কবি শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৬) অতি উন্নতমানের, সফল, পাঠকনন্দিত একজন ছড়াশিল্পী ছিলেন। বিষয়টি এখনো পর্যন্ত বিশদে আলোচিত বিশ্লেষিত হয়েছে বলে শুনিনি। শিশু-কিশোরদের জন্য ইচ্ছেপূরণের রঙিলা কল্পভুবন নির্মাণে তার যে সিদ্ধি ও ঋদ্ধি, তা সমকালীন বাংলা সাহিত্যেরই শ্লাঘার বিষয়। শিশু-কিশোরদের জন্য তার লেখাগুলো, বিশেষ করে ছড়া-কবিতা এক আশ্চর্য সম্পদ। কাল থেকে কালে এসব রচনা প্রাসঙ্গিক থাকবে, সব বয়সীমনস্ক পাঠকের তৃষ্ণা মেটাবে, এমন প্রত্যয়ী আশাবাদ করাই চলে। ছড়ায় তিনি ছিলেন বৈচিত্র্যসন্ধানী, নতুনত্বপ্রয়াসী, ছন্দনিপুণ, ¯িœগ্ধ-শৈল্পিক জগতের নির্মাতা। নিখুঁত ছন্দে ভাবনারাশিকে তিনি কুশলী যতেœ ও মমতায় গেঁথেছেন সুরভিত মাল্যে। সমাজ ও দেশচিন্তন স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঠাঁই করে নেয় ওইসব রচনাপুঞ্জে। যেন এটাই ছিল অমোঘ অনিবার্যতা। ৭৭ বছরের আয়ুষ্কালে তার যে বিপুল রচনাসম্ভার সৃজিত হয়েছে, তার মধ্যে ছড়া বেশ উল্লেখযোগ্যভাবেই তার আপন জায়গায় স্বমহিমায় অধিষ্ঠিত হয়ে আছে।
লোকছড়া যে আমাদের চিরন্তন ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাবহ এক সম্পদ, সেই বিষয়টি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি নিজে
লোকছড়া সংগ্রহে সংকলনে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। এই প্রসাদ পরম্পরাক্রমে আমরা উপভোগ করছি, এতকাল পরও। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লোকছড়ার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ মূল্যায়নে নিবিষ্ট ছিলেন। এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন তিনি, “...আমাদের ভাষা ও সমাজের ইতিহাস নির্ণয়ের পক্ষে সে ছড়াগুলির বিশেষ মূল্য থাকিতে পারে, কিন্তু তাহাদের মধ্যে যে সহজ স্বাভাবিক কাব্যরস আছে, সেইটিই আমার নিকট অধিকতর আদরণীয় বোধ হইয়াছিল।...”কবি শামসুর রাহমানের ছড়াসমগ্র প্রথম প্রকাশিত হয় তার ৭০তম জন্মদিন উপলক্ষে, ১৯৯৮ সালে। ২২৪ পৃষ্ঠার বইটি বের করেছিল জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন। কবির মৃত্যুর অনেক বছর পরে ২০১৭ সালে আবারও
কথাপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে ছড়াসমগ্র। এটি পরিবর্ধিত সংস্করণ। নতুন অনেক লেখা এতে সংযোজিত হয়েছে। কথাপ্রকাশের এ বইটি সংকলন ও সম্পাদনা করেছেন সুজন বড়ুয়া। প্রথমবার যখন ছড়াসমগ্র বের হয়, কবির স্বল্পসংখ্যক শুভানুধ্যায়ীর দীর্ঘকালীন পীড়াপীড়ি ও সনির্বন্ধ নিরন্তর তাগিদ ছিল সেই প্রকাশনার নেপথ্যে। বর্তমান লেখক তাদের অন্যতম। ছড়াসমগ্রর ভূমিকা তথা ‘প্রাক্কথন’-এ কবি শামসুর রাহমান তার সরস