রবিবার, ২৫ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

পুড়ছে আমাজন কাঁদছে পৃথিবী

সাইফ ইমন

পুড়ছে আমাজন কাঁদছে পৃথিবী

পৃথিবীতে যতটুকু অক্সিজেন আছে তার ২০ শতাংশ আসে আমাজন বন থেকে। প্রতিবছর ২০০ কোটি মেট্রিক টন কার্বন-ডাই অক্সাইড শোষণ করে এই বন। যে কারণে ‘পৃথিবীর ফুসফুস’ বলা হয় একে। এই ফুসফুস খ্যাত আমাজন আজ হুমকির মুখে। চলমান দাবানলে প্রতি মিনিটে আমাজন প্রায় ১০ হাজার বর্গমিটার এলাকা পুড়ে যাচ্ছে। এভাবে পুড়তে থাকলে জলবায়ু পরিবর্তনবিরোধী আন্দোলনে বিশাল প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে বলে বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা। চলতি বছরে এখন পর্যন্ত আমাজনের ব্রাজিল অংশে ৭২ হাজার ৮৪৩টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে, গত বছরের তুলনায় যা ৮০ শতাংশ বেশি...

 

 

ফ্রান্সিস দে ওরেলানা। স্প্যানিশ এই পর্যটক প্রথম মানুষ যিনি আমাজন নদী ধরে পৌঁছে যান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রেইন ফরেস্ট আমাজনে। যার আয়তন ৫৫ লাখ বর্গ কিলোমিটার। এই বনের বুক চিরে বয়ে গেছে আমাজন নদী। যে নদী প্রতি সেকেন্ডে ৪.২ মিলিয়ন ঘন ফুট পানি নিয়ে ফেলে সাগরে। গোটা পৃথিবীর ২০ শতাংশ অক্সিজেন উৎপাদন করে আমাজন। যে কারণে আমাজনকে বলা হয় পৃথিবীর ফুসফুস। প্রায় ৪০০-এর বেশি  গোত্রের আদিবাসীর বসবাস এই বনে। যাদের বেশির ভাগেরই আধুনিক পৃথিবীর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। এখনো আমাজনের বহু গহিন স্থানে মানুষের পা পড়েনি। সোনার শহরের খোঁজে শত শত বছর ধরে এই বনেই ছুটে এসেছেন অভিযাত্রীরা। নানা রহস্য আর রোমাঞ্চ আমাজনের আসল সৌন্দর্য। কিন্তু পৃথিবীর ফুসফুস আজ বিপন্ন। আগুনের    লেলিহান শিখা ক্রমশ গ্রাস করছে ওই চিরহরিৎ বনভূমিকে। ব্রাজিলের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘ইনপে’-র সমীক্ষা বলছে, এ বছর আমাজন বৃষ্টি-অরণ্যে ৭২,৮৪৩টি দাবানলের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে। গত বছরের এই সময়ের তুলনায় যা ৮৩% বেশি! এবং ২০১৩-এর   তুলনায় দ্বিগুণ! এই প্রকোপ আগের সব রেকর্ড ছাপিয়ে গিয়েছে বলে দাবি ব্রাজিলের ওই সংস্থার। মুখ ঢাকা পড়েছে সূর্যের। যে দিকে তাকানো যায় শুধু কুণ্ডলি পাকানো ধোঁয়া। ছাড় পায়নি ২৭০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ব্রাজিলের সাও পাওলোর আকাশ। দুপুরের আকাশ যেন রাতের চেয়েও অন্ধকার।   ব্রাজিলের রোরাইমা প্রদেশ থেকে পেরুর আকাশেও হানা দিয়েছে ধোঁয়া। মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসার উপগ্রহ চিত্রেও ধরা পড়েছে আমাজনে ঘটতে থাকা ৯৫০৭টি নতুন দাবানলের চিত্র। আমাজনের আগুনের ওপর নজর রাখছে নাসা। আগুনের তীব্রতার ছবিও পাঠাচ্ছে নাসার একাধিক স্যাটেলাইট। তবে আগুনের থেকেও বিজ্ঞানীদের বেশি ভাবাচ্ছে আগুন থেকে উৎপন্ন ধূম্রজাল। প্রায় ১৭০০ কিমি দূরত্ব পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে কালো ধোঁয়া।

 

কীভাবে এই দাবানল

বৃষ্টিপ্রবণ অঞ্চল হওয়ায় বছরের বেশিরভাগ সময় ওই বৃষ্টি-অরণ্যে জুলাই-আগস্ট মাসে আমাজনের আবহাওয়া কিছুটা শুষ্ক হয়ে ওঠে। তবে স্থানীয় পরিবেশবিদদের ধারণা, প্রাকৃতিকভাবে এই আগুন লাগেনি। ব্রাজিলের ফেডেরাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের একাংশ বলছেন, শুকনো বাতাসে দাবানল জ্বলে ওঠা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে এ ক্ষেত্রে দাবানলের প্রকোপে আগুন লাগেনি বলেই মনে করছেন তারা। ওই বিজ্ঞানীদের মতে, অনেক সময়েই চাষের জন্য জমি বা খামার তৈরি করতে ইচ্ছাকৃতভাবে জঙ্গলে আগুন ধরিয়ে দেন স্থানীয় গ্রামবাসীরা।

সেখানেও এমনটাই হয়ে থাকতে পারে।

জলবায়ু বিজ্ঞানী কার্লোস নোব্রে বলেছেন, গবাদি পশুর চারণভূমি হিসেবে জমি ব্যবহার করতে চাওয়া কৃষকরা জায়গা পরিষ্কার করতে শুকনো আবহাওয়ার জন্য অপেক্ষা করেন। এ সময় বন দাহ্য হয়ে থাকে এবং খুব সহজেই তাতে আগুন লাগে। যদিও সাও পাওলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজের গবেষক নোব্রের মতে, আমাজনে কর্মরত এনজিওগুলো কৃষিকাজে আগুন ব্যবহার করে না।

তারা বরং লোকজনকে আগুন ব্যবহার না করতে উৎসাহিত করে।

প্রতি মিনিটে একটি ফুটবল খেলার মাঠের সমান বনাঞ্চল ধ্বংস খনিজ পদার্থের ভাণ্ডার আমাজন অরণ্যে লাগাতার জঙ্গল সাফ করে খনন কাজ চালানো হয়। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি মিনিটে একটি ফুটবল মাঠের মাপের জঙ্গল কাটা হয় এখানে। ফলে স্বল্প বৃষ্টিপাত ঘটে। এটিও আমাজনে আগুন লাগার কারণ হতে পারে। কার্বন ছাঁকনি হিসেবে পরিচিত চিরসবুজের ওই জায়গা দাবানলের পর কার্যক্ষমতা হারাবে সে বিষয়ে নিশ্চিত প্রায় সমস্ত গবেষক।  

রয়েছে রাজনৈতিক কারণ

আমাজনে ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য দক্ষিণপন্থি প্রেসিডেন্ট জাইর বোলসোনারোর নীতিকে দায়ী করছেন পরিবেশবিদরা। এর কারণ ক্ষমতায় আসার আগে কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করেই আমাজন অঞ্চলকে চাষ ও খনিজ উত্তোলনের কাজে ব্যবহারের ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি। তার এ উদ্যোগের ফলে বন উজাড় হয়ে যেতে পারে বলে আন্তর্জাতিক মহলের আশঙ্কা দিনের পর দিন উপেক্ষা করে গেছেন বোলসোনারো। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ আমাজন বনাঞ্চলে চলতি বছরের রেকর্ড অগ্নিকাণ্ডকে ‘আন্তর্জাতিক সংকট’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি এ বিষয়টি জি-৭ সম্মেলনের আলোচ্যসূচির শীর্ষে থাকা উচিত বলেও উল্লেখ করেছেন। তবে তার এ মন্তব্যের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জাইর বোলসোনেরো। কট্টর ডানপন্থি এ প্রেসিডেন্ট বন উজাড়ে কাঠুরে ও কৃষকদের উৎসাহিত করছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। বোলসোনেরো প্রথম দিকে আমাজনের চলতি বছরের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের জন্য এনজিওকে দায়ী করলেও এ দাবির সমর্থনে কোনো প্রমাণ তিনি দেখাতে পারেননি। গত বৃহস্পতিবার অবশ্য তিনি তার অবস্থান থেকে সরে এসে ‘কৃষকরাও বনে আগুন দিতে পারে’ এমন মন্তব্যও করেছেন।

৭২ হাজার অগ্নিকাণ্ড আমাজনে অন্তত ৭২ হাজার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। যার ফলে মৃত্যু হয়েছে অনেক পশুপাখিরও। আগুন লাগার ফলে কার্বন-ডাই অক্সাইড ছাড়াও কার্বন মনোক্সাইড বিষাক্ত গ্যাস নির্গত হচ্ছে।  বিশ্বের সবচেয়ে বড় চিরহরিৎ বনাঞ্চল আমাজন বিপুল পরিমাণ কার্বন জমা রেখে বৈশ্বিক উষ্ণতার গতিকে খানিকটা শ্লথ রেখেছে।

আগুন নিয়ন্ত্রণে সেনা মোতায়েন

আমাজনের এই অগ্নিকাণ্ড এবং পরিস্থিতি নিরসনে ব্রাজিলের বর্তমান সরকারের অবস্থান নিয়ে বিশ্বজুড়েই তীব্র প্রতিবাদ ও ক্ষুব্ধ        প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। নিন্দা ও সমালোচনার মুখে পৃথিবীর এই ফুসফুস আমাজনের আগুন নিয়ন্ত্রণে সেনা সদস্যদের পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট। শুক্রবার   প্রেসিডেন্ট জাইর বোলসোনারো এ সংক্রান্ত একটি ডিক্রি জারি করেছেন। এর আগে গত এক সপ্তাহেই স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ৯ হাজার ৫০০ স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে। এদিকে  চলমান এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে গত শুক্রবার ফ্রান্স ও আয়ারল্যান্ড ঘোষণা করেছে আমাজনের আগুন নিয়ন্ত্রণে ব্রাজিল পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না নিলে তারা দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি নবায়ন করবে না। এ ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে ব্রাজিলের মাংস আমদানি বন্ধের আহ্বান জানায় ফিনল্যান্ড।

 

বিস্ময়ের শেষ নেই

আমাজনের প্রাণী-বৈচিত্র্যর পাশাপাশি উদ্ভিদ লক্ষণীয়। সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন আমাজনের গাছের প্রজাতির সংখ্যা এবং বৈচিত্র্য অনেক বেশি হওয়ায় এদের তালিকা তৈরি করতে তিনশ বছর লেগে যাবে। এরই মধ্যে জাদুঘরে রাখা ৫ লাখেরও বেশি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এ পর্যন্ত গাছের প্রায় ১২ হাজার প্রজাতি আবিষ্কৃত হয়েছে। এসব তথ্যের ভিত্তিতে অনুমান করা হয়, গাছের আরও প্রায় চার হাজার বিরল প্রজাতি আবিষ্কারের এবং বর্ণনা আকারে লিপিবদ্ধ হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। আমাজনে দেখা মিলবে মাংসখেকো গাছের। অনেকেই এ ধরনের গাছকে মানুষখেকোও মনে করেন। এই গাছের আঠায় প্রজাপতি, ফড়িংয়ের  মতো ছোট প্রাণীরা আটকে যায়। তখন গাছের পাতা ঢেকে গিলে নিতে শুরু করে। আমাজনে শুধু ভয়ঙ্কর প্রাণী আর গাছের দেখাই মিলবে না, মিলবে চোখ ধাঁধানো ফুলগাছেরও। তেমনি একটি গাছ ‘লবস্টার ক্ল ফ্লাওয়ার’। এই ফুলটি লম্বায় দেড় থেকে ১৫ ফুট পর্যন্ত হতে পারে। এর একেকটি পাতা ৬ থেকে ১০ ফুট পর্যন্ত প্রসারিত হয়। এ ছাড়া আমাজন অর্কিডের দিক থেকেও বেশ সমৃদ্ধ। এ বনে ৩ হাজারেরও বেশি প্রজাতির অর্কিড রয়েছে। এ বনে আছে রাবার গাছ। আমাজনের সবচেয়ে দামি গাছগুলোর মধ্যে এটি একটি। আমাজনের রাবার গাছগুলো ১০ তলা দালানের সমান উঁচু হয়ে থাকে। চকো-বীন বা চকলেট উৎপাদনকারী গাছেরও ঠিকানা আমাজন। আমাজনের গভীরে কফি গাছের দেখা পেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। দৈত্যাকার পদ্মের দেখা মিলবে এ বনে। ভিক্টোরিয়া আমাজোনিকা আমাজনের এক বিস্ময়। প্রায় ৩ ডায়ামিটারের এই পদ্ম শুধু আমাজনের গহিনেই দেখা মেলে। রয়েছে পাসিফ্লোরা।

এটি এক ধরনের ফ্রুট ফ্লাওয়ার। প্রতিবছর এ ফুল গাছ প্রায় ২০ ফুট পর্যন্ত বাড়ে।

 

ক্রমাগত চলছে ধ্বংসের উৎসব

আবহাওয়া, ভৌগোলিক অবস্থান, ক্রমাগত বিরূপভাবে পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক জলবায়ু, মানুষের করাল আঘাতসহ নানা কারণে ধ্বংস হচ্ছে আমাজন। গত ৪০ বছরে আমাজনের শতকরা প্রায় ২০ ভাগ ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। ২০০৪ সালে আমাজনের ২৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার বন উজাড় হয়েছিল, যা একটি রেকর্ড। সয়া এবং গম চাষ আমাজনের রেইন ফরেস্ট উজাড়ের জন্য অনেকটা দায়ী। পারার কাছের শহর গড়ে তুলতে ৪০০ হেক্টর জমি পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল আমাজনের। বন উজাড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে সেখানকার কাঠ। অবৈধভাবে উজাড় হওয়া আমাজন এখন চারণ ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আমাজনের ভিতরে সোনার খনি খুঁজে বেড়ায় সংঘবদ্ধ চোরাকারবারিরা। শত শত বছর ধরে আমাজন এই সোনা সন্ধানী চোরাকারবারিদের হাতে ধ্বংস হচ্ছে। প্রতিদিনই আমাজনকে ধ্বংস করে চলেছে মানুষ। প্রতিদিন, প্রতি মিনিটে ১৫০ একর এবং বছরে ৭৮ মিলিয়ন একর করে ধ্বংস হচ্ছে আমাজন।

 

আমাজনের মানুষ ওরা

আধুনিক সভ্যতা থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন আমাজনে বসবাস করা উপজাতিদের নিয়ে সাধারণ মানুষের প্রবল কৌতূহল রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, আমাজনের গহিনে মানুষখেকো মানুষের বসবাস রয়েছে। এর পক্ষে-বিপক্ষে নানা যুক্তি থাকলেও এটা সত্যি যে, মানুষের অজানা অনেক নৃগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে আমাজনে। আমাজনের বলিভিয়া অঞ্চলে পৃথিবীর সবচেয়ে সুস্থ হার্টের মানুষেরা বসবাস করেন। ধারণা করা হয়, আমাজনে প্রায় ৪০০-এর বেশি আদিবাসী গোত্রে ভাগ হয়ে অন্তত ২ লাখ মানুষের বসবাস। এদের সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায়নি। কিছু নৃগোষ্ঠী যাযাবর প্রকৃতির। বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে এদের যোগাযোগ তেমন একটা নেই বললেই চলে। বেশিরভাগ গোত্রের আদিবাসীর নিজস্ব ভাষাও রয়েছে। সম্প্রতি আলোচিত হয়েছে ব্রাজিলের আমাজন জঙ্গলে সন্ধান পাওয়া এক আদিবাসী গোত্রের। এই গোত্রটিতে প্রায় ২০০ সদস্য বসবাস করেন। তারা আমাজন অরণ্যের পেরুর সীমান্ত-সংলগ্ন এলাকায় বসবাস করেন। গোত্রটির নাম ‘আনকন্টাকটেড’। তারা জঙ্গলে বিভিন্ন পশুপাখি শিকার করে জীবন কাটান। আধুনিক সভ্যতা কিংবা আমাজন জঙ্গল ছাড়া এলাকার বাইরের রাজ্য সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই। এ বছর ব্রাজিলের আক্রে রাজ্যের জিনানে নদীর অববাহিকায় বিমানে করে একদল ফটোগ্রাফার ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় তাদের দেখতে পান এবং ছবি তোলেন। এসব ছবিতে দেখা যায় আদিবাসীরা বিমান দেখে ঘাবড়ে গেছেন এবং সবাই একসঙ্গে বর্শা উঁচিয়ে বিমানকে ভয় দেখাচ্ছেন। এমন আদিবাসী গোত্রের কথা প্রায়ই জানা যায়। সত্যি বলতে, আমাজনের আদিবাসীদের উৎপাত করতে চায় না কেউ। তারা নিজেদের মতোই বনে বসবাস করছেন যুগের পর যুগ।

 

আরেক বিস্ময়!

আমাজন নদী বয়ে গেছে আমাজন বনের বুক চিরে। আমাজন নদী আমাজনের আরেক বিস্ময়। দক্ষিণ আমেরিকার পেরুর আন্দিজ পর্বতের নেভাদো মিসমি নামক চূড়া থেকে এই নদীর উৎপত্তি। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৬ হাজার ৪০০ কিলোমিটার। আর প্রস্থ কোনো কোনো স্থানে ১০ কিলোমিটার। দক্ষিণ আমেরিকার আন্দিজ পর্বত থেকে শুরু হয়ে পাঁচটি দেশজুড়ে বিস্তৃত আমাজন নদী আটলান্টিক মহাসাগরে গিয়ে মিলিত হয়েছে। বিশ্বের যে কোনো নদীর তুলনায় বেশি পানি এই নদীতে বয়ে যায়। আমাজন নদী যেখানটায় সাগরের সঙ্গে মিশেছে সেখানে প্রতি সেকেন্ডে ৪.২ মিলিয়ন ঘন ফুট পানি সাগরে নামে। বর্ষা মৌসুমে এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৭ মিলিয়ন ঘন ফুট। আমাজনের নদীতে এক দিনে ১৮ হাজার কিউসেক লিটার বেশি পানি প্রবাহিত হয়। আমাজন নদীর প্রাণী-বৈচিত্র্য অসাধারণ। এই নদীতেই দেখা মেলে লম্বায় সাড়ে ৪ মিটারের চেয়েও দীর্ঘ ফ্রেশ ওয়াটার ফিশ, বুল শার্ক, ক্যাট ফিশ, ইলেকট্রিক ইল আর ভয়াবহ রাক্ষুসে মাছ পিরানহা। আমাজন নদী সম্পর্কে একটি মজার তথ্যÑ আমাজন নদী থেকে এত পরিমাণে সুমিষ্ট পানি সমুদ্রে গিয়ে মেশে যে প্রায় ১০০ মাইল পর্যন্ত সমুদ্রের পানি কম লবণাক্ত থাকে। পৃথিবীর মোট ২৫ শতাংশ স্বাদু পানি আসে আমাজন থেকেই। আমাজন নদীর মুখ এতই বিশাল, যার জন্য এর নিকটবর্তী দ্বীপ মাজারিও ধীরে ধীরে ডুবে যায়। শুনতে অবিশ্বাস্য হলেও সত্য হলো, মাজারিও আকৃতিতে প্রায় সুইজারল্যান্ডের সমান ছিল। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নদীর প্রবাহ পথটি উল্টে গেছে। একটা সময় থেকে আমাজন নদী পূর্ব থেকে পশ্চিমে  প্রবাহিত হচ্ছে। ১০ মিলিয়ন বছর আগে আমাজনের বেসিন তৈরি হয়েছিল অন্য একটি নদীর দ্বারা যা পশ্চিমের দিকে প্রবাহিত হয়ে উত্তরাংশের আন্দিজে একটি বিশাল লেকে মিলিত হতো। তবে বিস্ময়ের এখানেই শেষ নয়। বিজ্ঞানীরা আমাজন নদীর নিচে আরও একটি নদীর খোঁজ পেয়েছেন। প্রস্থে তা আমাজনের চেয়ে দ্বিগুণ বড়। আমাজন অববাহিকায় নদীর ৪ কিলোমিটার গভীরে এই নদীটি বহমান। নাম রিও হামজা।

 

মিথ্যা নয় সত্যি!

সোনার সন্ধানে স্প্যানিস কিছু মানুষ আমাজনে প্রবেশ করেছিলেন। তাদের বেশিরভাগই আর ফিরে আসেননি। যে কজন জীবন নিয়ে ফিরতে পেরেছেন তারা বলেছেন, ওই বনে বিষাক্ত পানি আছে। আছে মানুষখেকো সাপ। আর আছে ফুটন্ত নদী, যার পানি নিচ থেকে টগবগিয়ে ফুটছে। সে মিথ এবার বাস্তব হলো। আমাজন বনে সত্যিই রয়েছে ফুটন্ত নদী। এই রহস্যময় নদীর পানির তাপমাত্রা ৮৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর পানি এত গরম যে তাতে মানুষ মারা যেতে পারে। আমাজনের অ্যানাকোন্ডা নিয়েও নানা রকমের মিথ রয়েছে। মানুষ গিলে ফেলা সাপের কথা উঠলেই দৈত্যাকার অ্যানাকোন্ডার দিকে অভিযোগের আঙ্গুল ওঠে। কিন্তু বাস্তবে মানুষের কাছ থেকে দূরে থাকতেই পছন্দ করে এই দৈত্যাকার সাপ। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আকারের এই সাপ আমাজনের আতঙ্ক বলেই জানেন সাধারণ মানুষ। আমাজনের গ্রিন অ্যানাকোন্ডার ওজন প্রায় ১৫০ থেকে ২২৭ কেজি। লম্বায় ২৭ থেকে ৩০ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। শীতল রক্তবিশিষ্ট এই প্রাণীটি রাতে শিকারে বের হয়। এই দৈত্যাকার অ্যানাকোন্ডার তেমন বিষ নেই। এ ছাড়া আমাজনে রয়েছে ব্ল্যাক কেইম্যান কুমির। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কুমির এটি। দৈর্ঘ্যে ৯ থেকে ১৬ ফুট পর্যন্ত লম্বা ব্ল্যাক কেইম্যানের ওজন হতে পারে প্রায় ৪০০ কেজি। আমাজন নদীর সবচেয়ে বড় আকর্ষণ গোলাপি ডলফিন। গোলাপি রঙের ডলফিন মিঠাপানির সবচেয়ে বড় সাইজের ডলফিন। প্রায় সাড়ে আট থেকে সাড়ে নয় ফুট লম্বা এই গোলাপি ডলফিন। এদের মস্তিষ্কের আয়তন মানুষের মস্তিষ্কের চেয়ে শতকরা ৪০ ভাগ বেশি বলে গবেষকদের কাছে গোলাপি ডলফিনের আলাদা গুরুত্ব আছে। আমাজনের অন্যতম প্রাণী হলো পিরানহা। আকারে ছোটখাটো হলেও মাংসাশী পিরানহা খুবই হিংস্র। একঝাঁক পিরানহা যখন একসঙ্গে নদীতে সাঁতরে চলে, তখন তাদের ধারালো দাঁত যে কোনো সাইজের প্রাণীকে মুহূর্তের মধ্যে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে পারে। আমাজনের আদিবাসীরা পিরানহা মাছের দাঁত দিয়ে হাতিয়ার তৈরি করে।

 

অমূল্য বৈচিত্র্যে ভরপুর

গরম আবহাওয়া, বৃষ্টিপাত এবং আর্দ্রতার কারণে এ বনে উদ্ভিদ ও প্রাণীকুলের বৈচিত্র্যময় সমাহার ঘটেছে। বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী ইকোসিস্টেম সমৃদ্ধ আমাজনের বয়স কম করে হলেও ৩ হাজার বছর। এখানে আছে ১২০ ফুট উঁচু গাছ, ৪০ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ, ২৫ লাখ  প্রজাতির কীট-পতঙ্গ, ১ হাজার ২৯৪ প্রজাতির পাখি, ৩৭৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ৪২৮ প্রজাতির উভচর এবং ৪২৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীসহ হাজারো প্রজাতির অজানা জীব-অণুজীব। গবেষকরা শুধু আমাজনের ব্রাজিল অংশেই ১ লাখ ২৮ হাজার ৮৪৩টি অমেরুদন্ডী প্রজাতি আবিষ্কার করেছেন। আমাজনের প্রাণী-বৈচিত্র্যের ছোট একটি উদাহরণ পেলেই চমকে উঠতে হয়Ñ আমাজনে পেরুর অংশের একটি গাছে ৪৩ হাজার প্রজাতির পিঁপড়ার সন্ধান মিলেছে। সমগ্র ব্রিটেনেও এত প্রজাতির পিঁপড়ার দেখা পাওয়া যায়নি এখন পর্যন্ত। চিকিৎসা বিজ্ঞানে যত পথ্য আমরা জানি, তার প্রায় ৩৭ শতাংশ আসে আমাজনের বৃক্ষরাজি থেকে। এখানকার  প্রাণী-বৈচিত্র্য অতুলনীয়। এ বনের স্তন্যপায়ীদের মধ্যে উল্লে­খযোগ্য হলো- জাগুয়ার, গোলাপি ডলফিন (একমাত্র প্রজাতির ডলফিন, যা স্বাদু পানিতে বাস করে), তামানডুয়া, তাপির, মানাতি, ইঁদুর, কাঠবিড়ালি, বাদুড় ইত্যাদি। পাখিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ ঈগল, টুকান, হোয়াটজিন, দ্রুতগামী হামিং বার্ড এবং আরও রং-বেরঙের অনেক পাখি। পৃথিবীর সব পাখির এক-পঞ্চমাংশ এ বনের অধিবাসী। মাছের মধ্যে আছে মাংসাশী লাল পিরানহা, বিপজ্জনক বৈদ্যুতিক মাছ এবং স্বাদু পানির অন্যতম বড় মাছ-পিরারুকু, যার ওজন ১৫০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। উভচর প্রাণীর মধ্যে বিস্ময় জাগাবে লাল চোখের গেছো ব্যাঙ। আছে পয়জন ফ্রগ। রঙিন এই ব্যাঙের ছোঁয়াতেই বিষক্রিয়ায় জীবন হারাতে পারে একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষ। তা ছাড়া রয়েছে কুমির, অ্যালিগেটর, কচ্ছপ প্রভৃতি। এখানকার ইকোসিস্টেম লাখো বছর ধরে টিকে আছে।

 

গোপন ‘সোনার শহর’

আমাজনের ইতিহাস পড়লে জানা যাবে, এই বনের বয়স কম করে হলেও ৩ হাজার বছর হতে চলল। আমাজন প্রাচীনকাল থেকেই অত্যন্ত দুর্গম। অতীতে অভিযাত্রীরা আমাজনে সোনা, রুপা এবং ধন-রত্নের খোঁজে প্রবেশ করতেন। এখনো সেটি অব্যাহত আছে। এই রহস্যঘেরা বনে অফুরন্ত সম্পদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এমনটাই বিশ্বাস মানুষের। যেমন পর্তুগিজ অভিযাত্রীরা বিশ্বাস করতেন, বিশাল এ বনের মধ্যেই কোথাও লুকিয়ে আছে ‘এলডোরাডো’ নামের এক গুপ্ত শহর। ধারণা করা হতো, এই শহরটি পুরোটা সোনার। সেই সোনার শহরের খোঁজ আজও করছেন অভিযাত্রীরা। অনেকে সোনার শহরের গল্প ভ্রান্ত বলেই মানেন। সোনার শহরের ধারণাটি এসেছে গ্রিক পৌরাণিক গল্প থেকে। সে গল্পে বলা হয়েছে ‘এলডোরাডো’ নামক সোনায় মোড়ানো শহরটি পাহারা দেয় একশ্রেণির বিশেষ নারীযোদ্ধা। যাদের গল্পে ‘আমাজন’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। পর্তুগিজ, স্প্যানিশ এবং ফ্রেঞ্চ অভিযাত্রীরা প্রতিযোগিতায় নামেন এই ‘এলডোরাডো’ শহর আবিষ্কারের জন্য। কিন্তু কেউ এই কাল্পনিক শহরের খোঁজ পাননি। শহরের সন্ধান না পেলেও আমাজনের নামটি স্থায়ী হয় সেই নারীযোদ্ধাদের নামে। তাদের নামানুসারেই এই জঙ্গলের নাম হয় ‘আমাজন’।

সর্বশেষ খবর