যানই এ ফরম্যাটে ১৫ হাজার রান অতিক্রম করতে পারেননি। ওয়ানডেতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংগ্রহ শ্রীলঙ্কার কুমার সাঙ্গাকারা ১৪ হাজার ২৩৪ রান।

২০০ টেস্ট : সর্বোচ্চ টেস্ট খেলার  রেকর্ডও শচীন টেন্ডুলকারের দখলে। একমাত্র ব্যাটসম্যান হিসেবে  খেলেছেন ২০০ টেস্ট। তার পরে সর্বোচ্চ সংখ্যক টেস্ট খেলেছেন ১৬৮টি করে যথাক্রমে দুই অজি কিংবদন্তি রিকি পন্টিং ও স্টিভ ওয়াহ্।

টেস্টে ৫১ সেঞ্চুরি : টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ সেঞ্চুরির মালিক শচীন  টেন্ডুলকার। দুই দশকের বেশি ক্যারিয়ারে ৫১ সেঞ্চুরি করেছেন তিনি। তার কাছাকাছি আছেন, দক্ষিণ আফ্রিকার জ্যাক ক্যালিসের এ ফরম্যাটে ৪৫ সেঞ্চুরি রয়েছে।

আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ৩৪ হাজার ৫৭ রান : টেস্ট ও ওয়ানডে মিলিয়ে এ রান করেছেন এই ব্যাটিং ঈশ্বর  শচীন ছাড়া কেবল কুমার সাঙ্গাকারা দুই ফরম্যাটে মিলে করেছেন ২৮ হাজার রান।

 

শচীনের জন্যই বিশ্বকাপ জয়

এত রেকর্ড, এত খ্যাতি-শুধু নেই সাধের বিশ্বকাপ। শচীনের শেষ বিশ্বকাপে ভারত তাই রণসাজে এসেছিল। লক্ষ্য বিশ্বকাপ, তাও শচীনের জন্য। কিন্তু বিশ্বকাপ যেন তার কাছে সোনার হরিণ হয়ে উঠেছিল। ২০১১ সালে নিজ দেশে ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বকাপ খেলতে নামেন তিনি। ভারতীয় দলে শোর ওঠে ‘শচীনের জন্য বিশ্বকাপ’।  ধোনির এই মন্ত্রে উদ্দীপ্ত হয়ে নিজেদের মেলে ধরেন যুবরাজ-জহির খানরা।     ব্যাট-বলে আলো ছড়িয়ে টুর্নামেন্ট সেরা হন যুবরাজ। শচীন টেন্ডুলকার ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বকাপটা নিজের করে নিতে সর্বোচ্চ চেষ্টাই করেন। ৯ ম্যাচে ৪৮২ রান করে দুইয়ে থাকেন তিনি। ক্যারিয়ারের ষষ্ঠ বিশ্বকাপ খেলতে নেমে শিরোপা জিতেই ঘরে ফেরেন শচীন। ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা তারকাকে বিশ্বকাপ শূন্য থাকতে হলো না। অসংখ্য রেকর্ডের পাশাপাশি তার নামের পাশে বিশ্বকাপ শিরোপাটাও লেখা হয়ে গেল।

সর্বশেষ খবর