বুধবার, ৩ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

রোমান সাম্রাজ্যের স্মৃতি লেবাননে

শিমুল মাহমুদ, বৈরুত থেকে ফিরে

রোমান সাম্রাজ্যের স্মৃতি লেবাননে

অসীমের প্রতি মানুষের আকর্ষণ চিরকালের। কাউকে পাহাড় টানে আর কাউকে সমুদ্র। পাহাড় আর সমুদ্র এক মোহনায় মিলে লেবানন যে অনন্য সৌন্দর্য নিয়ে অপেক্ষা করছে এবার গিয়ে সেটা বুঝলাম। হাজার বছরের প্রাচীন বৈরুত নগরীর পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে সৌন্দর্যের আলোকছটা। নামে আরব দেশ হলেও অবাধ সৌন্দর্যসেবায় ইউরোপিয়ানদেরও যেন পেছনে ফেলে দেয়। দিনের বৈরুতের চেয়ে রাতের বৈরুত আরও উত্তেজক, আরও উদ্দীপনাময়। যখন নাইট ক্লাবগুলোর পর্দা উন্মোচন হয়ে যায়, যখন হুক্কা বারগুলো জমজমাট হয়ে ওঠে তখন দিনের চেনা বৈরুতকে অচেনা লাগে। লেবাননে এখন চলছে সামার। দিনের তাপমাত্রা ২৮ ডিগ্রির নিচেই থাকছে। এই মিষ্টি আবহাওয়ায় রাত-দিন একাকার করে আনন্দে মাতে লেবানিজরা। শীতে লেবাননের উত্তরাঞ্চলের পাহাড়ি এলাকা ফারায়া বরফে ঢেকে যায়। বৈরুত শহর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার উত্তরে এই এলাকার তাপমাত্রা ৪ থেকে ৫ ডিগ্রিতে নেমে আসে। কখনো তার চেয়েও কম। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে গড়ে ১৩০০ মিটার উঁচু এই জায়গাটিকে উর্বরতার জন্যই ‘ফল ও সবজির এলাকা’ বলে চেনা হয়। শীতে সারা রাতের জমে থাকা বরফ গলতে গলতে যখন পথঘাট কিছুটা স্বাভাবিক হয় তখন সূর্য গড়িয়ে বিকাল। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ভরা শীতের সময় ডা. দীপু মনিদের সঙ্গে এই ফারায়া ভ্রমণ করেছিলাম। তখন অসংখ্য পর্যটক এই বরফ দেখতে যান। বরফের মধ্যে গড়াগড়ি খাওয়া কিংবা নিছক বরফ খন্ড যে অনাবিল আনন্দের উৎস হতে পারে সেই ভ্রমণে গিয়ে সেটি টের পাওয়া গেল। এবার গিয়ে হাজার বছরের পুরনো জনপদ, ধ্বংসস্তূপ ও ধ্বংসাবশেষ দেখে লেবাননের ঐতিহ্যের উৎসমূল খুঁজে পাওয়া গেল। লেবানিজ নারীদের সৌন্দর্যের খ্যাতি বিশ^জুড়ে। শারীরিক সৌন্দর্য আর মেধার দীপ্তিতে তারা নিজেদের গন্ডি ছাপিয়ে বিশ্বপরিমন্ডলেও জায়গা করে নিয়েছেন। নিজেদের সক্রিয় রাখতে পারলার, ফিটনেস সেন্টার, জিমের ছড়াছড়ি বৈরুতের সর্বত্র। রাস্তায় গাড়িচালকদের প্রায় অর্ধেকই নারী। তারা নিজেদের গাড়ি নিয়ে দ্বিতীয় আরোহী ছাড়াই যে যার গন্তব্যে চলাফেরা করেন। পুরো লেবাননই যেন ছবির মতো সুন্দর-সাজানো প্রকৃতি। বিস্তীর্ণ উঁচু পাহাড় আর ভূমধ্যসাগরের জলরাশি ঘেরা অসংখ্য সি-বিচের এ দেশ যেন প্রকৃতির উপচেপড়া সৌন্দর্যের আধার। এ সুন্দর-সমৃদ্ধ দেশটির প্রতি ‘গরিবের সুন্দরী বউ’য়ের মতোই লোলুপ দৃষ্টি আগ্রাসী প্রতিবেশি ইসরায়েলের। জাতিসংঘ মাঝপথে বাধার দেয়াল তুলে না দাঁড়ালে লেবানন কবেই ইসরায়েলের চারণভূমিতে পরিণত হতো। বর্তমানে ৪৩টি দেশের ১০ হাজার ১২৪ জন শান্তিরক্ষী লেবাননের সীমান্ত সুরক্ষায় কাজ করছে। ছয় দেশের নৌবাহিনীর সদস্য ও যুদ্ধজাহাজ নিয়ে গঠিত ম্যারিটাইম টাস্কফোর্সের সদস্য বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সদস্যদের বিরত্বগাথা লেবাননজুড়ে। তাদের বার্ষিক মেডেল প্যারেড অনুষ্ঠান দেখতে গিয়ে লেবাননকে নতুন করে চেনা হয়। লেবাননের সমুদ্রসীমায় দুই হাজার ৫০ মিটার গভীরতায় ছুটে বেড়ায় বাংলাদেশ নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ বিএনএস বিজয়। মাইলের হিসাবে তা দুই মাইলেরও বেশি গভীর। ১৪ জুন ভোর ৭টা থেকে প্রায় দুই মাইল গভীর ভূমধ্যসাগরে জাহাজের ভিতর পুরো একটা দিন কাটে আমাদের। সেদিন ছিল শুক্রবার। দুপুরে অতলান্ত জলরাশির ওপর জাহাজের ডেকে জুমার নামাজ আদায়ের অনুভূতি ছিল বর্ণনাতীত। হাজার বছরের ইতিহাসের ধারক লেবাননের বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে খ্রিস্টপূর্ব সময়ের নানা স্থাপনা। রাজধানী বৈরুতের অলিতে-গলিতে মিউনিসিপ্যালিটি কর্তৃপক্ষ রোমান সাম্রাজ্যসহ বিভিন্ন স্থাপনার বর্ণনা দিয়ে রেখেছে। নৃতাত্ত্বিক তথ্য-প্রমাণ অনুযায়ী, খ্রিস্টপূর্ব তিন হাজার বছর আগের ইতিহাস রয়েছে লেবাননের। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৩ সাল পর্যন্ত এটি ছিল পারস্য সামাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। এরপর ৩৯৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল লেবানন। এরপর ৬২২ পর্যন্ত বাইজাইনটাইন এবং ৭৫০ সাল পর্যন্ত উম্মাইয়াদ শাসনে ছিল। এরপর ১১১০ সাল পর্যন্ত আব্বাসিয়া, ১২৯১ পর্যন্ত ক্রুসেডার্স এবং ১৫১৬ সাল পর্যন্ত মামলুক শাসনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এরপর অটোমান সাম্রাজ্যের দীর্ঘ শাসনের অন্তর্ভুক্ত ছিল লেবানন ১৯২০ সাল পর্যন্ত। লেবানন ফ্রান্স মেনডেটের অন্তর্ভুক্ত থাকে ১৯২০ থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত। ১৯৪৩ সালে স্বাধীন হয় লেবাননবাসী। লেবাননের বালবেক, বিবলস, টায়ারসহ বিভিন্ন এলাকায় অতীত শাসকদের দুর্গ, মন্দিরসহ বিভিন্ন স্থাপনা এখন বিশ^ঐতিহ্যের অংশ। তবে দীর্ঘ কয়েক হাজার বছরের শাসনামলে পরস্পরবিরোধী প্রতিপক্ষের শাসনের অন্তর্ভুক্ত থাকলেও কেউ কারও নৃতাত্ত্বিক নিদর্শন ধ্বংস করেননি বরং একেক শাসক পূর্ববর্তী শাসকদের নিদর্শনগুলো সযত্নে আগলে রেখেছেন।

 

আধা মণ ওজনের তরমুজ!

