শনিবার, ৬ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

ভারতীয় ব্যবসার আইকন বি কে বিড়লা

ভারতীয় ব্যবসার আইকন বি কে বিড়লা

বিড়লা গ্রুপের চেয়ারম্যান শিল্পপতি বসন্ত কুমার বিড়লা (বি কে বিড়লা) চলে গেলেন গত ৩ জুলাই। ৯৮ বছর বয়সে তার প্রয়াণ হলেও তিনি রেখে গেছেন বহুজাতিক আদিত্য বিড়লা গ্রুপের বিশাল ব্যবসা সাম্রাজ্য। গত কয়েক দশকে তিনি একে একে গড়ে তোলেন বিড়লা গ্রুপ অব কোম্পানিজের ব্যানারে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান। সিমেন্ট, টেক্সটাইল, পলিয়েস্টার, কাগজ, চা-কফি, শিপিং, কেমিক্যাল, টেলিযোগাযোগ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সার, বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানসহ নানামুখী ব্যবসার প্রসার ঘটান। কৃষ্ণার্পণ চ্যারিটি ট্রাস্ট, বি কে বিড়লা ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজিসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ট্রাস্টের চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। মাত্র ১৫ বছর বয়সেই ব্যবসায় যোগ দেন। ভারতের শীর্ষ শিল্প উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে নিয়ে গেছেন গৌরবময় উচ্চতায়। আম্বানি, টাটা গ্রুপের পর ভারতের শিল্প বিকাশ ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে বি কে বিড়লার অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাকে নিয়ে আজকের রকমারি। লিখেছেন- তানিয়া তুষ্টি

 

শিল্পপতি বাবার পথ ধরে

যেভাবে গড়ে তুললেন বিড়লা গ্রুপ অব কোম্পানিজ

বাবা ঘনশ্যাম দাশ বিড়লা ছিলেন ভারতের শীর্ষ ব্যবসায়ীদের একজন। তার তিন ছেলের মধ্যে ছোট ছেলে বি কে বিড়লা (বসন্ত কুমার বিড়লা)। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯২১ সালের ১২ জানুয়ারি। মাত্র ১৫ বছর বয়সে বড় বড় বেশ কিছু কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত হয়ে যান তিনি। এরপর ধীরে ধীরে নিজের যোগ্যতা প্রদর্শন করে কেশরাম ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি হন। পরে তিনি ইন্দো ইথিওপিয়ান টেক্সটাইল শেয়ার কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যেটি ভারতীয় শিল্পপতির প্রথম যৌথ উদ্যোগ ছিল। বি কে বিড়লার সৃষ্টিশীল কাজে অভিভূত হয়ে ইথিওপিয়া সম্রাট হাইল সেলাসি-১ তাকে ‘অর্ডার অব মেলেনিক-২’ পদক প্রদান করেছিলেন; যা ইথিওপিয়ান সর্বোচ্চ পুরস্কার।

ঘনশ্যাম দাশ বিড়লা ছিলেন ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। তিনি মহাত্মা গান্ধী, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল ও জওহরলাল নেহরুর দর্শন অনুসরণ করতেন। প্রকৃতপক্ষে তার ব্যবসায়িক দর্শন গান্ধীর আর্থ-সামাজিক ধারণা দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত ছিল। এমন বাবার সন্তান হিসেবে বি কে বিড়লাও ছিলেন সমমতাদর্শের অধিকারী। বাবার ব্যবসায় যোগদানের পর গ্রুপের প্রসার ঘটাতে থাকেন সুদক্ষ পরিচালনায়। কেশরাম ইন্ডাস্ট্রিজ ছাড়াও একে একে গড়ে তোলেন সেঞ্চুরি টেক্সটাইল, সেঞ্চুরি এনকা ও জয়শ্রী টি অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ। কৃষ্ণার্পণ চ্যারিটি ট্রাস্টেরও সভাপতি ছিলেন বিড়লা। বি কে বিড়লা ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি নামে একটি কলেজ তৈরি করেন রাজস্থানের পিলানি। এ ছাড়া ভারতে অন্তত ২৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকও ছিলেন বি কে বিড়লা। তিনি তুলা, ভিস্কোজ, পলিয়েস্টার ও নাইলন সুতা, কাগজ, শিপিং, টাইরেকর্ড, স্বচ্ছ কাগজ, স্পুন পাইপ, সিমেন্ট, চা-কফি, কারডাম, রাসায়নিক, পাতলা কাঠ, এমডিএফ বোর্ড প্রভৃতি শিল্পের উন্নয়নে মনোনিবেশ করেছিলেন। নিজের কোম্পানিকে পরিণত করেছিলেন ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম ব্যক্তিমালিকানাধীন কোম্পানিতে। ২০১৮ সালে কোম্পানির বার্ষিক রেভিনিউ দাঁড়ায় ৪৪.৩ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে ৩৫টি দেশে ১ লাখ ২০ হাজার কর্মী নিয়ে কোম্পানিটি তার কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তিনি বেশ কয়েকটি বইয়েরও লেখক। এর মধ্যে ‘সভান্তাহ সুকাইয়া’ নামে একটি আত্মজীবনী রয়েছে। এত এত অর্জনের নায়ক বি কে বিড়লা গেল ৩ জুলাই ৯৮ বছর বয়সে মারা যান।

 

ছেলের নামে ব্যবসা সাম্রাজ্য

সত্য শিব নারায়ণ বিড়লা ১৮৫৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন বিড়লা গ্রুপ। তার ছেলে ঘনশ্যাম দাশ বিড়লা ব্যবসার হাল ধরেন। এরপর ঘনশ্যাম দাশ বিড়লার ছোট ছেলে বি কে বিড়লা মাত্র ১৫ বছর বয়সে ১৯৩৬ সালে কোম্পানিতে যোগদান করেন। এরপর ধীরে ধীরে ব্যবসার সম্প্রসারণ ঘটান। আজ কোম্পানিটির অবস্থান ভারতে ব্যক্তিমালিকানাধীন কোম্পানির মধ্যে তৃতীয়। বি কে বিড়লার ২৩ বছর বয়সে ছেলে আদিত্য বিক্রম বিড়লা জন্মগ্রহণ করেন। এই আদিত্য বিক্রমের নামেই পারিবারিক ব্যাবসাপ্রতিষ্ঠানের নামকরণ আদিত্য বিড়লা গ্রুপ। আদিত্য বিক্রম বিড়লার জন্ম ১৪ নভেম্বর, ১৯৪৩ সালে কলকাতায়।

আদিত্য বিড়লার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ করার পর ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে রাসায়নিক প্রকৌশল সম্পন্ন করেন। তারপর ১৯৬৫ সালে আদিত্য ভারতে ফিরে এসে তার পারিবারিক ব্যবসায় যোগ দেন। আদিত্য নিজস্ব কৌশল অবলম্বন করে ব্যবসাকে বিশ্বব্যাপী প্রসারিত করতে থাকেন। তার নেওয়া সব উদ্যোগের বেশির ভাগই সফল হয়। মুনাফাও অর্জন করে অনেক। কলকাতায় তার প্রথম উদ্যোগ হিসেবে ছিল ‘ইস্টার্ন স্পিনিং মিলস’। সে সময় বিলুপ্তির প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা রাইয়ান ও পোশাকশিল্পকে একটি লাভজনক ব্যবসায় ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে এ উদ্যোগ দারুণ সফল হয়। তার পর থেকে আদিত্য কয়েক বছরে শিল্প ও বাণিজ্যিক সাফল্যের ধারাবাহিকতা সৃষ্টি করেন। তবে পিতামহ ঘনশ্যাম ১৯৮৩ সালে মারা যাওয়ার পর তাকে একটি বড় ভূমিকা পালন করতে হয়েছিল।

আদিত্য ‘ইস্টার্ন এক্সপ্রেস মিলস’ নামে একটি কাপড়ের ব্যবসা শুরু করেছিলেন; যা কলকাতায় খুব সফল ছিল। এ সফল যাত্রার মাধ্যমে তিনি ডুবে যাওয়া কাপড়ের ব্যবসায় নতুন জীবন দেন। তার সর্বশ্রেষ্ঠ চ্যালেঞ্জ ছিল তেল সেক্টর। এ সেক্টরের সঙ্গে বিড়লা গ্রুপেরও বিস্তার ঘটতে থাকে আদিত্যের হাতে। এই চ্যালেঞ্জ শুধু বিড়লা গ্রুপকে তুলে আনেনি, ভারতের অর্থনীতির সমাজতান্ত্রিক ধারণা ও জাতীয়করণ, ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নীতি ও বেসরকারি বিনিয়োগে প্রভাব ফেলে। কিন্তু নিজের কর্মময় জীবনকে তিনি খুব বেশি লম্বা করতে পারেননি। দুই বছর ধরে প্রোস্টেট ক্যান্সারে ভোগার পর ১৯৯৫ সালের ১ অক্টোবর তিনি মারা যান।

 

বাঁ দিক থেকে আদিত্য বিড়লা, কুমার মঙ্গলাম বিড়লা, ঘনশ্যাম দাশ বিড়লা, বসন্ত কুমার বিড়লা

কোম্পানির ক্যাশিয়ার থেকে মালিক হলেন যেভাবে

ঘনশ্যাম দাশের সবচেয়ে ছোট ছেলে ছিলেন বি কে বিড়লা। তার বিশাল ব্যবসা ছিল। তাই বলে বাবা তাকে সেই প্রতিষ্ঠানের বড় পদে বসাননি। বি কে বিড়লা গ্রুপের আজকের যে সাম্রাজ্য দেখা যায় তার অনেকটাই নিজের হাতে গড়েছেন বি কে বিড়লা। তার বাবা ছিলেন শীর্ষ শিল্পপতি। কিন্তু তিনি সন্তানকে গড়ে তুলেছেন একেবারে গোড়া থেকে। ব্যবসাটা যেন হাতেকলমে শিখে বসতে পারেন তাই তাকে বড় কোনো পদে বসাননি। বি কে বিড়লা সেই স্মৃতি রোমন্থন করে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, বিড়লা গ্রুপের প্রধান প্রতিষ্ঠান কেশরামে তিনি প্রথম জয়েন করেন একজন সাধারণ ক্যাশিয়ার হিসেবে। সেখান থেকেই পথচলা তার। কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর পর্যায়ে কিংবা নীতিনির্ধারণী কোনো মিটিংয়ে থাকার সুযোগ তখন ছিল না। তবে ব্যবসাটা কীভাবে করতে হয় তা ভালোভাবেই আঁচ করতে শেখেন। বাবা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন বলে জাতীয় নেতাদের খুব কাছ থেকে দেখে শেখার সুযোগ পেয়েছেন বি কে বিড়লা। বিশেষ করে গান্ধীজির সামাজিক উন্নয়নে অর্থনৈতিক ধারণা তাকে দারুণ অনুপ্রাণিত করেছে। বাবার হাতে গড়ে ওঠা বিড়লা গ্রুপ সত্যিকার অর্থে বাজিমাত করে কেশরাম ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যান্ড সিমেন্ট টেক্সটাইল থেকে। ইঞ্জিনিয়ারিং, শিপিং, সিমেন্ট, কাগজ আর সুতার ব্যবসা সম্প্রসারণ করে তিনি বিড়লা গ্রুপের সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। এক বছরেই প্রতিষ্ঠানের লাভের হার বেড়ে ১৬ হাজার কোটি রুপি ছাড়িয়ে যায়। সবাইকে বিস্মিত করে তিনি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ভারতের বাইরে তিনি ছড়িয়ে দেন ব্যবসার ডালপালা। বিড়লা গ্রুপের আয়ের ও প্রতিষ্ঠার পেছনে তখন কেশরাম ইন্ডাস্ট্রিজ, সেঞ্চুরি টেক্সটাইল অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ, সেঞ্চুরি ইনকা, মঙ্গলাম সিমেন্ট ও ইসিই ইন্ডাস্ট্রিজ দারুণ ভূমিকা রাখে। তিনি পুরোদমে ব্যবসায় মন দেন। তাকে নিয়ে কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও খুব ব্যস্ত থাকতেন। কোনো কারণে দেশের বাইরে গেলেও তার হাতে পৌঁছাতে হতো কোম্পানির প্রতিদিনের হিসাব-নিকাশ। কী কাজ করার ছিল, কতটুকু হলো আর কতটুকু করতে হবে সব হিসাবের একটি প্রতিবেদন তার হাতে সন্ধ্যার পরপরই পৌঁছে দেওয়া হতো। তিনি লেনদেনেও খুব মনোযোগী ছিলেন। ব্যবসায় লাভের চেয়ে ব্যবসা ছড়িয়ে দিতে আগ্রহী ছিলেন বেশি।

 

       টাইমলাইন

টাকা ঢালতেন মানবসেবায়

ভারতের ৫ হাজার গ্রামে বিভিন্ন ধরনের সেবামূলক কাজ করে আদিত্য কুমার বিড়লা গ্রুপ। তাদের সেবা পৌঁছেছে প্রায় সাড়ে ৭ মিলিয়ন মানুষের কাছে। দেশের ২০টি হাসপাতালে ৫ হাজারের মতো মেডিকেল ক্যাম্প করা হয়েছে কোম্পানির পক্ষ থেকে। ৭০ মিলিয়ন শিশুকে পোলিও টিকা প্রদান করা হয়েছে তাদের পক্ষ থেকে। বর্তমানে ৫৬টি স্কুলে সাড়ে ৪৬ হাজার শিশুকে শিক্ষা প্রদান করা হচ্ছে। পড়াশোনার সুবিধার্থে ৪ লাখ ৫০ হাজার শিশুকে সোলার লাইট প্রদান করা হয়েছে। প্রতিদিন ভারতের ২৬৮টি স্কুলে ৬৩ হাজার ছেলেমেয়েকে দুপুরের খাবার পরিবেশন করে এ কোম্পানি। এখন পর্যন্ত নানা বিষয়ের ওপর দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিনামূল্যে ৯৫ হাজার যুবককে প্রশিক্ষণ প্রদান করেছে তারা। বেশ কয়েক বছর ধরে বি কে বিড়লা নিজের প্রতিষ্ঠানসহ বেশ কয়েকটি সংস্থায় অনেক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। এগুলো মূলত বিভিন্ন দাতব্য ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধান করত। তিনি কৃষ্ণার্পণ চ্যারিটি ট্রাস্টের চেয়ারম্যান ছিলেন। এটি পিলানি অঞ্চলে বি কে বিড়লা ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি নামে একটি প্রকৌশল কলেজ পরিচালনা করে।

 

সর্বশেষ খবর