রবিবার, ২০ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

পারস্যে শাহদের শাসন

জামশেদ আলম রনি

পারস্যে শাহদের শাসন

ব্ল্যাক ফ্রাইডেতে সাধারণ মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায় পুলিশ। নারী নিয়ে বেশির ভাগ সময় কাটাতেন সে সময়ের শাহরা। ইসলামী বিপ্লবের আগে ইরানি তরুণীদের এভাবেই পশ্চিমা পোশাকে দেখা যেত।

ইতিহাসের স্বাভাবিক নিয়মে কোনো রাজবংশের শাসনকাল সর্বোচ্চ এক শতাব্দীকাল। কিংবা তার কমবেশি সময়ও হয়ে থাকে। অথচ শাহ বংশ আড়াই হাজার বছর ধরে প্রভাব-প্রতিপত্তি নিয়ে ইরানে রাজত্ব করেছে। যার অবসান ঘটে ১৯৭৯ সালে আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে। ইতিহাসে এটি ইরানের ইসলামী বিপ্লব নামে পরিচিত। এ বিপ্লবকে বলা হয় ফরাসি এবং বলশেভিক বিপ্লবের পর ইতিহাসের তৃতীয় বিপ্লব। সেই বিপ্লবে ক্ষমতাচ্যুত শাহদের নিয়েই আজকের রকমারি...

 

পারস্যে শ্বেত অভ্যুত্থান

মোহাম্মদ রেজা পাহলভি ১৯১৯ সালের ২৬ অক্টোবর তেহরানে জন্মগ্রহণকারী ইরানের শাহানশাহ ছিলেন। ১১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৯ সালে ইসলামিক বিপ্ল­বের ফলে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। তিনি শাহেনশাহ পদবি ধারণ করেন। এ ছাড়াও আরিয়ামের, বুজুর্গ আর্তেশতারান পদবিও তিনি লাভ করেন। ইরান সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় ও পাহলভি পরিবারের সর্বশেষ সম্রাট ছিলেন তিনি।

রেজা পাহলভি ও তার দ্বিতীয় স্ত্রী তাজ উল-মূলক দম্পতির সন্তান তিনি। ১১ বছর বয়সে ইনস্টিটিউট লে রোজে নামের একটি সুইস বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি হন। চার বছর অধ্যয়নের পর ১৯৩৬ সালে হাইস্কুলের ডিপ্লে­ামা নিয়ে ইরানে ফিরে আসেন। এরপর তেহরানের স্থানীয় সামরিক একাডেমিতে নিবন্ধিত হন এবং ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৪১ সালে তিনি ক্ষমতায় আসেন। এ সময় অ্যাংলো-সোভিয়েত বাহিনী তার বাবা রেজা শাহকে জোরপূর্বক ক্ষমতা থেকে পদত্যাগ করান। তার আমলে সংক্ষিপ্তকালের জন্য ইরানের তেলশিল্প জাতীয়করণ করা হয়। শাসক হিসেবে অর্থনীতি, সামাজিক ও রাজনৈতিক পুনর্গঠনকে ঘিরে শ্বেত অভ্যুত্থানের প্রবর্তন করেন। এ ছাড়াও ইরানকে বৈশ্বিক শক্তিতে রূপান্তর ও রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত শিল্প-কারখানার আধুনিকীকরণ এবং নারীদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। ধর্ম নিরপেক্ষবাদী মুসলিম হিসেবে তিনি শিয়াদের সমর্থন হারানোসহ শ্রমিক শ্রেণি, বাজারি নামে পরিচিত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সংঘর্ষ, ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক বজায়, দুর্নীতিতে শাসকগোষ্ঠীর জড়ানোয় তার জনপ্রিয়তা কমতে থাকে। এ ছাড়া বিভিন্ন বিতর্কিত নীতি গ্রহণ, সমাজতান্ত্রিক দল তুদেহ পার্টি নিষিদ্ধকরণ ও গোয়েন্দা সংস্থা সাভাককে রাজনীতিতে জড়ান। রাষ্ট্রীয় পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৭৮ সালে ২,২০০ রাজনৈতিক কর্মীকে কারাগারে পাঠানো হয়। যার ফলে ইসলামিক অভ্যুত্থান ঘটে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মদদপুষ্ট সরকারকে ঘিরে ইসলামপন্থিদের সঙ্গে তার মতভেদ ঘটতে থাকে ও কমিউনিস্টদের কার্যকলাপ বৃদ্ধি পায়। রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলে ১৭ জানুয়ারি, ১৯৭৯ সালে বিপ্ল­ব সংঘটিত হয় ও তাকে ইরান ত্যাগে বাধ্য করা হয়। এর ফলে ইরানীয় রাজতন্ত্রের আনুষ্ঠানিকভাবে বিলোপ ঘটে ও ইমাম খোমেনির নেতৃত্বে ইরান ইসলামিক প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়।

 

শাহ বংশের শেষ শাসক

রেজা শাহ পাহলভি শাহ বংশের সর্বশেষ শাসক। ১৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৭ সালে ইরানের শাসক হিসেবে শাহ বংশের সিংহাসনে বসেন। পৃথিবীতে টিকে থাকা সবচেয়ে প্রাচীন বংশের শাসক তৎকালীন রেজা শাহ পাহলভি। বিপ্লবের শুরুটা হয়েছিল মূলত ইরানের ভূখন্ডে আবিষ্কৃত তেল খনির মালিকানা নিয়ে। শাহ ইরানের এসব মূল্যবান সম্পদ মার্কিন ও ব্রিটিশদের মালিকানায় রেখে বিলাসবহুল জীবনযাপনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপর ইরানের ভূখন্ডে প্রচুর তেল সম্পদ আবিষ্কার হয়। যা পরবর্তীতে ইরানের প্রধান সম্পদের একটিতে পরিণত হয়। ইরানের ভূখন্ডের এতগুলো তেল সম্পদ আবিষ্কারের মূলে ছিল ব্রিটিশ বিভিন্ন কোম্পানি। যার ফলে যত তেলের খনি আবিষ্কার হয়েছে, তার অধিকাংশের মালিকানা ব্রিটিশদের হাতে ছিল। এদিকে ইরানের শাহ বংশের শাসকগোষ্ঠী ব্রিটিশদের থেকে নানা সুযোগ-সুবিধা নিতে থাকে। বিশেষ করে তখনকার শাহ বংশ পরিচালনার মূল কাঠি নাড়ত ব্রিটিশরা।

রেজা শাহ পাহলভি ১৮৭৮ সালের ১৫ মার্চ মাজান্দারান প্রদেশের ইরান আলাশত এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। ইরানের শাহেনশাহ হিসেবে তিনি ১৯২৫ থেকে ১৯৪১ সালে ইরান সাম্রাজ্য পরিচালনা করেন। ১৯২৫ সালে ব্রিটিশদের সহায়তায় অভ্যুত্থানের মাধ্যমে কাজার রাজবংশের শেষ শাহ আহমদ শাহ কাজার ক্ষমতাচ্যুত হন ও তিনি পাহলভি রাজবংশের সূচনা করেন। ১৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৪১ সালে অ্যাংলো-সোভিয়েত বাহিনী ইরান অভিযান করলে তাকে  জোরপূর্বক ক্ষমতা থেকে সরানো হয়। তিনি সাংবিধানিকভাবে রাজতন্ত্রের সূচনা করেন। কিন্তু ১৯৭৯ সালে ইরানি বিপ্ল­বের পরিপ্রেক্ষিতে পাহলভি সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। তার আমলে ট্রান্স-ইরানিয়ান রেলপথ নির্মিত হয় ও আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন ঘটে। তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ও তার আমলেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অনেক ইরানি ছাত্রকে ইউরোপীয় শিক্ষায় সম্পৃক্ত করতে তার সরকার সহায়তা করে। এ ছাড়াও জনস্বাস্থ্যের আধুনিকায়নেও তার সরকার ভূমিকা রাখে। এর ফলেই আধুনিক ইরান রাষ্ট্রের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৮৭৮ সালে মেজর আব্বাস আলী খান ও নুশাফারিন আয়রোমলু দম্পতির সন্তান রেজা শাহ পাহলভি। তার মা সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবার থেকে আসেন।

বাবাৃত্যুর পর রেজার মা তেহরানে অবস্থানরত তার ভাইয়ের বাড়ীতে অবস্থান করেন। ১৮৭৯ সালে মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে হলে রেজা শাহ তার চাচার তত্ত্বাবধানে থাকেন। এরপর পারিবারিক বন্ধু ও পারস্য সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা আমির তুমান কাজিম খানের কাছে তাকে পাঠানো হয়। ষোল বছর বয়সে পারস্য কস্যাক ব্রিগেডে তিনি যোগ দেন। ১৯১৮ সালে পারস্য কস্যাক ব্রিগেডের জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি পান। ১৯২৫ সালে কাজার রাজতন্ত্রের পতনের পূর্বে সর্বশেষ কর্মকর্তা হিসেবে নিশান-ই-আকদান উপাধী পান। রুশ বিপ্লবের পর পারস্য যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। ১৯১৭ সালে ব্রিটেন রাশিয়ায় আক্রমণ পরিচালনার স্বার্থে ইরানকে ব্যবহার করে। কিন্তু ব্রিটেনের ব্যর্থতায় সোভিয়েত ইউনিয়ন পারস্যের উত্তরাংশ দখল করাসহ পারস্য সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র গঠন করে। ১৯২০-এর দশকে রাশেট জাঙ্গালিস, কুর্দ, আর্মেনীয় ও আজারবাইজানীদের নিয়ে গঠিত ১,৫০০ সদস্যের গেরিলা বাহিনী তেহরান অভিমুখে যাত্রা করে। এরফলে রাজধানীতে গভীর রাজনৈতিক সঙ্কটের সৃষ্টি করে।

 

যেভাবে শিল্পকলায় শীর্ষে ইরান

প্রথম আব্বাস (২৭ জানুয়ারি ১৫৭১-১৯ জানুয়ারি ১৬২৯) যিনি মহান আব্বাস নামেও পরিচিত। তিনি ১৫৮৭ থেকে ১৬২৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পারস্যের শাহ ছিলেন। তিনি তার পিতা শাহ মোহাম্মদ খোদাবন্দের পর সাফাভি রাজবংশের পঞ্চম শাহ হিসেবে মাত্র ১৬ বছর বয়সে পারস্যের শাসনভার গ্রহণ করেন। আব্বাসকে সবচেয়ে শক্তিশালী সাফাভি রাজা হিসেবে গণ্য করা হয়। তিনি পারস্য থেকে উসমানীয় ও উজবেক সৈন্যদের বিতাড়িত করেন এবং একটি সদাপ্রস্তুত সেনাবাহিনী গঠন করে পারস্যে সাফাভি রাজবংশের কর্তৃত্ব সুসংহত করেন। আব্বাস এসফাহন শহরকে তার রাজধানী  ঘোষণা করেন। তার শাসনামলে এসফাহন বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর একটি শহরে পরিণত হয়। আব্বাসের আমলে শিল্পকলায় পারস্যের কীর্তি শীর্ষে আরোহণ করে। আলোকিত পান্ডুলিপি, মৃৎশিল্প, চিত্রকলা এর সবই বিকাশ লাভ করে। পর্তুগিজ, ওলন্দাজ ও ইংরেজরা বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনে পারস্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। আব্বাস একজন উদারমনা ও সহিষ্ণু শাসক ছিলেন। তিনি খ্রিস্টান সম্প্রদায়কে বিশেষ সুযোগ সুবিধা দেন।

নিরাপত্তার ব্যাপারে ভীতির কারণে তিনি তার ঘনিষ্ঠ পরিবার স্বজনদের সাথে নির্মম আচরণ করতেন। তিনি তার পুত্রদেরকে হয় হত্যা করেন বা অন্ধ করে দেন।

১৬০২ খ্রিষ্টাব্দে বাহরাইন পুনদ্ধার করেন তিনি। ভারতের মুঘল সম্রাটের নিকট হতে কান্দাহার পুনরুদ্ধার তার রাজত্বকালের আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। মহান মুঘল সম্রাট আকবর ১৫৯১ খ্রিষ্টাব্দে সাফাভীদের নিকট হতে কান্দাহার দখল করে নিয়েছিলেন। ফলে উভয় দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। শাহ্ আব্বাস সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে ১৬২২ সালে কান্দাহার পুনরায় নিজেদের অধিকারে আনেন।

শাহ আব্বাস অত্যন্ত দুর্যোগপূর্ণ সময়ে পারস্যের সিংহাসনে আরোহণ করেন। এ সময় দেশে আইন শৃংখলা বলতে কিছুই ছিলনা। তিনি সমগ্র পারস্যভূমিকে শত্রু কবল হতে মুক্ত করে সাম্রাজ্যে সুদুঢ় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করেন।

শাহ আব্বাসের খ্যাতি কেবল সামরিক বিজয়ের সীমাবদ্ধ ছিল না, শাসন ক্ষেত্রেও তিনি যোগ্যতা ও প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিলেন। শাসক হিসেবে শাহ আব্বাস ছিলেন উদার ও ন্যায়পরায়ন। তিনি নিরপেক্ষভাবে অপরাধের বিচার করতেন। শাসনকার্যের সুবিধার জন্য তিনি রাজধানী ইস্পানে স্থানান্তরিত করেন। তার প্রচেষ্টায় ইস্পাহানে কালক্রমে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নগরীর মর্যাদা লাভ করে।

শাহ আব্বাস ছিলেন পারসিক জাতীয়তাবাদের সংগঠক। তিনি পারস্যের সকল গোত্রকে একত্রিত করে একটি জাতিকে পরিণতক করার প্রচেষ্টা চালান। এক জাতি এক রাষ্ট্র গঠনের উদ্দেশ্যে তিনি শিয়া মতবাদকে জনপ্রিয় করে তোলেন।

শাহ আব্বাস পারস্যের সর্বশ্রেষ্ঠ হলেও মধ্যযুগীয় দোষত্রুটি হতে মুক্ত ছিলেন না। সমকালীন অন্যান্য নরপতির ন্যায় তিনিও মদ্যপায়ী ছিলেন। চরিত্রগতভাবে তিনি ছিলেন সন্দেহপ্রবণ ও নির্মম প্রকৃতির। পিতা ও পুত্রের প্রতি আচরণ চরম নির্মমতারই পরিচায়ক। পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা ও তাকে অন্ধ করে তিনি সিংহাসন দখল করেন। অন্যদিকে সুযোগ্য পুত্রদের সাহসিকতা ও বীরত্বে তার মন ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠে এবং পুত্রগণ কর্তৃক সিংহাসনচ্যুত হতে পারেন। এ আশংকায় তিনি পুত্রদের কাউকে হত্যা এবং কাউকেও অন্ধ করে সিংহাসনের পথ নিষ্কন্টক করেন। পুত্রদের প্রতি তার নৃশংসতা সমর্থন করতে পারেন নি অনেকেই

 

সম্রাটের কাছ থেকে রাজ্য উদ্ধার

নাদের শাহ নাদের কুলি বেগ হিসেবেও পরিচিত। ইরানের শাহ হিসেবে শাসন করেছেন এবং তিনি ছিলেন আফছারিদ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। তার প্রখর সামরিক দক্ষতার কারণে কোনো কোনো ইতিহাসবিদ তাকে পারস্যের নেপোলিয়ন বা দ্বিতীয় আলেক্সান্ডার হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। নাদের শাহ তুর্কির আফছার উপজাতির সদস্য ছিলেন। যারা প্রথম শাহ ইসমাইলের সময় থেকেই সাফাভিদ রাষ্ট্রে সামরিক রসদ সরবরাহ করতেন। হুতাকি আফগানদের দ্বারা বিদ্রোহ শুরু হলে ইরানে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তারা পারস্যের শাহ সুলতান হুসাইনকে সহজেই ক্ষমতাচ্যুত করে। উসমানীয় ও রাশিয়া উভয়েই পারস্যের বিভিন্ন অঞ্চল দখল করে নেয়। এমন পরিস্থিতিতে নাদের শাহ ক্ষমতায় আসেন। তিনি ক্ষমতায় আসার পর পারস্যের অঞ্চলগুলোকে পুনরায় একত্রিত করেন ও সেখান থেকে দখলদারীদের উচ্ছেদ করেন। তিনি এত ক্ষমতাবান হয়ে উঠেন যে ২০০ বছর ধরে পারস্য শাসন করা সাফাভিদ রাজবংশের শেষ শাসককে পদচ্যুত করার পরিকল্পনা করেন। ১৭৩৬ সালে সাফাভিদ রাজবংশের শাসককে ক্ষমতাচ্যুত করে নিজেকে ইরানের শাহ হিসেবে ঘোষণা করেন। তিনি বহু দেশে সামরিক অভিযান চালিয়ে নিজেদের সাম্রাজ্য বিস্তার করলেও তার সেনাবাহিনী পারস্যের অর্থনীতিতে ধ্বংস ডেকে আনে।

নাদের শাহ তার আদর্শ হিসেবে মধ্য এশিয়ার অপর দুই বিজেতা চেঙ্গিস খান ও তৈমুর লংকে অনুসরণ করেন। তিনি তাদের সামরিক ক্ষমতা, তাদের রাজত্বের পরিধি ও পরবর্তীকালে তাদের মতো নিষ্ঠুরও হয়ে ওঠেন। তার এই বিজয় তাকে মধ্য-প্রাচ্যের সার্বভৌম ক্ষমতাধর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু ১৭৪৭ সালে তাকে হত্যা করার পরপরই তার সাম্রাজ্য ধ্বংসের দিকে ধাবিত হয়। নাদের শাহকে এশিয়ার ইতিহাসের সর্বশেষ মহান সামরিক বিজেতা হিসেবে গণ্য করা হয়। পরবর্তীতে ১৬২২ সালে সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে রাজ্য উদ্ধার করেন তিনি।

 

সিআইএ-মোসাদের হাতেই মোসাদ্দেগ ক্ষমতাচ্যুত!

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই ইরানে ব্যাপক আকারে তেলক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়, যার মালিক ছিল ব্রিটিশ কোম্পানিগুলো। ঠিক এই সময়ে মোসাদ্দেগ নামে জনপ্রিয় এক রাজনৈতিক নেতা দেশের সব তেল সম্পদ জাতীয়করণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। ব্রিটেনে তখন উইনস্টন চার্চিল ক্ষমতায় আর যুক্তরাষ্ট্রে হেনরি ট্রুম্যান। মোসাদ্দেগের জয়লাভের ফলে দুই ক্ষমতাশালী দেশ শঙ্কিত হয়ে পড়ল। শুরু হলো  মোসাদ্দেগকে ক্ষমতাচ্যুত করার নীল নকশা। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ‘সিআইএ’ এবং ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা ‘এসআইএস’- লন্ডনে বসে যৌথ পরিকল্পনা করল। প্রেসিডেন্ট থিউডর রুজভেল্টের নাতি কার্মিট রুজভেল্ট তখন সিআইএ প্রধান। তিনি তখন লন্ডনে আসেন। প্রণীত হলো অপারেশন ‘অ্যাজাক্স’ এর নীল নকশা। পরিকল্পনা মতে ইরানি সেনাবাহিনীতে ঘটানো হলো অভ্যুত্থান।

প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেগ পদচ্যুত হলেন। তার স্থানে আজ্ঞাবহ জেনারেল ফজলুল্লাহ জাহেদীকে নিয়োগ দেওয়া হলো। কিন্তু মূল ক্ষমতা রাখা হলো ইঙ্গো মার্কিন সাম্রাজ্যের অনুগত মোহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভির হাতে। এ ঘটনার একদিনের মাথায় সেনাবাহিনীতে একটি কাউন্টার অভ্যুত্থান ঘটে। অভ্যুত্থানকারীরা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেগকে উদ্ধার করেন। অন্যদিকে শাহ পালিয়ে গেলেন বাগদাদে এবং এরপর ইতালিতে। কিন্তু এর দুই দিন পর আরও একটি রক্তাক্ত পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটানো হয় সেনাবাহিনীতে। ফলে মার্কিন-ব্রিটেনের নীল নকশা অপারেশন অ্যাজাক্স সফল হয় শতভাগ।

কিন্তু মোসাদ্দেগ বেশি দিন ক্ষমতায় থাকতে পারেননি। শিয়া ওলামাদের গণঅভ্যুত্থানে ১৯৫৩ সালে ক্ষমতা ছেড়ে দেশ  থেকে পলায়নে বাধ্য হন তিনি। অধিকাংশ বিশ্লেষকের ধারণা, এই অভ্যুত্থানের পেছনে সিআইএ এবং মোসাদের হাত রয়েছে। যা-ই হোক, মোসাদ্দেগের অপসারণ  মোহাম্মদ শাহের জন্য আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়ায়।

 তিনি ধীরে ধীরে ক্ষমতাবৃদ্ধি করতে থাকেন এবং নিজের বাবার পথেই হাঁটেন। '৬০ এর দশকেই তিনি কুখ্যাত স্বৈরশাসক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। হিটলারীয় পন্থায় তিনিও একটি গোপন পুলিশ ফোর্স ‘সাভাক’ গঠন করেন, যার প্রধান কাজই ছিল বিরুদ্ধ মত দমন করা। ১৯৭৫ সালে শাহ তার জীবনের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ভুলটি করেন। তিনি দেশের প্রধান এবং বড় দুই রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত ঘোষণা করে তাদের স্থলে ‘রিসার্জেন্স পার্টি’ প্রতিষ্ঠা করেন।

 

রিসার্জেন্স পার্টি প্রতিষ্ঠার পরই ইরানের ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ সময়গুলোর একটি শুরু হয়। শাহ হয়ে ওঠেন একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী। রাজনৈতিক নির্যাতন, সংবাদপত্রের উপর কঠোর বিধিনিষেধ, বিরুদ্ধমতকে গলা চেপে ধরা, আইন শৃঙ্খলার সার্বিক অবনতি, রাজনৈতিক হত্যা ও গুম ইত্যাদির মধ্য দিয়ে ইরানি সাধারণ মানুষের মাঝে ত্রাসের রাজত্য কায়েম করেন শাহ। ছোটখাট প্রতিবাদ, আন্দোলন তখনও হচ্ছিল। কিন্তু শাহের স্বৈরাচারী রাষ্ট্রযন্ত্রের সামনে সব আন্দোলন অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। অনেকে প্রতিবাদ করলে কারাবরণ করতে হতো। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ মতামত প্রকাশ করেন যে, শাহের বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলন গড়ে ওঠা সম্ভব নয়। অবস্থাদৃষ্টে, শাহ যেন চিরস্থায়ী আসনই পেতে ফেলেছিলেন!

 

ব্ল্যাক ফ্রাইডে

রেজা শাহ পাহলভি ছিলেন পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত। তার স্ত্রী, সন্তানরাও পশ্চিমা বেশভূষায় চলতেন। শাহ এবং তার স্ত্রী সব রাজকীয় অনুষ্ঠান এবং দেশি-বিদেশি সরকারি অনুষ্ঠানসমূহে পশ্চিমাদের পোশাক পরতেন। এসব কারণে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা প্রতিনিয়ত ফুঁসে উঠতে থাকেন। আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি ছিলেন একজন অপরিচিত ধর্মীয় ইমাম। মুসলমানদের এই মনের কষ্ট তিনি বুঝতে পেরে ইরাকের পবিত্র নাজাফ শহরে একটি জনসভা আহ্বান করেন। অবাক করার মতো সেখানে লাখ লাখ লোকের সমাবেশ হয়। শাহের সরকার প্রথমে এই বিশাল সমাবেশকে তেমন পাত্তা দেয়নি। কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকল দ্রুত। শিয়া-সুন্নি নির্বিশেষে বিক্ষুব্ধ মুসলমানরা নেমে এলেন তেহরানের রাজপথে। সংখ্যায় ছিলেন তারা অগণিত। সেদিন ছিল শুক্রবার। ১৯৭৮ সালের ৮ সেপ্টেম্বর। প্রায় ৬০ থেকে ৭০ লাখ লোক তেহরানে জমায়েত হয়। শাহের বিশাল বাহিনী তেহরানের জালেহ স্কয়ারে জনসমাবেশের ওপর নৃশংসভাবে গুলি চালিয়ে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করে। ইতিহাসে এটি ব্ল্যাক ফ্রাইডে নামে পরিচিত। বলা হয়ে থাকে, ৮৪-১৫ হাজারের মতো মানুষ এদিন প্রাণ হারান। এ ছাড়া ২০৫-৮ হাজারের মতো আহত হন।

 

 

এলেন ইরান বিপ্লবের নায়ক

ইরান বিপ্লবের পর দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন আয়াতুল্লাহ খোমেনি। তিনি ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব ইরান’ এর জন্য গণভোটের আয়োজন করেন। ওই গণভোটের মাধ্যমে ইরানের জনগণ ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে রায় দেন। সেই সময় ইসলামী প্রজাতন্ত্রের পক্ষে ৯৮ দশমিক ২ শতাংশ ভোট পড়েছিল। এরপর ১৯৭৯ সালের ১ এপ্রিল ইরানকে একটি ইসলামী প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়। নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী বাছাই করার প্রক্রিয়া অনুমোদন করে তিনি ইরানকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে  ঘোষণা দেন। ১৪ বছরেরও বিশি সময় তিনি নির্বাসনে ছিলেন। যার বেশির ভাগ সময় ইরাকের নাজাফ শহরে কাটান। ১৯৭৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারি দীর্ঘ নির্বাসন জীবন কাটিয়ে ইরানে ফিরে এলে লাখো জনতা খোমেনিকে বরণ করে নেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ১৯৭৯ সালের ৩ জুন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আজও ইরানিরা আয়াতুল্লাহ খোমেনিকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে থাকেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর