শনিবার, ১৬ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

পানিতে ঢাকা পর্যটন শহর

তানিয়া তুষ্টি

পানিতে ঢাকা পর্যটন শহর

  দেশ উন্নত হলেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ন্ত্রণে থাকবে এমন কোনো কথা নেই। চকচকে তকতকে শহরগুলোও গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের মতো জলবায়ু পরিবর্তনের বড় শিকার হতে পারে। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ ঠিক এই সময়ে পানিতে ঢেকে গেছে ইতালির ভেনিস। দেশটিতে চলছে জরুরি অবস্থা। পানিতে ভাসা ভেনিস শহর বিশ্বের অন্যতম পর্যটন তীর্থ। সেই শহরেই পানিবন্দী হয়ে পড়েছে মানুষ। এমনি করে বিশ্বের অনেক পর্যটন শহর ও ব্যস্ততম শহর অনেক সময় পানিকবলিত হয়ে পড়ে। এমন কিছু ঘটনা নিয়েই এ আয়োজন।

 

ডুবে আছে রূপের নগরী ভেনিস

পানির ওপর সারি সারি ভেসে আছে দৃষ্টিনন্দন প্রাসাদ। তার গা ঘেঁষে এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে স্বচ্ছ পানির লেক। পুরো শহরের বুকজুড়ে

থাকা প্রাসাদের প্রতিবিম্ব পড়ছে লেকের পানিতে। এই দৃশ্যপট চিরে বয়ে চলে রঙিন গন্ডলা। সব মিলে ইতালির ভেনিস হয়ে উঠল পৃথিবীর বুকে এক টুকরো রূপনগরী। বর্তমান ভেনিসবাসীর পূর্বসূরিরা রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর উত্তরের দস্যুদের হাত থেকে রক্ষা পেতে চতুর্থ শতকে জলমগ্ন ভেনিসকে বেছে নিয়েছিল। কয়েক শতক ধরে তারা তিলে তিলে গড়ে তোলে শহরটি। প্রথম দিকে গাছের গুঁড়ি দিয়ে পাইলিং করে ভূমি তৈরি করা হয়। একটি ভবনের ভিত্তি গড়তেই কয়েকশ পাইল বা লার্চ গাছের কা- গাড়তে হতো। শহরের প্রকৌশলীরা পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থাও রাখেন। তখন থেকে দূরদর্শিতার সঙ্গে তত্ত্বাবধান চলছে ভেনিস নগরীর। যার জন্য এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর নিরাপত্তায় কোনো ঘাটতি হয়নি কখনো। প্রতিবছর লাখো-কোটি পর্যটকের ভার সামলে স্থানীয় বাসিন্দাদের নিয়ে অপরূপ মহিমায় দাঁড়িয়ে আছে ভেনিস। কিন্তু বিগত ৫০ বছরের মধ্যে বর্তমানে পানির উচ্চতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ফলে বন্যার পানিতে ডুবে গেছে ভেনিস শহরের পর্যটন অঞ্চলগুলো। এখন পর্যন্ত দুজনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে। ক্ষতির পরিমাণ বিপুল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত স্কুলগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে। অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। ভেনিসের মেয়র লুইগি ব্রুগনারোর দাবি, জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি প্রভাবেই এই বন্যা। এক টুইট বার্তায় তিনি জানান, পানির উচ্চতা প্রায় ৬ ফুট (১ দশমিক ৮৭ মিটার) পর্যন্ত উঠেছিল। এর আগে ১৯৬৬ সালে জোয়ারের পানি ১ দশমিক ৯৪ মিটার পর্যন্ত উঠেছিল। গির্জা সূত্রে জানা গেছে, গত ১ হাজার ২০০ বছরের মধ্যে এখানকার ব্যাসিলিকা মাত্র ছয়বার বন্যার পানিতে ডুবেছে। বন্যার পানিতে সবচেয়ে নিচু এলাকা সেন্ট মার্কস স্কয়ার মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইতালির প্রধানমন্ত্রী গুইসেপ কন্তে ভেনিস নগরীতে জরুরি অবস্থা জারি করেছেন।

 

বন্যার কবলে ভারতের পর্যটন নগরী

সৌন্দর্যের লীলাভূমি ভূস্বর্গ ভারতের জম্মু-কাশ্মীর এলাকা। প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক যান এই এলাকা ভ্রমণ করতে। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এই এলাকাও কবলিত হয়েছিল প্রবল বন্যায়। বন্যার কারণ ছিল তুমুল বৃষ্টিপাত। এর ফলে ৩৫০টির মতো গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। মানুষ মারা গিয়েছিল কমপক্ষে ২০০ জন। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল ব্যাপক। এলাকার রাস্তাঘাট, ঘরবাড়িসহ নষ্ট হয়েছিল গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। পৃথিবীর অন্যতম বিস্ময়কর সৌন্দর্যের অধিকারী ভারতের লাদাখ। এটি জম্মু ও কাশ্মীরের একটি অঞ্চল। পাথরের কত রকম রং আর রূপ হতে পারে তা লাদাখ না দেখলে সহজে বোঝা যাবে না। লাদাখে মূলত নিসর্গ, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, বন্যপ্রাণী মিলিয়ে পর্যটন আকর্ষণ সবার ওপরে। এর দক্ষিণে হিমালয় দ্বারা বেষ্টিত। ২০১০ সালের আগস্টে এই লাদাখেরও একটি বৃহৎ অংশজুড়ে বন্যা কবলিত হয়েছিল। লেহ অঞ্চলের প্রধান শহরসহ ৭১টি শহর ও গ্রাম সেই বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কমপক্ষে ২৫ জন লোক মারা গিয়েছিল সে বন্যায়। ঝড় আর ভারি বর্ষণে বন্যার সৃষ্টি হয়। হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে। সম্পত্তি ও অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। সামগ্রিকভাবে এই বন্যায় ৯ হাজার লোক সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

 

 

অস্ট্রেলিয়ার রাস্তায় কুমির

চলতি বছরের শুরুতে অস্ট্রেলিয়ার উত্তর-পূর্ব অংশ চলে যায় বন্যার পানির নিচে। সে সময় স্কুল, কলেজ, ঘরবাড়ি এমনকি বিমানবন্দরও ডুবে গিয়েছিল। এক শতাব্দীর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ এ বন্যায় সেখানে হাজার হাজার ঘরবাড়ি পানিতে ডুবে যায়। বন্যার প্রভাবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কুইন্সল্যান্ড। ধস ও বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঘটে বেশি। কুইন্সল্যান্ড রাজ্যের ব্রিসবেনে কমপক্ষে পাঁচ হাজার ঘরবাড়ি ও সম্পদ বন্যার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেখানকার বাড়ির ছাদ থেকে আটকেপড়া দুর্গতদের উদ্ধার করে অস্ট্রেলিয়ার সেনাবাহিনী। বন্যার পানির তোড়ে রাস্তায় উঠে এসেছিল কুমিরও। কুইন্সল্যান্ড ছাড়াও দেশটির নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্যেও বন্যা দেখা দেয়।

গ্রীষ্মম-লীয় শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সৃষ্ট প্রবল বর্ষণের পর সেখানে বিভিন্ন নদীর পানি বাড়তে থাকে। বিশেষ করে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি সময়টাতে বরাবরই এই অঞ্চলে বেশি বৃষ্টিপাত হয়। কিন্তু এ রকম ভয়াবহ বর্ষণ আগে কখনো দেখেননি বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দারা। টানা ১০ দিনে সেখানে ৩.৩ ফিটের বেশি বৃষ্টিপাত হয়। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত টাউন্সভিল থেকে সাড়ে ৬শর বেশি লোককে তাদের ঘরবাড়ি থেকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়। সেখানে প্রায় ১১ হাজার ঘরবাড়ি বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। অস্ট্রেলিয়ার সেই বন্যায় দুজনের মরদেহ উদ্ধার করে কর্তৃপক্ষ।

 

কানাডায় হাজার বাড়ি প্লাবিত

কানাডার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মানুষকে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য অবিরাম হাতছানি দেয়। শুধু তাই নয়, এর সৌন্দর্য অবলোকন করতে প্রতিবছর অসংখ্য মানুষ বেড়াতে যান। কিন্তু এই পর্যটনের দেশ কানাডা পতিত হয় বন্যায়। এক সপ্তাহ ধরে ভারি বৃষ্টিপাত আর চলে তুষারপাত। ফলে মন্ট্রিয়াল, কুইবেক সিটি, টরোন্টো, ভ্যাঙ্কুভার, ভিক্টোরিয়াসহ অনেক শহর কবলিত হয় প্রবল বন্যায়। ২০১৭ সালের এই বন্যায় যোগাযোগ ব্যবস্থার মারাত্মক অবনতি ঘটে। কানাডার পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশে বন্যার কারণে প্রায় ২ হাজার ঘরবাড়ি তলিয়ে যায়। এতে নিহতের ঘটনাও ঘটে। দুর্গত এলাকায় আটকে পড়ে হাজার হাজার মানুষ। তাদের উদ্ধারে কাজ করেন স্বেচ্ছাসেবক আর কয়েক শ সেনাসদস্য। রাজধানী অটোয়ার আশপাশের অনেক শহরাঞ্চল ও অন্টারিও প্রদেশের রাস্তাঘাট তলিয়ে যায়। কুইবেকে বন্যার কারণে শত শত জনপদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। লেক অন্টারিওর পানির স্তর প্রায় দুই যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থায় প্রবাহিত হয় এই বন্যায়। খবর পাওয়া যায় বন্যার সময় সেখানকার জমে থাকা বরফও গলতে শুরু করেছিল। তাই বিপদ বেড়ে গিয়েছিল অনেক বেশি।

 

 

ব্রাজিলে বন্যায় প্রাণহানি

ব্রাজিলের বাণিজ্যিক নগরী সাও পাওলোতে ভারি বৃষ্টিপাতে সৃষ্টি হয় বন্যার। ২০১৯ সালে মার্চের এই বন্যাতে মারা যায় ১২ জনের মতো। গুরুতর আহত হন আরও অনেকে। ব্রাজিলের সবচেয়ে ঘন জনবসতিপূর্ণ রিবেরাও পিরেস শহরে এই প্রাকৃতিক দুর্যোগে একই পরিবারের চার সদস্য মারা যায়। মধ্যরাতের দিকে একটি বাড়ি ধসে পড়লে এই হতাহতের ঘটনা ঘটে। এম্বু ডাস আর্টেসে অপর এক ভূমিধসের ঘটনায় এক ব্যক্তি নিহত হয়েছে। এ ছাড়া সাও কাইতানো ডু সুলে পানিতে ডুবে তিনজন, সাও পাওলোতে একজন, পার্শ্ববর্তী সান্তো আন্দ্রেতে দুজন ও বাণিজ্যিক নগরী সাও বার্নার্ডো ডো কাম্পোতে একজন মারা যান। দমকল কর্মীরা সাও পাওলোতে কাদামাটি থেকে বেশ কয়েকজনকে উদ্ধার করেন। এর আগে ২০১১ সালে বন্যায় ও ভূমিধসে মারা যায় প্রায় ৩৫০ জন। রিও ডি জেনিরো শহরের কাছে পাহাড়ি এলাকা টেরেসোপোলিস ও এর আশপাশে এই প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া অনেকেই নিখোঁজ হন। প্রচ- বৃষ্টিপাতের কারণে এই বন্যার সৃষ্টি হয়েছিল।

 

রিয়াদের মরুতে বন্যা

মরুভূমির দেশ সৌদি আরবেও মাঝে মাঝে হানা দেয় বন্যা। চলতি বছরের জানুয়ারির শেষ দিকে টানা পাঁচ দিনের ধূলিঝড়সহ ভারি বর্ষণে মদিনা শহর এবং উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা বন্যায় প্লাবিত হয়। সেই বন্যায় ১২ জন নিহত ও আহত হন কয়েক শ মানুষ। টানা বৃষ্টিপাতের ফলে প্লাবিত হয় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রধান প্রধান রাস্তাঘাট। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে তাবুক, আরার ও আল-জাওয়াফ অঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ ঘোষণা করা হয়। রাজধানী রিয়াদও বন্যার কবলে পড়ে। এ ধরনের আবহাওয়ার জন্য রিয়াদ, মক্কা, উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্ত এলাকা, মদিনা, আসির, জাজান ও আল-জাওয়াফ এলাকায় অস্থিতিশীল আবহাওয়া বিরাজ করে। এর আগেও ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে তমুল বর্ষণের ফলে রিয়াদসহ পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ, জাজান, মক্কা ও তাবুকে বন্যা হয়। তখনো ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কবলে পড়ে দেশটি। এ ছাড়া ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে আকস্মিক বন্যায় মারা যান ৩০ জন। বন্যা ছাড়াও তাদের বেশিরভাগের মৃত্যুর কারণ ছিল বিদ্যুৎস্পৃষ্টতা।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর