বুধবার, ২১ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

বাস্তবে আধা যন্ত্র আধা মানব যারা

সাইফ ইমন

বাস্তবে আধা যন্ত্র আধা মানব যারা
বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর বদৌলতে রোবোকপ কিংবা টার্মিনেটর ইত্যাদি কাল্পনিক আধা যন্ত্র আধা মানব চরিত্র অনেক আগে থেকেই মানুষের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়। ম্যানফ্রেড ক্লাইনেস এবং নাথান ক্লেইন ১৯৬০ সালে সর্বপ্রথম ‘সাইবর্গ’ বা ‘আধা যন্ত্র আধা মানব’ টার্মটি উদ্ভাবন করেন। কিন্তু বর্তমান প্রযুক্তির অগ্রযাত্রার ফলে সাইবর্গরা এখন আর শুধু কল্পনার চরিত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বাস্তবের সাইবর্গদের নিয়ে আজকের রকমারি...

 

 

সাইবর্গ বা আধা যন্ত্র আধা মানব কী?

‘Cybernatic Organism’ শব্দদ্বয়ের সম্মিলনে গড়ে উঠেছে Cyborg’ শব্দটি। প্রকৃতপক্ষে সাইবর্গ বলতে বোঝায় এমন এক সত্তা যার মাঝে জৈবিক অংশের সঙ্গে যান্ত্রিক অংশের সমন্বয় ঘটেছে, প্রযুক্তির ছোঁয়ায় যার ক্ষমতা স্বাভাবিকের গন্ডিকে অতিক্রম করতে পেরেছে। এক কথায় সাইবর্গ মানে মানবশরীর আর প্রযুক্তির এক অভুত মেলবন্ধন। এই সাইবর্গ প্রযুক্তি দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ধারণা করা হচ্ছে, সামনের দিনগুলোতে সাইবর্গ প্রযুক্তি মানবজাতির বিবর্তনে রাখবে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। সেইসঙ্গে এই প্রযুক্তির সহায়তায় চিন্তাশক্তির মাধ্যমে শুধু যন্ত্র নয়, প্রায় সব কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।

 

নিজেই যখন নিজের সাইবর্গ কারিগর

কেভিন ওয়ারউইক

পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত যত সাইবর্গ হয়েছেন সবাই কোনো না কোনো সীমাবদ্ধতা দূর করতেই সাইবর্গের খাতায় নাম লিখিয়েছিলেন। কিন্তু কেভিন ওয়ারউইক তার ব্যতিক্রম। ‘ক্যাপ্টেন সাইবর্গ’ নামে সুপরিচিত কেভিন ওয়ারউইক ইউনিভার্সিটি অব রিডিংয়ের একজন প্রফেসর। কেভিন ওয়ারউইক তৈরি করেছেন শরীরে স্থাপনযোগ্য মাইক্রোচিপ, যা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন অনেক কিছু। ১৯৯৮ সাল থেকেই তিনি নিজের শরীরে নানা রকম মাইক্রোচিপ বসিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা চালিয়ে আসছেন। তিনি তার বাহুতে লাগিয়েছেন এমন এক মাইক্রোচিপ যার সাহায্যে তিনি ঘরের লাইট, ফ্যান, টিভিসহ নানা রকম ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।

 

বিশ্বের প্রথম স্বীকৃত সাইবর্গ

নিল হারবিসন

নিল হারবিসন বিশ্বের প্রথম আইন স্বীকৃত সাইবর্গ। তবে তিনি যান্ত্রিক রোবট নন। ৩২ বছর বয়সী হারবিসন জন্ম থেকেই বর্ণান্ধ। প্রযুক্তি তাকে মুক্তি দিয়েছে শারীরিক সীমাবদ্ধতা থেকে। তার খুলির মধ্যে অপারেশন করে বসানো হয়েছে অ্যান্টেনা। যেটির তরঙ্গের মাধ্যমে তার কানে পৌঁছে যায় কোন জিনিসটির কী রং। ২০০৪ সালে হারবিসনের জন্য মন্টানডন পাঁচ কিলোগ্রামের এক কম্পিউটার সংযুক্ত অ্যান্টেনা বানিয়ে দেন। ওই কম্পিউটার সংযুক্ত অ্যান্টেনা ৩৬০টি ভিন্ন শব্দতরঙ্গের মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন রংয়ের অনুবাদ করত, আর হেডফোনের মাধ্যমে ওই শব্দতরঙ্গ শুনে কোনটির কী রং তা বোঝার চেষ্টা করেন হারবিসন।

 

বিশ্বের প্রথম মহিলা সাইবর্গ

ক্লডিয়া মিশেল

দুর্ঘটনায় অনেক সময় অনেকের অঙ্গহানি ঘটে। কিন্তু প্রযুক্তি আমাদের নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এখন আমরা অনেকাংশেই শারীরিক সীমাবদ্ধতা জয় করতে পারছি। এমনই একজন বিশ্বের প্রথম মহিলা সাইবর্গ ক্লডিয়া মিশেল। মেরিন কর্পে কর্মরত মিশেল একদিন এক মোটরবাইক দুর্ঘটনায় একটি হাত হারিয়ে ফেলেন। এরপর তার শরীরে স্থাপন করা হয় এক বায়োনিক হাত যা তার শরীরের নার্ভাস সিস্টেমের সঙ্গে সংযুক্ত। এই রোবটিক হাতের সাহায্যে মিশেল এখন প্রায় সব ধরনের স্বাভাবিক কাজ করতে পারেন। তিনিই পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম রোবটিক হাতের সাহায্যে রান্নাবান্না, কাপড় ভাঁজ করাসহ প্রায় সব গৃহস্থালির কাজ করতে পারেন।

 

প্রথম বায়োনিক হাতযুক্ত সাইবর্গ

জেসি সুলিভান

জেসি সুলিভান নামের এক ইলেকট্রিক্যাল লাইন্সম্যান ২০০১ সালের মে মাসে মর্মান্তিক দুর্ঘটনার শিকার হন। এই দুর্ঘটনায় তিনি তার দুটি হাতই হারান। এর ফলে তার জীবন হয়ে পড়েছিল অর্থহীন। সে সময় শিকাগোর পুনর্বাসন কেন্দ্র তাকে বায়োনিক বা রোবটিক হাত লাগানোর প্রস্তাব দেয়। স্বাভাবিকভাবেই শিকাগোর পুনর্বাসন কেন্দ্রের প্রস্তাবে সানন্দে রাজি হয়ে যান সুলিভান। হয়ে ওঠেন বিশ্বের প্রথম বায়োনিক হাতযুক্ত সাইবর্গ। কৃত্রিম হাত দুটি তার শরীরের নার্ভাস সিস্টেমের সঙ্গে যুক্ত। তিনি স্বাভাবিক হাতের মতোই রোবটিক হাত দুটিকে মস্তিষ্কের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। তার বিশেষত্ব কোনো জিনিস মুঠো করে ধরলে কত জোরে চাপ দিয়ে ধরছেন সেটাও বুঝতে পারেন।

 

তৃতীয় কানের পারফরমেন্স সাইবর্গ

স্টেলিউস আর্কাডিও

স্টেলিউস আর্কাডিও বা স্টেলার্ক নামেই যিনি বেশি পরিচিত এই সাইবর্গ। পেশায় তিনি একজন পারফরমেন্স আর্টিস্ট। নিজের বাহুতে স্থাপন করেছেন তৃতীয় একটি কান। হ্যাঁ, বিষয়টি খুব উদ্ভট মনে হলেও সত্য। ১৯৯৬ সালে তিনি এই কান লাগানোর পরিকল্পনা করছিলেন। কিন্তু তখন প্রযুক্তি সহায় ছিল না। অনেক পরে ২০০৭ সালে একটি অপারেশনের মাধ্যমে তিনি তার চামড়ার নিচে একটি কৃত্রিম কান স্থাপন করতে সক্ষম হন। এটি এখন তার শরীরেরই একটি অংশ। স্টেলার্কের পরিকল্পনা ছিল বিশাল। উদ্দেশ্য ছিল পৃথিবীর সবাই যেন সব সময় তাকে শুনতে পায়! এই প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে কানটির মধ্যে ছোট্ট একটি মাইক্রোফোন বসানো হয়েছে। যাতে করে এটি ওয়াইফাই হটস্পটের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে ইন্টারনেটের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে ২৪ ঘণ্টা।

 

বায়োনিক লেগ নিয়ে দৌড়ান নিয়মিত

জ্যাক ভাওটার

মাইন্ড কন্ট্রোলার বায়োনিক লেগ ধারণাটা খুব বেশি আগের নয়। ২০১২ সালে মাইন্ড কন্ট্রোলার বায়োনিক লেগ প্রথম ব্যবহৃত হয়। জ্যাক ভাউটার এটি ব্যবহার করেছিলেন।

কারও আইকিউ স্কোর যদি ১৪০-এর বেশি হয় তবে তিনি জিনিয়াস। জ্যাক ভাউটারও একজন জিনিয়াস। একটা দুর্ঘটনায় জ্যাক ভাওটার তার পা হারান। এরপর সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার জ্যাক ভাওটার লেগে পড়েন এই কৃত্রিম পা তৈরিতে। তিনি চেয়েছিলেন এমন একটি পা তৈরি করতে যেটি মস্তিষ্কের সিগন্যাল অনুযায়ী চলবে। যেমন করে আমাদের হাত-পা পরিচালিত হয়। একসময় তিনি সফল হন এবং ব্যবহার করতে শুরু করেন বায়োনিক লেগ।

 

বায়োনিক দুই পা এবং এক হাতের সাইবর্গ 

ক্যামেরুন ক্ল্যাপ

জীবন শুরু করেছিলেন একজন অ্যাথলেট হিসেবে। জনপ্রিয়ও হয়ে উঠেছিলেন অল্প দিনের মধ্যেই। কিন্তু অতিরিক্ত মদ্যপানের অভ্যাস ছিল ক্যামেরুন ক্ল্যাপের। এই মদ্যপানই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এক দুর্ঘটনায় দুই পা এবং এক হাত হারান ক্যামেরুন। এক ট্রেনের ধাক্কায় ছিটকে পড়েছিলেন তিনি। দীর্ঘ চিকিৎসার পর তার দুই পা এবং হাতের বদলে প্রস্থেটিক হাত এবং পা সংযুক্ত করা হয়। প্রায় সব কাজই করতে পারেন তিনি। যেটা দেখে মনে হয় এটা স্বাভাবিক মানুষের হাতের মতোই কর্মক্ষম। তিনি স্বাভাবিক পা এবং হাতের মতোই রোবটিক হাত এবং পা দুটিকে মস্তিষ্কের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। তিনি এখন শিশুদের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন।

সর্বশেষ খবর