লেবানিজদের গায়ের রং ও শারীরিক ফিটনেস এতটা আকর্ষণীয় হয় কি করে? বিশেষ করে মেদহীন সুঠাম শরীরের নারীদের? সেই রহস্য জানা গেল বিভিন্নজনের কাছ থেকে। মূলত খাদ্যাভ্যাসের কারণেই তাদের এই নজরকাড়া শারীরিক সৌন্দর্য। তারা মূলত ভাত জাতীয় কার্বোহাইড্রেড এড়িয়ে চলে। প্রাণিজ প্রোটিনের চেয়ে উদ্ভিজ প্রোটিনের দিকে তাদের ঝোঁক। এর পাশাপাশি আছে অনেক রকমের মৌসুমি ফল। লেবাননের ফলের তালিকায় আম, কাঁঠাল নেই। আমাদের সুস্বাদু এই দুই ফল লেবাননের মাটিতে জন্মে না। লেবাননের প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীরা বাংলাদেশের আম খেয়েছেন বৈরুতে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত আবদুল মোতালেব সরকারের উপহার হিসেবে। প্রথমবার খেয়ে যতবারই দেখা, প্রশংসার শেষ নেই। পরে মোতালেব সরকার একাধিকবার বাংলাদেশ থেকে আম নিয়ে তাদের খাওয়ান। সেই আম কূটনীতির ফল পাওয়া যাচ্ছে। লেবাননের হাজার হাজার অবৈধ প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য সুখবর আসছে শিগগিরই, জানালেন রাষ্ট্রদূত। লেবাননের বাজারে একেক মৌসুমে একেক রকমের ফল আসে। এখন সামার চলছে। ফলের দোকানগুলোতে অসংখ্য ফলের সমাহার। শীর্ষে রয়েছে চেরি। সড়কের পাশেই বিশাল ফল বাগান। আপেল, কমলা, মালটা, কলার পরিকল্পিত চাষাবাদ। পাকা টসটসে কমলা পড়ে আছে গাছের নিচে। খাওয়ার লোক নেই। বাংলাদেশের গ্রামের বাড়ির উঠানের পাশের মাচার লাউ, শিম গাছের মতোই প্রতিটি বাড়িতেই ছোট-বড় অনেক আঙ্গুর গাছ। তারা গ্রিন হাউসেও প্রচুর পরিমাণে ফল ও সবজির চাষ করে। তিন-চার ফুট লম্বা কলা গাছে বড় কলার ছড়া ঝুলে আছে। রাস্তার দুই পাশে বিশাল সাইজের তরমুজ বিক্রি হচ্ছে। এতবড় তরমুজ এই প্রথম দেখা হলো। আমাদের সহযাত্রী এক কর্মকর্তা নাকুরা ফোর্স হেডকোয়ার্টার থেকে ফেরার সময় মাঝারি সাইজের ১৪ কেজি ওজনের একটি তরমুজ কিনলেন ১১ হাজার স্থানীয় টাকায়। যেটি ৭ ডলারের সমমূল্য। আধা মণ ওজনের তরমুজ পাওয়া যায়, যা পুরো এক পরিবারও খেয়ে শেষ করতে পারে না।

 

উটের মাংসের স্বাদ

লেবাননে এবারের ভ্রমণের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল উটের সুস্বাদু মাংসের স্বাদ আস্বাদন। আরব এই দেশটিতে বাণিজ্যিকভাবে উট পালন করে অনেকেই। এজন্য লেবাননে উটের মাংস সহজপ্রাপ্য এক উপকরণ। এবারের ভ্রমণে আমাদের থাকার জায়গায় কিংবা জাহাজের ডেকে প্রথমবারের মতো একাধিকবার উটের মাংস আস্বাদনের সুযোগ হয়। উটের মাংস সাধারণভাবে আমাদের কাঁচাবাজারের ব্রয়লার মুরগির মতো করেই বিক্রি হয়। খামারে গিয়ে উট পছন্দ করে দিলে খামারের লোকজন সেটির ওজন মেপে দাম নির্ধারণ করে জবাই করে দেন। পরে নাড়ি-ভুঁড়ি ও অপ্রয়োজনীয় অংশ ফেলে দিয়ে বাকি অংশ প্যাকেটজাত করে দেন। যারা অল্প পরিমাণে কিনতে চান তারা সেটি সংগ্রহ করেন সুপারস্টোর থেকে। লেবাননের পর্যটন নগরী বিবলসে গিয়ে দেখা গেল, রোমান সাম্রাজের ঐতিহ্য নগরীর প্রবেশপথে তিনটি উট বেঁধে রাখা আছে। অর্থের বিনিময়ে পর্যটকদের উটে চড়ার ব্যবস্থা করেছে স্থানীয়রা। এই উটের সঙ্গে সেলফি তুলতেও দেখা গেল অনেক পর্যটককে।

 

মসজিদ গির্জা পাশাপাশি

বৈরুতের প্রাণকেন্দ্রে রফিক হারিরি মসজিদের পাশেই সুবিশাল এক গির্জা। লেবাননের সমাজে খ্রিস্টানদের সঙ্গে মিলেমিশে আছে মুসলিমরা। পাশাপাশি অবস্থিত মসজিদ ও গির্জায় দুই সম্প্রদায়ের লোকজনই নিজেদের নির্বিঘœ উপাসনায় লিপ্ত। পারস্পরিক সম্প্রীতির এমন নজির বিশ্বে বিরল। মসজিদ ও গির্জায় যাওয়ার আলাদা কোনো পথ নেই। উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ পাশাপাশি হাঁটে, পাশাপাশি অবস্থিত উপাসনালয়ে স্র্রষ্টার কাছে প্রার্থনায় নত হয়। স্বল্প বসনা খ্রিস্টান উর্বশীর পাশাপাশি হেঁটে বেড়ায় হিজাব পরা মুসলিম নারীরা। এতে অবশ্য নাগরিকদের ধর্মাচার ও জীবনাচারে কোনো প্রভাব পড়ে না। অবশ্য সত্তরের দশকের শুরুতে এই ধর্মীয় মতবাদের ভিত্তিতে গৃহযুদ্ধের মুখোমুখি হয় লেবানন। পরে বিরল রাজনৈতিক সমঝোতার মধ্য দিয়ে সরকারে ও সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়। দেশটির আইনানুসারে প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন একজন ম্যারোনেইট খ্রিস্টান, প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন সুন্নি মুসলমান, স্পিকার হচ্ছেন শিয়া মুসলমান। সেখানকার সংসদীয় আসনগুলো মুসলমান এবং খ্রিস্টানদের মধ্যে সমানভাগে ভাগ করা। সংসদ দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে। পরে প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করেন। লেবাননের সরকারি ভাষা আরবি। এ ছাড়া ফ্রেন্স, ইংরেজিও চলে সমানতালে। নামে মুসলিম দেশ হলেও জীবনাচারে, সংস্কৃতিতে পশ্চিমাদের চেয়েও অগ্রসর। আরবি সাহিত্যের বড় তারকা ‘দি প্রফেট’ খ্যাত খলিল জিবরান এই লেবাননের মানুষ। তাকে নিয়ে অসম্ভব গর্ব করেন লেবানিজরা।

 

বৈরুত বন্দরে জুহি চাওলার সঙ্গে দেখা

সেই চোখ, সেই ঠোঁট, সেই হাসি। সেই সহাস্য টোল পড়া গাল। প্রথম দেখায় দৃষ্টি থমকে যায়। বলিউডের সিনেমা স্টার জুহি চাওলা লেবাননের বৈরুত বন্দরে! লাখো তরুণের ভালোবাসার নায়িকা বাংলাদেশ নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ বিএনএস বিজয়ের ডেকে। অসংখ্য লেবানিজ স্কুলশিশু পরিবেষ্টিত। গত ১৩ জুন সকালে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জাহাজ বিএনএস বিজয় পরিদর্শনে আসে  বৈরুত শহরের অন্যতম শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘অ্যান্থনিক সোশ্যাল ওরিয়েন্টেশন স্কুল’। এই স্কুলের ৯৬ জন শিক্ষার্থী এবং ১৬ জন শিক্ষক জাহাজ পরিদর্শনে এলে জাহাজের ডেকে পরিচিতি সভায় মেরিটাইম টাস্কফোর্সের কার্যক্রম এবং লেবাননের সমুদ্রপথের নিরাপত্তা, চোরাচালান ও সমুদ্রসম্পদ রক্ষায় বাংলাদেশ নৌবাহিনীর শান্তিরক্ষীদের কর্মকা- তুলে ধরেন লে. কমান্ডার আল আমীন কবির ও লে. কমান্ডার রাকিব উল হাসান। লে. কমান্ডার রাকিব উল হাসান বলেন, যুদ্ধজাহাজ দেখতে এসে আজ তোমরা যেমন অনেক খুশি তেমনি তোমাদের পেয়ে আমরাও অনেক খুশি। বাংলাদেশে আমরা তোমাদের মতোই ছোট ছোট শিশুদের রেখে এসেছি। এখানে তোমাদের নিরাপত্তা ও উন্নয়নে কাজ করছি। এরপর চারটি গ্রুপে ভাগ হয়ে জাহাজের ভিতরের অপারেশনাল কার্যক্রম দেখে স্কুল শিক্ষার্থীরা। এর আগে শিক্ষার্থীদের জন্য জাহাজের ডেকেই ফুটবল ও তীর নিক্ষেপ খেলার আয়োজন করা হয়। সমুদ্রের বুকে বিশাল যুদ্ধজাহাজের কার্যক্রম দেখে অভিভূত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। শিক্ষক জুহি চাওলা তখন জাহাজের ডেকে পায়চারি করছিলেন। ব্রিফিংয়ের সময় তার অনেক ছবি তোলা হয় মোবাইল ফোনে। সেটি তার দৃষ্টি এড়ায়নি। তাকে বলা হলো, আপনি দেখতে ভারতের বিখ্যাত ফিল্ম স্টার জুহি চাওলার মতো। তিনি হাসলেন, বুঝে নাকি না বুঝে তা জানা গেল না। কারণ তার ভাষা আরবি। সঙ্গে ছবি তুলতে চাইলে সহাস্যে সাগ্রহে সম্মতি দিলেন। সেই ছবি নিয়ে আলোচনার শেষ নেই।   

 

হুক্কায় টান দিলে...

ধোঁয়াসর্বস্ব হুক্কা যে এতটা জনপ্রিয় হতে পারে লেবাননে না গেলে তা অজানাই থেকে যেত। ফিরে আসার আগের রাতে বৈরুতে ভূমধ্যসাগরে আছড়ে পড়া ঢেউসংলগ্ন যে রেস্তোরাঁয় আমরা বসেছিলাম তার পাশের টেবিলেই ছিল একটি লেবানিজ পরিবার। চারজন নারী সদস্যের এই পরিবারের তিনজনই ছিলেন তরুণী। তারাও ছিলেন হুক্কায় মগ্ন। বৈরুতে অবস্থানের শেষ রাতে লাগামহীন আমাদের কোথাও ফেরার তাড়া ছিল না। রাত দুটার দিকে হুক্কা টানা শেষ করে তরুণীরা যখন চলে যান তখন পাশের টেবিলের বিদেশিদের বসে থাকার উৎসাহেও ভাটা পড়ে। সঙ্গে বয়স্ক নারীটি না থাকলে পাশাপাশি দুই টেবিলের হুক্কাসেবিদের আসরটা আরও জমজমাট হতে পারত। হুক্কা লেবাননের সংস্কৃতি ও সভ্যতার অংশ হয়ে আছে। শহর থেকে গ্রাম, অলি-গলি সর্বত্র হুক্কার ছড়াছড়ি। বৈরুত শহরের প্রায় প্রতিটি মার্কেট, শপিং মলে হুক্কা সেবনের প্রলুব্ধকর আয়োজন দেখলে যে কারও হুক্কা নিয়ে বসে যেতে ইচ্ছা করবে। বৈরুতের প্রতিটি রাস্তায়, প্রতিটি এলাকায় গড়ে উঠেছে বিলাসবহুল হুক্কা বার। সেই হুক্কা বারে দুপুর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত পরিবারের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই মিলে হুক্কায় মগ্ন থাকে। আজ থেকে ৩০-৪০ বছর আগেও আমাদের গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে হুক্কা সেবনের নির্দোষ সংস্কৃতি ছিল। বাংলার বহুল প্রচলিত হুক্কা লেবাননের রাজধানী বৈরুতের সর্বত্র তাদের প্রাত্যহিক জীবনের অপরিহার্য অনুষঙ্গ হিসেবে ঠাঁই করে নিয়েছে। প্রায় ৬০ লাখ মানুষের এই দেশটিতে হুক্কা এখন তাদের কোটি কোটি ডলারের ব্যবসা।

 

হারিয়ে যাওয়া ফিলিস্তিনি যোদ্ধা

ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন অন্তত পাঁচ শতাধিক বাংলাদেশি যোদ্ধা। তাদের একজন ছিলেন সিলেটের জকিগঞ্জের ইসমাইল চৌধুরী আকরাম। ৪০ বছরের বেশি সময় কেটেছে তার লেবাননের রাজধানী বৈরুতে। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে লেবানন গিয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসের এক সমাবেশে দেখা পাই আকরামের। ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধে অংশগ্রহণ নিয়ে তিনি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দেন বাংলাদেশ প্রতিদিনে। সেটি ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ‘শনিবারের সকাল’-এ পুরো এক পৃষ্ঠায় ছাপা হয়। এই সাক্ষাৎকার ছাপা হওয়ার দীর্ঘদিন পর দেশে তার স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। তিনি অনেকদিন পর দেশে আসার সিদ্ধান্ত নেন। লেবানন থেকে প্রবাসী সাংবাদিক বাবু সাহা জানান, ৪২ বছরের দীর্ঘ প্রবাস জীবনে আকরাম চৌধুরী অত্যন্ত মিশুক, পরোপকারী, সৎসাহসী এবং সর্বজনপ্রিয় একজন মানুষ ছিলেন। সব সময় সৎ থাকা, বিপদ সঙ্গে করেও অন্যের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়াÑ এতসব গুণ নিজের সঙ্গে যুক্ত করে নিয়েছিলেন। এতসব গুণ এক জনমে অর্জন করা এবং সারা জীবন লালন করে যাওয়া সুকঠিন। নিঃস্বার্থ মানুষ ও আওয়ামী লীগের নিবেদিতপ্রাণ হিসেবে পরিচিত এই মানুষটি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ লেবানন শাখার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। সাধারণ জীবনযাপনের কারণেই তিনি লেবাননের সামাজিক-রাজনীতিক অঙ্গনসহ সাধারণ প্রবাসীদের কাছে একজন সাদা মনের মানুষ ছিলেন। মাত্র ১৫ বছর বয়সে ফিলিস্তিন গিয়ে ১৯৭৭ সালের শেষদিকে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি সিলেটে স্বদেশের মাটিতে ফিরেই না ফেরার দেশে চলে যান লেবানন প্রবাসী এই বাংলাদেশি ফিলিস্তিনি যোদ্ধা। এবার বৈরুত গিয়ে হাজারো মানুষের ভিড়ে সেই ইসমাইল চৌধুরী আকরামকে মনে পড়েছে বার বার।

সর্বশেষ খবর