শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা
পর্ব - ২

একাত্তরের সেইসব নিষ্ঠুরতার ভয়ঙ্কর চিত্র

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান

একাত্তরের সেইসব নিষ্ঠুরতার ভয়ঙ্কর চিত্র

সাক্ষী ফরিদা বানুর সাক্ষ্যের অংশ :

“আমার নাম ফরিদা বানু, স্বামী জনাব নূরুল হক। আমার বর্তমান বয়স ৭৪ বছর। ১৯৭৩ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে যোগদান করি। আমি অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০০৫ সালে অবসর গ্রহণ করি।

 

আমি শহীদ অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিনের ছোট বোন হিসেবে খুব কাছ থেকে তাকে দেখেছি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ক্রাক ডাউনের পর অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন ছাত্রদের উদ্দেশ করে বলেছিলেনÑ পাকিস্তানের মৃত্যু হলো, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় একটি সময়ের ব্যাপার মাত্র। এরপর থেকে তিনি গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের আর্থিক সাহায্য প্রদান, তাদেরকে কাপড় চোপড় ও ঔষধপত্রাদি সরবরাহে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি একই সময়ে শহীদ পরিবারের সদস্যদেরও খোঁজখবর রাখতেন।

১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর সকালে উঠে দেখি ভাই বাসায় নেই। মুহসীন হলে পানির সরবরাহ ছিল না এই খবর পেয়ে তিনি হলের ভিতরে পাম্প হাউসে কী হয়েছে দেখতে যান। তখন আমাদের ফ্ল্যাটেও পানি ছিল না। সকাল ৮টার দিকে তৎকালীন ইপিআরটিসির একটি কাদামাখা মাইক্রোবাস আমার ভাইয়ের বাসার সামনে এসে দাঁড়ায়। আমার স্বামী আমার ভাইয়ের দোতলা বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতে পান কয়েকটি যুবক গাড়ি থেকে নামে, যাদের মধ্যে দুজন অস্ত্রধারী ছিল, তারা বিল্ডিংয়ে ঢুকে দোতলায় উঠে আমাদের দরজায় কড়া নাড়ে। দরজা খুলে দিলে তারা ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করে গিয়াস উদ্দিন সাহেব কোথায়। তারা যখন জানতে পারে তিনি বাসায় নেই তৎক্ষণাৎ তারা চলে যায় এবং কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে আসে এবং ওরা আমার মামাত ভাই গোলাম কিবরিয়াকে (ওই সময় ওই বাসায় থাকত) সঙ্গে নিয়ে মুহসীন হলে যায়। আমরা দক্ষিণের বারান্দা থেকে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম অপহরণকারীরা আমাদের টেলিফোনের তার বিচ্ছিন্ন করছিল। তাদের এ কর্মকান্ড দেখে আমাদের মনে হয়েছিল এরা সাধারণ অপহরণকারী নয়, এরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একটি দল। কিছুক্ষণ পর কিবরিয়া এসে জানায় অস্ত্রধারীরা মুহসীন হলের পাম্প হাউস থেকে আমার ভাই গিয়াস উদ্দিনকে ধরে একজন দারোয়ানের কাছ থেকে একটি গামছা নিয়ে তাঁর চোখ বেঁধে ওই মাইক্রোবাসে করে নিয়ে যায়।

যখন আমার ভাইকে অপহরণকারীরা চোখ বেঁধে নিয়ে যায় তখন সৈয়দ আনোয়ার হোসেনও মুহসীন হলের পাম্প হাউসে উপস্থিত ছিলেন। তিনি অপহরণের ঘটনাটি দেখেছিলেন বলে আমাদেরকে জানান। এ ছাড়াও রত্না (পি.ডব্লিউ-১) আমাদেরকে বলেছিলেন, যে দুজন অস্ত্রধারী আমাদের বাসায় এসেছিল তাদের সে চিনতে পেরেছে। কারণ সে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সময়ে ইসলামী ছাত্রসংঘের মিছিল-মিটিং করতে দেখেছে। এদের নাম মইন উদ্দিন এবং আশরাফুজ্জামান খান বলে সে উল্লেখ করেছিল।

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এর পর থেকে নানাভাবে খোঁজখবর করে আমরা কোনোভাবে আমাদের ভাইয়ের খোঁজখবর পাইনি। ৪ জানুয়ারি, ১৯৭২ সালে আমরা জানতে পারি, অপহরণে ব্যবহৃত ইপিআরটিসির মাইক্রোবাসের ড্রাইভার মফিজুল হক জানিয়েছে যে, অপহরণকৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও আরও কিছু বুদ্ধিজীবীকে মিরপুর বধ্যভূমিতে নিয়ে আশরাফুজ্জামান খান নিজ হাতে গুলি করে হত্যা করেছে। আমরা এই খবরটি পাই লাশগুলো বধ্যভূমি কবরস্থান থেকে উত্তোলনের পর যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে নিয়ে আসা হয়। সেই রাত্রে মোমেন খান সাহেব এবং আমার স্বামী নূরুল হক সাহেব মর্গে গিয়ে লাশ শনাক্ত করতে চেষ্টা করেন। লাশগুলোর মধ্যে অনেকের লাশই আমাদের পরিচিত ছিল। এদের মধ্যে যাদের লাশ ছিল তারা হলেন- অধ্যাপক সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য, ড. আবুল খায়ের, অধ্যাপক রশিদুল হাসান, আনোয়ার পাশা, ড. ফয়জুল মহি, ড. সিরাজুল হক খান এবং ডাক্তার মর্তুজা।

পরদিন অর্থাৎ ৫ জানুয়ারি আমার ভগ্নিপতি মোমিন খান এবং আমার স্বামী আবারও মিরপুর বধ্যভূমিতে যান এবং আমার ভাইয়ের পরনের লুঙ্গি, পিপিং স্যুটের শার্ট এবং সোয়েটার দেখে এটি আমার ভাই গিয়াস উদ্দিনের লাশ বলে শনাক্ত করেন। তখন লাশটি অর্ধগলিত ও বিকৃত ছিল। তারপর তার লাশ তুলে এনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদে জানাজা পড়ে মসজিদের পাশের গোরস্থানে সমাহিত করা হয়।”

 

ড. এনামুল হক খানের (শহীদ ড. সিরাজুল হক খানের ছেলে)  সাক্ষ্যের অংশ :

“আমি বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর সকাল আনুমানিক সাড়ে ৮টা কি পৌনে ৯টা হবে তখন একটি ইপিআরটিসির কাদামাখা মিনিবাস আমাদের বাসার সামনে এসে থামে। ওই মিনিবাস থেকে ৫-৭ জন সশস্ত্র লোক নেমে এসে আমাদের চারতলার ফ্ল্যাটের কলিং বেল টিপে। এদের পরনে ছিল খাকি রংয়ের কাপড়, গায়ে পুলওভার জড়ানো ছিল, পায়ে ছিল বাদামি রংয়ের কাপড়ের জুতা। কলিং বেলের আওয়াজ পেয়ে আমার ছোট চাচা দরজা খুলে দিলেন, আমি তার পেছনেই ছিলাম। দুটি ফ্ল্যাটের মাঝখানের জায়গায় দুজন এসে দাঁড়ায় এবং তাদের পেছনে অন্যরা সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ছিল। যে দুজন উপরে এসেছিলেন তারা যথেষ্ট কেতাদুরস্ত মানুষ ছিলেন। তাদের একজন জানতে চেয়েছিলেন আমার পিতা ড. সিরাজুল হক খান কোথায় বা এটি তাঁর বাসা কিনা। আমি পেছন থেকে দুজনকেই লক্ষ্য করছিলাম। আমার ছোট কাকা একটু কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে জানিয়েছিলেন আমার বাবা নিচতলায় অধ্যাপক ইসমাইল সাহেবের বাসায় গিয়েছেন। আগন্তুকরা নিচতলায় অধ্যাপক ইসমাইল সাহেবের বাসায় যায় (১৬ নং বিল্ডিংয়ের পশ্চিম পাশে)। বারান্দা থেকে আমি এবং আমার চাচা দাঁড়িয়ে দেখছিলাম আমার বাবাকে ইসমাইল সাহেবের বাসা থেকে আগন্তুকরা বের করে আনে। আমার বাবার পকেটে রুমাল ছিল, সেই রুমাল দিয়ে ওনার চোখ বেঁধে ইপিআরটিসির মিনিবাসে তাঁকে উঠিয়ে নিয়ে যেতে দেখেছি।

সেদিন কারফিউ ছিল। আমরা নিচে নেমে এসে কম্পাউন্ডের ভিতরে খোঁজখবর করছিলাম। আমরা জানতে পারি বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকা থেকে আরও বেশ কয়েকজনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমাদের ক্যাম্পাস থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারের ডাক্তার ডা. মর্তুজা এবং আরবি বিভাগের অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান সাহেবের শ্যালককে আগন্তুকরা ধরে নিয়ে গেছে। সেদিন আমরা তেমন আর কোনো খোঁজখবর পাইনি। পরদিন অর্থাৎ ১৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১ একটি সামরিক জিপে করে মুস্তাফিজুর রহমান সাহেবের শ্যালককে বাসায় পৌঁছে দিয়েছিল। আমি এই খবর পেয়ে মুস্তাফিজুর রহমান সাহেবের বাসায় যাই তার শ্যালকের সঙ্গে দেখা করতে এই প্রত্যাশায় যে, তার কাছ থেকে আমার বাবার খবরাখবর পাব। কিন্তু মুস্তাফিজ সাহেবের প্রবল আপত্তির মুখে আমি তার শ্যালকের সঙ্গে দেখা করতে পারিনি। ওই দিন বিকাল বেলায় আমরা আরও জানতে পারি ফুলার রোড, ইশা খাঁ রোডস্থ বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকা থেকে প্রায় একই সময়ে ড. ফয়জুল মহি, ড. আবুল খায়ের (ফুলার রোড), প্রফেসর আনোয়ার পাশা, প্রফেসর রশিদুল হাসান, সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য (ঈশা খাঁ রোড) এবং অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন (মুহসীন হলের পাম্প হাউস) প্রমুখকে একই কায়দায় ওই আগন্তুকরা অপহরণ করে নিয়ে গেছে। ১৫ ডিসেম্বর কারফিউ থাকার কারণে আমরা বাবা এবং অন্য অপহৃতদের আর কোনো খবর নিতে পারিনি।

১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ বিকাল বেলা পাক সেনাদের আত্মসমর্পণের পর আমি এবং অন্যান্য বন্ধু-বান্ধব এবং বাবার সহকর্মীদের নিয়ে বাবা এবং তাঁর অন্যান্য অপহৃত সহকর্মীদের খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করি। ১৬ ডিসেম্বর থেকে প্রায় দুই সপ্তাহ ঢাকার আশপাশের সমস্ত বধ্যভূমিতে বাবার লাশ খোঁজ করি। নদীতে ভেসে যাওয়া লাশের মধ্যেও আমার বাবার লাশ খোঁজ করার চেষ্টা করি। কিন্তু কোথাও খুঁজে পাইনি। আমি নিজ হাতে অগণিত গলিত বিকৃত লাশ নেড়েছি। হাতে মৃত মানুষের গন্ধ লেগে থাকত, কিন্তু আমার মনে হতো এই গন্ধটি আমার বাবার লাশের গন্ধ (সাক্ষী তার কান্না সংবরণ করতে চেষ্টা করেন কিন্তু আবেগে আপ্লুুত ছিলেন)।

একপর্যায়ে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে এনএসআই কর্মকর্তা সামাদ তালুকদারের সহায়তায় যে মিনিবাসে করে আমার বাবা এবং অন্যদেরকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সেই মিনিবাসের ড্রাইভার মফিজ উদ্দিনকে আমাদের বাসায় আনা হয় তার কাছ থেকে শোনার জন্য আমার বাবাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ড্রাইভার মফিজ উদ্দিন আমার বাবার ছবি দেখে নিশ্চিত করেছিল তার গাড়িতে করেই আমার বাবাসহ অন্যদের আলবদর সদস্যরা প্রথমে গাবতলী লোহার ব্রিজের ওপরে নিয়ে যায়। সেখানে হত্যার উদ্দেশ্যে আরও বেশ কিছু লোককে জড়ো করা হয়েছিল। সে জন্য আমার বাবা এবং অন্যদেরকে মিরপুর মাজার রোড দিয়ে নিয়ে বর্তমানে যেখানে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে সেখানে নিয়ে (তখন জায়গাটি নিচু ছিল) তাদেরকে আশরাফুজ্জামান খান নিজ হাতে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে বলে ড্রাইভার মফিজ উদ্দিন আমাদের জানিয়েছিল। অপহরণকারী আলবদররা সকলেই বাঙালি ছিল। মফিজ উদ্দিন আরও জানায়, ব্রাশফায়ার করার পর মৃতদেহগুলো দুটো গর্তে মাটিচাপা দিয়ে রাখা হয়।

এরপর সম্ভবত ৪ জানুয়ারি, ১৯৭২ সামাদ তালুকদার সাহেব, তৎকালীন ওসি মিরপুর থানা, একজন ভারতীয় সামরিক কর্মকর্তা ও কিছু সিপাহি, একজন ম্যাজিস্ট্রেটের তত্ত্বাবধানে মফিজ ড্রাইভারের দেখানো মতে আমার বাবা এবং অন্যদের গলিত কঙ্কালসার লাশ সেই গর্ত দুটি থেকে উত্তোলন করা হয়। এই সময় আমি এবং অন্যান্য শহীদ পরিবারের সদস্যগণ সেখানে উপস্থিত ছিলাম। আমি আমার বাবার কোমরের বেল্ট, পরিহিত গ্যাবাডিনের প্যান্ট, পকেটে থাকা পরিচয়পত্র দেখে তাঁর লাশ শনাক্ত করতে পেরেছি। সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্যের লাশও আমি শনাক্ত করি। তিনি আমার শিক্ষক ছিলেন, তাঁর লাশটি শনাক্ত করতে আমার খুব অসুবিধা হয়নি। উত্তোলিত মোট ৮টি লাশের মধ্যে তাৎক্ষণিকভাবে অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিনের লাশ ছাড়া যাদের লাশ আমরা শনাক্ত করতে পেরেছিলাম তাদের মধ্যে ছিলেনÑ আমার বাবা ড. সিরাজুল হক খান, অধ্যাপক আবুল খায়ের, ড. ফায়জুল মহি, সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল অফিসার ডাক্তার মর্তুজা।”

অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেনের সাক্ষ্যের অংশ :

“আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক, বর্তমানে এলপিআরে আছি। ১৯৭০ সালের ৩ আগস্ট আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করি।

আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলের সহকারী আবাসিক শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলাম। আমার আবাস ছিল হলের ভিতরে ছোট একটি বাসায়। বিশ্ববিখ্যাত ইতিহাসবিদ আর্নল্ড টয়েনবির মত অনুসারে পৃথিবীর সভ্যতা বিকাশের পেছনে প্রতিটি জাতিতে একটি সৃজনশীল মুষ্টিমেয় মানুষের অবদান থাকে। আমাদের দেশে সেই ধরনের মুষ্টিমেয় সৃজনশীল মানুষের মধ্যে আমার পরম শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন আহমেদ ছিলেন তাদেরই একজন। বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার লক্ষ্যেই আমার শিক্ষক অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন আহমেদসহ এদেশের অনেক সৃজনশীল মানুষ তথা বুদ্ধিজীবীদের পাক সেনারা এবং এদেশীয় আলবদর গোষ্ঠী নৃশংসভাবে স্বাধীনতার ঊষালগ্নে হত্যা করেছিল দেশকে মেধাশূন্য করার জন্য। বাঙালির মুক্তি চেতনায় প্রাণিত ছিলেন এই ব্যক্তিবৃন্দ।

১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি আমাদের বাসায় পানি নেই অর্থাৎ পানির পাম্প চালু করা হয়নি। আমি মুহসীন হলের পেছনে উত্তর-পশ্চিম কোণে পাম্প ঘরে যাই। কিছুক্ষণ পর অধ্যাপক জহুরুল হক সাহেব সেখানে এসেছিলেন। আমরা দেখলাম পাম্প ঘরে কোনো লোক নেই। তখন আনুমানিক সকাল ৮টা-সোয়া ৮টার মধ্যে পাম্প হাউসে এলেন গিয়াস উদ্দিন স্যার। গিয়াস স্যারই পাম্পের মেইন সুইচ অন করেন, এতে পাম্পটি চালু হয়। পাম্প চালু করে পাম্প হাউস থেকে বের হওয়ার সময় পাম্পের দরজার মুখে আমি দেখতে পেলাম একজন লোক, যার পরনে ছিল ছাই রংয়ের পোশাক, হাতে ছিল ৩০৩ রাইফেল, মুখ রুমাল দিয়ে বাঁধা অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। জানতে পারি সাধারণত এ ধরনের পোশাক আলবদর, আলশামস বা রাজাকাররা পরত। সেই লোকটি গিয়াস স্যারের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল ”Are you Mr. Giasuddin?’ গিয়াস স্যার উত্তরে বললেন, ‘ণবং.’ তারপর ওই ব্যক্তিটি গিয়াস স্যারকে ভাঙা উর্দুতে বলল, ‘হামকো সাথ আইয়ে’। এ অবস্থায় গিয়াস স্যার ইতস্তত করছিলেন। আমরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়েছিলাম। এরই একপর্যায়ে লোকটি স্যারের বুকের দিকে বন্দুক তাক করে। তখন স্যার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আনোয়ার চলি, দোয়া করো।’ স্যারকে যখন লোকটি নিয়ে যাচ্ছিল তখন বিপরীত দিক থেকে একই পোশাক পরিহিত আর একজন লোক এগিয়ে আসে। সামনে এবং পেছনে উভয়ই সশস্ত্র প্রহরায় স্যারকে হলের পেছন দিক থেকে সামনের দিকে নিয়ে যেতে শুরু করল। স্যার যখন ডাইনিং হলের পেছনের বারান্দায় উঠলেন তখন সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল হলের অবাঙালি উর্দুভাষী দারোয়ান রহিম। ওই লোক দুটি রহিমের গামছাটি নিয়ে স্যারের দুটি চোখ বেঁধে উনাকে নিয়ে গেল। এই স্যারকে আমার শেষ দেখা তারপর আর আমি স্যারকে দেখতে পাইনি।

আমরা পরে হলের সামনের গেটে এসে দাঁড়ালাম। সেখানে এসে হলের সামনে দাঁড়ানো অন্য দারোয়ানদের কাছ থেকে জানতে পারলাম গিয়াস স্যারকে কাদামাখা একটি মাইক্রোবাসে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। আমরা এও শুনি যে, ওই অবাঙালি দারোয়ান রহিম সশস্ত্র ব্যক্তিদ্বয়কে পথ দেখিয়ে পাম্প হাউসে নিয়ে গিয়েছিল। আমরা এরপর গিয়াস স্যারের বাসায় যাই। সেখানে গিয়ে জানতে পারি সশস্ত্র ব্যক্তিরা প্রথমে স্যারের বাসায় গিয়েছিল তাঁর খোঁজে। তাকে না পেয়ে দ্বিতীয়বার ওরা আবার স্যারের বাসায় যায় এবং স্যারের এক মামাত ভাই যিনি ওই বাসায়ই থাকতেন তাকে বন্দুকের মুখে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে তিনি হলে গেছেন। তখন তারা ওই মামাত ভাইকে সঙ্গে করে মুহসীন হলে নিয়ে আসে। সেখানে এলে পরে দারোয়ান রহিম ওই সশস্ত্র ব্যক্তিদের পাম্প হাউসের দিকে ইশারা করে উর্দুতে বলে, ‘গিয়াস স্যারকে সে এদিকে যেতে দেখেছে।’

সেদিন ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১ দুপুর বেলা আমরা জানতে পারলাম শুধু গিয়াস স্যার নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষককেই ওইদিন সকাল বেলা ওই মাইক্রোবাসে করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। যাদের মধ্যে আমার অপর দুই শিক্ষক সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য ও ড. আবুল খায়ের ছিলেন।”

ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানের সাক্ষ্যের অংশ :

“আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ইমেরিটাস অধ্যাপক। ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল ভারতের আগরতলায় এবং ১৫ মে এখান থেকে সপরিবারে কলিকাতায় গিয়ে পৌঁছি। কলকাতায় আমি প্রথমে বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থী শিক্ষকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি’ গঠনের কাজে যুক্ত হই। আমি এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করি। পরে আমি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য পদে যোগ দিই।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে কলকাতা থাকা অবস্থায় ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যার বিষয়ে সংবাদপত্রের মাধ্যমে প্রথমে জানতে পারি। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি আমি সপরিবারে ঢাকায় ফিরে আসি। ৯ জানুয়ারি আমার দুজন শহীদ শিক্ষক মুনীর চৌধুরী ও মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর পরিবারের সঙ্গে তাদের বাড়িতে গিয়ে সাক্ষাৎ করি। সেই সময় শহীদ অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর স্ত্রী সৈয়দা মনোয়ারা চৌধুরী আমাকে বলেন, ‘আপনাদের ছাত্ররাই আপনার স্যারকে (মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী) নিয়ে গেছে।’ আমি শহীদ অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর ছোট ভাই অধ্যাপক লুৎফুল হায়দার চৌধুরীর কাছ থেকে জানতে পারি, ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর তাঁর (অধ্যাপক লুৎফুল হায়দার চৌধুরী) বাসা থেকে অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে মুখে রুমাল বাঁধা অবস্থায় কয়েকজন যুবক ধরে নিয়ে যায়। এই যুবকদের মধ্যে যে সামনে ছিল একপর্যায়ে তার মুখের রুমাল খুলে যায়। তখন মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী তাকে বলেন, ‘মইন উদ্দিন তুমি?’ সে আবার মুখে রুমাল বাঁধতে বাঁধতে বলে ‘জি, আপনি আমার সঙ্গে যাবেন কোনো ভয় নেই।’ এই মইন উদ্দিন তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের ছাত্র এবং দৈনিক পূর্বদেশে কর্মরত স্টাফ রিপোর্টার ‘চৌধুরী মইন উদ্দিন।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে আমিও তাকে ১৯৬৯ সালে অল্প দিনের জন্য ছাত্র হিসেবে পেয়েছিলাম। চৌধুরী মইন উদ্দিন এবং তার সঙ্গীরা অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে নিয়ে যাওয়ার পর তিনি আর ফিরে আসেননি।

সংবাদপত্র থেকে প্রকাশিত সূত্র থেকে এবং নানা সময়ে উদ্ধার হওয়া দলিলপত্র থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের হত্যার একটি পরিকল্পনা করা হয়। ডিসেম্বর মাসে আলবদর বাহিনী এই পরিকল্পনা কার্যকর করতে শুরু করে। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা এবং এভাবে বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, আইনজীবী আল-বদর বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন।”

ওমর হায়াৎ (শহীদ ডাক্তার মর্তুজার স্ত্রীর ভাই)-এর সাক্ষ্যের অংশ :

“১৪ ও ১৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১ ঢাকা শহরে কারফিউ চলছিল। ১৬ ডিসেম্বর আমার বোনের কাছ থেকে খবর পাই তার মেয়ের ওড়না (পরে বলেন শাড়ি) দিয়ে তার স্বামী ডাক্তার মর্তুজাকে অপহরণকারীরা চোখ বেঁধে অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে কাদামাখা একটি বাসে ওঠায়। এরপর তিনি আর ফিরে আসেননি।

সামাদ সাহেব নামে একজন পুলিশ অফিসার মফিজ নামে একজন ড্রাইভারকে সঙ্গে নিয়ে এসে বেশ কয়েক দিন পর আমার বোনকে জানায়, মিরপুর মাজারের পেছনে একটি জায়গায় কিছু মৃতদেহ পড়ে আছে। আমাদের কেউ যেন সেখানে গিয়ে খোঁজ নেন ডাক্তার মর্তুজা সাহেবের মৃতদেহ সেখানে আছে কিনা। আমি ৪ জানুয়ারি, ১৯৭২ আমার বোনের বাসায় উপস্থিত হই। সেখান থেকে মিত্রবাহিনীর একজন মেজর, পুলিশ কর্মকর্তা সামাদ, ড. সিরাজুল হক খানের ছেলে এনামুল হক খান (পি.ডব্লিউ-৪) এবং বাসের ড্রাইভার মফিজসহ আমরা মাজার শরিফের পেছনে একটি জায়গায় যাই। ড্রাইভার মফিজের দেখানো মতে একটি জায়গায় মাটি সরিয়ে বেশ কিছু লাশ দেখতে পাওয়া যায়। মাটি খোঁড়ার পর দ্বিতীয় গর্তের প্রথম লাশটিই সম্ভবত ছিল ডাক্তার মর্তুজার। ...ডাক্তার মর্তুজার চোখ তাঁর মেয়ের শাড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল এবং একপায়ে একটি পামসু পরা ছিল। সেখানে ওই সময় ড্রাইভার মফিজের মুখেই শুনতে পাই জনৈক মইন উদ্দিন এই অপহরণের ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল এবং জনৈক আশরাফুজ্জামান ব্রাশফায়ার করে অপহরণ করে নিয়ে আসা বুদ্ধিজীবীদের এখানেই হত্যা করে। এই বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যাদের নাম সে বলেছিল তারা হলেন- ড. সিরাজুল হক খান, ড. সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য, ড. ফয়জুল মহি, প্রফেসর আনোয়ার পাশা, সৈয়দ রাশিদুল হাসান প্রমুখ। ডাক্তার মর্তুজা ছাড়া অন্য সবারই মৃতদেহ গলিত ও বিকৃত ছিল।

ডাক্তার মর্তুজার লাশসহ অন্য বুদ্ধিজীবীদের লাশ গর্ত থেকে উত্তোলনের পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে নিয়ে আসা হয়। সেখান থেকে তাদের লাশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদে এনে জানাজা পড়ানো হয় এবং মসজিদের পাশের গোরস্থানে তাদের সমাহিত করা হয়। আমার বোন মিসেস সায়িদা মর্তুজা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে ছেলের সঙ্গে অবস্থান করছেন।”

সাক্ষী রাশেদুল ইসলামের (শহীদ ড. আবুল খায়েরের পুত্র) সাক্ষ্যের অংশ :

“১৯৭১ সালে আমার বয়স ছিল ৬ বছর। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর সকাল আনুমানিক ৯টায়। আমার পিতা শহীদ ড. আবুল খায়ের হাঁটার জন্য আমাদের বাড়ির বাইরে বের হন। ... উনি যখন বাড়ির গেটের বাইরে হাঁটছিলেন তখন ৪-৫ জন অজ্ঞাতনামা যুবক আমার বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন আপনি কি ড. আবুল খায়ের? আমার বাবা উত্তরে বলেছিলেন আমি ড. আবুল খায়ের। এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে আগত অজ্ঞাতনামা যুবকরা আমার বাবাকে তাঁর গায়ে থাকা চাদর দিয়ে তাঁর চোখ বেঁধে ফেলে এবং তাদের সঙ্গে নিয়ে গেটের বাইরে অবস্থানরত কাদা মাখানো মিনিবাসে জোর করে উঠিয়ে নেয়। ওই সময় আমি আমাদের বাড়ির বারান্দায় খেলছিলাম এবং এই অপহরণের ঘটনাটি আমি বারান্দা থেকে প্রত্যক্ষ করি। বাবাকে যখন জোর করে গাড়িতে উঠানোর ঘটনাটি দেখি তখন আমি দৌড়ে আমার মায়ের কাছে এসে ঘটনাটি বলি। আমার মা তৎক্ষণাৎ ছুটে এসে বাবাকে ওই অজ্ঞাতনামা যুবকদের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে ওই যুবকরা অস্ত্র উঁচিয়ে গুলি করার ভয় দেখায় এবং আমার বাবাকে তারা গাড়িতে করে নিয়ে চলে যায়। তখন আমার মা কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় আমাদের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে এই চলে যাওয়ার দৃশ্যটি দেখছিলেন। একই সময়ে আমাদের ওই বাড়ির ৪ তলায় বসবাসরত ড. ফজলে মুহিকেও একই কায়দায় ওই অস্ত্রধারী যুবকরা ওই কাদা মাখানো মিনিবাসে জোর করে তুলে নিয়ে যায়। এ ঘটনাটিও আমি আমাদের বাসার বারান্দা থেকে দেখেছিলাম।

১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারি কাদা মাখানো যে মিনিবাসে করে আমার বাবাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তার ড্রাইভারকে আমাদের বাসায় ধরে নিয়ে আসা হয়েছিল। ওই ড্রাইভারের নাম ছিল মফিজ। ধৃত মফিজ জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছিল, মিরপুর বধ্যভূমিতে বেশ কিছু বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে লাশ ফেলে রাখা হয়েছিল। এ খবরের প্রেক্ষিতে আমার মামা এবং চাচাত ভাই ওই দিনই মিরপুর বধ্যভূমিতে গিয়ে আমার বাবার লাশের সন্ধান করে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর গলিত এবং অর্ধগলিত অনেক লাশের মধ্যে আমার বাবার চাদর দেখে (যা দিয়ে বাবার চোখ বাঁধা ছিল) তাঁর বিকৃত লাশ শনাক্ত করতে পারে। তখন তারা আমার বাবার সেই বিকৃত গলিত লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে নিয়ে আসে। সেখান থেকে লাশের ময়নাতদন্তের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদে জানাজা শেষে তার পাশের কবরস্থানে দাফন করা হয়।”

অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর অপহরণ ও হত্যা

এই অভিযোগ প্রমাণের জন্য সাক্ষ্য প্রদান করেন শহীদ অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর ভ্রাতুষ্পুত্র জনাব ইফতেখার হায়দার চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ও রায়েরবাজার বধ্যভূমি থেকে বেঁচে ফিরে আসা একমাত্র ভিকটিম জনাব দেলোয়ার হোসেন। ১৯৭১ সালে সাক্ষী জনাব ইফতেখার হায়দার চৌধুরী ছিলেন ৮ বছরের শিশু। তিনি তাঁর চাচি শহীদ মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর স্ত্রী, তাঁর মা ও বাবার কাছ থেকে তাঁর চাচা অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর অপহরণ ও হত্যাকান্ডের ঘটনা শুনেছেন। অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর লাশ তাঁর পরিবার আর কখনো খুঁজে পাননি। পরিবারের জন্য এটি কত যে কষ্টের! এই সাক্ষীগণ ট্রাইব্যুনালে যে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন তার কিছু অংশ তুলে ধরা হলো :

সাক্ষী ইফতেখার হায়দার চৌধুরীর (শহীদ অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর ভ্রাতুষ্পুত্র) সাক্ষ্যের অংশ :

“শহীদ বুদ্ধিজীবী মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী আমার বড় চাচা। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন।... আমার চাচা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করার পর থেকেই দেশের ভাষা আন্দোলনসহ সব ধরনের প্রগতিশীল আন্দোলনের প্রতি তাঁর উচ্চকিত সমর্থন ছিল। তিনি ছিলেন একজন অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার মানুষ। তিনি মুক্ত চিন্তা এবং মুক্ত বুদ্ধির চর্চার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।... তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় শিক্ষকের উদ্যোগে পাকিস্তান সরকারের পক্ষে যে স্বাক্ষর অভিযান চলছিল তার প্রচ- বিরোধিতা করেছিলেন।

১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর আমার চাচা নিরাপত্তাজনিত কারণে তাঁর ফুলার রোডের বাসা ছেড়ে আমাদের শান্তিবাগের বাসায় এসে সপরিবারে আশ্রয় নিয়েছিলেন। আমাদের শান্তিবাগের বাসার হোল্ডিং নং ছিল ১৯৬/৩। আমার চাচা যখন আমাদের বাসায় চলে আসেন তখন নুরু নামের একটি কাজের ছেলেকে তাঁর ফুলার রোডের বাসায় রেখে এসেছিলেন এবং তাকে তিনি বলে এসেছিলেন তিনি কোথায় যাচ্ছেন।

আমার বড় চাচি (শহীদ মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর স্ত্রী), আমার বাবা এবং আমার মায়ের কাছ থেকে আমার বড় চাচার অপহরণের বিষয়ে শুনেছি যে, ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আল-বদরের একটি সশস্ত্র গ্রুপ মুখে কাপড় বাঁধা অবস্থায় দুপুরের দিকে ফুলার রোডের চাচার বাসায় যায় এবং নুরুর কাছে জানতে চায় মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী সাহেব কোথায় আছেন। নুরু প্রথমে আমার চাচার অবস্থান জানাতে অস্বীকার করলে অস্ত্রের মুখে সে ভীত হয়ে চাচার অবস্থান জানায় এবং তারা তাকে সঙ্গে করে আমাদের শান্তিবাগের বাসায় নিয়ে আসে। বাসার কলাপসিবল গেট দারোয়ান খুলে দিলে ওরা ঘরের দরজায় কড়া নাড়ে। বাসাটি দোতলা ছিল, আমরা নিচতলায় থাকতাম। দরজায় কড়া নাড়ার পর আমার বাবা লুৎফুল হায়দার চৌধুরী সাহেব দরজাটি খুলে দিলে ৫/৬ জন অস্ত্রধারী মুখোশ পরা অবস্থায় আমার বাবাকে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করে, ‘Where is Mofazzal Haider Chowdhury’। আমার বাবার সঙ্গে মুখোশধারীদের এই কথাগুলো আমি নিজেই শুনেছি এবং পরবর্তীতে আমার বাবার কাছ থেকেও জেনেছি। তখন আমার বাবা তাদের জিজ্ঞেস করেছিলেন কেন তারা আমার চাচাকে খুঁজছে এবং কোনো ওয়ারেন্ট আছে কিনা। প্রত্যুত্তরে তারা বলেছিল, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী সাহেবকে ক্যাপ্টেন সাহেবের কাছে নিয়ে যাবেন এবং তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলার পর তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। এ অবস্থায় একটু ধাক্কাধাক্কি করেই সশস্ত্র লোকগুলো ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়ে এবং এরই একপর্যায়ে আমার বড় চাচা সামনে এসে বলেন আমিই মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী। চাচাকে মুখোশধারীরা তাদের সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইলে আমার বাবা বলেছিলেন, তিনি কাপড় পরিবর্তন করে তারপর যাবেন। মুখোশধারীদের একজন ঘরের ভিতরে আমাদের ডাইনিং টেবিলের পাশে অবস্থান করছিল।... একপর্যায়ে তিনি ওই মুখোশ পরা লোকটিকে বললেন, আপনারা মুখোশ পরে আছেন কেন, এই বলে তিনি ওই লোকটির মুখে বাঁধা রুমালটি টান দিয়ে সরিয়ে ফেলেন। তখন আমার বড় চাচা ওই লোকটির মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, ‘তুমি মইন উদ্দিন না?’ লোকটি উত্তরে বলেছিল, ‘জি আমি মইন উদ্দিন, আমি আপনার ছাত্র।’ এই কথাগুলো আমরা সবাই আমার বাবা এবং চাচার পাশে দাঁড়িয়ে শুনেছিলাম। আমার স্পষ্ট মনে আছে, ওই লোকটি আরও বলেছিল, ‘আমি স্যারকে নিয়ে যাচ্ছি, ক্যাপ্টেন সাহেবের সঙ্গে দেখা করিয়েই তাঁকে ফিরিয়ে দিয়ে যাব’। মুখের রুমালটি খোলার পর থেকে সে আর কখনো রুমালটি মুখে বাঁধেনি। আমার চাচাকে যখন নিয়ে যাচ্ছিল তখন বাড়িতে আমরা সবাই কান্নাকাটি করছিলাম, একপর্যায়ে কলাপসিবল গেটের কাছে গিয়ে আমার চাচা আমার বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, আমি যেহেতু কোনো অন্যায় করিনি, আমি নিশ্চয়ই তোমাদের মাঝে আবার ফিরে আসব। আমার বড় চাচিসহ আমরা যখন এগোতে চেষ্টা করলাম লোকগুলো আমাদেরকে বাইরে যেতে কঠোর ভাষায় নিষেধ করে এবং আমার চাচাকে একটি কাদামাখা মাইক্রোবাসে উঠিয়ে নিয়ে যায়। এই সময়ে শহরে কারফিউ চলছিল।

১৬ ডিসেম্বর সকাল ১০/১১টার দিকে আমরা যখন বুঝতে পারলাম দেশ স্বাধীন হয়ে যাচ্ছে, চারদিকে জয় বাংলা স্লোগান উচ্চারিত হচ্ছে, আমরা তখন আমাদের শান্তিনগরের বাসায় ফিরে আসি। আমার বাবা এবং মেজ চাচা উভয়েই আমার বড় চাচার খোঁজে বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি চালান। চারদিক থেকে বিক্ষিপ্তভাবে খবর আসছিল এখানে-সেখানে অনেক লাশ পড়ে আছে। যেখানেই লাশ পড়ে আছে খবর পেয়েছেন আমার বাবা এবং মেজ চাচা সেখানেই গেছেন বড় চাচার খোঁজে। ওই সময়ে আরও অনেক বুদ্ধিজীবীর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না।... আমার বাবা এবং চাচা রায়েরবাজার, মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন বধ্যভূমিতে আমার বড় চাচার লাশ খুঁজতে গিয়েছিলেন। তারা সেখানে অনেক বিকৃত ও গলিত লাশ দেখেছিলেন কিন্তু আমার বড় চাচার লাশ তারা খুঁজে পাননি। আমরা শুনেছি আরও অনেকের লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি।”

কী পেলাম এই সাক্ষীর সাক্ষ্য থেকে? একজন ছাত্র তার শিক্ষকের ঘাতক। একজন ছাত্র তার শিক্ষককে অপহরণ করে নিয়ে যায়, হত্যা করে। সাহসী শিক্ষকের লাশটি তার পরিবার ও স্বজনরা খুঁজে পাননি। এমন বর্বরতার কোনো নজির কোথায় আছে জানি না। উপরের কজন বিশিষ্টজন, যাঁরা সাক্ষ্য দিয়েছেন তাঁদের কথা থেকেই উঠে এসেছে কীভাবে পরিকল্পিতভাবে একই দিনে শিক্ষকদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। কত ঠান্ডা মাথায় নির্মমভাবে তাঁদের নিধন করা হয়। হিংস্র ঘাতক অভিযুক্তরা বর্বরতার সব সীমা অতিক্রম করেছিল।

অধ্যাপক মুুনীর চৌধুরীর অপহরণ ও হত্যা

এই অভিযোগটি প্রমাণের জন্য সাক্ষ্য দিয়েছেন শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর ছেলে আসিফ মুনীর ও জনাব দেলোয়ার হোসেন যিনি রায়েরবাজার বধ্যভূমি থেকে অলৌকিকভাবে বেঁচে ফিরে আসতে পেরেছিলেন। ১৯৭১ সালে আসিফ মুনীর ছিলেন ৪ বছরের শিশু। তিনি ও তাঁর পরিবার শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর লাশটি খুঁজে পাননি।

আসিফ মুনীরের (শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর পুত্র) সাক্ষ্যের অংশ :

“আমার নাম আসিফ মুনীর ওরফে তন্ময়, পিতা শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী। ১৯৭১ সালে আমি ৪ বছরের শিশু ছিলাম। আমার বড় ভাই ভাষণ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আমার মা লিলি চৌধুরী (৮৪) এখনো জীবিত আছেন। বার্ধক্যজনিত কারণে তিনি বাসায় অবস্থান করেন। আমার ভাই মিশুক মুনীরের দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর পর থেকে আমার মা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। তিনি জনসম্মুখে কথা বলার মতো অবস্থায় নেই।

২০, সেন্ট্রাল রোড, ঢাকা আমার দাদার বাসা। ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে সেন্ট্রাল রোডের সেই বাসা থেকে আমার বাবা অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীকে আল-বদর বাহিনীর সদস্যরা ধরে নিয়ে যায়। আমার বাবা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। আমার বাবা মুনীর চৌধুরী একাধারে নাট্যকার, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, ভাষাতত্ত্ববিদ ও শিক্ষক ছিলেন। তবে তিনি নাট্যকার হিসেবেই সমধিক পরিচিত ছিলেন। তাঁর সবচেয়ে বহুল প্রচারিত নাটক ছিল ‘কবর’ যা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট অবলম্বনে রচিত। এ ছাড়া তাঁর লেখা ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’ কলেজ পর্যায়ে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভাষাতত্ত্ববিদ হিসেবে তাঁর অবদান বাংলা ব্যাকরণ বই রচনার ক্ষেত্রে এবং বাংলা টাইপ রাইটারের কি-বোর্ড মুনীর অপটিমা তৈরির ক্ষেত্রে অপরিসীম। বর্তমানে কম্পিউটারে বাংলা কি-বোর্ড ব্যবহৃত হয় তার ভিত্তি এই মুনীর অপটিমা কি-বোর্ড, যা বিজয় কি-বোর্ডের প্রবর্তক জনাব মোস্তাফা জব্বার তাঁর বিভিন্ন লেখায় উল্লেখ করেছেন।

১৯৫০ এর দশক থেকেই আমার বাবা বাম রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সংগঠক হিসেবে কাজ করার জন্য তাঁকে জেল খাটতে হয়েছে। এরই প্রেক্ষিতে ১৯৫৩ সালে তিনি জেলে বসেই ‘কবর’ নাটকটি রচনা করেছিলেন।

১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে আমার বাবার ধারণা হয় যে, দেশ স্বাধীন হতে চলেছে, এ বিষয়ে তিনি পরিবারের সবার সঙ্গে আলোচনা করতেন। পরিবার থেকে বিভিন্ন সময় আমার বাবাকে নিরাপত্তার স্বার্থে এই বাসা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার উপদেশ দেওয়া হলেও তিনি তার মাকে ছেড়ে যেতে না চাওয়ায় সেখানেই অবস্থান করতে থাকেন।

এরই একপর্যায়ে ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১ বেলা ১টার দিকে যখন আমার বাবা মধ্যাহ্নভোজের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ঠিক তার আগে বাড়ির সদস্যরা বাড়ির লোহার গেটে ঝনঝনানির শব্দ পান। তখন দোতলা থেকে জানালার পর্দা সরিয়ে আমার মা একটি মিনিবাস দেখতে পান, যার জানালাগুলোতে কাদা লাগানো ছিল এবং ছাদটি গাছের ডালপালা দিয়ে ঢাকা ছিল। আমার মা ওই মিনিবাস থেকে ৩/৪ জন তরুণকে নামতে দেখেন। ওই বাড়িতে অবস্থানরত আমার অপর চাচা শমসের চৌধুরী ওরফে রুশা দোতলা থেকে নিচে নেমে গেটের দিকে এগিয়ে যান। তরুণদের মধ্য থেকে একজন তাকে জিজ্ঞেস করেন ‘আপনি কি মুনীর চৌধুরী?’ তখন আমার রুশো কাকা উত্তরে বলেন, মুনীর চৌধুরী আমার বড় ভাই। তখন ওই তরুণরা আমার কাকাকে বলে আপনি একটু মুনীর চৌধুরী সাহেবকে ডেকে দিন। আমার কাকা বাসার দোতলায় গিয়ে বাবাকে খবর দিলে তিনি লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরিহিত অবস্থায় কাকাকে নিয়ে নিচে নেমে আসেন। আমার মেজো ভাই মিশুক মুনীর রুশো কাকার অনুরোধে গেটের তালার চাবিটি নিচে দিয়ে যায় এবং উপরে গিয়ে বারান্দা থেকে লুকিয়ে পুরো দৃশ্যটি দেখেন।

আমার মা আমার বাবাকে নিচে যেতে নিষেধ করেছিলেন। উত্তরে আমার বাবা বলেছিলেন যাই দেখি ওরা কী বলে। রুশো কাকা এবং আমার বাবার পেছনে পেছনে আমার মাও নিচে নেমে আসেন। আমার কাকা রুশো গেটের তালা খুলে দেন, বাবা আগত ৩/৪ যুবককে জিজ্ঞাসা করেন ‘তোমরা কী চাও’। জবাবে তারা বলে, ‘স্যার আপনাকে একটু আমাদের সঙ্গে যেতে হবে।’ তখন আমার বাবা শহীদ মুনীর চৌধুরী একটু উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমাদের কাছে কি কোনো ওয়ারেন্ট আছে’। জবাবে তাদের একজন বলে, ‘আছে’। এই বলেই তাদের একজন আমার বাবার পেছনে এসে বন্দুক ধরে। তখন আমার বাবা আমার রুশো কাকার দিকে তাকিয়ে শুধু বলেছিলেন, ‘রুশো, তাহলে যাই’। আমার বাবা লক্ষ্য করেননি যে, পেছন থেকে আমার মা এসব দৃশ্য দেখছিলেন। ওই ৩/৪ জন তরুণ আমার বাবাকে ঠেলে গাড়ির দিকে নিয়ে যায়। আমার বাবাকে আমাদের সেই শেষ দেখা। আমি তখন শিশু, আমাকে তখন ঘরের ভিতরে রাখা হয়েছিল। সেই থেকে তাঁর কোনো সন্ধান পাইনি।

১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালের পরে আমরা শুনতে পেলাম মিরপুর এবং রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে অনেক বুদ্ধিজীবীর লাশ পড়ে আছে। তখন আমার রুশো কাকা এবং আমার বড় চাচা অধ্যাপক কবীর চৌধুরী রায়েরবাজারে আমার বাবাকে খুঁজতে যান। সেখানে পড়ে থাকা বিকৃত, আধা বিকৃত বুদ্ধিজীবীদের লাশগুলোর মধ্যে আমার বাবার লাশ শনাক্ত করতে পারেননি। পরবর্তীতে আমার চাচা, ভাই পত্রিকার মারফত জানতে পেরেছেন সুপরিকল্পিতভাবে ওই সময়ে বাসা থেকে ধরে নিয়ে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছে। আমি ১৪ ডিসেম্বরে আমার বাবাকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাসহ অন্য বুদ্ধিজীবীদের অপহরণ করার ঘটনাগুলো আমার মা, রুশো কাকা ও আমার মেজ ভাই মিশুক মুনীর (সম্প্রতি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত) এর কাছ থেকে শুনেছি।”

সাংবাদিক সাহিত্যিক শহীদুল্লাহ কায়সারের অপহরণ ও হত্যা

এই অভিযোগ প্রমাণে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য প্রদান করেন শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লাহ কায়সারের স্ত্রী পান্না কায়সার। তিনি তাঁর স্বামীকে অপহরণ করে নিয়ে যেতে দেখেছেন। তারপর শহীদুল্লাহ কায়সার আর ফিরে আসেননি, এমনকি তাঁর লাশটিও তাঁর পরিবার খুঁজে পায়নি। সাক্ষী পান্না কায়সার ট্রাইব্যুনালে যে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন তার কিয়দংশ :

“আমার নাম প্রফেসর পান্না কায়সার, স্বামী শহীদ সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সার। ১০ ডিসেম্বর, ১৯৭১ আমাদের সবার অতি প্রিয় শহীদ সাংবাদিক সিরাজউদ্দিন হোসেন সাহেবকে আল-বদররা বাসা থেকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। আমার স্বামী এ কথাটি আমাকে বলেননি, পরবর্তীতে আমি জানতে পেরেছি। শহীদুল্লাহ কায়সার তখন দেশের স্বাধীনতার মন্ত্রে বিভোর ছিলেন। শুধু তাঁর প্রিয় পত্রিকা, সংবাদের জন্য হেডলাইন, এডিটোরিয়াল, পোস্ট এডিটোরিয়াল লিখতে থাকেন এই আশায় যে দেশ স্বাধীন হয়ে গেলে সেগুলো পত্রিকায় ছাপা হবে।

ডিসেম্বর মাসের ১২ তারিখ গণতন্ত্রী পার্টির সভাপতি নূরুল ইসলাম সাহেব আমাদের বাসায় আসেন। ফিস ফিস করে তিনি আমার স্বামীর সঙ্গে কথা বলে চলে যান। তাঁর চলে যাওয়ার পর আমার স্বামী আমাকে বলেছিলেন, নূরুল ইসলাম তাঁকে বাসা ছেড়ে অন্যত্র নিরাপদ স্থানে চলে যেতে বলেছেন।... তিনি বললেন যে, আল-বদরদের অত্যাচার বেশি বেড়ে গেছে সেজন্য এখানে থাকা বেশি নিরাপদ না।

১৩ ডিসেম্বর দুই ঘণ্টার জন্য কারফিউ শিথিল হলে তিনি কাপড়-চোপড় গুছিয়ে তাঁর মায়ের পরামর্শ মতো বাসা ছেড়ে বেরিয়ে যান এবং যাওয়ার সময় ক্রন্দনরত তাঁর মা এবং আমাকে বলেছিলেন, তোমরা কাঁদছো কেন। দু-এক দিনের মধ্যে দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে, আমি চলে আসব। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে তিনি জোরে জোরে ‘জয় বাংলা’ উচ্চারণ করছিলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি আবার ফিরে চলে এলেন, এসে বললেন যেখানে যেতে চেয়েছিলাম সেখানে তারা আমাদের সবার জন্য থাকার ব্যবস্থা করেছে। তাই আগামীকাল আমরা সবাই সেখানে যাব। মা, আপনি পান্নাসহ তৈরি হয়ে নেন, কাল কারফিউ উঠলেই আমরা চলে যাব। আমরা তৈরি হয়েছিলাম আর শহীদুল্লাহ কায়সার বিজয়ের আনন্দে বিভোর ছিলেন এবং শুধু বন্ধুদের সঙ্গে কথাবার্তা বলা, গান গাওয়া, কবিতা পড়া এগুলো করছিলেন। তিনি অনেকটা বাচ্চাদের মতো আচরণ করছিলেন।

১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১ কারফিউ আর শিথিল হয়নি। ওইদিন একটি ছোট্ট চিরকুট আমাকে উদ্দেশ করে তিনি লিখেছিলেন। আমার কাছে চিরকুটটি দিয়ে তিনি বলেছিলেন, তোমাকে তো কোনো দিন প্রেমপত্র লিখতে পারিনি এটি সেই প্রেমপত্র। চিরকুটটি আমি হাতে নিয়ে দুই লাইন পড়ে আমি আর পড়তে পারিনি। আমি চিৎকার করে বলেছিলাম, তুমি এসব কী লিখলে আমি তো কোনোভাবেই নিজেকে সংবরণ করতে পারছি না। চিরকুটটিতে লেখা ছিলÑ ‘পান্না, যদি আমি না থাকি আমার সন্তানদেরকে তুমি আমার আদর্শে মানুষ করো।’ এই চিরকুটটিতে আরও লেখা ছিল, আমি এইটুকু লেখা পড়ার পরই তা ছিঁড়ে ফেলেছিলাম। আজ আমার অনুশোচনা হয় কেন আমি তা ছিঁড়ে ফেলেছিলাম (এ সময় সাক্ষী অঝরে কাঁদতে থাকেন)।

                [ধারাবাহিকের শেষ পর্ব পড়ুন আগামীকাল]

সর্বশেষ খবর