শনিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

শহরের বুকে বিখ্যাত নদী

তানিয়া তুষ্টি

শহরের বুকে বিখ্যাত নদী

যুগে যুগে নদী অববাহিকায় গড়ে উঠেছে বহু সভ্যতা। আপন গতিতে ছুটে চলা নদীর পানির ওপর নির্ভর করেছে তাদের জীবিকা, সংস্কৃতি, দর্শন ও জীবনধারা। কখনো কখনো নদীর গর্ভে হারিয়েও গেছে অনেক সভ্যতা। তবে বর্তমান বিশ্বের বহু নামকরা শহর রয়েছে যারা বুকে ধারণ করে রেখেছে হাজার বছরের পুরনো বিখ্যাত সব নদী। এসব নদীর সৌন্দর্য ও মানব সভ্যতায় রাখা অবদান টিকে আছে প্রত্যক্ষ ভূমিকায়। নদীর তীরে গড়ে ওঠা জনবসতির ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা সেসব নদীকে দিয়েছে আলাদা বৈশিষ্ট্য। আজকের রকমারি আয়োজনে থাকছে বিশ্বের সেইসব নামকরা শহর ও বিখ্যাত নদী সম্পর্কে বিস্তারিত।

 

ইংল্যান্ডের দাপুটে টেমস

ইংল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত অন্যতম প্রধান নদী টেমস। লন্ডনের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়ার কারণেই এই নদী বিখ্যাত। অবশ্য লন্ডনের সঙ্গে আরও বেশ কিছু শহরের বুক ছুঁয়ে গেছে এই নদী। এর মধ্যে রয়েছে অক্সফোর্ড, রেডিং এবং উইন্ডসর। টেমসকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে জনবসতি, আধুনিক শহর আর শহরে গড়ে উঠেছে অসংখ্য দৃষ্টিনন্দন ও অর্থনৈতিক স্থাপনা। নদীবিধৌত শহরগুলোর পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা দাপুটে যৌবনদীপ্ত টেমসের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। টেমসের ঝিরিঝিরি বাতাসে মিশে থাকে এক জাদুময় মোহ। আর তা গায়ে মাখতেই হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে ছুটে আসে পর্যটকরা। এই নদীর উৎপত্তিস্থল দক্ষিণ-মধ্য ইংল্যান্ডের অপূর্ব কটসওল্ড গিরিশ্রেণির চারটি জলপ্রবাহ থেকে। এটা পূর্বদিকে ৩৫০ কিলোমিটার পথ এঁকেবেঁকে বয়ে গেছে। এই যাত্রাপথে এর সঙ্গে আরও অন্যান্য নদী এসে মিলিত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত নদীটি প্রায় ২৯ কিলোমিটার প্রশস্ত মোহনার মধ্য দিয়ে উত্তর সাগরে গিয়ে পড়েছে। নদীটি ইংরেজদের ইতিহাসকে প্রভাবিত করেছে। প্রায় ৫৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জুলিয়াস সিজার ইংল্যান্ডে রোমীয়দের প্রথম আক্রমণে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। পরের বছর তিনি যখন আরও এগিয়ে যাবেন পরিকল্পনা করলেন তখন একটি নদী বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেই নদীর নাম দিয়েছিলেন টেমেসিস বা টেমস নদী। সময়ের পালাবদলে ৯০ বছর পর এসে রোমীয় সম্রাট ক্লডিয়াস সেই দেশ নিজের অধিকারে নিয়ে নেন। তখন টেমস নদীর দুই ধারেই জলাভূমি ছিল। মোহনা থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে রোমীয় সৈন্যবাহিনী একটি কাঠের সেতু নির্মাণ করেছিল। নদীর উত্তর তীরে একটি বন্দরও তৈরি করেছিল। বন্দরের নাম দিয়েছিল লনডিনিয়াম। সেটিই পরে লন্ডন নামে আত্মপ্রকাশ ঘটে। পরবর্তী ৪০০ বছর ধরে রোমীয়রা ইউরোপের অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্য বিস্তার করেছিল। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে বিলাসদ্রব্য ও লেবানন থেকে কাঠ আমদানি করেছিল এই বন্দর দিয়ে। এ ছাড়া টেমস নদী দিয়েই তারা দেশের মধ্যভাগ থেকে লন্ডনে মালপত্র নিয়ে আসত। ফলে লন্ডন শহর শিগগিরই এক গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল।

পানিতে ভাসা ভেনিস

পানির ওপর ভেসে থাকা দৃষ্টিনন্দন প্রাসাদ, গা ঘেঁষে এঁকেবেঁকে বয়ে চলা স্বচ্ছ পানির লেক। পুরো শহরের বুকজুড়ে থাকা পানিতে প্রাসাদের প্রতিবিম্ব স্পষ্ট, আকাশের মেঘগুলোও ন্ডে লেকের জলে লুটোপুটি খাচ্ছে। বিস্ময়ের অলিগলি জলপথ ভেনিসকে পরিণত করেছে ‘সিটি অব লাভ অ্যান্ড লাইটস’ অর্থাৎ ‘ভালোবাসা ও আলোর নগরীতে। তার বিস্তৃতিও ইউরোপের ৬টি বৃহত্তম নগরীর মধ্যে অন্যতম। আদ্রিয়াটিক সাগরের উপকূলে ইতালির ভেনিটো অঞ্চলে বো ও পিয়াভব নদীর মিলনস্থলে প্রায় ৪১৭.৫৭ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে গঠিত ভেনিস। ৩ লাখ নাগরিক বুকে ধারণ করেছে ভেনিসের ১১৮টি ছোট ছোট দ্বীপ। এর ভিতর দিয়ে বয়ে গেছে ১৭৭টি খাল। এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে পায়ে হেঁটে যাওয়ার জন্য রয়েছে ৪০৯টি  সেতু। আর তাই রূপের পসরা সাজানো ভেনিসকে ভাসমান নগরীও বলা হয়। বাড়িতে ঢুকতে গেলে বা কোথাও বেড়াতে গেলে বাহন হবে ঐতিহ্যবাহী নৌকা ‘গন্ডোলা’। এখানে স্থলপথ  নেই বললেই চলে। ইউরোপের একমাত্র মোটরগাড়িহীন ও একবিংশ শতাব্দীতেও গাড়ির ন্ডে ধোঁয়াহীন শহরের উদাহরণ হয় ভেনিস। প্রায় প্রতিটি বাড়ির সামনেই বেঁধে রাখা থাকে ব্যবহারের জন্য ছোট নৌকা, স্পিডবোট বা গন্ডোলা।

হাডসন নদী

যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব নিউইয়র্কের মধ্য দিয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়েছে হাডসন নদী। এতে নিউজার্সি ও নিউইয়র্কের কিছু অংশ বিভেদ হয়েছে। এই নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে নানা ধরনের স্থাপনা। মানুষের আনন্দভ্রমণ থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক বাণিজ্যের নানা দিককে প্রভাবিত করে আসছে এই নদী। এই নদীতে চলাচল করে অসংখ্য মালবাহী কার্গো। নদীর ওপর তৈরি করা অসংখ্য সেতু রেল ও মহাসড়কের সুবিধাদি প্রদান করে। বলা যায়, নিউইয়র্ক ও নিউ জার্সির মধ্যকার যৌথ ট্রাফিক ব্যবস্থার ওপর প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলেছে এই নদী। উভয় শহরের শিল্প কলকারখানা ও স্যুয়ারেজ ব্যবস্থার সুবিধার্থেও এই নদী ব্যবহৃত হয়। ৩১৫ মাইল দীর্ঘ এই নদীটি হেনরি হাডসন ১৬০৯ সালে আবিষ্কার করেন। নিউইয়র্কের অ্যাডিরনডাক পর্বতমালা থেকে উৎপন্ন হয়ে শেষে পৌঁছেছে নিউইয়র্ক হারবারের আটলান্টিক মহাসাগরে।

বন্দরনগরী সিডনি

অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস অঙ্গরাজ্যের রাজধানী এবং অস্ট্রেলিয়া তথা ওশেনিয়ার বৃহত্তম শহর সিডনি। শহরটি অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব উপকূলের জ্যাকসন বন্দরকে ঘিরে অবস্থিত। আর এই জ্যাকসন বন্দর গড়ে উঠেছে সিডনি হারবার, মিডল হারবার, উত্তর হারবার, লেন কোভ এবং পররামাতা নদীর জলের সমন্বয়ে। এটাকে অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের সিডনির রিয়া বা প্রাকৃতিক বন্দর বলে। বন্দরটি তাসমান সাগরের (দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের অংশ) একটি খাঁড়ি। এখানেই সিডনি অপেরা হাউস এবং সিডনি হারবার ব্রিজের অবস্থান।  পোর্ট জ্যাকসন সিডনির ইতিহাস ও বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। শহরটি স্থলভাগের অভ্যন্তরে পশ্চিমের ব্লু পর্বতমালার দিকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। এর উত্তরে হকসবেরি শহর, দক্ষিণে রয়্যাল ন্যাশনাল পার্ক বা রাজকীয় জাতীয় উদ্যান এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে ম্যাকার্থার শহর। সিডনিতে ৬৫৮টি উপশহর, ৪০টি স্থানীয় সরকার অঞ্চল এবং ১৫টি সংলগ্ন অঞ্চল আছে। ২০১৭ সালের জুন মাসের হিসাব অনুযায়ী সিডনি মহানগর এলাকার জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৫১ লাখ। এখানে নিউ সাউথ ওয়েলস অঙ্গরাজ্যের প্রায় ৬৫% জনগণ বাস করে।

মিসরের বুক চিরে বয়ে গেছে নীলনদ

প্রাচীন সভ্যতার অন্যতম উদাহরণ হলো মিসরীয় সভ্যতা। প্রাচীন এই সভ্যতার সব নিদর্শন টিকে আছে সারি সারি। তারই মাঝ দিয়ে মিসরের বুক চিরে বয়ে চলেছে নীল নদ। আফ্রিকা মহাদেশে অবস্থিত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এই নদের দৈর্ঘ্য প্রায় ৪ হাজার ১৩২ মাইল। মূলত নীলনদকে কেন্দ্র করেই মিসর সভ্যতার উৎপত্তি। এই নদের জল মানুষ পানীয় বা কৃষি কাজের জন্য ব্যবহার করত। মিসরে বৃষ্টিপাত না হলেও ইথিওপিয়াতে প্রচুর বৃষ্টিপাত হতো। সেই বৃষ্টি মিসরে বন্যা সৃষ্টি করত। বন্যার কাদামাটি কৃষিকাজ ও পিরামিড তৈরিতে ব্যবহার করা হতো। পিরামিডের পাথর নিয়ে আসার জন্য নীলনদকে মিসরীয়রা পরিবহনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে। এর দুটি উপনদী রয়েছে, শ্বেত নীলনদ ও নীলাভ নীলনদ। এর মধ্যে শ্বেত নীলনদ দীর্ঘতর। পৃথিবীর প্রায় ১১টি দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। উপনদ দুটি সুদানের রাজধানী খার্তুমের কাছে মিলিত হয় এবং পরে মিসরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মোহনার কাছে বিশাল ব-দ্বীপ সৃষ্টি করে যা ভূমধ্য সাগরে মিশেছে। নীলনদের উৎসস্থল হিসেবে মনে করা করা হয় লেক ভিক্টোরিয়াকে। কারণ এখান থেকে ছোট উপনদী তৈরি হয়ে নীলনদে মিশেছে।

বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল নদী অববাহিকা গঙ্গা

ভারত ও বাংলাদেশে প্রবাহিত একটি আন্তর্জাতিক নদী গঙ্গা। এই নদী ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের জাতীয় নদীও বটে। ২ হাজার ৫২৫ কিমি দৈর্ঘ্যরে এই গঙ্গার উৎসস্থল পশ্চিম হিমালয়ে ভারতের উত্তরাখ- রাজ্যে। দক্ষিণ ও পূর্বে গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গঙ্গা মিশেছে বঙ্গোপসাগরে। জলপ্রবাহের ক্ষমতা অনুযায়ী গঙ্গা বিশ্বের প্রথম ২০টি নদীর একটি। গাঙ্গেয় অববাহিকায় বর্তমানে ৪০ কোটি জনসংখ্যার বাস। তাদের ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক সংস্থানে এই নদীর প্রভাব অপরিসীম। তাই দিনে দিনে এখানে বেড়েছে জনসমাগম। বর্তমানে জনঘনত্ব প্রতি বর্গ মাইলে ১ হাজার জন। এটিই বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল নদী অববাহিকা। গঙ্গাকে হিন্দুরা দেবীজ্ঞানে পূজা করেন।

গঙ্গার ঐতিহাসিক গুরুত্বও অপরিসীম। এর তীরেই প্রাদেশিক ও সাম্রাজ্যিক রাজধানী যেমন পাটলিপুত্র, কনৌজ, কাশী, এলাহাবাদ, মুঙ্গের, মুর্শিদাবাদ ও কলকাতা অবস্থিত। মানুষের জীবনে গঙ্গার অকাতর দান

থাকলেও প্রতিদানে এর তীরবর্তী মানুষ করে চলেছে পানিদূষণ। আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলা এই দূষণ শুধু গঙ্গাতীরে বসবাসকারী কয়েক কোটি ভারতীয়দের ক্ষতি করছে না, বরং ১৪০টি মাছের প্রজাতি, ৯০টি উভচর প্রাণীর প্রজাতি ও ভারতের জাতীয় জলচর প্রাণী গাঙ্গেয় শুশুকেরও ক্ষতি করছে।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর