শনিবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

এখনো রহস্য শীনা বোরা হত্যাকাণ্ড

বয়স পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই ইন্দ্রাণীর। আগুন সুন্দরী এই নারীর প্রেমে পড়েন ক্ষমতাবান পুরুষেরা। প্রেমের খেলায় কম যান না ইন্দ্রাণী। দ্বিতীয় স্বামী ছেড়ে আবার প্রেম জমান স্টার টিভির সিইও পিটার মুখার্জির সঙ্গে। সে প্রণয় বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়। টাকা আর ক্ষমতার লোভ ইন্দ্রাণীর মনে। ছোট শহর ছেড়ে তত দিনে পৌঁছে যান রাজধানী মুম্বাইয়ে। নিজের হাতে পেয়েছেন অঢেল সম্পদ আর ক্ষমতা। সেই ক্ষমতা আর সম্পদে বাধা হয়ে দাঁড়ায় নিজের মেয়ে শীনা বোরা। তাকে খুন করতে বাধেনি মায়ের। নিখুঁত পরিকল্পনা এঁটে খুনের সময় সঙ্গে রাখেন দ্বিতীয় পক্ষের স্বামীকে। মায়ের হাতে মেয়ে খুনের ঘটনায় তোলপাড় চলে পুরো ভারতবর্ষজুড়ে। একে একে বেরিয়ে আসতে থাকে খুনের রোমহর্ষক বর্ণনা। এখনো রহস্য ঘিরে থাকা শীনা বোরা হত্যাকান্ড নিয়ে আজকের রকমারি -

তানিয়া তুষ্টি

এখনো রহস্য শীনা বোরা হত্যাকাণ্ড

শর্ত জুড়ে দেন, তারা বলতে পারবে না যে ইন্দ্রাণী তাদের মা। ভাই-বোন হিসেবে পরিচয় দিয়েই থাকতে হবে। দুই ভাই-বোন সেই শর্তে রাজি হয়ে যান, কারণ মিখাইল ও শীনার তখন টাকার প্রয়োজন ছিল...

 

ভারতে সংঘটিত শীনা বোরা হত্যাকা- নিয়ে চলে ব্যাপক তোলপাড়। মুম্বাইয়ের মেট্রোওয়ানে কর্মরত ছিলেন শীনা বোরা। ২০১২ সালের এপ্রিল মাসে শীনা রহস্যজনকভাবে নিরুদ্দেশ হন। ঘটনার পর তাৎক্ষণিকভাবে মুম্বাই পুলিশ তার মা ইন্দ্রাণী মুখার্জি, গাড়িচালক শ্যামবর পিন্ডোরাম ও সঞ্জীব খান্নাকে হত্যার অভিযোগে গ্রেফতার করে। ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে ঘটনার পুনঃতদন্ত শুরু হলে ইন্দ্রাণী মুখার্জি ও পিটার মুখার্জিকে হত্যা করার ষড়যন্ত্রে অভিযুক্ত দেখিয়ে গ্রেফতার করে পুলিশ। শ্যামবর ও পিটার এই হত্যার অভিযোগ স্বীকার করে নিলেও ইন্দ্রাণী মুখার্জির দাবি, শীনা এখনো জীবিত আছে। পড়াশোনার জন্য সে আমেরিকায় বসবাস করছে। সার্টিফিকেট অনুযায়ী শীনা বোরার বাবার নাম উপেন্দ্র কুমার বোরা আর মায়ের নাম দুর্গারানী বোরা। দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন গুয়াহাটির ডিজনিল্যান্ড স্কুলে। জন্মের তারিখ ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৭, জন্মস্থান মেঘালয়ের শিলংয়ে। অথচ এই উপেন্দ্র কুমার বোরা আর দুর্গারানী বোরা হলেন শীনার প্রকৃত মা ইন্দ্রানী মুখার্জির বাবা-মা। হত্যাকান্ডের পর বাবা সিদ্ধার্থ দাস নামের এক ব্যক্তি দাবি করেন, ১৯৮৭ সালে ইন্দ্রাণী মুখার্জির গর্ভে শীনার জন্ম হয়। একই সঙ্গে নিজেকে শীনার জন্মদাতা বাবা হিসেবেও দাবি করেন। ত্রিপুরার একটি চা-বাগানের মালিক ছিলেন এই সিদ্ধার্থ। সিদ্ধার্থের সঙ্গে যখন বিয়ে হয় তখন ইন্দ্রাণীর বয়স ছিল ২১ বছর। তথ্য পাওয়া যায়, শীনার জন্মের সময় বাবা হিসেবে দাবি করা আসামের করিমগঞ্জে বাস করা সিদ্ধার্থ দাস বাংলাদেশে পালিয়ে গিয়ে পরে কলকাতায় আত্মগোপন অবস্থায় ছিরলন। সিদ্ধার্থ কলকাতায় থাকা অবস্থায় আবারও বিয়ে করেন। সেখানে তার একটি ছেলে রয়েছে। সিদ্ধার্থ দাসের স্বীকারোক্তিতে, ইন্দ্রাণীর সঙ্গে সামাজিকভাবে বিয়ে হয়নি। ঘটনার তদন্ত থেকে জোরালো হয় সিদ্ধার্থ-ইন্দ্রাণী বিয়ের আগেই শীনার জন্ম হয়েছে। সে সময় ইন্দ্রানীর বাবার বাড়িতে থেকে উপেন্দ্র কুমার বোরার সঙ্গে ব্যবসা করেছিল সিদ্ধার্থ দাস। সিদ্ধার্থের দাবি, তার পিতৃত্বে ইন্দ্রাণীর গর্ভে মেয়ে শীনা ও ছেলে মিখাইলের জন্ম হয়। সিদ্ধার্থের এই আত্মগোপনের পর ইন্দ্রাণী একপক্ষীয়ভাবে তাদের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটান। তারপর ৩ বছরের শীনা ও মিখাইলকে উপেন্দ্র কুমার বোরার কাছে দিয়ে নিজের উচ্চ শিক্ষার জন্য কলকাতায় চলে যায়। শীনা ও মিখাইল তখন নানা-নানীকে নিজের বাবা-মায়ের পরিচয় দিয়ে বড় হয়ে ওঠে। কিছুকাল পর ইন্দ্রাণী কলকাতার সঞ্জীব খান্না নামের এক ব্যক্তিকে বিয়ে করেন। ১৯৯৩ সালে ইন্দ্রাণী-সঞ্জীবের ঘরে বিধি নামের এক মেয়ে সন্তান জন্ম নেয়। পরবর্তী সময়ে সঞ্জীবের সঙ্গেও ইন্দ্রাণীর বিচ্ছেদ ঘটে। সঞ্জীবের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর ২০০২ সালে স্টার টিভি নেটওয়ার্কের সিইও পিটার মুখার্জির সঙ্গে বিয়ে হয় ইন্দ্রাণীর। তিনি নিজে সেই সময় স্টারের এইচআর কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করতেন। পিটার ও ইন্দ্রাণীর কোনো সন্তান নেই। যদিও পিটারের আগের সংসারে রাহুল ও বরীন নামের দুটি ছেলে আছে। শীনা ও তার ভাই মিখাইল নানা- নানীর কাছে বড় হওয়ার পর মা ইন্দ্রাণীর সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে। বলতে গেলে জন্মের পর থেকে তারা মাকে কাছে পায়নি। ২০০২ সালে তারা খবরের কাগজে পিটারের সঙ্গে ইন্দ্রাণীর বিয়ের খবর দেখে। তখন ইন্দ্রাণীও গুয়াহাটিতে আসেন বেড়াতে। সেই প্রথম তাদের মায়ের সঙ্গে দেখা। ইন্দ্রাণী ছেলেমেয়ের আর্থিক দায়িত্ব আর পড়াশোনার দায়িত্ব নিতে রাজি। কিন্তু শর্ত জুড়ে দেন, তারা বলতে পারবে না যে ইন্দ্রাণী তাদের মা। ভাই-বোন হিসেবে পরিচয় দিয়েই  থাকতে হবে। দুই ভাই-বোন সেই শর্তে রাজি হয়ে যান, কারণ মিখাইল ও শীনার তখন টাকার প্রয়োজন ছিল। এরপর শীনার জন্য ইন্দ্রাণী মুম্বাইয়ে পড়াশোনা করার ব্যবস্থা করে দেয়। ২০০৯ সালে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক হওয়ার পর ২০১১ সালে অ্যাসিসট্যান্ট ম্যানেজার হিসেবে যোগ দেন রিলায়েন্স এডিএজিতে। কলেজে পড়ার প্রথম দিকেই পিটার মুখার্জির আগের পক্ষের ছেলে রাহুলের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন শীনা। তবে শুরু থেকেই এই সম্পর্ক পছন্দের ছিল না ইন্দ্রাণীর। এরপর ২০১২ সালে হঠাৎই নিখোঁজ হয়ে যান শীনা। ইন্দ্রাণী সবাইকে জানিয়েছিলেন, শীনা বিদেশে পড়তে গিয়েছেন। এরপর বারবারই ছেলে মিখাইলের কাছে শীনা প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়েছেন ইন্দ্রাণী। রাহুল তাকে খোঁজার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন।

 

নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র

২০১৫ সালের প্রায় অর্ধেক সময়ই খবরের শিরোনামে ছিল শীনা বোরা হত্যাকা-। চাঞ্চল্যকর এ হত্যারহস্য নিয়ে কম জল ঘোলা হয়নি। এখনো বিচারাধীন এই কান্ডের অভিযুক্তরা। এই ঘটনা আসে বড় পর্দায়। ‘ডার্ক চকোলেট’ শিরোনামে সেই কাহিনির ছায়াতে নির্মিত বাংলা ক্রাইম থ্রিলার চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছেন পরিচালক অগ্নিদেব চট্টোপাধ্যায়। এটি মুক্তি পায় ২ সেপ্টেম্বর ২০১৬ সালে। ছবিতে শীনা বোরার চরিত্রে অভিনয় করেছেন কিংবদন্তি অভিনেত্রী সুচিত্রা সেনের নাতনি রিয়া সেন। চলচ্চিত্রে এই চরিত্রটির নাম রিনা বর্ধণ। শীনার মা ইন্দ্রাণী মুখার্জির ভূমিকায় অভিনয় করেছেন মহিমা চৌধুরী। বলিউড অভিনেত্রী মহিমা চৌধুরীর বাংলা চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটে এ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। মিডিয়া ব্যারন পিটার মুখার্জির আদলে তৈরি ভিক্টর চরিত্রে অভিনয় করেছেন সুদীপ মুখোপাধ্যায়। এ ছাড়াও ছবিতে আছেন ইন্দ্রাশিস, মুমতাজ সরকার, রাজেশ শর্মা প্রমুখ। বাস্তবের শীনা বোরার করুণ পরিণতির মধ্য দিয়ে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে তার অবতারণা হয়েছে এই ছবিতে।

 

খুনের আগে মা ফোনে বললেন, ‘বান্দ্রার ন্যাশনাল কলেজের সামনে আসো, জরুরি কথা আছে’

পুলিশের দাবি অনুযায়ী ২০১২ সালের ২৪ এপ্রিল খুন করা হয় শীনা বোরাকে। তাদের বর্ণনায়, কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করার অজুহাতে মেয়ে শীনাকে ডাকেন ইন্দ্রাণী। সন্ধ্যে সাড়ে ছয়টার সময় আসতে বলেন বান্দ্রার ন্যাশনাল কলেজের সামনে। নির্দিষ্ট সময়ে সেখানে প্রাক্তন স্বামী সঞ্জীব খান্নাকে নিয়ে পৌঁছেন ইন্দ্রাণী। গাড়ি চালাচ্ছিলেন চালক শ্যাম রাই। প্রেমিক রাহুলকে নিয়ে উপস্থিত হন শীনা কিন্তু শীনাকে রেখে চলে যায় রাহুল। পরে পুলিশকে রাহুল জানিয়েছেন, শীনার সঙ্গে সেটাই ছিল শেষ দেখা। রাহুল পুলিশকে জানিয়েছেন, তিনি ২৫ এপ্রিল ২০১২ থেকে দেখেন শীনার ফোন বন্ধ। দুদিন অপেক্ষার পরে খার  থানায় যান অভিযোগ জানাতে। পুলিশ অভিযোগ নিতে অস্বীকার করে। এরপর ওরলি থানায় রাহুল মিসিং ডায়েরি দায়ের করেন। পুলিশ কথা বলে ইন্দ্রাণীর সঙ্গে। ইন্দ্রাণী জানান, শীনা পড়াশোনা করতে আমেরিকা গেছেন। তথ্য বেরিয়ে আসে, মেয়েকে গাড়িতে উঠতে বলেন ইন্দ্রাণী। গাড়ির পেছনের আসনে সঞ্জীব খান্নাকে বসে থাকতে দেখে গাড়িতে উঠতে বেঁকে বসেন শীনা। তাকে ঠেলে গাড়িতে ঢোকান ইন্দ্রাণী। গাড়ি ছুটে চলে ইস্টার্ন এক্সপ্রেস হাইওয়ে ধরে। অভিযোগ, গাড়িতেই শীনার হাত চেপে ধরে সঞ্জীব। দুটো পা চেপে ধরে চালক শ্যাম। আর মেয়েকে শ্বাসরোধ করে খুন করেন ইন্দ্রাণী। তারপর খোপলি-পেন রোডের ধারে প্রত্যন্ত জায়গায় পেট্রল ঢেলে পুড়িয়ে ফেলা হয় শীনার দেহ। ফেলে দেওয়া হয় ৪০ ফিট গভীর খাদে।

 

ডায়েরির পাতায় মায়ের জন্য ঘৃণা

মুম্বাই পুলিশের হাতে আসে শীনা বোরার একটি ডায়েরি। যেখানে ফুটে ওঠে মায়ের প্রতি শীনার তীব্র ঘৃণা এবং বিদ্বেষ। স্পষ্ট হস্তাক্ষরে সেখানে ইন্দ্রাণীর বিরুদ্ধে লিখেছেন। ২০০৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ডায়েরিতে শীনা বোরা ইংরেজিতে যা লিখেছেন তার অনুবাদ করলে দাঁড়ায়-  ‘ওহ! হ্যাপি বার্থডে টু মি! কিন্তু আমি জীবনে হ্যাপি নই। মনে হচ্ছে এই জীবনে আমি কিছুই পাইনি। কিচ্ছু না! নিজের ভবিষ্যৎকে পুরো শূন্য মনে হচ্ছে। সব দিক থেকে অবসাদ ঘিরে ধরছে আমাকে। জঘন্য বিরক্তিকর জীবন। আমার মাকে আমি ঘৃণা করি। দ্যাট ব্লাডি ** । ও মা নয়। ও একটা ডাইনি।’ কলকাতায় ইন্দ্রাণীর দ্বিতীয় পক্ষের স্বামী সঞ্জীব খান্নার বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে ডায়েরিটি পাওয়া যায়। তদন্তকারী পুলিশের দাবি, যদি এই ডায়েরি সত্যি শীনার হয় তাহলে হত্যা মামলায় এর বয়ান হবে সবচেয়ে মূল্যবান নথি। আর সেজন্য ডায়েরির সব নথি খতিয়ে দেখে পুলিশ। এ নিয়ে প্রশ্নও চলে মামলায় অভিযুক্ত আসামিদের।

 

খুনে কেন জড়ালেন দুই স্বামী?

শীনা বোরা হত্যা গল্পের মূল চরিত্র ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়। নিজের সন্তানকে দ্বিতীয় পক্ষের স্বামী সঞ্জীব খান্নার সহায়তায় মহারাষ্ট্রের রায়গয় জেলায় এক নির্জন এলাকায় হত্যা করেন। তারপর পেট্রল ঢেলে সেই মৃতদেহ পুড়িয়ে দেন। তিন বছর পর ২০১৫ সালের ২১ আগস্ট তার গাড়িচালক শ্যাম মনোহর রাইকে পুলিশ গ্রেফতার করে এক অন্য মামলায়। কিন্তু জেরার মুখে তিনি পুরনো খুনের কথা উল্লেখ করেন। সেই সূত্র ধরেই পুলিশ গ্রেফতার করে ইন্দ্রাণী ও তৃতীয় স্বামী স্টার টিভির প্রাক্তন সিইও পিটার মুখার্জিকে। কিন্তু এই ঘটনায় কেন জড়িয়ে গেলেন ইন্দ্রাণীর দ্বিতীয় স্বামী সঞ্জীব? এমন প্রশ্নের জবাবে ইন্দ্রাণী জানিয়েছেন, বিবাহবিচ্ছেদ হলেও তাদের মধ্যে যোগাযোগ ছিল। মেয়ে বিধিকে দেখার জন্যই তিনি মাঝেমধ্যে মুম্বাই যেতেন। সঞ্জীব জানিয়েছেন, ইন্দ্রাণীর সঙ্গে আবার তার ঘনিষ্ঠতা বাড়ছিল। তার কাছে ফিরে আসার ইচ্ছাও নাকি প্রকাশ করেছিলেন ইন্দ্রাণী। তত দিনে দুজনের মধ্যে কিছু ব্যবসায়িক লেনদেনও শুরু হয়েছিল। এই ঘনিষ্ঠতার কারণেই হয়তো সঞ্জীব ইন্দ্রাণীকে সাহায্য করতে চেয়েছিল। তাছাড়া পিটারের কাছ থেকে যে অঢেল সম্পত্তি ইন্দ্রাণী হাত করে নিতে পারবে তার ভাগ পাওয়ার লোভও কিছু কাজ করেছিল হয়তো সঞ্জীবের মনে। সেখানে উভয়ের পথের কাঁটা ছিল এই শীনা। তাকে তখন সরিয়ে দেওয়াটাই উপযুক্ত মনে করেছিলেন তারা। এখন প্রশ্ন হলো- এই খুনে ইন্দ্রাণীর তৃতীয় স্বামী পিটার মুখোপাধ্যায় কতটা কেন জড়িত থাকবেন? পিটার নিজেও দাবি করেন, শীনা ইন্দ্রাণীর বোন বা মেয়ে সে বিষয়ে তিনি অবগত নন। দাবি করেন, তার স্ত্রী তাকে ঠকিয়েছেন। সেই দাবি অবশ্য ধোপে টেকে না। রাহুল নাকি নিজের বাবাকে শীনার প্রকৃত পরিচয় জানিয়েছিলেন। শীনা নিজেও কথা বলেন পিটারের সঙ্গে, নিজের আসল পরিচয় প্রকাশ করেন।

ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআইয়ের অভিযোগ, সৎমেয়ে শীনার হত্যাকা-ে ভারতের মিডিয়া মুঘল হিসেবে পরিচিত পিটারের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল। অপরাধের আগে, পরে, অপরাধ হওয়ার সময়ে বারবার ইন্দ্রাণীর সঙ্গে কথা হয়েছে পিটারের। সেই সময়টায় ইন্দ্রাণীর সঙ্গে তিনি যেভাবে ফোনে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখেছিলেন তেমন তিনি সচরাচর করতেন না।

 

হত্যার পর এসএমএস কান্ড

২০১২ সালের ২৪ এপ্রিল খুনের কয়েক দিন পরে শীনার ফোন নম্বর থেকে একটি এসএমএস পেয়েছিলেন রাহুল। শীনার ফোন থেকে আসা ওই এসএমএসে লেখা ছিল তিনি রাহুলের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখতে চান না। যে সম্পর্ক ছিল তা তিনি ভেঙে দিতে চান। এমনকি দেশের বাইরে চলে যাবেন নিজের লেখাপড়ার জন্য। এরপর থেকে রাহুল যেন তার আর খোঁজ না করেন। কিন্তু শীনার নম্বরে রাহুল ফোন করলে কেউ সেই কল রিসিভ করেনি। পুলিশের ধারণা, ইন্দ্রাণীই মেয়ের ফোন থেকে রাহুলকে মেসেজ করেন। যাতে বোঝানো যায় নিহত মেয়ের মিথ্যে উপস্থিতি। এদিকে শীনার কোনো হদিস না পেয়ে অস্থির হয়ে যান রাহুল। কে ওই এসএমএস করেছিল সে বিষয়ে কোনো উত্তর জানতে পারেননি রাহুল। মূলত রাহুলের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল শীনার। সেই সম্পর্ক পছন্দ করতেন না ইন্দ্রাণী। এই মামলায় তথ্য উদঘাটনে ইন্দ্রাণীর ল্যাপটপ, মোবাইল এবং পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করেছিল পুলিশ।

 

শীনার খোঁজে আগ্রহ ছিল না কারও

শীনা খুন হওয়ার তিন বছরের মধ্যে তার পক্ষ থেকে কোনো সাড়াশব্দ ছিল না। আপন ভাই মিখাইল ও নানা-নানীও কোনো কথা বলেনি এই বিষয়ে। পুলিশের দাবি, এর পেছনেও হয়তো টাকার খেলা থাকতে পারে। ঘটনার তদন্ত শুরু হলে ইন্দ্রাণীর বাবা উপেন্দ্র কুমার বোরা স্বীকার করেছিলেন সার্টিফিকেটে বাবা হিসেবে নাম থাকলেও তিনি শীনার নানা। এদিকে ইন্দ্রাণীও পুলিশ ও মিডিয়ার কাছে একের পর এক মাপা জবাব দিয়ে গেছে।  শীনাকে খোঁজার চেষ্টা করেননি পিটারও। বরং শীনার ব্যাপারে রাহুলকে তিনি বারবার মিথ্যে বলেছিলেন। রাহুল বাবার কাছে শীনার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে বলতেন, শীনা আছে আমেরিকায়। একমাত্র শীনা মিসিং হওয়ার পর থেকে রাহুল উদ্বিগ্ন হয়েছে বারবার। এদিকে উল্টো খুনের ঘটনা ঢাকতে ২৪ এপ্রিল ২০১২ সালে শীনার পক্ষে অফিস থেকে ছুটির জন্য আবেদন করা হয়। আবার ছুটি চলাকালীন সময়ে পদত্যাগপত্রও পাঠানো হয়। সেই দিনই শীনার নম্বর থেকে রাহুলের মোবাইলে বিদায় জানিয়ে শেষ এসএমএস আসে। সেই দিন থেকেই শীনার আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি।

 

খুনের কারণ সম্পত্তি

আদালতে ইন্দ্রাণী মুখার্জি স্বীকার করেন, শীনা তার সম্পত্তিতে ভাগ বসাবেন। রাহুলের সঙ্গে শীনার সম্পর্ক থাকলে সে মুখার্জি বাড়ির বউ হয়ে আসবে। ফলে তাকে সম্পত্তির ভাগ দিতে হবে। এ ভাবনা থেকেই ইন্দ্রাণীর মনে জন্মে হিংসা।  অপরদিকে মা হয়েও শীনাকে ঘৃণা করতেন কিন্তু ভালোবাসতেন সঞ্জীবের ঘরের মেয়ে বিধিকে। তার জন্য ভবিষ্যৎ ভাবছিলেন ইন্দ্রাণী। পিটার মুখার্জিকে যখন ইন্দ্রাণী বিয়ে করে তখন প্রথম বিয়ে, সন্তান সবকিছুই বেমালুম অস্বীকার করে যান। তবে দ্বিতীয় বিয়ে আর সন্তানের কথা জানতেন পিটার। এদিক থেকেও ইন্দ্রাণীর মনে একটি শঙ্কা কাজ করত। কারণ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পিটার জানতেনই না শীনা ইন্দ্রাণীর মেয়ে। ইন্দ্রাণী তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল বোন হিসেবে। কারণ যতই থাকুক, খুনের প্রধান কারণ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে সম্পত্তি ভাগ দেওয়ার ভয়।

সর্বশেষ খবর