শনিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

আবার হিরো ট্রুডো

তানভীর আহমেদ

আবার হিরো ট্রুডো

প্রেসিডেন্ট নিক্সন বলেছিলেন, এই বাচ্চাটা  একদিন প্রধানমন্ত্রী হবে...

পিয়েরে ট্রুডো ছিলেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর অফিসে কোলে করে নিয়ে আসতেন তার সন্তানদের। অফিসজুড়ে তারা ছুটোছুটি করত। তাদের মধ্যে এক সন্তান অফিসে গিয়ে সোজা গিয়ে বসে পড়ত প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে। এ নিয়ে গণমাধ্যমে ছবিও প্রকাশ পায়। কানাডার সাধারণ লোকজন সেই ছবি দেখে বলত, বাপ কা ব্যাটা। প্রধানমন্ত্রী বাবার হাস্যোজ্জ্বল মুখ, প্রধানমন্ত্রীর অফিশিয়াল চেয়ারে বসা তার চার বছর বয়সী সন্তান। এরই মাঝে অটোয়াতে রাষ্ট্রীয় সফরে এসেছিলেন আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন। তার পিছু নিয়েছে আন্তর্জাতিক ফটো সাংবাদিকরা। সফরকালে রাষ্ট্রীয় ভোজসভায় কানাডার প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডো ও তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বসেছেন রিচার্ড নিক্সন। পিয়েরে ট্রুডোর কোলে থাকা তার শিশুটিকে দেখে প্রেসিডেন্ট নিক্সন মজা করে বলেন, এই শিশুটি একদিন কানাডার প্রধানমন্ত্রী হবে। লোকজন তো তাই বলে! সেই রসিকতা কিন্তু হাসি ঠাট্টায় মিলিয়ে যায়নি। সেই ভবিষ্যদ্বাণী একদিন সত্যি হয়েছে! ৪৩ বছর পর সেই শিশুটিই হলেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী। তাও একবার নয়। দুবার! পিয়েরে ট্রুডোর সন্তান জাস্টিন ট্রুডো দ্বিতীয় দফায় নির্বাচিত হয়েছেন। পরপর দুবার কানাডার প্রধানমন্ত্রী হলেন তিনি। প্রথমবার মাত্র ৪৩ বছর বয়সে কানাডার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তিনিই হলেন কানাডার ইতিহাসে প্রথম প্রধানমন্ত্রী যার বাবাও ছিলেন একজন প্রধানমন্ত্রী। ২০১৫ সালের নির্বাচনে কনজারভেটিভ দলের ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপারকে বিপুল ভোটে হারিয়ে বিজয়ী হন লিবারেল পার্টির নেতা ট্রুডো। প্রায় নয় বছর পর কানাডায় কনজারভেটিভদের হারিয়ে বিজয় লাভ করে দেশটির লিবারেল পার্টি। ২০১৯ সালে এসে ১৫৮টি সিট পেয়েছে লিবারেল পার্টি।

রাজনীতিতে এসেই চমক

পারিবারিকভাবে রাজনৈতিক পরিবেশে বেড়ে উঠলেও তিনি রাজনীতি শুরু করেন ২০০৮ সালে। এর আগে এই তরুণ নানা পেশায় জড়িয়েছেন। জাস্টিন ট্রুডো গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে শিক্ষকতা পেশা বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু তার বাবা মারা যাওয়ার পর তিনি রাজনীতিতে ঝুঁকে পড়েন। তখন থেকেই তিনি আলোচনায় ছিলেন। দুটি কারণে তার জনপ্রিয়তার পারদ ধীরে ধীরে উপরে উঠতে থাকে। প্রধানমন্ত্রীর ছেলে বলে কানাডার রাজনীতিতে বাড়তি সুবিধা পাওয়ার জো নেই। জাস্টিন ট্রুডো সবার নজর কাড়েন কথা দিয়ে। দারুণ গুছিয়ে কথা বলতে পারেন। যতক্ষণ বক্তৃতা দেন শ্রোতারা জাদুমন্ত্রের মতো মুগ্ধ হয়ে থাকেন। খুব সহজেই মানুষের মনের চাওয়া-পাওয়া, দাবি- অভিযোগ তুলে ধরেন বক্তৃতায়। এ কারণে সাধারণ মানুষের কাছে তিনি বেশ গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে যান। দ্বিতীয়ত, সাধারণ জীবন। বড় নেতার এই গুণ তার মধ্যেও রয়েছে ট্রেনে, রেস্টুরেন্টে, স্টেডিয়ামে যেখানেই যান, গিয়ে বসেন সাধারণ মানুষের কাতারে। দুবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলেও এখনো সাধারণ মানুষ থেকে তাকে বিলাসিতায় অথবা ক্ষমতা আলাদা করে দেখার জো নেই। রাস্তায় দাঁড়ানো মানুষের সঙ্গে সেলফি তোলেন, বাচ্চা পেলে কোলে তুলে হেঁটে বেড়ান। রেস্টুরেন্টে খাবার অর্ডার করে সবার সঙ্গে খেতে বসে যান। সকালে মর্নিং ওয়ার্কের জন্য দৌড়াতে শুরু করেন। সঙ্গেই থাকে শহরের অন্য সাধারণ মানুষ। তাদের কথা শোনেন, আড্ডা দেন। কলেজ জীবনে বক্সিং খেলতেন। রাজনীতিতে নামার আগেই তিনি দেশে তারকা। সুন্দরীদের কাছে তার আবেদনও কম ছিল না। সব মিলিয়ে, সাধারণ মানুষ তাদের নিকটজন বলে মেনে নিয়েছে অনেক আগেই। যখন ভোট চাইলেন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য তখন তার বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে। যুবক বয়সেই সবার আস্থা আর ভালোবাসায় মাখামাখি তার। তারই প্রতিদান পেলেন। কানাডার পরপর দুবারের প্রধানমন্ত্রী হলেন। তার শুরুটা হয়েছিল, ২০০৮ সালে মন্ট্রিয়লের পাপিনিউ থেকে এমপি নির্বাচিত হয়ে। সকালের সূর্য গোটা দিনের প্রতিচ্ছবি- কানাডার প্রভাবশালী পত্রিকা গ্লোব অ্যান্ড মেইলের প্রধান সম্পাদক এডওয়ার্ড গ্রিনস্পন তার সম্পাদকীয়তে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন এই বলে যে, নতুনদের মধ্যে তিনিই হয়তো আগামীর প্রধানমন্ত্রী। ২০১১ সালের নির্বাচন। লিবারেল পার্টির অবস্থা তখন নাজুক। কিন্তু চমক দেখালেন ট্রুডো। ২০১১ সালের নির্বাচনে যেখানে লিবারেল পার্টির আসন সংখ্যা ছিল মাত্র ৩৬টি সেখানে এবারের নির্বাচনে তার দল আসন পায় ১৮৪টি। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজন ছিল ১৭০টি। তিনি তারচেয়েও ১৪টি বেশি আসন পান। নির্বাচনে ভরাডুবির পর মাইকেল পদত্যাগ করেন দলের নেতৃত্ব থেকে। ২০১৩ সালে জাস্টিন ট্রুডো দলনেতা পদে  প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন এবং বিপুল সমর্থন পেয়ে দলের নেতৃত্ব নেন। লিবারেল পার্টির প্রধান নেতা হিসেবে তিনি ২০১৫ সালের জাতীয় নির্বাচনে নামেন। মাত্র এক বছর নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে জয় ছিনিয়ে নেন তিনি। প্রথম দফা প্রধানমন্ত্রী থেকেই দ্বিতীয় দফা নির্বাচনে নামেন ২০১৯ সালে। সাধারণ মানুষ এবারও ট্রুডোকেই বেছে নিল কানাডার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে।

 

যে কারণে বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়তা তার

৪৩ বছর বয়সে প্রথম কানাডার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন জাস্টিন ট্রুডো। কানাডার সবচেয়ে কম বয়স্ক প্রধানমন্ত্রীর তালিকায় তিনি রয়েছেন দুই নম্বরে। কিন্তু হাস্যোজ্জ্বল, খোলা মনের ও চটপটে তারুণ্যেমাখা প্রধানমন্ত্রীর কথা এলে তিনি এক নম্বরে। রাজনীতিবিদ ও প্রধানমন্ত্রীর কথা উঠলে আমরা ভেবেই নেই ব্যক্তিটি রাশভারী। গম্ভীর মুখে, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার বহর নিয়ে সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকবেন তিনি। না, সে ভাবনায় ছেদ ফেলেছেন জাস্টিন ট্রুডো। রাস্তায় নেচে গেয়ে ভক্তদের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগিতেই তিনি বরং  স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। ফেসবুক, টুইটারে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় তার নাচ। ভারতীয় উৎসব সংগীত ‘হাদিপ্পা’ এর সঙ্গে তার নাচে কোটি কোটি মানুষ আনন্দ পেয়েছে। কোর্তা-পায়জামা পরে এ ধরনের নাচ নতুন নয় তার জন্য। এর আগে নির্বাচনী প্রচারণাতেও তাকে রাস্তায় নাচতে দেখা গেছে। টরেন্টো গিয়ে চীনা নববর্ষ উদযাপনেও সিংহ পুতুলের সঙ্গে তিনি নেচে গেয়ে আনন্দ করেন। রেগিনা মোসাইক কালচার ফেস্টিভ্যালেও স্টেজ মাতিয়েছেন তিনি। শার্ট-প্যান্ট পরেই দর্শকদের আনন্দ-উল্লাসে নেচে শামিল হন তিনি। ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে তার ভালোলাগার গল্প এখন আর কারোই অজানা নেই। ত্রিনিদাদে গিয়ে ভারতীয় উৎসব সংগীতে নেচেছিলেন তিনি। তার উদার মনের এই শারীরিক প্রকাশই তাকে সাধারণের কাছে আলোচনায় এনেছে। অন্য প্রধানমন্ত্রীদের মতো বড়সড় নিরাপত্তা বহর নিয়ে ছোটেন না তিনি। তার পরিবারের অতীত ঘাঁটলে জানা যাবে তিনি বেড়েই উঠেছেন বেশ রাজনৈতিক পরিবেশে। তার দাদা ছিলেন প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের একজন। তার নানা ছিলেন এমপি এবং মন্ত্রী। তার বাবা ছিলেন কানাডার প্রেসিডেন্ট। তার মা ছিলেন, অভিনেত্রী, জনপ্রিয় টেলিভিশন উপস্থাপক। তার স্ত্রী সোফিয়াও একজন খ্যাতনামা মডেল, উপস্থাপিকা। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে জাস্টিন ট্রুডো নানা পেশায় জড়িয়েছেন। বরফে স্কি করার স্নো-বার্ডিং খেলায় তিনি পেশাদার কোচ ছিলেন। নাইট ক্লাবের গেটে দারোয়ান হিসেবেও কাজ করেছেন। বরফে ছোটার ‘র‌্যাফটিং গাইড’ও ছিলেন তিনি। এ ছাড়া অভিনেতা ও ক্যাম্প কাউন্সিলর হিসেবে রয়েছে তার সুনাম। করেছেন শিক্ষকতা। বন্ধুদের পাল্ল­ায় পড়ে অল্পবিস্তর গাঁজাও পান করেছেন- সহজ স্বীকারোক্তি তার। এখন সেসব ছেড়েছেন পুরোপুরি। ক্ষমতার মালিক হয়ে গেলেই যে নেতারা বদলে যান- সেই ধারণা ভেঙে দিয়েছেন তিনি। বরং সব শ্রেণির মানুষের মনই জয় করে নিয়েছেন। ধর্ম, জাতি, ভাষা ও শ্রেণির বিভেদ ভুলে সবাইকে কাছে টেনে নিয়েছেন, প্রাপ্য সম্মান দিয়েছেন বলেই তিনি সবার চেয়ে আলাদা। নির্বাচিত হওয়ার পর সিরিয়া ও তুরস্কের শরণার্থীদের কানাডায় আশ্রয় দিয়েছেন। মধ্যবিত্তের করের বোঝা কমিয়ে বাড়িয়েছেন ধনীদের।

চুটিয়ে প্রেম তারপর বিয়ে

শুধু রাজনীতিতে নয়, প্রেমিক হিসেবেও দারুণ সফল ট্রুডো। স্ত্রী সোফিয়ার সঙ্গে দীর্ঘদিনের প্রেমের গল্পের শুরুটা বেশ মজার। ২০০৩ সালের ঘটনা। একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানের জন্য তহবিল উঠানোর অনুষ্ঠানে প্রথম চোখে চোখে কথা হয় দুজনের। সোফিয়াকে কিন্তু আগে থেকেই চিনতেন ট্রুডো। তবে প্রেমের ব্যাপারে কেউই পা বাড়াননি। জাস্টিনের ছোট ভাইয়ের সহপাঠিনী ছিলেন সোফিয়া। সে হিসেবে চেনাজানা ছিল তাদের। সেই চ্যারিটি অনুষ্ঠানের পর চুটিয়ে প্রেম শুরু করেন। এরপর ২০০৪ সালের অক্টোবরে এনগেজমেন্ট সারেন। আর ২০০৫ সালের মে মাসে করেন বিয়ে। এখন তাদের সংসারে রয়েছে তিন সন্তান।

শরণার্থীদের বন্ধু

হাতে এঁকেছেন ট্যাটু। যোগব্যায়াম করেন নিয়মিত। সব দিক থেকেই সবার চেয়ে আলাদা। রাষ্ট্রনায়ক হিসেবেও তিনি ব্যতিক্রম। শরণার্থীদের মানবাধিকার নিয়ে বড় বড় কথা বলা পশ্চিমা বিশ্ব শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে নারাজ। না খেয়ে, চিকিৎসাসেবা না পেয়ে, মরুভূমি পেরিয়ে, সমুদ্রে ভেসে যখন শরণার্থীরা পৌঁছাচ্ছে তাদের সীমান্তে তখন কাঁটাতার দিয়ে আটকে দিচ্ছে তারা। এই জায়গাতেই চোখে জল আর বুকে ভালোবাসা নিয়ে কানাডার প্রধানমন্ত্রী বললেন, ইউ আর ওয়েলকাম। কানাডার দরজা খুলে দিয়েছেন শরণার্থীদের জন্য। তাদের খাবার দিচ্ছেন, ঘর দিচ্ছেন। কাজের  সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছেন। মানবতার কথা মুখের বুলি নয় তার কাছে। ২০১৫ সালে কানাডার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই শরণার্থীদের জন্য দরজা খুলে দিয়েছেন তিনি। প্রথম চার মাসেই প্রায় ২৫ হাজার শরণার্থীকে কানাডায় আশ্রয় দেন। মুসলমানদের প্রতি সহানুভূতিশীল এই তরুণ প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন- ‘ধর্মবিশ্বাস যাই হোক না কেন নির্যাতন, সন্ত্রাস ও যুদ্ধপীড়িত অঞ্চল থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থীরা কানাডায় স্বাগত।’

 

নারী ভক্তদের কাণ্ড

এখন তার বয়স ৪৭ বছর। উচ্চতা ৬ ফুট ২ ইঞ্চি। এমন প্রধানমন্ত্রী কে কবে দেখেছেন? বক্সিং খেলছেন, রেস্টুরেন্টে বসে আড্ডা দিচ্ছেন সাধারণ মানুষের সঙ্গে। বাচ্চাদের পেলে খেলায় মজছেন। ঘরোয়া অনুষ্ঠানে নেচে গেয়ে সবাইকে চমকে দিচ্ছেন। দারুণ ফ্যাশনেবল ট্রুডো। কথা বলার স্টাইল আর স্মার্ট চলন-বলন দেখে নারীভক্তের বাড়াবাড়ি থেমে নেই। কানাডার প্রধানমন্ত্রীর প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া নারী ভক্তরা তাই ইন্টারনেটে খোঁজ নেন, ইজ কানাডিয়ান প্রাইম মিনিস্টার ম্যারিড? নারী ভক্তদের প্রবল কৌতূহল দেখে সার্চ ইঞ্জিন গুগল মজার কা- ঘটিয়েছে। কানাডিয়ান প্রধানমন্ত্রী কি বিবাহিত- এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে গুগল ট্রুডোর স্ত্রী সোফিয়ার ছবি দেখাচ্ছে। নারী ভক্তরা যা বোঝার, বুঝে নিক!

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর