শনিবার, ১৫ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

ইতিহাসের অন্যতম সেরা ওপেনার সুনীল গাভাস্কার

তানিয়া তুষ্টি

ইতিহাসের অন্যতম সেরা ওপেনার সুনীল গাভাস্কার

ভারতের জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক ও প্রথিতযশা ব্যাটসম্যান সুনীল গাভাস্কার। পুরো নাম সুনীল মনোহর গাভাস্কার। ডাকনাম হিসেবে তিনি সানি ও লিটল মাস্টার বলে সবার কাছেই পরিচিত। ১৯৪৯ সালের ১০ জুলাই তিনি ভারতের বোম্বে জন্মগ্রহণ করেন।  ক্রিকেট ইতিহাসে তাকে অন্যতম সেরা উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান হিসেবে ধরা হয়। ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান সর্বাধিকসংখ্যক টেস্ট রান ও সেঞ্চুরি নিয়ে ক্রীড়াজীবন শেষ করেন। গাভাস্কারের অভিষেকটাও হয়েছিল দুর্দান্ত। ১৯৭১ সালের ৬ মার্চ ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম সিরিজেই ১৫৪.৮০ গড়ে ৭৭৪ রান করেন। শুনে হয়তো অবাক হবেন, ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে খেলে সিরিজও জয় করেছিলেন। এরপর অবশ্য ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে ভারত সিরিজ জিতেছে দীর্ঘ অপেক্ষার পর ২০০৬ সালে। ১৯৮৩ সালে ভারতীয় ক্রিকেট দলের সদস্য হয়ে তিনি আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপ জয় করেন। টেস্ট ক্রিকেটে ১০ হাজার বা তদূর্ধ্ব রান সংগ্রহ করা একজন ক্রিকেটারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৮৭ সালের ৪ মার্চ সুনীল গাভাস্কার ১০ হাজার রান সংগ্রহের সম্মাননায় সর্বপ্রথম অন্তর্ভুক্ত হন। সুনীল গাভাস্কার তার খেলোয়াড়ী জীবনের ১৫ বছরে ৩৬২ দিনের মাথায় বিশ্বের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে এই মাইলফলক স্পর্শ করেন।

গাভাস্কার সেদিন খেলেছিলেন পাকিস্তানের বিপক্ষে। দুই দেশের টেস্ট খেলাকালীন এ মাইলফলকে পৌঁছেন। পাকিস্তান দলের ইজাজ ফাকিহর বলে লেট কাটের মাধ্যমে ব্যক্তিগত ৫৮ রানের সময় এ সম্মাননা অর্জন করেন তিনি। এ মাইলফলক অর্জনে ১২৪ টেস্টের ২১২ ইনিংস খেলতে হয়েছে তাকে। গাভাস্কারের ক্রিকেট জীবন থেকে অবসর গ্রহণের ছয় বছর ও ১৩৬ টেস্ট পর দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে অ্যালান বর্ডার ১০ হাজার রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন।

 

মাইলফলকের ম্যাজিক সিরিজ

মাদ্রাজের চিদাম্বরাম স্টেডিয়ামে ১৯৮৩ সালের ডিসেম্বরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে খেলা টেস্টের ফলাফল ড্র হয়। কিন্তু তাতে কি, এই সিরিজে গাভাস্কার ছুঁয়েছিলেন একাধিক মাইলফলক। এটি যেন তার জন্য ছিল একটি ম্যাজিক সিরিজ। দিনটি ছিল ২৮ ডিসেম্বর। এই দিন গাভাস্কার ৬৪৪ মিনিট ক্রিজে থেকে করেন অপরাজিত ২৩৬ রান। এটি ছিল গাভাস্কারের ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ স্কোর। তবে এদিন লিটল মাস্টার আরেক বিরাট রেকর্ড গড়েন ব্র্যাডম্যানের সর্বোচ্চ টেস্ট সেঞ্চুরির রেকর্ড ভেঙে দিয়ে। ব্র্যাডম্যানের ২৯ সেঞ্চুরির রেকর্ড টপকে তিনি ৩০তম সেঞ্চুরির দেখা পান এই টেস্টেই। ১৯৮৩ সালের জানুয়ারিতেই সুনীল দেখা পেয়েছিলেন ২৮তম সেঞ্চুরির। তারপর ১০ মাসের বেশি লেগে যায় পরের সেঞ্চুরির দেখা পেতে। অবশেষে ওই বছরের ২৯ অক্টোবর গাভাস্কার ব্র্যাডম্যানের ২৯তম সেঞ্চুরির রেকর্ড স্পর্শ করেন রাজসিকভাবেই। এই সিরিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ১২১ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলেন মাত্র ১২৮ বলে। সেঞ্চুরির দেখা পান মাত্র ৯৪ বলে। অর্ধশত হাঁকান ৩৭ বলে।

ম্যালকম মার্শাল, মাইকেল হোল্ডিংদের বেশ নাস্তানাবুদ করে ছাড়েন গাভাস্কার। ৯৪.৭৩ স্ট্রাইক রেটের এই ইনিংসটি গাভাস্কারের স্বভাববিরুদ্ধ। মজার ব্যাপার হলো, মার্শালকে চার মেরে যখন গাভাস্কার ব্র্যাডম্যানকে ছুঁঁয়ে দিলেন তখন নাকি গাভাস্কারের সেই ব্যাপারটি মাথায়ই ছিল না। শুধু নিজের ভালো পারফরম্যান্স নিয়েই ভাবছিলেন। কিন্তু উইকেটে সঙ্গী ব্যাটসম্যান দিলীপ ভেংসরকার গাভাস্কারকে মনে করিয়ে দেন এটি তার ৩০তম সেঞ্চুরি।

 

লিটল মাস্টারের যত রেকর্ড

গাভাস্কারের ৩৪ সেঞ্চুরির ১৩টি ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। অথচ ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলিং আক্রমণ ছিল অনেকের চোখেই ইতিহাসের সেরা। ব্যাটিং পিচে গাভাস্কারের স্নায়ু ছিল ইস্পাতের মতো কঠিন। রানের প্রতি তার ক্ষুধা ছিল বিস্ময়কর। লড়াকু মানসিকতার গাভাস্কার সব সময় ব্যর্থতাকে ঘৃণা করতেন। ১২৫ টেস্টের ১১৪ ইনিংসে ১০ হাজার ১২২ রান সংগ্রহ করেছেন। তাতে গড় রান ছিল ৫১.১২। লিটল মাস্টার খেতাব পাওয়া গাভাস্কার শৈশব থেকেই তার প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে এগোন। ১৯৬৬ সালে ভারতের সেরা স্কুল ক্রিকেটার হন গাভাস্কার। ১৯৭১ সালের ৬ মার্চ অভিষিক্ত গাভাস্কার পরের দুই দশক মাতিয়ে রাখেন তার ব্যাটিংশৈলী দিয়ে। ১৯৭৬ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে অধিনায়কত্বের দায়িত্বও পান। তার অধিনায়কত্বে ভারত পাকিস্তানের বিপক্ষে ২-০ তে সিরিজ জেতে। ১৯৮৭ সালের ১৩ মার্চ গাভাস্কার শেষ টেস্টটি খেলেন। ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা ওপেনিং ব্যাটসম্যান এখনো পর্যন্ত ভারতীয়দের মধ্যে দ্রুততম ৬ হাজার রান করেছেন। তিনি ১১৭ ইনিংসে ৬ হাজার রানের গন্ডি টপকান। এখনো ক্রিকেটের সঙ্গেই জড়িয়ে আছেন। ধারাভাষ্যকার হিসেবেও তার খ্যাতি কম নয়। ক্রিকেট সংক্রান্ত চারটি বইও লিখেছেন ‘সানি’।

 

তার নামে স্টেডিয়াম

ভারতীয় ক্রিকেট কিংবদন্তি সুনীল গাভাস্কারের কদর যুক্তরাষ্ট্রেও কম নয়। ২০১৭ সালে তার নামে লন্ডনে একটি স্টেডিয়াম নির্মাণ করা হয়েছে। আমেরিকার কেন্টাকির লুইসভিলে নির্মিত স্টেডিয়ামের নাম দেওয়া হয়েছে ‘সুনিল গাভাস্কার ফিল্ড’। অপরদিকে ভারতের বেশির ভাগ স্টেডিয়ামের নামকরণ করা হয় রাজনীতিবিদদের নামে। তবে স্টেডিয়ামের ভিতরকার বিভিন্ন স্ট্যান্ডের নাম থাকে খেলোয়াড়দের নামে। যেমন- সুনীল গাভাস্কার, শচীন টেন্ডুলকার ও সৌরভ গাঙ্গুলীর নামে মুম্বাই ও কলকাতায় রয়েছে স্ট্যান্ড। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের একটি স্টেডিয়ামেরই নামকরণ করা হলো গাভাস্কারের নামে। বিশ্বের তৃতীয় খেলোয়াড় হিসেবে স্টেডিয়ামের নাম পেলেন গাভাস্কার। এর আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ভিভিয়ান রিচার্ডসের নামে অ্যান্টিগায় করা হয়েছে স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডস স্টেডিয়াম এবং সেন্ট লুসিয়ার স্টেডিয়ামের নামকরণ হয়েছে ড্যারেন সামি ন্যাশনাল ক্রিকেট স্টেডিয়াম নামে। যুক্তরাষ্ট্রে গাভাস্কারের নামে স্টেডিয়ামের নামকরণ অবাক করার মতোই। তাই গাভাস্কার নিজেও অবাক হয়েছেন। তিনি বলেন, এখানে ক্রিকেট প্রধান খেলা না হওয়া সত্ত্বেও আমার নামে স্টেডিয়ামের নামকরণ করাটা অনেক বেশি সম্মানের।

 

সুনীলের নামেও নিন্দা

অতি সতর্ক ব্যাটিংয়ের কারণে কখনো কখনো নিন্দাও কুড়িয়েছেন সুনীল গাভাস্কার। ১৯৭৫ সালের ৭ জুন ইংল্যান্ডের লর্ডস মাঠে প্রথম গড়ায় বিশ্বকাপ ক্রিকেট টুর্নামেন্ট। ৭ জুনের উদ্বোধনী ম্যাচ ছিল স্বাগতিক ইংল্যান্ড এবং ভারতের মধ্যে। টসে জিতে ব্যাটিং বেছে নিয়েছিল ইংলিশ অধিনায়ক মাইক ডেনেস। সেই ম্যাচে প্রথমে ইংল্যান্ড ৬০ ওভারে ৪ উইকেট হারিয়ে ৩৩৪ রানের চ্যালেঞ্জিং স্কোর সংগ্রহ করে। জবাবে ভারত ব্যাট করতে নামে। প্রতি ওভারে ভারতকে নিতে হতো ৬-এর চেয়ে কম রান। ওপেনিংয়ে নামেন কিংবদন্তিতুল্য ক্রিকেটার সুনীল গাভাস্কার। পুরো ৬০ ওভার শেষে ১৭৪ বলে ৩৬ রান নিয়ে অপরাজিত থাকেন! পুরো ইনিংসে ১টি মাত্র বাউন্ডারি মারতে সক্ষম হয়েছিলেন গাভাস্কার। স্ট্রাইক রেট ছিল ২০.৬৮। ৬০ ওভারে ৩ উইকেট হারিয়ে ভারতের অর্জন ছিল মাত্র ১৩২ রান। গাভাস্কারের ওই ইনিংসকে বলা হয় ওয়ানডে ক্রিকেটের সবচেয়ে বিখ্যাত টেস্ট ব্যাটিং পারফরম্যান্স। সেই ম্যাচে ভারত হেরে যায় ২০২ রানে। এমন স্লো ইনিংস খেলায় স্বাভাবিকভাবেই তিনি সমালোচনার মুখোমুখি হন। এ কারণেই ওয়ানডেতে তার সেঞ্চুরি মাত্র একটি, তাও ক্যারিয়ারের শেষ সিরিজ ১৯৮৭ বিশ্বকাপে।

 

পরিসংখ্যান

 

 

জীবনের শেষ টেস্টেও রেকর্ড

১৯৮৭ সালের ১৩ মার্চ বেঙ্গালুরে চলছে ভারত বনাম পাকিস্তানের টেস্ট ম্যাচ। আর এটিই ছিল সুনীল গাভাস্কারের জীবনের শেষ টেস্ট। ঘূর্ণি পিচে সেই ম্যাচটা তিনি বাঁচাতে পারেননি সত্য কিন্তু গড়েছিলেন এক অনন্য রেকর্ড। তার অলৌকিক ৩২০ বলে প্রতিপক্ষ রান উঠাতে সক্ষম হন মাত্র ৯৬। সেই ম্যাচে পাকিস্তান প্রথম ইনিংসে ১০ উইকেট হারিয়ে ৪৯.২ ওভারে রান তোলে মাত্র ১১৬। অপরদিকে ভারতের সংগ্রহে আসে ১০ উইকেটে ১৪৫ রান। এজন্য তারা খরচ করে ৬৪ ওভার বল। দ্বিতীয় ইনিংসে পাকিস্তান ৯৪.৫ ওভার খরচ করে ১০ উইকেটের বিনিময়ে ঝুলিতে তোলেন ২৪৯ রান। অপরদিকে ৯৩.৫ ওভার খরচ করে ভারত পান ২০৪ রান।

সর্বশেষ খবর