কলমে লেখেন, “যখন খুব ছোট ছিলাম, কারও মুখে ছড়া শুনেছিলাম বলে মনে পড়ে না। এটা কোনো শিশু কিংবা বালকের জন্য সুখকর কথা নয়। অথচ আজকাল কত শিশুকে চমৎকার ছড়া বলতে শুনি। আমার ছেলেবেলায় যারা ছোট ছিল, তারা অনেকেই নিশ্চয়ই ছড়া শুনত আর নিজেরা দুলে দুলে আওড়াত। আমার বেলা সেটা ঘটেনি বলে আমার অনেক কষ্ট হয় আজও। তবে আমার নানী দুপুরবেলা আমাকে খাইয়ে-দাইয়ে শীতল পাটিতে শুইয়ে তালপাতার হাতপাখা চালাতে চালাতে তার ছোট নাতিটিকে ঘুম পাড়াতেন। তিনি ঘুমপাড়ানি মাসিপিসিকে না ডেকে ছোট ছোট গল্প শোনাতেন। সেসব গল্পে রাজপুত্র, রাজকন্যা, পঙ্খিরাজ, ঘোড়া, রাক্ষস-খোক্কস আর মস্ত বড় পাষাণপুরীর কথা থাকত। বড় ভালো লাগত সেসব গল্প শুনতে। কখনো-কখনো বন্দিনী ঘুমন্ত রাজকন্যার গল্প শুনতে শুনতে নিজেই ঘুমিয়ে পড়তাম।
ছড়ার সঙ্গে আমার পরিচয় অনেক পরে, যখন আমি রীতিমতো বড়সড়। এখানে বলা দরকার, ছেলেবেলায় যোগীন্দ্রনাথ সরকারের ছোটদের জন্য লেখা ‘হাসিখুসি’ বইটিতে হারাধনের দশটি ছেলে বিষয়ে একটা স্মরণীয় ছড়া পড়েছিলাম। তখন সেই ছড়া পড়ে মন কেমন করেছিল ছেলেগুলোর জন্য। বয়স বাড়ার পর অবশ্য বহু ছড়া পড়েছি। এখনো পড়ি। লোকজ ছড়া, রবীন্দ্রনাথ, সুকুমার রায়, অন্নদাশঙ্কর রায় এবং আরও অনেকের মনকাড়া ছড়া। লোকজ ছড়া ভেঙে নিজের মতো করে পাকিস্তানি আমলের হাল-হকিকত এবং তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বেশ কিছু ছড়া লিখেছি। কখনো কখনো সাম্প্রতিক ঘটনাও আমার ছড়ায় ঠাঁই করে নেয়। তবে শুধু বাস্তব ঘটনাই আমার ছড়ার বিষয়বস্তু নয়, কল্পনার রাজ্যের কথাও অনেক জায়গা জুড়ে থাকে।
তরুণ কবি-সাংবাদিক হাসান হাফিজ কিছুকাল থেকে আমাকে ছড়াসমগ্র প্রকাশের জন্য তাগিদ দিয়ে আসছেন। আসলে এই নাছোড় তরুণ সহযাত্রীর উদ্যোগেরই ফসল এই বই। পরবর্তীকালে তরুণ নিষ্ঠাবান ছড়াকার রহীম শাহ আমার বই প্রকাশের জন্য যে শ্রম এবং প্রীতির পরিচয় দিয়েছেন তা আমি কোনোদিন ভুলব না। প্রতিভাবান শিল্পী ধ্রুব এষের খুব অল্প সময়ে বইয়ের প্রচ্ছদ অঙ্কন এবং অলঙ্করণের দায়িত্ব পালন আমাকে প্রীত করেছে।...”
এবার আমরা কবি শামসুর রাহমানের ছড়াভুবনে প্রবেশ করব। স্বল্প সময়ের চকিত পর্যবেক্ষণে সীমিত রস আস্বাদনেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। ‘বক মামা’ শিরোনামের ছড়ায় আমরা দেখি স্বপ্নজগতের সঙ্গে রূঢ় বাস্তবতার দ্বন্দ্ব। বক মামাকে মাছ এনে দিতে বলা হচ্ছে ওই ছড়ায়। বিনিময়ে কানাকড়ি দেওয়া হবে বককে। সেই কড়ি দিয়ে বক যেন চরে বসে তেলেভাজা খায়। ওই ছড়ার শেষাংশে নগরজীবনের দুর্দশা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে খুবই অল্প কথায়,
ঘরে এলে তোমায় আমি
খেতে দেব কী?
খেতে দেব চালের কাঁকর
দেব ভেজাল ঘি।
চিলে কান নিয়েছে। সবাই যাচাই-বাছাই না করে ছুটছে তো ছুটছেই। পরে দেখা গেল কান রয়েছে ঠিক জায়গাতেই। ‘প-শ্রম’ নামের এই ছড়াটি স্কুলের পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত ছিল। লোকছড়াকে বর্তমান জীবনের সঙ্গে ব্লেন্ডিং করে নতুনভাবে উপস্থাপনার প্রয়াস আমরা লক্ষ করি। নতুন শব্দের ব্যঞ্জনাও এই ছড়ার সম্পদ। ‘আয় ঘুমানি’ ছড়ায় তিনি বলছেন :
আয় ঘুমানি আয়,
পক্ষী উড়ে যায়,
ঝুরঝুরানি ছায়া
দিল খুকির গায়।
নদীর পানি ফুরফুরানি,
লাগছে দোলা নায়।
আয় ঘুমানি আয়
স্বপ্ন নিয়ে আয়।
মাত্র চারটি পঙ্ক্তিতে নগরজীবনের চিত্র কবি শামসুর রাহমান তুলে ধরেছেন ‘কলতলাতে’ নামের ছড়ায়।
কলতলাতে ভিড় জমেছে
পানি হবে আনতে।
কিউ দিয়েছে কলসিগুলো
নোংরা গলির প্রান্তে।
মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, মৌলবাদের কুফল, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে অনায়াসে তিনি উপজীব্য করেন ছড়ায়। কাজটি বেশ কঠিন। কিন্তু প্রতিভা, শিল্পকুশলতা, নিষ্ঠার বৈগুণ্যে তা কঠিন থাকে না শেষ অব্দি। সহজ সরল ভাষায় সৃজিত সেসব ছড়ার আবেদন খুব সহজেই পাঠকের মর্ম ছুঁতে সমর্থ হয়।
শত্রুসেনা বাংলা জুড়ে
ক্ষণে ক্ষণে জুলুম করে।
শহর এবং গ্রাম পোড়াল,
লাশ সাজাল থরে থরে।
তাই-না দেখে বীর বাঙালি
বনবাদাড়ে, মাঠে লড়ে।
মুক্তিসেনার দীপ্ত চোখে
প্রতিশোধের আগুন ঝরে।
অত্যাচারী শত্রুসেনা
যুদ্ধে হেরে যাওয়ার পরে
টুকটুকে লাল স্বাধীনতা
এল সবার সুখের ঘরে।
(টুকটুকে লাল স্বাধীনতা)
বাংলাদেশ বন্যাপ্রবণ দেশ। ফিবছর বানভাসি মানুষের কষ্ট দুর্ভোগ ছড়াশিল্পী শামসুর রাহমানের মনকে পীড়িত, বেদনার্ত করে। বন্যা নিয়ে গ্রাম বাংলার সাধারণ মানুষের কষ্ট লানত নিয়ে তিনি লিখেছেন বেশ কয়েকটি ছড়া।
ঘর হারানো মা ব’সে রয়
কোলে রুগ্ণ ছেলে।
বাঁচবে ছেলে একটু খাবার,
একটু ওষুধ পেলে।
বাড়ছে পানি চতুর্দিকে,
বাঁধও যাচ্ছে ফেটে।
হাত মেলালে সবাই শেষে
বিপদ যাবে কেটে।
(বানের জুলুম)
ছড়া অন্যায় অসঙ্গতি অবিচার জুলুমের বিরুদ্ধে হুল ফোটায়। প্রতিবাদ করে। ব্যঙ্গ শ্লেষের চোখা অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে। সে আক্রমণ অব্যর্থ। এমনি একটি ছোট্ট ছড়ার নাম ‘ফাও’-
ফাও পেতে চাও? ফাও?
ওয়াসার কাছে চাও।
পানির সঙ্গে পাবে
গুবরেপোকার ছা-ও।
মোক্ষম ছড়ায় ছান্দিক ব্যঙ্গনৈপুণ্য। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। আগেই বলেছি, কবি শামসুর রাহমানের ছড়া কত প্রাসঙ্গিক।
এই ছড়াশিল্পী মৌলবাদের অন্ধকার তাড়ানোর অঙ্গীকার করেন। তার সেই চিন্তন ফুটে ওঠে ছড়ার শরীরে।