বুধবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

জুয়ার নগরী লাসভেগাস

সাইফ ইমন

জুয়ার নগরী লাসভেগাস

রাতজাগা শহর

রাতজাগা শহর বলা হয় লাসভেগাসকে। পৃথিবীর বিভিন্ন শহর থেকে বিমানে লাসভেগাসে আসা যায়। এখানকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম ম্যাকারান। এটি প্রমোদনগরী হিসেবে সারা বিশ্বে বিখ্যাত। এখানে জুয়া খেলার ক্যাসিনো ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র তথা সারা বিশ্বের বৃহত্তম হোটেলগুলোর অধিকাংশ অবস্থিত। প্রতি বছর কয়েক কোটি লোক এখানে ভ্রমণের জন্য আসেন। প্রমোদনগরী হিসেবে সারা বিশ্বে বিখ্যাত লাসভেগাস। এখানে জুয়া খেলার  আসর বসে সন্ধ্যা নামতেই। দিনের বেলা এ নগরী ঘুমিয়ে থাকে আর রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই লাসভেগাসের চেহারা বদলাতে থাকে। রকমারি আলোয় হোটেলগুলো আরও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। রাস্তার দুপাশে বড় বড় বাতিস্তম্ভগুলো নানারকম বিজ্ঞাপনের মোড়কে চমকাতে থাকে। মাইলের পর মাইল চোখ জুড়ানো আলোর বন্যা। ঈদ কিংবা পুজোর সময় যেমন আমাদের বাড়িঘর-রাস্তা-প্যান্ডেল-রাস্তার পাশের গাছ নানারকম আলোয় সাজানো হয়, এখানেও তেমন সারা বছরই ঝলমলে! প্রতিটা হোটেলের সামনেই নানারকম আলোর বাহার। কোনো কোনো হোটেলের সামনে বিশাল জলাশয়ের মধ্যে আবার কৃত্রিম ঝরনা! তার ওপর বিভিন্ন রঙের আলোর বিচ্ছুরণে এক অপূর্ব দৃশ্য তৈরি হয়! কোনো হোটেলে রয়েছে সুদৃশ্য লেজার রশ্মির শো। কোথাও বা বাচ্চাদের জন্য আছে নানা রকমের রাইড। দেখে মনে হয় যেন কোনো মেলায় এসে হাজির হয়েছেন। কোনো হোটেলে আছে সার্কাস দেখানোর ব্যবস্থাও। এখানে রাত যত বাড়ে মানুষের ভিড়ও তত বাড়তে থাকে! জীবনের আনন্দের সব রকম উপকরণের পসরা যেন সাজিয়ে বসেছে এ লাসভেগাসে। নানা রকমের দৃশ্য বিভিন্ন বর্ণের আলোর রশ্মিতে দর্শনার্থীদের মনও প্রফুল্ল হয়।

 

হানিমুনের স্বর্গ

পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে হাজার হাজার মাইল পেরিয়ে পর্যটকরা এখানে শুধু মনোরঞ্জনের জন্যই আসেন প্রতি বছর...

একটি মামুলি পশুচারণক্ষেত্র, শস্যক্ষেত্র থেকে আজকের লাসভেগাস হানিমুনের অন্যতম স্বর্গরাজ্য। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে হাজার হাজার মাইল পেরিয়ে পর্যটকরা এখানে শুধু মনোরঞ্জনের জন্যই আসেন প্রতি বছর। সব সময়ে তাই ভিড় লেগেই থাকে। নবদম্পতিদের কাছে যে কয়টি স্থানের আবেদন সবচেয়ে বেশি তার মধ্যে লাসভেগাস শীর্ষে। কথায় আছে এ শহর নাকি ঘুমায় না। যুক্তরাষ্ট্রের এ শহরকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বিশাল অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য। রয়েছে ক্যাসিনো, বার, ডিসকো ও বিশ্বের নামিদামি হোটেল চেইন শপের শাখা। হানিমুন যুগলদের কথা মাথায় রেখে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ট্যুরিজম কোম্পানি। যারা নির্দিষ্ট একটি প্যাকেজের মাধ্যমে গোটা লাসভেগাসের আনন্দ উপভোগ হাতের মুঠোয় এনে দিতে সক্ষম। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে হানিমুন যুগলরা ছুটে আসেন এখানে। বিশেষ করে সামার ভ্যাকেশনে ইউরোপের নবদম্পতিরা সবচেয়ে বেশি পাড়ি জমান লাসভেগাসে।

 

মরুভূমিতে আধুনিক শহর

মাত্র এক শতাব্দী আগেও লাসভেগাস ছিল মরুভূমিঘেরা ছোট্ট একটি রেলপথ সার্ভিস সেন্টার। যার আশপাশে ছিল কিছু বসতি। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শেষে এসে এই লাসভেগাসই পরিণত হয়েছে উন্নত সর্বাধুনিক এক মহানগরীতে। এটা সম্ভব হয়েছে বিচক্ষণ উদ্যোক্তা, উন্নত যোগাযোগ ও যাতায়াত ব্যবস্থা এবং সহনশীল রাজ্য আইন ব্যবস্থার কারণে। এখানকার রাস্তাঘাট একেবারে মসৃণ এবং ভীষণ চওড়া। তিন-চারটে গাড়ি অনায়াসে পাশাপাশি যেতে পারে। এখানে যাওয়ার গোটা রাস্তাই মোহাভি মরুভূমির মধ্য দিয়ে গেছে। কিছু মাইল পাহাড়ি রাস্তায় চলার পর বাকিটা  গেছে উপত্যকার মধ্য দিয়ে।

 

হাসপাতালও যেখানে চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য

লাসভেগাসের ঝকঝকে অংশটুকুর বাইরে আর পাঁচটা পশ্চিমা শহরের মতো একটি সাধারণ শহর রয়েছে। যেখানে হোটেলের পরিবর্তে স্থায়ী বসতিও আছে। আরও আছে গির্জা, শপিং সেন্টার। এখাসে রয়েছে স্থায়ী বাসিন্দারাও। তাদের জন্য রয়েছে হাসপাতাল। কিন্তু এখানেও জাঁকজমকের ছড়াছড়ি। পৃথিবীর সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ হাসপাতাল সেইন্ট রোজ ডোমিনিকান হসপিটাল এ লাসভেগাসেই। স্প্যানিশ স্থাপত্যকলায় নির্মিত সেইন্ট রোজ ডোমিনিকানের আবেদনময়তা এর বাইরে যেমন রয়েছে তেমনই রয়েছে অভ্যন্তরেও। হাসপাতালের রুমে থেকে রোগীরা দেখতে পারেন চোখ ধাঁধানো লাসভেগাস এবং হাসপাতাল সংলগ্ন মরুভূমির প্রান্তর। অত্যাধুনিক চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি এখানে রোগী এবং দর্শনার্থীদের বিনোদনের জন্য রয়েছে নানা ব্যবস্থা। হাসপাতালের অভ্যন্তরে রয়েছে ইনডোর বাগান। দর্শনার্থীরা এখানে চমৎকার বৈচিত্র্যময় মরুজ উদ্ভিদ জগতের সঙ্গে পরিচিত হতে পারেন।

 

জুয়াড়িদের আখড়া

একজন নার্স নাকি বাজিতে জেতার জন্য একজন রোগীকে হত্যা পর্যন্ত করেছিল। লাসভেগাস আসলে গ্যাম্বলিংয়ের রাজধানী; জুয়ার আদর্শ স্থান...

ক্যাসিনো এবং পতিতালয় মানুষের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে এ লাসভেগাস। গোটা বিশ্ব থেকে জুয়াড়িরা এখানে আসেন। এ শহরের লোকজন এত বেশি জুয়া আসক্ত যে তারা নাকি যে কোনো বিষয় নিয়ে বাজি ধরে। একটি ঘটনা এরকম যে ১৯৮০ সালে লাসভেগাস হাসপাতালের বেশ কিছু কর্মীকে চাকরি থেকে বাদ দিতে হয়েছিল জুয়ার কারণে। কারণ তারা নাকি হাসপাতালের রোগীদের ওপর বাজি ধরত যে কোন রোগী কখন মারা যাবে। এমনকি একজন নার্স নাকি বাজিতে জেতার জন্য একজন রোগীকে হত্যা পর্যন্ত করেছিল। লাসভেগাস আসলেই গ্যাম্বলিংয়ের রাজধানী। এখানকার শ্রেষ্ঠ ক্যাসিনোগুলোতে রয়েছে নানা ধরনের গ্যাম্বলিং প্রচলিত স্টস, রুলে, ব্ল্যাকজ্যাক থেকে শুরু করে ভিডিও হর্স রেসিংও। এক সেন্ট থেকে যে কোনো মূল্যের জুয়া খেলার সুযোগ আছে এখানে। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে ৭১ শতাংশ লোক শুধু জুয়া খেলার উদ্দেশ্যেই আসে লাসভেগাসে।

 

সবচেয়ে  আলোকিত

বিশ্বের সবচেয়ে আলোকিত নগরী এ লাসভেগাস। মহাকাশ থেকে দেখলে পৃথিবীর সবচেয়ে আলো চকচকে যে স্থানটি দেখতে পাওয়া যায় সেটি হলো এই ভেগাস। এখানে সারা রাত মিলিয়ন মিলিয়ন বাতি জ্বলার কারণেই মূলত এ শহর এত ঝলমলে থাকে। সত্যি কথা বলতে, ভেগাসের আসল সৌন্দর্য ফুটে ওঠে রাতের বেলায়। এখানে সব সরকারি দালান, রাস্তার বাতি, পার্কে পুনর্নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করা হয়। ‘বুল্ডার সোলার-১’ নামে ভেগাসে ১০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি সোলার প্ল্যানেল আছে যার যাত্রা শুরু হয় ২০০৮ সালে এবং এতে খরচ হয় প্রায় ৪০ মিলিয়ন ডলার।

 

 

সুপ্রাচীন সংস্কৃতি

লাসভেগাসকে মনোরঞ্জনের রাজধানীও বলেন অনেকে। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে হাজার হাজার মাইল পেরিয়ে পর্যটকরা এখানে শুধু মনোরঞ্জনের জন্যই আসেন প্রতি বছর। সব সময়ে তাই ভিড় লেগেই থাকে। আমেরিকার নেভাদা প্রদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত লাসভেগাসের সংস্কৃতি সুপ্রাচীন। ১৯০৫ সালে এ শহরের জন্ম। তবে নগরের মর্যাদা পায় ১৯১১ সালে। লাসভেগাসের সংস্কৃতি দক্ষিণ আমেরিকার এক সুপ্রাচীন সংস্কৃতি। প্রাগঐতিহাসিক এ সংস্কৃতির বিকাশকাল মোটামুটি ৮০০০-৪৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। কালের বিচারে এ সভ্যতার সময়কাল প্লাইস্টোসিন যুগের একেবারে শেষ দিক থেকে শুরু হয়ে বর্তমান হলোসিন উপযুগে বিস্তৃত বলে ধারণা করে থাকেন ঐতিহাসিকরা। নৃতত্ত্ববিদরা মনে করেন ইকুয়েডরের প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূল অঞ্চলের জটিল জীববৈচিত্র্যের সঙ্গে সঙ্গে সুন্দরভাবে খাপ খাইয়ে অধিবাসীরা এদের বসতিগুলো গড়ে তুলেছিল। এ অঞ্চলে খুঁজে পাওয়া প্রায় ৩১টি সুপ্রাচীন বসতির অবশেষ। এসব জিনিসপত্রের রেডিওকার্বন পরীক্ষায় এদের বয়সের প্রাচীনত্ব সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারিত হয়েছে।

 

মানুষ ছিল শিকারি

লাসভেগাসকে মনোরঞ্জনের রাজধানী বলাই যেতে পারে! পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের অনেক রাজ্যেও জনসম্মুখে মাতলামি করা অপরাধ বলে বিবেচিত হলেও লাস ভেগাসে প্রকাশ্যে মাতলামি করা কোনো অপরাধ নয়। লাসভেগাসে মদ্যপান করা, জনসম্মুখে মাতাল হয়ে ঘুরে বেড়ানো কোনো প্রকার দণ্ডনীয় অপরাধের আওতায় পড়ে না। তাই বলে এখানে অন্যায় কিংবা অপরাধে ভরপুর এমনটি বলা যাবে না। এখানকার মানুষ আমুদে তবে শান্তিপ্রিয়। আগে এখানকার মানুষ ছিল মূলত শিকারি ও সংগ্রাহক। এরা মাছ ধরতে জানত। এদের বসতিতে হাড়ের তৈরি সুচ ও চামচ জাতীয় ইত্যাদি জিনিস থেকে ধারণা করা হয় তারা সুতা দিয়ে জাল এবং সম্ভবত অন্যান্য কাপড়ও বুনতে পারত। নব্যপ্রস্তর যুগের পাথর ও হাড় দিয়ে তৈরি বিভিন্ন ধরনের হাতিয়ার তৈরির প্রমাণ এখানে বিদ্যমান। পরবর্তীকালে এরা আদিম পদ্ধতিতে চাষও শুরু করে। ৬০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ তারা যে লাউ, মেইজ প্রভৃতি কিছু খাদ্যদ্রব্য অন্তত চাষ করতে শুরু করেছিল। এছাড়া কাঠ, বাঁশ, লম্বা ঘাস ও গাছের ছালও এরা ব্যবহার করতে জানত।

 

লাস ভেগাসে কত বিলাসিতা!

বিলাসিতা বলতে সাধারণের ভাবনা, বেশকিছু টাকা খরচ করে দেশে বা দেশের বাইরে ঘুরতে যাওয়া, ভালো রেস্টুরেন্টে খাওয়া, গাড়ি নিয়ে বেড়ানো- এই তো? কিন্তু লাসভেগাসের বিলাসিতার কোনো শেষ নেই। পৃথিবীর যাবতীয় নিষিদ্ধ কাজ এখানে ডাল-ভাত। বিলাসিতার উদাহরণ হিসেবে পরিচিত লাসভেগাসের পামস ক্যাসিনো রিসোর্টের একটি বিলাসী রুমের কথা বলা যায়। এটিই বিশ্বের সবচেয়ে দামি স্যুট। এ রুমটির নাম এমপ্যাথি স্যুট। এতে এক রাতের খরচ হলো ১ লাখ ডলার। এখানে অন্তত দুই রাত থাকতে হবে। তাই কমপক্ষে ২ লাখ ডলার খরচ বহন করতে হবেই। যা প্রায় ১১ কোটি টাকা! এখানে রয়েছে ক্যালিফোর্নিয়া কিং বেডসহ দুটি মাস্টার বেডরুম। এর সঙ্গে প্রাইভেট ম্যাসাজ রুমও আছে। আছে হিলিং সল্ট রুম, ওয়াক-ইন স্টিম শাওয়ার, আর হাইড্রোথেরাপি জেটসহ বাথটাব। যারা আরাম করার পাশাপাশি শরীরটাকে সক্রিয় রাখতে চান তাদের জন্য আছে অত্যাধুনিক ফিটনেস রুম আর একটি প্রাইভেট পুল। লাসভেগাস থেকে ১৭ মাইল পশ্চিমে আছে বিখ্যাত রেড রক ক্যানিয়ন। চারদিকে পাহাড়। আর তার মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে গেছে রাস্তা। দূর থেকে দেখা যায় লাল-ধূসর ও হাল্কা কালো রঙের বিস্তৃত পাহাড় শ্রেণি। লাসভেগাসের পুরো দৃশ্য একবারে চোখে দেখতে আর গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের সৌন্দর্য উপভোগ করতে এখানকার হেলিকপ্টার ভ্রমণ অন্যতম জনপ্রিয় একটি কার্যক্রম। লাসভেগাসের সৌন্দর্য ও আনন্দ এক কথায় পৃথিবীর স্বর্গ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর