বুধবার, ১৩ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

অন্যরকম জাদুকর

তানভীর আহমেদ

অন্যরকম জাদুকর

হুমায়ূন আহমেদ। বাংলা সাহিত্যের কলম জাদুকর হিসেবে নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। ব্যক্তিজীবনে জাদু নিয়ে তার আগ্রহের কমতি ছিল না। তার লেখা বিভিন্ন গল্প, উপন্যাস, নাটক ও চলচ্চিত্রে জাদুর উপস্থিতি প্রমাণ করে তিনি কতটা জাদুমুগ্ধ ছিলেন। অতিবাস্তব চরিত্রায়ন ও উপস্থাপনার মুনশিয়ানার পাশাপাশি জাদুর প্রতি তার আগ্রহ পাঠক ও সাধারণ ভক্তদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে আছে আজও। জাদুর প্রতি তার প্রথম ভালো লাগার শুরু শৈশবেই। স্থান সিলেটের মীরা বাজার। দুরন্ত শৈশবে ঘুরে বেড়াতেন এখানেই। সময় পেলেই মীরা বাজারে ছুটে যেতেন। সঙ্গী কেউ ছিল না। একা একা ঘুরে বেড়াতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। একদিন দিলশাদ সিনেমা হলের টাঙানো পোস্টার দেখতে গিয়ে ভিড় লক্ষ্য করেন তিনি। সিনেমা হলের সামনে একজন জাদুকর ম্যাজিক দেখাচ্ছিলেন। অদ্ভুত সব জাদু তাকে মুগ্ধ করে। জাদুটা ছিল অনেকটা এরকমÑ কাঠের একটি তক্তার সঙ্গে গা লাগিয়ে এক বালিকা দাঁড়িয়ে আছে। তার থেকে ১০-১২ ফুট দূরত্বে চোখ বাঁধা অবস্থায় দাঁড়িয়ে জাদুকর বালিকাটির দিকে ছুরি ছুড়ে মারছেন। কিন্তু একটি ছুরিও বালিকার গায়ে লাগছে না। জাদুর এই অদ্ভুত রোমাঞ্চে হুমায়ূন আহমেদ জাদুর প্রেমে পড়ে যান। কিন্তু তার জাদুবিদ্যায় হাতেখড়ি ঘটে ১৯৬৫ সালে। তখন তিনি সবেমাত্র ঢাকা কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হয়েছেন। এবার ঢাকার পথে ঘুরতে গিয়ে একদিন দেখা পেয়ে গেলেন এক হকার ম্যাজিশিয়ানের। তিনি দাঁড়িয়ে থেকে উৎসুক মানুষের সঙ্গে জাদুকরের মনভুলানো জাদু দেখতে থাকলেন। জাদু শেষ হলে সবাই যার যার পথে চলে গেলেও দাঁড়িয়ে রইলেন হুমায়ূন। তিনি তখনই হকার ম্যাজিশিয়ানের কাছে জাদু শেখার ইচ্ছার কথা জানান। জাদুকরও কিছু টাকার বিনিময়ে কয়েকটি জাদুর কৌশল তাকে শেখান। জাদুমুগ্ধতা যেন আরও বেড়ে গেল তার। যেকটা জাদুর কৌশল শিখেছেন সেকটা বার বার অনুশীলন করে চললেন। হুমায়ূন আহমেদের জাদুগুরু সেই হকার ম্যাজিশিয়ান বেশির ভাগই জাদু দেখাতেন চানখাঁরপুলের এক বস্তিতে। চানখাঁরপুলের সেই বস্তিতে হুমায়ূন আহমেদ ছুটে যেতেন তার জাদুগুরুর কাছে। শুধু অবাক বিস্ময়ে জাদুই দেখতেন না পাশাপাশি তিনি আরও জাদুর কৌশল রপ্ত করতে শুরু করেন। এমনো হয়েছে টিফিন না খেয়ে টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে তিনি হকার ম্যাজিশিয়ানের কাছ থেকে ছোট ছোট ম্যাজিকের সরঞ্জাম কিনতেন। জাদুবিদ্যায় তার হাতেখড়ি হওয়ার পর জাদুর প্রতি তার ভালোবাসা বেড়েই চলল। জাদুর নতুন সব কৌশল আয়ত্ত করার প্রতি তিনি আরও আগ্রহী হয়ে ওঠেন। নতুন নতুন জাদুর কৌশল সম্পর্কে জানার জন্য তিনি জাদু বিষয়ে বিভিন্ন বই সংগ্রহ করতে শুরু করেন। দেশে তো বটেই বিদেশ ভ্রমণে গেলেও তিনি জাদুর সামগ্রী বিক্রি করে এমন দোকান বা জার্নালের খোঁজ নিতেন। তার সংগ্রহে জাদু সম্পর্কিত বহু বই ছিল। জাদুবিদ্যায় প্ল্যানচেট দিয়ে আত্মা আনার চেষ্টা করা হয়ে থাকে। কথিত আছে, হুমায়ূন আহমেদ তার সংগ্রহে থাকা প্ল্যানচেট দিয়ে মৃত আত্মার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলেন। প্ল্যানচেট ব্যবহার করে তিনি বেশ বিপদেও পড়েছিলেন বলে জানা যায়। হুমায়ূন আহমেদ জাদু কৌশল রপ্ত করার জন্য প্রায়শই জাদু প্রদর্শন করতেন। নিকটজনদের কাছে তিনি বিভিন্ন সময় জাদু দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। তিনি কলেজ ও ইউনিভার্সিটির লম্বা ছুটি কাটাতে যখন পরিবারের সদস্যদের কাছে আসতেন তখন তার সঙ্গী ছিল জাদু দেখানোর সহজ সরল সরঞ্জামগুলো। এ ছাড়া কৌশলী জাদু দেখিয়ে পরিবারের সদস্যদের বিস্মিত করতেন। লেখালেখির পাশাপাশি যখন হুমায়ূন আহমেদ নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মাণের দিকে ঝুঁকে গেলেন তখনো তার জাদুপ্রীতি এতটুকুও কমেনি। তিনি তার নাটক ও চলচ্চিত্র ইউনিটের লোকজনের সামনে, বন্ধু মহলে ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সামনে শখের বশে জাদু দেখিয়ে আনন্দ পেতেন। জাদু দেখিয়ে মানুষকে চমকে দেওয়াটাকে বেশ উপভোগ করতেন তিনি। স্বনামধন্য লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে এক আড্ডায় জাদু দেখিয়েছিলেন তিনি। হঠাৎই আড্ডার একপর্যায়ে হুমায়ূন আহমেদ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে বলেন, অ্যাসট্রে থেকে একটু ছাই তুলে নিতে। তারপর তুলে নেওয়া ছাই অন্য হাতের পিঠে ঘষে ঘষে মিলিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। তার কথামতো তাই করলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। কিছুক্ষণ পর তার সেই হাত উল্টে দেখতে বললেন কলম জাদুকর। হাত উল্টে দেখতেই সেখানে উপস্থিত সবাই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। কারণ হাতের পিঠের ছাই হাত ভেদ করে তালুতে চলে গেছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় রীতিমতো ভিরমি খেলেন তার জাদুতে। 

হুমায়ূন আহমেদ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তার খুব কাছের মানুষকে এভাবে জাদু দেখিয়ে বিস্মিত করতে পছন্দ করতেন। সবাই মিলে বসে আড্ডা দেওয়ার একপর্যায়ে তিনি হুট করেই জাদু দেখিয়ে বসতেন। মুহূর্তে সবাইকে হতবাক করে দিতে তিনি সিদ্ধহস্ত। ইন্টারন্যাশনাল ব্রাদারহুড অব ম্যাজিশিয়ান্স বিশ্বজুড়ে জাদুশিল্পীদের সর্ববৃহৎ জাদু সংগঠন। হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন এই আন্তর্জাতিক জাদু সংগঠনের একজন সম্মানিত সদস্য। কলম জাদুকরের জাদুমুগ্ধতা ছিল অকৃত্রিম অনন্য।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর