বৃহস্পতিবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

অদ্ভুত যত আবাস

সাইফ ইমন

অদ্ভুত যত আবাস

উড়োজাহাজ বাড়িও তৈরি করেছে মানুষ। সেখানে বাসও করছে। লেবাননের মিজিয়ারা অঞ্চলের এক গ্রামে রয়েছে এই উড়োজাহাজ বাড়ি। এ-৩৮৬ উড়োজাহাজের মডেলে নির্মিত এটি।

জলপ্রপাতের ওপর বাড়ি

১৯৩৫ সালে আমেরিকার পূর্ব প্রান্তের প্রদেশ পেনসিলভেনিয়ায় এক অদ্ভুত দৃষ্টিনন্দন বাড়ি তৈরি করেন বিখ্যাত মার্কিন স্থাপত্যবিদ ফ্রাঙ্ক লয়েড রাইট। রাইটের জীবনের সেরা নকশা ছিল এই জলপ্রপাত বাড়ি। কারণ পুরো বাড়িটি নির্মিত হয়েছে একটি জলপ্রপাতের ওপর। তৎকালীন মার্কিন ধনকুবের এডগার পেনসিলভেনিয়ার অ্যাপ্লেশিয়ান পাহাড়ের মাঝে ‘বেয়ার রান’ জলপ্রপাতের অংশে কিছুটা জমি কিনে এই বাড়ি বানানোর  উদ্যোগ নেন বলে  জানা গেছে। স্থাপত্যবিদ লয়েড গোটা জায়গা দেখে সার্ভে করে নিয়ে গেলেন। অনেক রকম নকশা করলেন। কারণ এর আগে এমন বাড়ি তৈরির নজির নেই পৃথিবীতে। কোনো নকশাই তার মনঃপূত হচ্ছিল না। পাহাড়, জঙ্গল আর জলপ্রপাতের সমন্বয়ে এমন বাড়ি নিঃসন্দেহে একটা মাইলফলক। এমন প্রকৃতির মাঝে নির্মিত হয় অবশেষে এই অনিন্দ্য সুন্দর বাড়িটি।

এ যেন রূপকথার গল্প থেকে উঠে আসা কোনো রাজপুরী। একেবারে জলপ্রপাতের ওপর হওয়ায় জলপ্রপাতের অবিরাম শব্দও যেন প্রশান্তি এনে দেয় মনে। পাহাড়ের বুকে ঘরের মধ্যে জল পড়ার শব্দ। সবুজ প্রকৃতির মধ্যে যেন মায়াবি এক পরিবেশ। শুরুতে জলপ্রপাতের ওপর বাড়ি তৈরির কথা ছিল না। কিন্তু ফ্লয়েডের ইচ্ছায় জলপ্রপাতের ওপর নির্মিত হয়েছে। এডগার চেয়েছিলেন বাড়ির সামনে জলপ্রপাত      থাকবে। কিন্তু লয়েডের ডিজাইনে জলপ্রপাতের ওপরেই গোটা বাড়ি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন দেখে মুগ্ধ হন এডগার। গেরুয়া আর কালচে লাল রঙের এই বাড়ি আজো স্থাপত্যবিদ্যায় এক মাইলফলক হয়ে রয়েছে।

অনেকেই আসেন এখানে ঘুরতে। এমন বাড়িতে রাত কাটানো খুবই লোভনীয় ব্যাপার।

পাহাড়ে পাথর বাড়ি

একটা বড় পাথর কেটে সুইমিং পুলও বানানো হয়েছে। পাহাড়ের প্রায় দুই হাজার ফুট উঁচুতে রয়েছে এই স্টোন হাউস ‘সেলরিকো দো বাস্তু’

পাহাড়েও বসবাস পর্তুগালের উত্তরে কাজা দো পেনেদো শহরের প্রান্তে রয়েছে ফাফ পাহাড়। সেই পাহাড়ের ঢালে পাথর কেটে বানানো হয়েছে এক বাড়ি। চারটে গ্রানাইট পাথর আর মাথায় কংক্রিটের ছাদ। এই হলো বাড়ির কাঠামো। তবে ছাদ কংক্রিটের কিনা, তাই নিয়ে মতভেদ আছে। বাড়ির জানালায় আবার বুলেটপ্রুফ কাচ লাগানো। ঘরের ভিতর ‘ফায়ার প্লেস’-এর ব্যবস্থা রয়েছে। একটা বড় পাথর কেটে সুইমিং পুলও বানানো হয়েছে। পাহাড়ের প্রায় দুই হাজার ফুট উঁচুতে রয়েছে এই স্টোন হাউস। স্থানীয়ভাবে পাথরের এই বাড়িটি ‘সেলরিকো দো বাস্তু’ নামে পরিচিত। এখন অবশ্য সে বাড়িতে কেউ থাকে না। কিন্তু ১৯৭২ সালে এটি তৈরি হয়েছিল অবসর সময় কাটানোর জন্য। দুবছর লেগেছিল বাড়িটি তৈরি করতে।

পাথরে বাড়িটির আসল মালিক কে ছিলেন, সেটি জানা যায়নি। তবে এখন স্থানীয় প্রশাসন এটিকে মিউজিয়াম হিসেবে ব্যবহার করছে। সেখানে পুরনো ছবি আর স্থানীয় ইতিহাসের কিছু স্মারক রাখা আছে।

খরস্রোতা নদীর বাড়ি

এক খরস্রোতা নদীর আশপাশে বসবাস করতে শুরু করে কিছু মানুষ। যার আশপাশে ছিল কিছু বসতি। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শেষে সেই নদীর ওপরই ঘর বানানো শুরু করে তারা। ছবিতে দেখা যাচ্ছে যে ঘরটি তা ২০১৩ সালে তৈরি করেছিল এমনই কয়েকজন। সার্বিয়ার ১৬০ কিলোমিটার পশ্চিমে নদীটির নাম ড্রিনা রিভার। এই নদীতে রয়েছে বেশ কিছু পাথরের স্তম্ভ। এই পাথরগুলোর ওপর বাড়ি তৈরি করতে পারলে হবে বসবাসের জন্য আদর্শ এই ভাবনা থেকেই প্রথম তৈরি হয়েছিল বাড়ি। খরস্রোতা এমন নদীর মাঝে রাত কাটানো নিশ্চয়ই দারুণ লোভনীয় ব্যাপার।

কোস্টারিকায় গাছে গাছে বাড়ি

কোস্টারিকার এক গ্রামই গড়ে উঠেছে জঙ্গলের গাছে গাছে বাড়ি তৈরি করে। সভ্যতার শুরুতে মানুষ এমন গাছে গাছে বাড়ি তৈরির প্রক্রিয়া থাকলেও এ সময়ে এসে শত শত গাছের ওপর বাড়ির গ্রাম সত্যিই বিরল। মধ্য আমেরিকার দেশ কোস্টারিকার একদিকে প্রশান্ত মহাসাগর; অন্যদিকে ক্যারিবিয়ান সাগর। পাহাড়, জঙ্গলে ঘেরা এই দেশে বছরে প্রায় ছয়-সাত মাস ধরে বৃষ্টি হয়। দেশের এমন এক বৃষ্টিস্নাত জঙ্গলে প্রায় ১১ বছর আগে আমেরিকার কলোরাডো প্রদেশ থেকে এক দম্পতি এসে ৬২ একর জমি কিনেন। ইচ্ছা ছিল, পর্যটকদের জন্য জঙ্গল কেটে বাড়ি-ঘর তৈরি করবেন। চাষাবাদ করার পরিকল্পনাও তাদের ছিল। কিন্তু জঙ্গল আর প্রকৃতির ভালোবাসায় পড়ে তাদের ভাবনাটাই গেল বদলে। গাছ কাটার বদলে গাছের মধ্যেই বাড়ি করে থাকতে লাগলেন তারা। তারপর আরও বাড়ি তৈরি হলো। সেসব বাড়ি বিক্রি করলেন বেশ ভালো দামে। এভাবে চলতে-চলতে আজ ৬০০ একর জঙ্গলের মালিক সেই দম্পতি।

 

পাখির বাসায় আবাস

সুইডেনে বৌদেন শহরের পাশের জঙ্গলে ২০১০ সালে প্রথম তৈরি হয় এক গাছবাড়ি। বাড়িটির নাম দেওয়া হয় ‘দ্য বার্ডস নেস্ট’

মন মাঝে মাঝেই হয়তো চায় পাখির মতো উড়ে বেড়াতে। কিন্তু পাখির বাসায় থাকতে চায় এমন কি কখনো হয়েছে! কিন্তু এমন ঘটনাই হয়েছে উত্তর ইউরোপের দেশ সুইডেনের ল্যাপল্যান্ড প্রদেশে। এই প্রদেশে লইলো ও বৌদেন নামে দুটি প্রাচীন শহর রয়েছে। পাহাড় আর সমুদ্রে ঘেরা অঞ্চলটি এমনিতেই বিখ্যাত। এখানে আরও আছে বেশ কিছু ন্যাচার পার্ক। জাতিসংঘের ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’-এর মর্যাদাও পেয়েছে এর কয়েকটি। এই অঞ্চলের জঙ্গলে ২০১০ সালে প্রথম তৈরি হয় এক গাছবাড়ি। বাড়িটির নাম দেওয়া হয় ‘দ্য বার্ডস নেস্ট’। বেসরকারি উদ্যোগে এটি তৈরি করা হয়েছিল কেবল পর্যটকদের কথা মাথায় রেখে। জঙ্গলে ঘুরতে এসে সেখানে রাত কাটানোর অভিজ্ঞতা সংগ্রহের জন্য এই পাখির বাসাকেই বেছে নেন আগত মানুষ। চারদিকে গাছের মাঝে ঝুলে রয়েছে কাঠের বাড়ি। তার মধ্যে এই পাখির বাসায় রাত কাটানো নিঃসন্দেহে দারুণ এক অভিজ্ঞতা।

পোল্যান্ডে উল্টো বাড়ি

আগে কখনো একটি উল্টো ঘর দেখেছেন। যদি না দেখে থাকেন তাহলে এখন দেখুন। এই ঘরটি প্রথমবার দেখলে আপনি মনে করবেন এই জায়গায় ভূমিকম্প হয়েছে কিংবা কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাড়ির এমন চেহারা। কিন্তু না এই ঘরটি এ রকম উল্টো ডিজাইন করেই নির্মাণ করা হয়েছে। এই চমকে দেওয়া ঘরটি পোল্যান্ডে অবস্থিত।  আর এটা পেট্রইয়াল ড্যানিয়েল নির্মাণ করেছেন। পৃথিবীর সবচেয়ে আজব ঘরগুলোর মধ্যে এটা একটি। এটা নির্মাণ করতে ১১৪ দিন সময় লেগেছে। শ্রমিকদের এই স্থাপনাটি নির্মাণ করতে অনেক সমস্যারও সম্মুখীন হতে হয়েছিল বলে জানা গেছে।

ইতালির সবুজ বাড়ি

‘ভেন্তিচিঙ্কে ভ্যার্দে’ বাড়িটির নাম। বাংলায় হবে ‘২৫ নম্বর সবুজ বাড়ি’। ইতালির তুরিন শহরের এই সবুজ বাড়িটি যে স্থপতি তৈরি করেছেন তাকে খোদ জুভেন্টাস তুরিন ফুটবল ক্লাবের একটি ‘সবুজ’ হোটেলের নকশা করতে দেওয়া হয়েছে। কারণ বাড়িটি সে অঞ্চলে বিখ্যাত। দেখলে মনে হবে যেন জঙ্গল আর মাচার সংমিশ্রণ বাড়িটা কিন্তু শহরের মধ্যে বাড়ির নাম ভেন্তিচিঙ্কে ভ্যার্দে, অর্থাৎ ‘২৫ নম্বর সবুজ বাড়ি’ নামের বাড়িটির পাঁচ তলায় ১১৫টি বড় বড় টবে নানা ধরনের গাছপালা লাগানো আছে। স্থপতি লুচিয়ানো পিয়া এক ধরনের ‘সবুজ স্থাপত্যের’ স্বপ্ন দেখেছিলেন। স্থপতি এখানে যতটা সম্ভব প্রকৃতিপ্রদত্ত মালমসলা ব্যবহার করার চেষ্টা করেছেন। যাতে রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়নি। যা প্রাকৃতিক নিয়মে পুরনো হয়, সময়ের সঙ্গে বদলাতে থাকে। যেমন এই লার্চ গাছের কাঠ, যার কোনো রাসায়নিক ট্রিটমেন্ট করা হয়নি। এই ইস্পাতেও মরচে ধরবে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা বদলে যাবে। সব মিলিয়ে বেশ একটা সুন্দর এফেক্ট।

রেইনফরেস্ট বাড়ি

লাউকালা দ্বীপটি তাভেউনির উপকূলে অবস্থিত। এখানে রয়েছে সব রেইনফরেস্ট ঘেরা বাড়ি। বাইরে থেকে অতিথিরা সরাসরি ফিজির মূল ভূখ- থেকে নাদি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে দ্বীপের নিজস্ব এয়ারক্রাফটযোগে যাত্রা করে। ফিজির টেকসই ও প্রকৃত সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা দিতে লাইকালার জুড়ি নেই। পুরো দ্বীপে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ নারিকেল গাছ রয়েছে, যা দ্বীপে মানুষের বসবাসের জন্য উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করে। দ্বীপটির মালিকের নাম ডিয়েটরিস ম্যাটচিটজ। তার দেওয়া তথ্যমতে, এক হাজার ৪০০ হেক্টরের এই দ্বীপ পুরোটাই রেইনফরেস্টে সমৃদ্ধ। এখানকার বিচ সাদা বালুময়, আরামদায়ক অনুভূতিপ্রবণ আবহাওয়া ও পর্যাপ্ত সি-ফুডের ব্যবস্থা রয়েছে। এই দ্বীপে অতিথিদের জন্য ফিজি স্টাইলে ২৫টি ভিলা নির্মাণ করা হয়েছে, যা দ্বীপের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট ছোট পাহাড়ের ওপর নির্মিত। নীল সাগরের বুকে এক টুকরো দ্বীপকে আরও সুশোভিত করেছে এখানকার গাছের সারি।

ভাসমান বাড়ির শহর

হল্যান্ড বা নেদারল্যান্ডসের রাজধানী আমস্টারডাম। পানির ওপর গড়ে উঠেছে পুরো শহরটি। নেদারল্যান্ডসের দুই-তৃতীয়াংশ ভূমি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা থেকে নিচে। সে কারণে এই শহরে প্রচুর নদী ছড়িয়ে আছে। জালের মতো ছেয়ে আছে নদীগুলো। এখানে শহর গড়ে উঠতে পারে একসময় এটি কল্পনায়ও ছিল না কারও। বন্যার জল এসে অঞ্চলটিকে তলিয়ে দিত। সব মিলিয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ ছিল এখানে শহর স্থাপনের। কিন্তু আধুনিক স্থাপত্যবিদদের নকশায় সেখানে গড়ে উঠেছে একটি আধুনিক শহর। প্রথমেই বাঁধ দেওয়া হয় শহরের চারপাশে। একেবারেই প্রাচীন বাঁধ দেওয়ার কৌশলই সে ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। তারপর জলের ওপর বাড়ি বানানোর দিকে ঝুঁকে পড়েন নগর পরিকল্পনাবিদরা। জলের তলে ভিত্তি স্থাপন করা হয় বাড়ির। তারপর জলের ওপর বাড়ি বানানো হয়। বেশির ভাগ বাড়িই একতলা। ধীরে ধীরে এই শহর এতটাই নান্দনিক হয়ে ওঠে যে, শহরটিতে বেড়াতে বিশ্বের লাখো মানুষের ঢল নামে। সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা অ্যামস্টেল নদীকে ঘিরে বেড়ে ওঠে। মূলত রাজধানী শহরটি নদীর মোহনায় যুক্ত হয়েছে। আর নর্থ সি ক্যানেলের মাধ্যমে উত্তর সাগরের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে। আমস্টারডামে পর্যটকদের প্রথম পছন্দ ক্যানেল ক্রুজ। ক্রুজ পুরো শহরের ভিতর দিয়ে বয়ে যাওয়া চওড়া ক্যানেল। এ দিয়ে পুরো শহরে চলাচল করা যায়। পর্যটকদের সুবিধার্থে ডাচ ও ইংরেজি দুই ভাষায়ই প্রাসাদ ও রাস্তা সম্পর্কে বিবরণী লিখে রাখা হয়েছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর