রবিবার, ৭ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

ভারতীয় রাজনীতিতে নেহেরু-গান্ধী পরিবার

সাইফ ইমন

ভারতীয় রাজনীতিতে  নেহেরু-গান্ধী পরিবার

‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস’ সাধারণভাবে ‘কংগ্রেস’ নামে পরিচিত। এটি বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন রাজনৈতিক সংগঠন। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে দলটির অগ্রণী ভূমিকা ছিল। ১৮৮৫ সালে থিওজোফিক্যাল সোসাইটির কিছু সদস্য কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা অর্জন করলে কংগ্রেস দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। সেই থেকে মূলত নেহেরু-গান্ধী পরিবারই কংগ্রেসকে নেতৃত্ব দিতে থাকেন। দলটি দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমতায়ও ছিল এবং আগামী দিনেও সম্ভাবনা উজ্জ্বল। শুরু থেকে কংগ্রেসকে নানা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হয়েছে। ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাসে এই গান্ধী পরিবার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। একই পরিবার থেকে দীর্ঘ সময় ভারত শাসন করেছেন তারা। কংগ্রেস সভানেত্রী মা ইন্দিরা গান্ধী ও ছেলে রাজীব গান্ধী তিন মেয়াদে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। রাজনৈতিক নেতা ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর জনপ্রিয়তা ছিল বিশ্বজোড়া। এই মহান নেতাকে নির্মমভাবে গুলি করে মেরে ফেলেন তারই দেহরক্ষী সতওয়ান্ত সিং ও বেয়ান্ত সিং। মা মারা যাওয়ার পর রাজীব গান্ধীকেই প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস তাকেও বোমা বিস্ফোরণে হত্যা করা হয়। বাদ পড়েনি ছোট ছেলে সঞ্জয় গান্ধী। তার অকাল মৃত্যুর কারণ হিসেবে বিমান দুর্ঘটনার কথা বলা হলেও তিনিও নির্মম ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয়।  ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত দল ও দেশের নেতৃত্ব দেন নেহেরু। তৃতীয় বিশ্বের প্রথম নেতা হিসেবে পরিচিত নেহেরু ‘জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলন’ ও ‘সবুজ বিপ্লব’-এর মতো ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ নিয়ে দেশের ভিতরে ও বহির্বিশ্বে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৯৬৪ সালে নেহেরুর মৃত্যুর পর দলের হাল ধরেন ইন্দিরা। তবে ১৯৫৯ সালেই কংগ্রেসের সভানেত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। নেহেরুর মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রী হন লালবাহাদুর শাস্ত্রী। ১৯৬৬ সালে তারও মৃত্যু হলে ভারতের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হন ইন্দিরা গান্ধী। ১৯৭৫ সালে সারা দেশে দেখা দেয় রাজনৈতিক অস্থিরতা। পরিস্থিতি সামাল দিতে ১৯৭৭ সালে দেশব্যাপী জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন ইন্দিরা। জরুরি অবস্থার শেষে পুনঃনির্বাচনে কংগ্রেস হেরে যায়। ১৯৮০ সালে ইন্দিরার নেতৃত্বে আবার ক্ষমতায় আসে কংগ্রেস। নেতৃত্বে গান্ধী পরিবারের সাময়িক অনুপস্থিতি। রাজীবের মৃত্যু পর কংগ্রেস সভাপতি ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন পি ভি নরসিমা রাও। পাশাপাশি চলতে থাকে রাজীব গান্ধীর ইতালীয় বংশোদ্ভূত স্ত্রী সোনিয়াকে রাজনীতিতে আনার প্রস্তুতি। কারণ এ সময় গান্ধী পরিবার নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ে। বিজেপির নেতৃত্বে ১৯৯৮ সালে ক্ষমতায় আসে এনডিএ জোট সরকার। ২০০৪ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকে তারা। ২০০৪ সালে সোনিয়ার নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসে কংগ্রেস।

 

মতিলাল নেহেরু

ভারতের সবচেয়ে প্রাচীন রাজনৈতিক দল কংগ্রেস। ভারতে ব্রিটিশ উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম রূপকার দলটি বর্তমানে প্রধান বিরোধী দল। ১৩২ বছরের এই রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নেহেরু-গান্ধী পরিবার ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নেহেরু-গান্ধী পরিবারে রাজনীতির সূচনা করেছিলেন মতিলাল নেহেরু, ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল  নেহেরুর বাবা। মতিলাল নেহেরু দুই দফায় কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন (১৯১৯-২০ এবং ১৯২৮-২৯)। তার ছেলে জওহরলাল নেহেরু কয়েক দফায় কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন। মতিলাল নেহেরু এলাহাবাদের একজন বিখ্যাত আইনজীবী ছিলেন। তিনি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম সক্রিয় কর্মীদের মধ্যে একজন। মতিলাল নেহেরু আগ্রায় জন্মগ্রহণ করেন ৬ মে ১৮৬১। তার বাবার নাম ছিল গঙ্গাধর। পাশ্চাত্য শিক্ষায় প্রথম প্রজন্মের মধ্যে তিনি ছিলেন একজন। তিনি এলাহাবাদের মুরে সেন্ট্রাল কলেজে পড়াশোনা করেন কিন্তু বিএ পাস করেননি। পরে তিনি কেমব্রিজ থেকে ‘বার অ্যাট ল’ নামক উপাধি গ্রহণ করেন এবং ইংরেজ আদালতগুলোতে উকিল হিসেবে কাজ শুরু করেন। মতিলাল নেহেরুর স্ত্রীর নাম ছিল রূপো রানী। জওহরলাল নেহেরু তার একমাত্র ছেলে। তাদের দুই মেয়ে ছিল। তার বড় মেয়েটির নাম বিজয়লক্ষ্মী, যিনি পরে বিজয়ালক্ষ্মী পন্ডিত নামে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। তার ছোট মেয়েটির নাম ছিল কৃষ্ণ। পরে কৃষ্ণ হত্তীসিংহ বলা হয়। কিন্তু পরে তিনি তার সমর্থকতা ত্যাগ করেছিলেন এবং ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে কাজ করেছিলেন। ১৯২৯ সালে তিনি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের পাশাপাশি কংগ্রেসের পক্ষ থেকে পৃথক হওয়ার পর তার স্বরাজ পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৮ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত কংগ্রেস কনভেনশনে সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি ১৯২৮ সালে কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠিত ভারতীয় সংবিধান কমিশনের সভাপতি হন।

 

জওহরলাল নেহেরু

পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের রাজনীতিবিদ, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা এবং স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, আদর্শবাদী, পন্ডিত এবং কূটনীতিবিদ নেহেরু ছিলেন একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। লেখক হিসেবেও নেহেরু ছিলেন বিশিষ্ট। ইংরেজিতে লেখা তার তিনটি বিখ্যাত বই-  ‘একটি আত্মজীবনী’, ‘বিশ্ব ইতিহাসের কিছু চিত্র’ এবং ‘ভারত আবিষ্কার’ চিরায়ত সাহিত্যের মর্যাদা লাভ করেছে।

পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুর জন্ম ১৮৮৯ সালের ১৪ নভেম্বর এলাহাবাদে। তার প্রথম শিক্ষার পাঠ বাড়িতেই গৃহ শিক্ষকদের কাছে। পনেরো বছর বয়সে ইংল্যান্ড যাত্রা করেন। হ্যারোতে দুই বছর থাকার পর তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন প্রকৃতিবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনার জন্য। এরপর তিনি ব্যারিস্টারি পড়তে শুরু করেন। ১৯১২ সালে দেশে ফিরেই তিনি সরাসরি রাজনীতির সংস্পর্শে চলে আসেন। ছাত্রাবস্থা থেকেই বিদেশি ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম তাকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করত। আয়ারল্যান্ডের সিন ফিন আন্দোলনের বিষয়ে জানতে তিনি খুবই উৎসাহী হয়ে ওঠেন। তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই ভারতে ফিরে স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে তিনি যুক্ত হয়ে পড়েন। ১৯১২ সালে একজন প্রতিনিধি হিসেবে তিনি বাঁকিপুর কংগ্রেসে উপস্থিত ছিলেন। ১৯১৯ সালে এলাহাবাদের হোমরুল লিগে তিনি সম্পাদক পদে নিযুক্ত হন। মহাত্মা গান্ধীর আদর্শ তাকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করে। ১৯২০-২২ এর অসহযোগ, ১৯৩১ থেকে ১৯৩৫ সালের মাঝে মাত্র চার মাস ছাড়া বাকি সময় তিনি বোন ও স্ত্রীসহ কারাগারে ছিলেন। চতুর্থবারের জন্য তিনি কংগ্রেস সভাপতি নিযুক্ত হন ১৯৪৬-এর ৬ জুলাই। পরবর্তীকালে ১৯৫১-৫৪ সাল পর্যন্ত আরও তিনবার তিনি ওই পদে নির্বাচিত হন।

 

সঞ্জয় গান্ধী

সঞ্জয় গান্ধী জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৬ সালের ১৪ ডিসেম্বর। ভারতের এই রাজনীতিবিদ ছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর পুত্র। সঞ্জয় গান্ধীকে সবাই ইন্দিরা গান্ধীর পরে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হবেন বলে ভাবতেন এবং এটাও ভাবা হয়েছিল, সঞ্জয়ই হবেন ইন্দিরার পরের প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু একটি বিমান দুর্ঘটনায় সঞ্জয় নিহত হলে তার বড় ভাই রাজীব গান্ধী ইন্দিরার উত্তরসূরি এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন। সঞ্জয়ের পত্নী মেনকা গান্ধী এবং ছেলে বরুণ গান্ধী ভারতীয় জনতা পার্টির সদস্য। রাজীব গান্ধীর মতোই সঞ্জয় প্রথমে ওয়েলহ্যাম বয়েজ স্কুল এবং ডুন স্কুল দেরাদুনতে অধ্যয়ন করেন। সঞ্জয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হননি কখনো। কিন্তু অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়েন। তাই গাড়ি নির্মাণ প্রকৌশলকে নিজের কর্মজীবন হিসেবে বেছে নেন এবং ইংল্যান্ডে তিন বছরের প্রশিক্ষণ নেন এই বিষয়ে। স্পের্টস কারের প্রতি আগ্রহ ছিল বেশি সঞ্জয়ের। ১৯৭৬ সালে বৈমানিকের লাইসেন্সও নেন। তিনি বিমান অ্যাক্রোব্যাটিক্সের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। তার ভাই রাজিব গান্ধী ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের একজন ক্যাপ্টেন ছিলেন এবং রাজীবের মতো সঞ্জয়ও তার মায়ের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ১৯৮০ সালের ২৩ জুন বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন ইন্দিরা গান্ধীর এই ছোট ছেলে সঞ্জয়। কিন্তু এই দুর্ঘটনাকে নিছক দুর্ঘটনা বলেই দেখা হয়নি কখনো। তদন্ত করে বেরিয়ে এসেছিল এটি বিমান দুর্ঘটনা। তবে এর পেছনে থাকা বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ্যে আসেনি কখনো। তবে তার মৃত্যুর গোপন রহস্যের বেশিরভাগই অনুমান। পরে অবশ্য রহস্যের তেমন প্রমাণও পাওয়া যায়নি। তখনকার তদন্ত এটি প্রমাণ করে যে, সঞ্জয় গান্ধীকে কোনো মহল অপসারণ করতে চেয়েছিল। আর এই ষড়যন্ত্রের শুরু ১৯৮০ সালে নয় বরং বহু বছর আগে থেকেই। এখন পর্যন্ত এটি সবচেয়ে রহস্যময় ঘটনা।

 

রাজীব গান্ধী

দেশের তরুণতম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাজীব গান্ধী নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে জাতির ইতিহাসে এক বিরল নজির স্থাপন করেন। তার মা নিহত হওয়ার পরে শোকের পরিবেশ কাটিয়ে উঠে তিনি লোকসভা নির্বাচনের নির্দেশ দেন। নির্বাচনে কংগ্রেস অতীতের আরও সাতটি নির্বাচনের ইতিহাস ম্লান করে দিয়ে বিপুল জনমত নিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। লোকসভার ৫০৮টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস দখল করে নেয় ৪০১টি। দেশের ৭০ কোটি মানুষের নেতা হিসেবে এভাবেই রাজনৈতিক জীবনে তার উত্থান। রাজীব রত্ন গান্ধী জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৪ সালের ২০ আগস্ট। ভারতের সপ্তম এই প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইন্দিরা ও ফিরোজ গান্ধীর  জ্যেষ্ঠ পুত্র। ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর মায়ের মৃত্যুর দিন মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে তিনি দেশের কনিষ্ঠতম প্রধানমন্ত্রীরূপে কার্যভার গ্রহণ করেছিলেন। রাজনীতিতে পদার্পণের আগে রাজীব ছিলেন ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের এক পেশাদার বিমানচালক। ১৯৬৮ সালে বিয়ে করেন সোনিয়া গান্ধীকে। ১৯৮৮ সালে রাজীব গান্ধী পিপলস লিবারেশন অরগানাইজেশন অব তামিল ইলম (পিএলওটিই) এর মতো জঙ্গি তামিল গোষ্ঠীগুলোর বিরোধিতা করে মালদ্বীপের সামরিক অভ্যুত্থান ব্যর্থ করে দেন। ১৯৮৭ সালে শ্রীলঙ্কার শান্তি প্রচেষ্টায় হস্তক্ষেপ করেন এবং পরে সে দেশে ভারতীয় শান্তিরক্ষী বাহিনী প্রেরণ করেন। এই বাহিনীর সঙ্গে লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলম (এলটিটিই) জঙ্গিগোষ্ঠীর সম্মুখ সমরের জন্য তাকেই দায়ী করা হয়। ১৯৮৭ সালের মাঝামাঝি বোফর্স কেলেঙ্কারির ফলে ১৯৮৯ সালের নির্বাচনে ভরাডুবি ঘটে তার দল কংগ্রেসের। ১৯৯১ সাল পর্যন্ত রাজীব গান্ধী ছিলেন ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি। ওই বছরই একটি নির্বাচনী জনসভায় জনৈক এলটিটিই জঙ্গির আক্রমণে নিহত হন তিনি।

 

ইন্দিরা গান্ধী

ইন্দিরা গান্ধীর জন্ম ভারতের রাজনীতিতে সবচেয়ে প্রভাবশালী, ঐতিহ্যবাহী নেহেরু পরিবারে ১৯১৭ সালের ১৯ নভেম্বর। বাবা পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু এবং মা কমলা দেবী। দাদা মতিলাল নেহেরু ছিলেন স্বনামধন্য আইনজীবী, ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম ব্যক্তিত্ব তথা কংগ্রেস নেতা। ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর নিজের দেহরক্ষীর গুলিতে নিহত হন তিনি। ইন্দিরা গান্ধী বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতনে কিছুদিন পড়াশোনা করেন। রবিঠাকুরই তার নাম রাখেন ‘প্রিয়দর্শিনী’। ইন্দিরা গান্ধী হয়ে যান ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী গান্ধী। এরপর তিনি ইংল্যান্ডে যান এবং অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশ নেন। কিছুদিন ব্রিস্টলের ব্যাডমিন্টন স্কুলে পড়াশোনা করেন এবং অক্সফোর্ডের সমারভিল কলেজে তার এনরোলমেন্ট সম্পন্ন হয়। ১৯৪২ সালে ফিরোজ গান্ধীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ইন্দিরা। ১৯৫০ সাল থেকে তিনি আনঅফিশিয়ালি তার বাবা প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৪ সালে বাবার মৃত্যুর পর তিনি রাজ্যসভার সদস্য হন এবং লালবাহাদুর শাস্ত্রীর কেবিনেটে তথ্য এবং যোগাযোগমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ভারতরত্ন উপাধিপ্রাপ্ত তামিলনাড়ুর তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী তথা কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট কুমারাস্বামী কামরাজের প্রয়াসের ভিত্তিতে ১৯৬৬ সালে ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভারতের রাজনীতিতে আবির্ভূত হন। সে সময় ভারতের রাজনীতিতে কংগ্রেস দুটি দলে বিভক্ত ছিল, ইন্দিরা গান্ধী সমাজতান্ত্রিক ব্লকের এবং মোরারজি দেশাই দক্ষিণপন্থি ব্লকের নেতৃত্ব দেন। পৃথিবীর ইতিহাসে ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন বেশি সময় ধরে দায়িত্ব পালন করা নারী প্রধানমন্ত্রীদের একজন [১৫ বছর]।

 

সোনিয়া গান্ধী

সোনিয়া গান্ধীর জীবন অনেকটা সিনেমার মতো বর্ণিল। ইতালির ভেনেত অঞ্চলের ভিসেনসা নগরী থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরের এক গ্রাম লুসেনিয়া। এই গ্রামের রোমান ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বী মাইনো পরিবারে ১৯৪৬ সালের ৯ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেছিলেন সোনিয়া। তার অসল নাম আন্তোনিয়া এদভিদ এ্যালবিনো মাইনো। এই মাইনো পরে সোনিয়া গান্ধী নামে বিখ্যাত হয়ে যান ভারতীয় রাজনীতিতে। ছোটবেলা থেকেই সোনিয়া ছিলেন মেধাবী। মাত্র ১৩ বছর বয়সে তুরিন শহর থেকে স্কুলজীবন শেষ করেন। ১৯৬৪ সালে সোনিয়া ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ শহরের বেল এডুকেশনাল ট্রাস্টে ইংরেজি ভাষায় উচ্চশিক্ষা নিতে ভর্তি হয়। নিজের খরচ জোগাতে সোনিয়া পার্ট-টাইম চাকরি নিয়েছিলেন এক রেস্টুরেন্টে। সে সময় কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রিনিটি কলেজে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর জ্যেষ্ঠ পুত্র রাজীব গান্ধী। সেই রেস্টুরেন্টে প্রথমবার দেখেই সোনিয়ার প্রেমে পড়ে যান রাজীব গান্ধী। পরে রেস্টুরেন্ট মালিকের সহায়তায় ন্যাপকিনে ছোট একটি কবিতা লিখে সবচেয়ে দামি পানীয়সহ পাঠিয়ে দেন সোনিয়াকে। তখনো সোনিয়া জানতেন না এই যুবক ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ছেলে। এভাবেই রেস্টুরেন্টে দেখা হতে হতে ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠ হয় রাজীব সোনিয়ার সম্পর্ক। তাদের প্রেম প্রথমে গান্ধী পরিবার মেনে নেয়নি। পরিবারের আপত্তি সত্ত্বেও ১৯৬৮ সালের জানুয়ারিতে সোনিয়া ভারতে আসেন। গান্ধী পরিবারের ঘনিষ্ঠ বিখ্যাত বচ্চন পরিবারে ওঠেন তিনি। কিছুদিন পরই দ্রুত বিয়ের আয়োজন করলেন ইন্দিরা গান্ধী। ১৯৬৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি মহা ধুমধামে বিয়ে হয়ে যায় রাজীব-সোনিয়ার। বিয়ে হলো পুরো হিন্দু রীতি মেনে। ২২ বছরের এক সাধারণ ইতালিয়ান তরুণী হন ভারতের বিখ্যাত গান্ধী পরিবারের সদস্য।

 

রাহুল গান্ধী

রাহুল গান্ধী জন্মগ্রহণ করেন ১৯৭০ সালের ১৯ জুন। তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বর্তমান সভাপতি। পরিবারিক রাজনিতিতে যুক্ত হওয়ার আগে তিনি লোকচক্ষুর আড়ালেই থাকতেন। তিনি ছোট বয়সে দিল্লির সেন্ট কলম্বাস স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন এবং পরবর্তী সময়ে দুন স্কুলে পড়েন ১৯৮১ থেকে ১৯৮৩ পর্যন্ত। ১৯৮৯ সালে দিল্লির সেন্ট স্টিফেন্স কলেজে স্নাতক স্তরে ভর্তি হন এবং পরবর্তী সময়ে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে চলে যান। ১৯৯১ সালে তার বাবা ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী নিহত হলে নিরাপত্তাজনিত কারণে তাকে রাউল ভিন্সি ছদ্মনামে ফ্লোরিডার রোলিন্স কলেজে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। সেখানেই ১৯৯৪ সালে কলা বিভাগে স্নাতক পাস করেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৫ সালে দর্শনে স্নাতকোত্তর করতে ট্রিনিটি কলেজ, কেমব্রিজে ভর্তি হন। এরপর ২০১৩ সালে রাজস্থানের জয়পুরে কংগ্রেস পার্টির চিন্তন শিবির নামে বিশেষ অধিবেশনে কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী ছেলে রাহুল গান্ধীকে কংগ্রেসের সহসভাপতির পদে বসিয়ে ভারতীয় রাজনীতির আঙিনায় তার আনুষ্ঠানিক অভিষেক পর্ব সম্পন্ন করেন।

 

 

প্রিয়াঙ্কা গান্ধী

রাজীব গান্ধী এবং সোনিয়া গান্ধীর দ্বিতীয় সন্তান হলেন প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। তিনি নয়াদিল্লির মডার্ন স্কুল, কনভেন্ট অব জিসাস অ্যান্ড মেরি থেকে স্কুলজীবন শেষ করেন। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনস্তত্ত্ব বিষয়ে ডিগ্রিপ্রাপ্ত হন। প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভারতের রাজনীতিতে আসা নেহেরু-গান্ধী পরিবারের সর্বশেষ সংযোজন। প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর জন্ম ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি। ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। নিজের ৪৭তম জন্মদিনের ১০ দিন পর তিনি রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার ঘোষণা দেন। ইন্দিরা গান্ধীকে যখন হত্যা করা হয়, তখন নিরাপত্তাজনিত কারণে বেশ কিছুদিন প্রিয়াঙ্কা স্কুলে যেতে পারেননি। বাসায় থেকেই পড়ালেখা করেছেন প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। খুব কম মানুষই হয়তো জানেন যে, প্রিয়াঙ্কা বৌদ্ধ ধর্মশিক্ষায় মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৯৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রিয়াঙ্কা তার ছোটবেলার বন্ধু রবার্ট ভদ্রকে বিয়ে করেন। রবার্ট দিল্লির সুপরিচিত ব্যবসায়ী। প্রিয়াঙ্কা-রবার্ট দম্পতির দুই সন্তান। ছেলে রোহান আর মেয়ে মিরায়া। সন্তানদের কাছে মা প্রিয়াঙ্কা ভীষণ কড়া শিক্ষকের মতো। রাহুল গান্ধীর চেয়ে দুই বছরের ছোট প্রিয়াঙ্কা সাধারণ মানুষের কাছে ইন্দিরা গান্ধীর দ্বিতীয় রূপ। দাদির মতোই তার ছোট চুল, খাড়া নাক। মাত্র ১৬ বছর বয়সে প্রিয়াঙ্কা প্রথম রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়েছিলেন।

সর্বশেষ খবর