বৃহস্পতিবার, ৪ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

শ্রমিক হত্যার করুণ উপাখ্যান

নিতান্ত গৃহকর্মী থেকে শুরু করে করপোরেটের সদর দফতরÑসর্বক্ষেত্রে শ্রমিক নির্যাতন একটি বহুল আলোচিত বিষয়। সীমা অতিক্রম করলে অনেক ক্ষেত্রে তা সংবাদ আকারে প্রকাশ হলে নেপথ্যেই থেকে যায় এই শ্রমিক নির্যাতনের সিংহভাগ ঘটনা। আবার ইতিহাসের অতল গহ্বরে এক সময় হারিয়েও যায় শ্রমিক নির্যাতনের করুণ উপাখ্যান। ইতিহাসের পাতা ঘেঁটে এমন কিছু করুণ কাহিনী বর্ণনা করেছেন- মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

শ্রমিক হত্যার করুণ উপাখ্যান

আগুনে পুড়িয়ে ৪৪ জন হত্যা

বিভিন্ন সূত্রের তথ্য মোতাবেক প্রতি বছর ভারতে ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজার কৃষক আত্মহত্যা করে। ভারতের বিগত ভোটযুদ্ধে বিভিন্ন রাজ্যে ভোটের মূল নিয়ামক হয়ে উঠেছিল কৃষকের বঞ্চনা, হতাশা এবং আত্মহত্যা। টাইম অব ইন্ডিয়ার ০৩ মে ২০১৭ তারিখের তথ্য মোতাবেক ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার সুপ্রিম কোর্টে প্রদত্ত এক পরিসংখ্যানে জানিয়েছে, ২০১৩ সাল থেকে প্রতি বছর ১২ হাজারের বেশি কৃষক আত্মহত্যা করে। সরকারি হিসাবটাই যদি এমন হয়, তবে প্রকৃত চিত্র কতটা ভয়াবহ, তা সহজেই অনুমেয়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ভারতে কৃষকের এবং কৃষি কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের এই নির্যাতন নতুন কিছু নয়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে হৃদয় বিদারক ঘটনা ঘটেছিল ভারতের তামিল নাড়ু রাজ্যের নাগপাত্তিনাম জেলার কিলভেলমানি গ্রামে। গ্রামটি কিঝাভেন মানি নামেও পরিচিত। ব্রিটিশ শাসনের অবসান ও ভারতের স্বাধীনতার ২০ বছরের মাথায় ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষত তামিল নাড়ুতে ‘সবুজ বিপ্লব’-এর কল্যাণে কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি ঘটে। কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধি এবং জমির মালিকদের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটলেও এক্ষেত্রে ভূমিহীন কৃষক বা কৃষি শ্রমিক, যার অধিকাংশই ছিল অবহেলিত ও নিগৃহীত। ‘দলিত’ সম্প্রদায়ের, তাদের ভাগ্যের কোনো উন্নতি ঘটেনি। এর বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল ভারতের মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টি। দলটি কৃষি শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির জন্য সংগঠিত করে আন্দোলন গড়ে তোলে। ১৯৬৮ সালের শেষভাগে এই আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। আন্দোলনের এক পর্যায়ে কৃষি শ্রমিকরা একতাবদ্ধ হয়ে তাদের নিজ গ্রাম ও আশপাশের এলাকায় বিপ্লবের চেতনায় ঐতিহাসিক লাল পতাকা টাঙিয়ে দেয়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে জোতদার ভূমি মালিকরা। তারাও সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে হলুদ পতাকা টাঙিয়ে দেয় তাদের অবস্থানে এবং কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত কৃষি শ্রমিকদের ছাঁটাই করতে থাকে। ফলে উভয়পক্ষে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। আন্দোলনের কৌশল হিসেবে দলিত সম্প্রদায়ের কৃষি শ্রমিকরা মাঠের পাকা ফসল কাটা বন্ধ করে দেয়। জমির মালিকরাও তখন সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে অন্য এলাকা থেকে শ্রমিক এনে ফসল কাটার উদ্যোগ নেয়। এমন উত্তেজনাকর অবস্থায় তারা কৃষি শ্রমিকদের সহায়তার কারণে স্থানীয় এক দোকানদারকে অপহরণ করে এবং প্রহার করে। উত্তেজিত কৃষি শ্রমিকরা তখন অপহৃত দোকনদারকে উদ্ধারের জন্য অপহরণকারীদের ওপর চড়াও হয়। এতে জমির মালিকদের পক্ষের একজন এজেন্ট মারা যায়। এমনি এক প্রেক্ষাপটে ১৯৬৮ সালের ২৫ ডিসেম্বর রাত ১০টায় জমির মালিক ও তাদের পেটুয়া বাহিনী পুলিশের লরি বা ভ্যান ব্যবহার করে কৃষি শ্রমিকদের জরাজীর্ণ গ্রামে আক্রমণ চালায়। পালানোর পথ বন্ধ করে তারা গুলি চালায় কৃষি শ্রমিকদের ওপর। এতে ঘটনাস্থলেই দুজন নিহত হন। অসহায় কৃষি শ্রমিকরা পাথর ছুড়ে মারা ছাড়া কিছুই করতে পারছিল না। তাই যে যার মতো পালাতে থাকল, অসহায় নারী, শিশু ও বয়ঃবৃদ্ধরা আশ্রয় নিল আট ফুট দৈর্ঘ্য আর নয় ফুট প্রস্থের একটি ছোট্ট ঘরে। আক্রমণকারী এবার সেই ঘর ঘিরে ফেলে এবং আগুন লাগিয়ে দেয়। আগুনের লেলিহান শিখা কুঁড়েঘরের শুকনো বাঁশ আর শনে তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে। বাঁচানোর আশায় দুটি শিশুকে ঘর থেকে বাইরে ছুড়ে ফেলে আবদ্ধ গ্রামবাসী। হিংস্র আক্রমণকারীরা আবারও শিশু দুটিকে আগুনে ছুড়ে মারে। প্রাণপণ চেষ্টা করে ছয়জন গ্রামবাসী আবদ্ধ ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। তাদের দুজন ধরা পড়লে তাদেরও আগুনে ছুড়ে ফেলে মৃত্যু নিশ্চিত করে। অবশেষে পুলিশের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে তবে ততক্ষণে করুণ মৃত্যুবরণ করে ৪৪ জন। যার মধ্যে পাঁচজন বয়ঃবৃদ্ধ, ১৯ জন মহিলা ও ২৩ জন শিশু ছিল। এ ঘটনার জন্য নিম্ন আদালতে ১০ জন ভূমি মালিকের ১০ বছর করে কারাদ- হলেও উচ্চ আদালতে     তারা রেহাই পেয়ে যান।

 

শত শত তুলাচাষির লাল রক্তে রঞ্জিত সাদা তুলা

কৃষ্ণাঙ্গ আর শ্বেতাঙ্গের দ্বন্দ্ব আধুনিক পৃথিবীর ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। পুঁজিবাদ কিংবা সামন্তবাদের ধারক ও বাহক ইউরোপে বিশেষত আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গ আর শ্বেতাঙ্গের দ্বন্দ্ব বিশেষ করে কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিক আর শ্বেতাঙ্গ মালিকের দ্বন্দ্ব রোমহর্ষক পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এমনই এক হৃদয়বিদারক ঘটনার করুণ সাক্ষী আমেরিকার আরাকানস রাজ্যের ফিলিপস অঞ্চল (কাউন্টি)। আমেরিকার আরাকানস রাজ্যটি মিসিসিপি নদীর তীরঘেঁষা একটি ব-দ্বীপ। যা আদিকাল থেকেই তুলা চাষের জন্য বিখ্যাত ছিল। এই এলাকার কৃষি জমিসহ প্রায় সব জমির মালিক ছিল শ্বেতাঙ্গ অভিজাত শ্রেণির। কিন্তু তুলা চাষে নিয়োজিত ছিল কৃষ্ণাঙ্গরা, যাদের নিজেদের কোনো জমিই ছিল না। তাত্ত্বিকভাবে কৃষ্ণাঙ্গরা ছিল বর্গাচাষি। যারা উৎপাদিত তুলার বিক্রয়লব্ধ অর্থের একটা ন্যায্য অংশ পাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যেত উৎপাদনের পর তুলা পরিমাপ করা, বিক্রীত তুলার মূল্য জানা ইত্যাদি থেকে কৃষ্ণাঙ্গদের সব সময় দূরে রাখা হতো। আর লেখাপড়া না জানার কারণে ভুল হিসাব দেখিয়েও তাদের বঞ্চিত করা হতো। তার চেয়েও বড় সমস্যা ছিল ‘ঋণের বোঝা। কৃষ্ণাঙ্গদের জীবন ধারণের যাবতীয় সামগ্রী ও কৃষি সরঞ্জাম কিনতে হতো শ্বেতাঙ্গ ভূমি মালিক ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। কিন্তু নগদ অর্থ না থাকায় কৃষ্ণাঙ্গরা ঋণ নিয়ে অতি উচ্চমূল্যে শ্বেতাঙ্গদের কাছ থেকে এসব কিনতে বাধ্য হতো। ফলে তুলা বিক্রির পর কারও ঋণই পরিশোধিত হতো না বরং বাড়তে থাকত ঋণের বোঝা। তাদের বেতনও ধরা হতো অতি নিম্ন অঙ্কে, যা ছিল এক নিষ্ঠুর শোষণ। ঋণ শোধ না করলে কাউকে খামার ছেড়ে যেতে দেওয়া হতো না।

১৯১৯ সালে অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাতে ফিলিপ অঞ্চলে কৃষ্ণাঙ্গরা গড়ে তোলে ‘প্রগ্রেসিভ ফার্মার্স অ্যান্ড হাউস হোল্ড ইউনিয়ন অব আমেরিকা’। রবার্ট এল হিল ছিলেন এই শ্রমিক সংগঠনের মূল সংগঠক। ১৯১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার রাতে বর্গাচাষি এবং তুলা সংগ্রহকারী মূলত নারী শ্রমিকরা আরাকানসের এলিন এলাকায় একটি চার্চে জড়ো হয়। কথা ছিল পার্শ্ববর্তী লিটন রক এলাকা থেকে এলিসেস ব্রেটন নামের এক শ্বেতাঙ্গ আইনজীবী (অ্যাটর্নি) চার্চে আসবেন এবং তাদের কথা শুনে প্রতিকারের ব্যবস্থা নেবেন। কিন্তু শ্বেতাঙ্গদের গতিবিধি দেখে সহজেই বোঝা যায়, বিষয়টি ভালো চোখে দেখছেন না তারা। কৃষ্ণাঙ্গ কৃষকদের একটি দল সম্ভাব্য বিপদ অনুমান করে অস্ত্রসহ হাজির হয় এলিন চার্চ ও আশপাশের এলাকায়। রাত ১১টায় শ্বেতাঙ্গ ভূমি মালিকরা স্থানীয় শ্বেতাঙ্গ পুলিশের ছত্রছায়ায় চার্চে গুলি ছোড়ে। কৃষ্ণাঙ্গরাও পাল্টা গুলি ছুড়ে তার জবাব দেয়। এতে একজন শ্বেতাঙ্গ নিহত হয়। এই খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় তুমুল আক্রমণ আর প্রতি-আক্রমণ। আশপাশের অঞ্চলের শ্বেতাঙ্গরা এসে যোগ দেয় ফিলিপস এলাকার শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে। পরিস্থিতি স্থানীয় প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে আরও ৫০০ সৈন্য আনা হয়। যদিও অস্ত্রধারী কৃষ্ণাঙ্গদের আটক করার জন্য সৈন্যদের আদেশ দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু বাস্তবে যা ঘটেছিল তা ছিল মর্মস্পর্শী। এই সংঘাতে শত শত কৃষ্ণাঙ্গের রক্তে ফিলিপ এলাকার মাটি রঞ্জিত হয়েছিল, তা কখনো প্রকাশ করেনি শ্বেতাঙ্গরা। একদিকে চার্চ এলাকায় যখন নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করা হয়, তখন চার্চের পার্শ্ববর্তী এলাকায় কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিক এমনকি নারী ও শিশুদের জবাইও করা হয়। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আসামি করা হয় ১২২ জন কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিককে। এদের মধ্যে যারা ক্রীতদাসের মতো বিনা বেতনে তাদের ভূমির মালিকদের মর্জি মোতাবেক অনির্দিষ্ট কালের জন্য খেত-খামারে শ্রম দিতে রাজি হয়, তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। অন্যদের দাঁড় করানো হয় বিচার নামের প্রহসনের সামনে। চরম নির্যাতন চালিয়ে তাদের স্বীকারোক্তি নেওয়া হয়। এতে ৭৩ জনের বিরুদ্ধে হত্যা আর অন্যদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও হত্যায় সহায়তার অভিযোগ আনা হয়। শ্বেতাঙ্গ বিচারকরা আসামিদের বক্তব্য দেওয়ার তেমন সুযোগই দেয়নি। এমনকি কারও কারও ক্ষেত্রে মাত্র ১০ মিনিটের শুনানি হয়। তথাকথিত এই বিচারে ১২ জন কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিককে বৈদ্যুতিক চেয়ারে বসিয়ে মৃত্যুদ- দেওয়া হয়। এই দৃশ্য দেখে ৩৬ জন নিজেদের দোষ স্বীকার করে, যাদের লঘু শাস্তি দেওয়া হয়। আর ৭৩ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে জেলে পাঠানো হয়, যার সর্বোচ্চ মেয়াদ ছিল ২১ বছর।

 

অগণিত চা শ্রমিকের রক্ত গড়িয়ে পড়ে মেঘনার জলে

ভারতবর্ষের চা শ্রমিকদের কাছে ২০ মে দিনটি বিশেষভাবে স্মরণীয়। ১৯২১ সালের এই দিনে তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারতের অন্তর্গত পূর্ববাংলার (বর্তমান বাংলাদেশের) চাঁদপুর জেলার স্টিমার ঘাটে শত শত চা শ্রমিকের রক্তে গিয়ে মিশে মেঘনা নদীর জলে। চা বাগানের ব্রিটিশ মালিক এবং তাদের দোসরদের গুলিতে এ দিন প্রাণ হারান কয়েকশ চা শ্রমিক। কারও কারও মতে এই সংখ্যা কয়েক হাজার।

ঠিক কবে চা পানের প্রথা চালু হয়েছিল, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। কারও মতে চায়ের প্রচলন ২২ হাজার বছর আগে আবার কারও মতে ২৮ হাজার বছর আগে। এ কথাও প্রচলিত আছে যে, চীনে সাং সাম্রাজ্য চলাকালে অর্থাৎ ব্রোঞ্চ যুগে বা খ্রিস্টপূর্ব ষোড়শ শতকে চীনের ইউনান প্রদেশে চা পানের প্রচলন ঘটে। চীন ও বর্তমান মিয়ানমার সীমান্তে বহু আগে থেকে চা উৎপাদিত হতো। এক সময় এই চা দিয়েই বিশ্বে চীনের পরিচিতি ও প্রতিপত্তি ঘটে। চীনের এই প্রতিপত্তি ঠেকাতে ১৭০০ শতকে পরাক্রমশালী ব্রিটিশরা তাদের বিভিন্ন উপনিবেশে চা চাষের প্রচলন ও বিস্তার ঘটায়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৭৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশ রাজত্ব শুরুর প্রায় ৬৩ বছর পর অর্থাৎ ১৮২০ সালে বাণিজ্যিকভাবে আসামে চা বাগান স্থাপন ও চা উৎপাদন শুরু হয়। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপত্যকায় চা বাগান স্থাপনের মধ্য দিয়ে তৎকালীন পূর্ব বাংলায় (বর্তমান বাংলাদেশে) চায়ের যাত্রা শুরু হয় ব্রিটিশদের হাত ধরে। আর বাণিজ্যিকভাবে প্রথমে চা বাগান স্থাপিত হয় সিলেটের মালিনীছড়ায়। যেহেতু পূর্ব বাংলার অধিবাসীরা তখন চা বাগান তৈরি, রক্ষণাবেক্ষণ ও চা উৎপাদনের কলাকৌশল জানত না, সেহেতু আসামসহ ব্রিটিশ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে চা শ্রমিকদের সপরিবারে নিয়ে আসা হয়েছিল পূর্ব বাংলার চা বাগানে। এসব বাগান ছিল মূলত ব্রিটিশ মালিকানাধীন। ফলে এ দেশের নীল চাষিদের মতো চা শ্রমিকরাও নানা বিধি-বৈষম্যের শিকার হতো। পরিশ্রমের তুলনায় তাদের মজুরি ছিল অতি সামান্য। বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো অত্যাবশ্যকীয় অধিকার থেকে তারা ছিল বঞ্চিত। ভারতবর্ষজুড়ে তখন খেলাফত আন্দোলন আর অসহযোগ আন্দোলনের উত্থাপ ঢেউ। মহাত্মা গান্ধীর অনুসারীরা তখন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে জীবনবাজি রেখে। এমনি এক প্রেক্ষাপটে বর্তমান বাংলাদেশের সিলেট জেলার সীমান্তবর্তী এলাকা করিমগঞ্জের চারগোলা চা বাগানের (বর্তমানে আসাম, ভারতের অংশ), শ্রমিকরা ধর্মঘট শুরু করে, একই সঙ্গে তারা ‘মূলূক চল’ অর্থাৎ নিজ বাসভূমে বিহার ও তৎকালীন ইউনাইটেড প্রভিন্সে ফিরে যাওয়ার আন্দোলন শুরু করে। এতে করে পায়ে হেঁটে ও দেশীয় যানবাহনে হাজার হাজার চা শ্রমিক বর্তমান সিলেট ও সিলেট সংলগ্ন আসামের চা বাগানগুলো ত্যাগ করে বাংলাদেশের চাঁদপুরে জড়ো হতে থাকে। উদ্দেশ্য চাঁদপুর থেকে স্টিমারযোগে কিংবা ট্রেনে চড়ে কলকাতা হয়ে নিজ ‘মূলূক’ বা নিজ আবাসস্থলে ফিরে যাওয়া, এতে বাদ সাধে ব্রিটিশ চা-বাগান মালিক ও ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী। তাদের ইশারায় এসব চা শ্রমিকের কাছে স্টিমার কিংবা ট্রেনের টিকিট বিক্রি বন্ধ করা হয়। এতে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে চা শ্রমিকরা। এই চা শ্রমিকদের দমনের জন্য তৎকালীন অ্যাসিস্ট্যান্ট ডেপুটি কমিশনার মিস্টার কে সি দের নির্দেশ ও তত্ত্বাবধানে আসামের ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণাধীন গুরখা রাইফেলসের ৫০ জন সৈন্য ২১ মে ১৯২১ তারিখে নির্বিচার গুলি চালায় স্টিমারঘাটে জড়ো হওয়া চা শ্রমিক ও তাদের পরিবারের ওপর। মুহূর্তে শত শত চা শ্রমিকের রক্ত স্টিমার ঘাট পেরিয়ে মিশে মেঘনা নদীর জলে। চা শ্রমিকদের মধ্যে ঠিক কতজন প্রাণ হারায় আর কতজন আহত কিংবা মেঘনার জলে নিখোঁজ হয়ে যায় তার হিসাব কখনো করতে দেয়নি ব্রিটিশ শাসকরা। তবে চা শ্রমিকদের এই রক্তদান বৃথা যায়নি। এই বর্বরোচিত হামলার পর স্টিমার শ্রমিক, রেল শ্রমিক এবং পুরো আসাম ও পূর্বে বাংলার চা শ্রমিকরা একযোগে ধর্মঘট শুরু করে। চা শ্রমিকদের আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী হরদয়াল নাগ চাঁদপুরের গান্ধী হিসেবে পরিচিতি পান এবং শ্রমিক হত্যার প্রতিবাদ অব্যাহত রাখেন। মহাত্মা গান্ধী, মাওলানা মোহাম্মদ আলী, চিত্তরঞ্জন দাস, নেতাজী সুবাস চন্দ্র বসুর মতো জাতীয় পর্যায়ের নেতারা ছুটে আসেন চাঁদপুর। চাঁদপুরে চা শ্রমিকদের এই আত্মত্যাগের মধ্য দিয়েই ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ত্বরান্বিত হয়।

 

যুদ্ধের আবরণে পৃথিবীজুড়ে অকাতরে শ্রমিক হত্যা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান বাহিনী জাতি, বর্ণ, ধর্ম, রাজনৈতিক পরিচয়, অক্ষমতা প্রভৃতিকে কেন্দ্র করে অকাতরে বন্দী করত বিভিন্ন দেশ ও জাতির মানুষ। এমনকি জার্মানির ভিতর অধিক সন্তান বিশিষ্ট মা, দেহপসারিণী, সমকামী, শারীরিকভাবে যুদ্ধ করার জন্য অনুপযুক্তদেরও বন্দী শিবিরে রাখা হতো। তারপর তাদের নিয়োগ করা হতো অমানবিক শ্রম নির্ভর কাজে। বিশেষত যুদ্ধের জন্য রাস্তা নির্মাণ, খাদ্য উৎপাদন, যুদ্ধ সরঞ্জাম তৈরির কারখানা নির্মাণ, মাটির নিচে টানেল, অস্ত্র ও গোলাবারুদের কারখানা নির্মাণের জন্য কমপক্ষে ১০-১২ ঘণ্টা কাজ করতে বাধ্য করা হতো। বিনিময়ে তাদের ন্যূনতম খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানও নিশ্চিত ছিল না। যারা কাজ করতে অস্বীকার করত, তাদের উলঙ্গ করে পেটানো হতো এবং প্রকাশ্যে ঝুলিয়ে রাখা হতো। শুধু একটি বন্দী শিবির থেকে ওষুধ ও রাসায়নিক সামগ্রী তৈরির কারখানার ২৫ থেকে ৩৫ হাজার তথাকথিত বন্দীকে কাজ করতে বাধ্য করা হয়, যার উল্লেখযোগ্য অংশের মৃত্যু ঘটে বিভিন্ন কর্মস্থলে।

১৮৮৫ থেকে ১৯০৮ সালের মধ্যে আফ্রিকার কঙ্গো বেলজিয়ামের শাসক রাজা দ্বিতীয় লিও পল্ডের অধীন ছিল। এ সময় কঙ্গবাসীদের রাবার উৎপাদন, সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে বাধ্য করা হতো। কেউ তা না করলে চাবুক দিয়ে পেটানো হতো। অথচ বিনিময়ে তাদের চাহিদার তেমন কিছুই পূরণ করা হতো না। এতে কঙ্গোর জনসংখ্যা দ্রুত কমতে থাকে। পরবর্তীতে ইতিহাসবিদরা সময়ে এক কোটিরও বেশি কঙ্গবাসী বাধ্যতামূলক শ্রম দিতে গিয়ে এবং এ সংক্রান্ত বিদ্রোহ ও যুদ্ধে মারা যায় বলে        নিশ্চিত করেন।

ভøাদিমির লেনিন ও যোশেফ স্টালিনের শাসনামলে সোভিয়েত ইউনিয়নে বাধ্যতামূলক শ্রম আদায়ের জন্য গুলাগ নামের এক ধরনের ক্যাম্প নির্মাণ করা হয়। এই ক্যাম্পে বন্দীদের নদীখনন, খনি থেকে সম্পদ আহরণ, দুর্গম এলাকায় রাস্তা, রেললাইন ও বসতি নির্মাণের মতো কঠিন কাজ করতে বাধ্য করা হতো। এর মধ্যে ১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত-জার্মান যুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়নে খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয়, যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে লেবার ক্যাম্প নামের বন্দী শিবিরে। এক হিসাবে ১৯৩০ থেকে ১৯৫৬ সালের মধ্যে ১৬ লাখ বন্দী বাধ্যতামূলক অতিরিক্ত শ্রম ও খাদ্য-বস্ত্রের অভাবে মারা যায় বলে প্রকাশিত হয়। ঐতিহাসিক জে. ওট্রো এক গবেষণায় বলেছেন, এ সময় ২৭ লাখ ৪৯ হাজার ১৬৩ জন বন্দীরূপী শ্রমিক প্রাণ হারায়।

‘মাও : দ্য আননোন স্টোরি’ বইয়ের রচয়িতা এবং মাও এর জীবনী লেখক জাং চাং এবং ঐতিহাসিক জন হলিডের হিসাবে মাও সে তুংয়ের আমলে বিভিন্ন বন্দীশিবির থেকে বাধ্যতামূলক কাজ করার কারণে ও যথাযথ সুযোগ-সুবিধা না পাওয়ায় ২ কোটি ৭০ লাখ শ্রমিক মৃত্যুবরণ করে। ডাচ ইতিহাসবিদ ফ্রাংক ডিকোডারের তথ্যানুসারে মাও সে তুংয়ের সামনে ১০ থেকে ৩০ লাখ চীনা বাধ্যতামূলক অমানবিক শ্রমের কারণে আত্মহত্যা করে। কঙ্গোতে ১৯০০ থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত ফ্রান্সের শাসন বিদ্যমান ছিল। এ সময় শুধু সমুদ্র-তীরবর্তী রাস্তা ও রেললাইন নির্মাণ করে ১৪ থেকে ২০ হাজার শ্রমিক নিখোঁজ হয়ে যায় বলে প্রচলিত রয়েছে। বাধ্যতামূলক শ্রমের কারণে শ্রমিক মৃত্যুর করুণ সাক্ষী বর্তমান মিয়ানমার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বার্মা নামে পরিচিত এ দেশটি মিত্রবাহিনীর প্রভাব থেকে মুক্ত রাখে প্রতিদ্বন্দ্বী জাপান। তারপর ভারতবর্ষের অবস্থানরত ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে তারা ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়। এরই অংশ হিসেবে যুদ্ধ সরঞ্জাম ও রসদ সরবরাহ করার জন্য নির্মিত হয় ‘বার্মা রেলওয়ে’। এই নির্মাণ কাজে বর্তমান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এক লাখ ৮০ হাজারের বেশি শ্রমিক এবং মিত্রবাহিনীর প্রায় ৬০ হাজার যুদ্ধবন্দী বাধ্যতামূলক শ্রমে নিযুক্ত করা হয়। এদের মধ্যে মালয়ান, তামিল, বার্মিজ, চাইনিজ, থাই ও অন্যান্য দক্ষিণএশীয় শ্রমিক ছিল। বিভিন্ন সূত্র মতে এই নির্মাণকালে এক লক্ষাধিক তামিল বেসামরিক শ্রমিক এবং ১২ হাজার ৬২১ জন যুদ্ধবন্দীর করুণ মৃত্যু ঘটে। যাদের মধ্যে ৬ হাজার ৯০৪ জন ব্রিটিশ, ২ হাজার ৮০২ জন অস্ট্রেলীয়, ২ হাজার ৭৮২ জন ডাচ এবং ১৩৩ জন আমেরিকান যুদ্ধবন্দী ছিল। তাই বার্মা রেলওয়ের আরেক নাম ‘ডেথ রেলওয়ে’।

জাতি, ধর্ম, বর্ণ কিংবা অঞ্চল ভেদে শ্রমিকদের ইতিহাসে একটি বিষয় শাশ্বত প্রমাণিত। তা হলো শ্রমিকরা সর্বদা নিপীড়নের শিকার হয়েছে।         এর অবসান হোক।

সর্বশেষ খবর