শিরোনাম
রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা
শেষ পর্ব

একাত্তরের সেইসব নিষ্ঠুরতার ভয়ঙ্কর চিত্র

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান

একাত্তরের সেইসব নিষ্ঠুরতার ভয়ঙ্কর চিত্র

ওই দিনই আমি আসরের নামাজ পড়ে বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওই চিরকুটটির কথাই ভাবছিলাম ঠিক ওই সময় দেখি ৪/৫ জন যুবক আমাদের বাসার দিকে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করছে।  তখন বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয় হয় ৫টা কি সোয়া ৫টা হবে, শীহদুল্লাহ কায়সার রেডিওর নব ঘুরিয়ে বিবিসি অথবা ভয়েস অব আমেরিকা শোনার চেষ্টা করছিলেন। আমি যুবকদের ইশারাটা সন্দেহজনক মনে করে বিষয়টি সঙ্গে সঙ্গে শহীদুল্লাহ কায়সারকে জানাই। সে তখন আমাদের বসার ঘরে আমার চাচা শ্বশুর জনাব সিদ্দিক উল্লাহর (সাংবাদিক শাহরিয়ার কবিরের পিতা) সঙ্গে বসে রেডিও শুনছিল। আমি যুবকদের সম্পর্কে বলার সঙ্গে সঙ্গেই সে চমকে ওঠে এবং আমাকে আমি আর কী কী দেখেছি জিজ্ঞেস করে। আমি তাঁর সঙ্গে কথা বলে মাগরিবের নামাজ পড়তে যাচ্ছিলাম, এ সময় তিনি ‘আমাকে বলেছিলেন আমার জন্য ভালো করে দোয়া করো।’ নামাজ শেষ করে এসে দেখি আমার ছেলেটি (অমিতাভ কায়সার) সোফায় তার পাশে শুয়ে আছে আমি তখন নিচে পাটিতে বসে মেয়েকে (শমী কায়সার) শিশিতে করে দুধ খাওয়াচ্ছিলাম। এমন সময় আমার চতুর্থ দেবর ওবাইদুল্লাহ সে আমার স্বামীকে বলে, ‘বড়দা কয়েকজন যুবক আমাদের বাড়ির গেটে কড়া নাড়ছে, কী করব’। তখন তিনি বলেছিলেন খুলে দাও দেশ বোধহয় স্বাধীন হয়ে গেছে, এরা সম্ভবত মুক্তিযোদ্ধার দল। তিনি তখন আমার আঁচল থেকে চাবির গোছা নিয়ে আলমারি খুলে গরম কাপড় চোপড় ও টাকা-পয়সা এই যুবকদের দেয়ার জন্য বের করে সোফার উপরে রেখেছিলেন আর বলছিলেন, ৯ মাস যুদ্ধ করে এরা এসেছে, এদের কাছে কিছুই নেই, তাই এগুলো এদেরকে দিতে হবে।

দু-এক মিনিট পরেই ৪/৫ জন যুবক মুখ বাঁধা অবস্থায় টক টক করে দোতলায় উঠে আসে। এসেই রুমে ঢুকে প্রশ্ন করে এখানে শহীদুল্লাহ কায়সার কে? শহীদুল্লাহ কায়সার প্রথমে ভেবেছিলেন এরা মুক্তিযোদ্ধা। তাই তিনি পরিষ্কারভাবে বলেছিলেন, ‘আমিই শহীদুল্লাহ কায়সার’। এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের মধ্যে একজন চট করে শহীদুল্লাহ কায়সারের হাত ধরে বারান্দায় নিয়ে যায়। এ সময় আমার কোল থেকে আমার মেয়ে পড়ে যায়। আমিও পিছে পিছে বারান্দায় যাই এবং শহীদুল্লাহ কায়সারের হাত ধরে রাখি এবং আরেক হাত দিয়ে বারান্দায় বৈদ্যুতিক বাতির সুইচ অন করি। বাতি নেভানো ছিল, কারণ তখন ব্ল্যাক আউট চলছিল। আমি চিৎকার করে কী যে বলেছিলাম মনে নেই। তখন পাশের রুম থেকে আমার সন্তানসম্ভবা ননদ শাহানা দৌড়ে এসে আমার পাশে দাঁড়ায়। তখন আমরা মুখ বেঁধে রাখা একজনের মুখের কাপড় সরাতে চেষ্টা করছিলাম, তারা সংখ্যায় বেশি থাকায় আমরা পারিনি। আমার চাচা শ্বশুর একজন সরল সোজা মানুষ ছিলেন, তিনি নিচতলায় গিয়েছিলেন সেখানে তাদের অবস্থা দেখার জন্য। একপর্যায়ে ধস্তাধস্তি করে আমি এবং আমার ননদ একজন আগন্তুকের মুখের কাপড় সরিয়ে আলোতে তার চেহারা দেখতে পেরেছিলাম। আমার এবং আমার ননদের বাধা সত্ত্বেও একপর্যায়ে তারা টেনেহিঁচড়ে আমার স্বামীকে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নিয়ে যেতে থাকে। এ সময় আমার হাত যখন স্বামীর হাত থেকে বিচ্ছিন্ন হয় তখন শহীদুল্লাহ কায়সার বলেছিলেন, ‘ভালো থেকো, আমি আবার ফিরে আসবো।’ বাড়ির সামনেই আমার শ্বশুরের প্রতিষ্ঠা করা মসজিদ ছিল। সেই মসজিদের ইমাম সাহেবের (বর্তমানে মৃত) কাছ থেকে জানতে পেরেছি আমার স্বামীকে একটি কাদামাখা মাইক্রোবাসে তুলে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। ইমাম সাহেব আরও বলেছিলেন, শহীদুল্লাহ কায়সার গাড়িতে ওঠার আগে তার পিতার প্রতিষ্ঠিত মসজিদের দেয়াল ধরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন।

১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সকাল ১০টা সোয়া ১০টার দিকে আমি আমার তৃতীয় দেবর জাকারিয়া হাবিবের সঙ্গে মামা জহুর হোসেন চৌধুরীর বাসায় যাই, তিনি আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে শক্ত থাকতে বলেছিলেন। আমি এবং আমার দেবর একটি রিকশায় করে রায়েরবাজার বধ্যভূমির দিকে যাচ্ছিলাম। রাস্তায় অসংখ্য মানুষকে বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধাদের বরণ করতে দেখেছি। কিন্তু আমি সেই বিজয় উদযাপন করতে পারিনি। রায়েরবাজারে গিয়ে দেখি অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, ডাক্তার আলিম চৌধুরীর স্বজনরাসহ অনেক বুদ্ধিজীবীর আত্মীয়-স্বজনরা কান্নাকাটি করছে। আমার দেবর আমাকে নিয়ে রায়েরবাজার বধ্যভূমির কর্দমাক্ত গর্তে নামলে আমি সেখানে গিয়ে অনেকের গলিত বিকৃত লাশ উল্টেপাল্টে দেখেছি কিন্তু শহীদুল্লাহ কায়সারের লাশ পাইনি। আমি তখন থেকেই স্থির করেছি শহীদুল্লাহ কায়সার আমার অন্তরেই থাকবে। বাড়িতে ফিরে আমার শাশুড়িকে বলেছি আমি এ বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাব না।”

শহীদ শহীদুল্লাহ কায়সারের স্ত্রী পান্না কায়সারের দেওয়া করুণ বর্ণনা থেকে উঠে এসেছে কত বড় সাহসী এবং দেশপ্রেমিক একজন মানুষ ছিলেন শহীদ শহীদুল্লাহ কায়সার। তাঁর সঙ্গে কত গভীর আত্মিক বন্ধন ছিল স্ত্রী পান্না কায়সারের! পরিণতি জেনেও শহীদুল্লাহ কায়সার ছিলেন নিরুদ্বিগ্ন, যখন তাঁকে জালেম আলবদররা ধরে নিয়ে যায়। তাঁর পরম প্রিয় স্ত্রীর কষ্টও পরিমাপ করার সুযোগ নেই। জীবন সাথীকে হারিয়েও তিনি এগিয়ে গেছেন। সন্তানদের পিতৃ আদর্শে গড়ে তুলেছেন। তিনি কেবল একজন শহীদের স্ত্রী নন, একই সঙ্গে তিনি একজন মহীয়সী মা।

 

ডা. ফজলে রাব্বীর অপহরণ ও হত্যা

এ অভিযোগ প্রমাণ করতে সাক্ষ্য দিয়েছেন তাঁর কন্যা ড. নুসরাত রাব্বী। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। ১৯৭১ সালে তাঁর বয়স ছিল ৮/৯ বছর। যৌক্তিক কারণে এই সাক্ষীকে তাঁর সাক্ষ্য অসমাপ্ত রেখে ফিরে যেতে হয়েছিল আমেরিকায়।

ড. নুসরাত রাব্বীর (শহীদ ডা. ফজলে রাব্বীর কন্যা) সাক্ষ্যের অংশ :

“আমার নাম ড. নুসরাত রাব্বি, পিতা-শহীদ বুদ্ধিজীবী ডাক্তার ফজলে রাব্বী। বর্তমান ঠিকানা- আমি ১৮০০, মার্কেট স্ট্রিট সানফ্রানসিসকোতে থাকি। আমি ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়াতে স্ট্যাটিসটিকস ও ক্যান্সার জেনেটিকসের অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষকতা ও গবেষণার কাজ করি। আমি স্টানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে এবং বার্কলিতে অধ্যাপনা করি। আমি গত ৪ আগস্ট, ২০১৩ তারিখে ঢাকা এসেছি। আমি সাক্ষ্য দেয়ার জন্য এসেছি এবং ৮ আগস্ট, ২০১৩ যুক্তরাষ্ট্রের কর্মস্থলে ফিরে যাব।

আমার বাবা শহীদ ডাক্তার ফজলে রাব্বীকে ১৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে আনুমানিক বিকাল ৩টার সময় আল-বদর বাহিনীর সদস্যরা বাসা থেকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। ১৮ ডিসেম্বর এক সাংবাদিকের মাধ্যমে জানতে পারি আমার বাবাকে অপহরণকারীরা রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেছে।... ১৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১ আনুমানিক ৩টার দিকে আলবদররা আমাদের বাসা ঘেরাও করে ফেলে এবং আমাদের বাসার সামনে একটি কাদা মাখানো মাইক্রোবাস এসে থামে। পরবর্তীতে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত চৌধুরী মইন উদ্দিন এবং আশরাফুজ্জামান খানের ছবি দেখে বুঝতে পেরেছিলাম এরাই ১৩ ডিসেম্বর আমাদের বাসায় এসেছিল এবং তারাই ১৫ ডিসেম্বর বাবাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়।”

 

ডা. আলীম চৌধুরীর অপহরণ ও হত্যা

অভিযোগ প্রমাণ করতে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য প্রদান করেন শহীদ ডা. আলীম চৌধুরীর কন্যা ডা. ফারজানা চৌধুরী নীপা। তিনি পেশায় একজন চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ। ১৯৭১ সালে তাঁর বয়স ছিল ৩ বছর।

 

ডা. ফারজানা চৌধুরী নিপার (শহীদ ডা. আলীম চৌধুরীর কন্যা) সাক্ষ্যের অংশ :

“আমার নাম ফারজানা চৌধুরী নিপা, স্বামীর নাম ডা. মো. আফতাবুল ইসলাম, পিতা-শহীদ ডাক্তার আলীম চৌধুরী, মাতা-শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী। আমি ১৯৯৫ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করি। নিপসম থেকে এমপিএইচ করি ২০০৪ সালে। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া থেকে ২০০৮ সালে এমএস এবং ২০১২ সালে পিএইচডি করি।

আমার পিতা শহীদ ডা. আলীম চৌধুরী পেশায় ছিলেন চক্ষু বিশেষজ্ঞ। তিনি ছাত্রাবস্থা থেকেই ভাষা আন্দোলনসহ প্রগতিশীল সকল আন্দোলন এবং দেশের স্বাধিকার আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯৭১ সালে আমার বাবা আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য শহীদ ডা. ফজলে রাব্বীসহ অন্য চিকিৎসকদের নিয়ে একটি গোপন হাসপাতাল পরিচালনা করতেন এবং তাঁরা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ঔষধ সরবরাহ করতেন, আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যার্থে আর্থিক সহায়তা প্রদান করতেন। ১৯৭১ সালে আমরা ২৯/১, পুরানা পল্টনের একটি ভাড়া বাসায় থাকতাম। সেখানে আমি, আমার মা, বাবা এবং ছোট বোন ডাক্তার নুজহাত চৌধুরী সম্পাসহ বসবাস করতাম। আমি তখন ৩ বছরের শিশু, আমার ছোট বোনের বয়স ছিল তখন ২ বছর। এই বয়সেই আমরা আমাদের পিতাকে হারাই।

পরবর্তীতে বড় হয়ে আমরা মায়ের কাছে আমার বাবা অপহরণের বিস্তারিত বিবরণ শুনি। আমার মা ছাড়াও আমার নানী ও আমার বাবার দুই সহকারী হাকিম ভাই ও মুমিন ভাই আমার পিতার অপহরণের ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিল। তাদের কাছ থেকেও আমি আমার বাবা অপহরণের ঘটনার বিস্তারিত শুনেছি।

যা জেনেছি তা হলো- ১৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১ বিকাল আনুমানিক ৪টায় আমার বাবা দোতলার বারান্দায় বসেছিলেন, মা’ও কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন ঠিক এই সময় আমাদের বাড়ির সামনে একটি কাদা মাখানো মাইক্রোবাস এসে থামে। সেই মাইক্রোবাস থেকে দুজন সশস্ত্র ঘাতক আমাদের বাড়ির নিচতলায় আসে যেখানে থাকতেন আলবদর অর্গানাইজার তথাকথিত মাওলানা আবদুল মান্নান (পরবর্তীতে মন্ত্রী)। সেখানে ঘাতকরা ২০-৩০ মিনিট থাকার পর তারা দোতলায় এসে আমাদের দরজার বেল টেপে এবং দরজায় সজোরে লাথি দিয়ে দরজা খোলার জন্য হাঁকডাক করতে থাকে। তখন আমার মা কী করবেন বাবাকে এ কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন দরজা খুলে দাও।

আমাদের দোতলা বাসা থেকে নিচতলায় নামার জন্য ভিতর দিক থেকে একটি সিঁড়ি ছিল। সেই সিঁড়ি দিয়ে আমার বাবা নিচতলায় নেমে মাওলানা মান্নান সাহেবের বাসার দরজায় কড়া নাড়েন। মাওলানা মান্নান ভিতরে থেকে দরজা খোলেননি, ভিতর থেকে তিনি বলেছিলেন ‘আমি আছি আপনি যান’। ইতিমধ্যে হাকিম ভাই এবং মোমিন ভাই আমাদের বাসার দরজা খুলে দেয়। আমার বাবা মাওলানা মান্নানের সঙ্গে দেখা করতে না পেরে উপরে চলে আসেন এবং এসে দেখেন ঘাতকরা বাসার ভিতরে ঢুকে গেছে। বাবাকে দেখেই ঘাতকরা বলে ‘হ্যান্ডস আপ’ এবং পরিষ্কার বাংলায় বলে ‘আপনাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে’। বাবা জানতে চান কেন যেতে হবে, প্রত্যুত্তরে তারা বলে দরকার আছে। বাবার পরনে ছিল শার্ট আর লুঙ্গি, তিনি কাপড় পাল্টিয়ে আসতে চাইলে ঘাতকরা বলে তার আর প্রয়োজন হবে না। তখন বাবা তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন আমাকে কোথায় যেতে হবে, প্রত্যুত্তরে তারা বলেন গেলেই জানতে পারবেন। আমি মোমিন ভাই এবং হাকিম ভাইয়ের কাছ থেকে শুনেছি ঘাতকরা (বাবাকে) চোখ, হাত বেঁধে মাইক্রোবাসে উঠিয়ে নিয়ে যায়।

এরই একপর্যায়ে মাইক্রোবাস ছেড়ে যাওয়ার আগেই আমার মা বিচলিত অবস্থায় নিচতলায় মাওলানা মান্নানের বাসার দরজায় গিয়ে দরজা খোলার জন্য আকুতি করেন এবং জানতে চান আমার বাবাকে কারা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। মাওলানা মান্নান বাসার ভিতর থেকে দরজা না খুলে ‘ঘাবড়াবেন না আমার আলবদরের ছাত্ররা উনাকে নিয়ে যাচ্ছে’। তিনি আরও বলেন, ওরা তো ডা. রাব্বীকেও নিয়ে গেছে। মা তখন জানতে চান কোথায় নেওয়া হচ্ছে, কেনই বা নেওয়া হচ্ছে। উত্তরে মাওলানা মান্নান বলেন, যুদ্ধাহতদের চিকিৎসার জন্য তাকে সিএমএইচে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এরপর থেকে বাবার আর কোনো খোঁজ আমরা পাইনি।

১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সকাল থেকেই চারদিকে জয় বাংলা স্লোগান হচ্ছিল। মা অপেক্ষা করছিলেন বাবা ফিরে এলে নামিয়ে ফেলা বাংলাদেশের পতাকাটি আবারও উড়াবেন। ‘মায়ের সেই অপেক্ষা আর শেষ হয়নি। আমার বাবা আর ফিরে আসেনি’। ১৬ ডিসেম্বর সকাল ১০/১১টার দিকে একজন মুক্তিযোদ্ধা আমাদের বাসায় এসে বাসার সকলকে লক্ষ্য করে জিজ্ঞেস করছিল ‘সেই শয়তানটা কোথায় যে আলীম ভাইকে মেরেছে’? তখনই আমার মা-সহ বাসার সবাই বুঝতে সক্ষম হয় আমার বাবাকে হত্যা করা হয়েছে। অবশেষে ১৮ ডিসেম্বর বেলা ১১/১২টার দিকে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে বাবার ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়া যায় (সাক্ষী এ সময় অঝরে কাঁদছিলেন)।

বাবার লাশ উদ্ধারের পর দেখা যায় উনার মাথায়, বুকে এবং শরীরের অন্যান্য জায়গায় বেয়নেটের আঘাতের চিহ্ন ছিল। আমি একটু বড় ছিলাম বিধায় আমাকে লাশ দেখানো হয়নি, আমার ছোট বোন তখন বাবার লাশ দেখে আধো আধোভাবে বলেছিল ‘বাবার বুকে কত রক্ত, বাবা আর আসবে না’। ১৮ ডিসেম্বর সম্ভবত বিকাল বেলা আজিমপুর পুরনো কবরস্থানে আমার বাবাকে দাফন করা হয়।”

শহীদের সন্তান ফারজানা চৌধুরী নিপার সাক্ষ্য থেকে ওঠে আসে মাওলানা মান্নান তাদের নিচতলার বাসিন্দা ছিল। সে জানত ড. আলীম চৌধুরীকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনাটি। সে জুগিয়েছিল সমর্থন। জাতির দুর্ভাগ্য ও চরম লজ্জার যে, এই লোকটিকে পরবর্তীতে মন্ত্রী করা হয়েছিল। শহীদ ডা. আলীম চৌধুরী তাঁর পেশাগত জ্ঞান ও আদর্শ মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এবং সর্বোপরি দেশমাতৃকার জন্য উৎসর্গ করেছেন। এই সাক্ষী ও তাঁর ছোট বোন শুধু একজন পিতাকে হারাননি। তাঁরা হারিয়েছেন পিতার ¯েœহ ও আদর। তাদের নিরন্তর কান্না মনাবতাকেও করে শোকাচ্ছন্ন। জাতি শহীদ ডা. আলীম চৌধুরী ও তাঁর পরিবারের জন্য গর্ব করে। শত প্রতিকূলতায় তাঁরা নিজেদের পিতৃ আদর্শে গড়ে তুলেছেন।

শুরুতেই বলেছি বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের এ মামলায় মোট সাক্ষী ছিলেন ২৫ জন। এখানে শুধু শহীদদের সন্তান ও নিকট আত্মীয় এবং বিশিষ্ট ক’জনের সাক্ষ্যের কিছু অংশ (তাঁরা যেভাবে ট্রাইব্যুনালে বলেছেন) তুলে ধরা হলো। তাঁদের দেওয়া সাক্ষ্য ছাড়াও দালিলিক সাক্ষ্য ও সেই সময়ের দেশ-বিদেশের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত অনেক প্রতিবেদন প্রাসঙ্গিক হিসেবে ট্রাইব্যুনাল বিবেচনায় নিয়ে রায়ে তুলে ধরেছিলেন। ট্রাইব্যুনালের ওয়েবসাইটে (www.ict-bd.org) আপলোডেড থাকা রায় পাঠে এগুলো যে কেউ পড়তে পারবেন।

কোনো অপরাধের বিচারের একমাত্র লক্ষ্য অভিযুক্তকে সাজা দেওয়া নয়। বিচারের মাধ্যমে সত্যও উদ্ঘাটিত হয়। আর এই সত্য সবার জানা প্রয়োজন। বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডে এই মামলায় সাক্ষীদের সাক্ষ্য থেকে সেই সত্যই বেরিয়ে এসেছে। বিচার কার্যক্রমে দেখা গেছে শহীদদের সন্তান, স্ত্রী ও স্বজনরা হৃদয়ে জমে থাকা বেদনা কীভাবে প্রকাশ করেছেন। বিচারকের দায়িত্ব হলো সামনে থাকা সাক্ষ্য প্রমাণের যৌক্তিক বিশ্লেষণ নিরপেক্ষ এবং নির্মোহভাবে সিদ্ধান্ত প্রদান। এই মামলায় প্রদত্ত রায়ে নির্মম সত্যটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ সত্য জাতিকে শোকাহত করেই যাবে।

প্রত্যেক বিচারকই প্রথমত একজন মানুষ। তবে একজন ব্যক্তি বিচারক হিসেবে শপথ নেন দেশের সংবিধান ও আইনকে সংরক্ষণ করার জন্য। আমাদের মনে রাখতে হবে এই সংবিধান কেউ আমাদের দান করেনি। জাতির জনকের ডাকে সাড়া দিয়ে এ দেশের আপামর জনসাধারণ অপরিসীম বীরত্বের সঙ্গে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে নয়টি মাস যুদ্ধ করে ৩০ লাখ শহীদের আত্মাহুতি ও দুই লক্ষাধিক মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা আমাদের স্বাধীন মাতৃভূমি বাংলাদেশ, লাল-সবুজের পতাকা ও সংবিধান পেয়েছি। রক্তের আখরে লেখা আমাদের এই সংবিধান। এর মালিক জনগণের অধিকার সংরক্ষণের জন্যই এই সংবিধান। এই মামলার বিচার করতে গিয়ে সে বিষয়টি স্মরণ রাখতে হয়েছে।

এটি এখন ইতিহাসের সত্য যে, স্বাধীনতার ঊষালগ্নে নিশ্চিত পরাজয় জেনে পরিকল্পিত নীলনকশায় দখলদার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ও তাদের কুখ্যাত দোসর আলবদররা বুদ্ধিজীবীদের চরম বর্বরভাবে হত্যা করে। এই হত্যাকান্ডের বিচারের প্রত্যাশায় জাতি একরাশ গ্লানি বুকে অপেক্ষা করেছে কয়েক দশক। তাঁদের হত্যাকারীদের বিচার করতে গিয়ে বিচারক হিসেবে আমাদের বারবার মনে হয়েছে আমরা যদি সুষ্ঠুভাবে এ বিচারটি করতে পারি তাহলে একটি সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করা হবে। একই সঙ্গে জাতি জানতে পারবে সত্যটি। শহীদ বুদ্ধিজীবীগণসহ লাখ লাখ শহীদ ভাই ও মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়েই আমরা এই সংবিধান পেয়েছি। পেয়েছি স্বাধীন মাতৃভূমি। আমাদের সামনে সাক্ষ্য দিতে এসে শহীদদের সন্তান, স্ত্রী, স্বজনরা যখন আবেগাপ্লুত হয়েছেন, চোখের পানি ফেলেছেন তখন আমরা ক্ষণিকের জন্য বিচলিত হলেও আমাদের নিরপেক্ষতার শপথ আমাদের তিন বিচারককেই দৃঢ় থাকার তাগিদ দিয়েছে। অবশেষে সব আবেগের ঊর্র্ধ্বে উঠেই বিচারকাজ শেষে অভিযুক্তদের দোষী সাব্যস্ত করে রায় প্রদান করেছি।

এই বিচার কার্যটি পরিচালনা করতে একজনের সাক্ষ্য আমাদের কাছে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। তিনি হলেন পি.ডব্লিউ-২২ দেলওয়ার হোসেন। রায়েরবাজার বধ্যভূমি থেকে জীবন নিয়ে ফিরে আসা একমাত্র মানুষ তিনি। তিনি নিজ চোখে যা দেখেছেন তার বর্ণনাটি ঘাতকদের বর্বরতার চিত্রটি স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত করে। তাই পৃথকভাবে নিম্নে তা উল্লেখ করা হলো।

 

রায়েরবাজারের বধ্যভূমি থেকে বেঁচে ফিরে আসা সাক্ষী পি.ডব্লিউ-২২ দেলওয়ার হোসেন সাক্ষ্যদানকালে বলেন যে,...

“আমার নাম মো. দেলওয়ার হোসেন, পিতা-মরহুম হাজী লাল মিয়া। স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম-শ্যামপুর, ডাকঘর- শ্যামপুর, উপজেলা-কসবা, জেলা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া। বর্তমান ঠিকানা-২১৫/১, শান্তিবাগ, থানা-শাহজাহানপুর, ঢাকা। আমার বর্তমান বয়স ৭০ বছর।

১৯৭০ সালে আমি গ্রিনল্যান্ড মার্কেন্টাইল কোম্পানিতে চিফ অ্যাকাউন্ট্যান্ট হিসেবে কর্মরত ছিলাম। তখনো আমি আমার শান্তিবাগের বর্তমান ঠিকানাতেই বসবাস করতাম। আমি যে প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতাম তার ডাইরেক্টর ছিলেন একজন অবাঙালি, তার নাম ছিল মইন আশরাফ। ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন বাঙালি, তার নাম ছিল আবুল কাশেম। আরও একজন অবাঙালি পরিচালক ছিলেন তার নাম আমার এই মুহূর্তে মনে নেই, তিনি পাকিস্তান বিমান বাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত উইং কমান্ডার ছিলেন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের প্রথমদিকে একদিন উইং কমান্ডার সাহেবের সঙ্গে আমার প্রচ- তর্কবিতর্ক হয়। তিনি বঙ্গবন্ধুকে অসম্মান করে তার সমস্ত কার্যকলাপের অযৌক্তিক সমালোচনা করছিলেন। আমি এর তীব্র প্রতিবাদ জানালে আমাদের মধ্যে তর্কবিতর্ক হয়। সেদিন উইং কমান্ডার সাহেব তার নোট বইয়ে আমাকে লক্ষ্যবস্তু হিসেবে চিহ্নিত করে আমার নামটি লিখেছিলেন বলে আমার অনুমান হয়।

১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের ১৪ তারিখ সকাল সাড়ে ১০টার সময় আমার বাসায় খাবারের ব্যবস্থা না থাকায় আমি কিছু কেনার জন্য ঘর থেকে বের হয়ে আশেপাশের দোকানে যাওয়ার চেষ্টা করি। তখন কারফিউ চলছিল, খুব গোপনে বের হয়ে আশেপাশের সমস্ত দোকানপাট বন্ধ দেখতে পাই এবং কিছুক্ষণের মধ্যে আমি বাসায় ফিরে আসি। আমার বসতঘরটি তখন চারদিকে বাঁশের বেড়া দ্বারা ঘেরা ছিল। উপরে ছিল টিনের চাল। বাসায় ফিরে আসার কিছুক্ষণ পর ৬ জন সশস্ত্র লোক খাকি পোশাক পরিহিত অবস্থায় আমার বাসায় আসে, তাদের সঙ্গে আরও দুজন লোক সাধারণ পোশাকে আমার বাসায় এসে দরজায় টোকা দিয়ে দরজা খুলতে বলে, দরজা খুলতে বিলম্ব হওয়ায় লাথি দিয়ে দরজা ভেঙে ঘরের ভিতর প্রবেশ করে। একজন সেনাবাহিনীর ইউনিফর্ম পরিহিত লোক আমার বাসা থেকে একটি বাসা পরে অন্য একটি বাসার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। যারা আমার ঘরে প্রবেশ করেছিল তাদের মধ্যে খাকি পোশাক পরিহিত ৩ জন আমার পেছন থেকে আমার দিকে বন্দুক তাক করেছিল, সিভিল পোশাকে আসা দুজন আমার দুই বাহু ধরে বলেছিল, সামনে সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তা আছেন আপনাকে তার কাছে যেতে হবে এই বলে তারা আমাকে তার কাছে নিয়ে যাচ্ছিল। দুজন যখন আমার হাত ধরে বাইরে নিয়ে যাচ্ছিল তখন একে অপরকে ‘আশরাফুজ্জামান’ ও ‘মইন উদ্দিন’ বলে সম্বোধন করছিল। তারা একে অপরকে ভাই বলেও সম্বোধন করেছিল। তখন তারা আমাকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্মকর্তার কাছে নিয়ে যায়। তার নির্দেশে মালিবাগ চৌরাস্তা থেকে ভিতরে শান্তিবাগের দিকে ‘পাবনা সমিতি’র অফিসের কাছে পূর্ব থেকেই অপেক্ষমাণ একটি মাইক্রোবাসের সামনে নিয়ে আমাকে দাঁড় করায়। সেখানে নিয়ে আমার গায়ের জামাটি খুলে আমার চোখ বেঁধে ফেলে। চোখ বাঁধার আগে আমি দেখতে পাই মাইক্রোবাসটির ভিতরে আরও ৩/৪ জন লোককে চোখ ও হাত বাঁধা অবস্থায় বসিয়ে রাখা হয়েছে।

মাইক্রোবাসটি কালো-নীল রং দ্বারা রং করা ছিল। মাইক্রোবাসটিতে আমাকে উঠানোর পর আমার হাত দুটি পেছন থেকে বেঁধে দেওয়া হয়। এরপর আমি আর কিছু দেখতে পাইনি। এরপর বাসটি ছেড়ে দিল।... মাইক্রোবাসটি পরিপূর্ণ হলে পরে বেলা ১২টা সাড়ে ১২টার দিকে একটি জায়গায় গিয়ে মাইক্রোবাসটি থামে এবং আমাদেরকে সেখানে নামানো হয় এবং আমি অনুমান করলাম আমাদেরকে দোতলায় একটি হলঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। দোতলায় যে ঘরে আমাদেরকে নেওয়া হয় এই ঘরের দরজা খুলে আমার পিঠে সজোরে লাথি মেরে এই ঘরটিতে ঢোকানো হয়। আমি লাথির আঘাতে মেঝেতে না পড়ে সেখানে পূর্ব থেকেই বন্দী অবস্থায় থাকা কিছু মানুষের ওপরে গিয়ে পড়লাম। আমি আমার হাতের বাঁধনের কারণে খুব ব্যথা অনুভব করছিলাম এবং ব্যথায় কাতরাচ্ছিলাম, এমন সময় সেখানে থাকা কম বয়সের একটি বন্দী ছেলে যার হাত তখন খোলা ছিল সে আমার কষ্ট দেখে আস্তে আস্তে আমার হাতের বাঁধন খুলে দেয়। আমি তখন আমার নিজ হাতে আমার চোখের বাঁধন সরিয়ে ফেলি। ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলে তার নাম বলে তারেক এবং অষ্টম শ্রেণির ছাত্র বলে জানায় এবং সে আরও জানায় এই জায়গাটি মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট যা আলবদর বাহিনীর হেডকোয়ার্টার।

আমি আমার চোখ খোলার পর অনেক লোককে বন্দী অবস্থায় ওই ঘরে কাত হয়ে পড়ে থাকতে দেখি, তাদের অনেকের চোখ বেরিয়ে এসেছে, কাঁধে গুরুতর জখম, শরীরের বিভিন্ন স্থানে কাটাছেঁড়ার দাগ এবং রক্তজমাট অবস্থায় দেখতে পাই। সারা ফ্লোর তখন রক্তে ভেসে যাচ্ছিল। তখন অনুমান বেলা ১টা হবে। যে ছেলেটি আমার হাতের বাঁধন খুলে দিয়েছিল সে আমাকে বলল, আপনার চোখ খোলা অবস্থায় দেখতে পেলে আলবদররা আপনাকে মেরে অর্ধমৃত করে ফেলবে। তখন আমি আমার চোখের বাঁধনের জন্য ব্যবহৃত আমার শার্টটিতে মেঝে থেকে রক্ত লাগিয়ে সেটি দিয়ে আমার চোখ আলতোভাবে বেঁধে রাখলাম যাতে আমি দেখতে পাই।

সারা দিন কেটে যাওয়ার পর সন্ধ্যার দিকে আরও কিছু লোককে ধরে এনে একই ক্যাম্পে একই হল ঘরে রাখা হয়। আমি তখন একটি দেয়ালের কাছে কাত হয়েছিলাম। বন্দীদের একজন অত্যন্ত আকুতি করে বলছিলেন তার হাতে খুব ব্যথা হচ্ছে কেউ যদি থাকেন তার হাতের বাঁধনটা যেন খুলে দেন। তখন আমি ধীরে ধীরে ওই লোকটির কাছে গিয়ে তার হাতের বাঁধনটি খুলে দিই। হাতের বাঁধন খোলার সময় আমি লোকটিকে চিনতে পারি, তিনি আর কেউ নন, আমাদের শিক্ষক মুনীর চৌধুরী। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিন্ন বিভাগের ছাত্র হলেও বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী প্রমুখকে ভালোভাবেই চিনতাম।

১৪ ডিসেম্বর দিবাগত রাত ৮টা-সাড়ে ৮টা হবে, দুজন লোক হারিকেন হাতে হলের অভ্যন্তরে (যেখানে আমরা সবাই বন্দী অবস্থায় ছিলাম) প্রবেশ করে, তাদের পেছনে আরও ১০-১২ জন লোক ছিল যাদের হাতে ছিল লোহার রড। শহরে ব্ল্যাকআউট থাকার কারণে ওরা হারিকেন নিয়ে ঢুকেছিল। আমি দেখতে পেয়েছি মুনীর চৌধুরী স্যারের কাছে গিয়ে ওই দুজন বলছিল, আপনি তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এতদিন ছাত্রদের মন্ত্র পড়িয়েছেন, আজ আমরা মন্ত্র পড়াব- এই বলে তারা স্যারকে জিজ্ঞেস করে ‘রবীন্দ্রনাথের ওপর তুমি কয়টি বই লিখেছ’। তিনি না-সূচক জবাব দিলে ওই লোকগুলো মুনীর চৌধুরী স্যারের পাশে থাকা মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী স্যারকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘আমি রবীন্দ্রনাথের ওপর বই লিখেছি।’ এ সময় ওই দুজন তাদের সাথীদের বলে, এদেরকে শেষ করে ফেলতে হবে এরা ইন্ডিয়ান স্পাই। এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে হাতে রড থাকা লোকগুলো মুনীর চৌধুরী স্যারের সমস্ত শরীরে এলোপাতাড়িভাবে লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে তুলাধোনা করে ফেলে। তখন স্যারের মুখ দিয়ে গল গল করে রক্ত বেরুচ্ছিল (সাক্ষী এ সময় আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে)। একইভাবে মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী স্যারকেও ওরা লোহার রড দিয়ে পেটায়। যে দুজন স্যারকে এবং অন্য বন্দীদের পেটানোর নির্দেশ দিয়েছিল তারা বলছিল সময় হাতে বেশি নেই যা করার খুব তাড়াতাড়ি কাজ সারতে হবে। এ সময় আমাকেও মাথায় এবং পায়ে আঘাত করে (মাথার আঘাতের চিহ্ন আদালতকে দেখায়)।

রাত ১২টা কি সাড়ে ১২টা হবে। তখন ওই লোকগুলো সদলবলে আবার আসে এবং আমাদের সকল আটককৃত লোকদের বাইরে দাঁড়ানো প্রায় ২০-২২টি বাসে ওঠায়। আমি যখন ওই হলে আটক অবস্থায় ছিলাম তখন একজন মহিলার আর্তনাদ শুনতে পেয়েছিলাম। সম্ভবত তাকে আমি যেখানে ছিলাম তার ছাদের ওপর অথবা পাশের কোনো কক্ষে নির্যাতন করা হচ্ছিল। বাসগুলো কিছুক্ষণ চলার পর একটা জায়গায় গিয়ে থামে এবং আমাদেরকে মোহাম্মদপুরের কাটাসুর নামক একটি জায়গায় বিলের কাছে একটি বটগাছের নিচে একটি পুকুরের চারপাশে বসায়, সেখানে গিয়ে আটককৃত অবস্থায় অনেক লোককে দেখতে পাই। সেখান থেকে আমাদেরকে ২০-২৫ জনের গ্রুপ করে একটি দড়ি দিয়ে এক এক করে বেঁধে একটি বিলের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে অনেকগুলো ইটের ভাটা ছিল (বর্তমান শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ এলাকার আশেপাশে)। সেখানে বন্দীদেরকে নিয়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে বিলের মধ্যে ফেলে দিতে থাকে। এদের মধ্যে যারা চিৎকার করত তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল।

এ সময়ে সমস্ত ঘটনা আমি আলতোভাবে বাঁধা আমার চোখের বাঁধনের ফাঁক দিয়ে দেখতে পাই। ঠিক এই সময়ে আমি একজন মহিলার আর্তনাদ শুনতে পাই তিনি আকুতি করে বলছিলেন, ‘আমাকে মেরো না, তোমাদেরও মা-বোন আছে, আমি যদি তোমাদের বোন হতাম তাহলে কী করতে, আমার একটি ছোট্ট শিশু বাচ্চা আছে, আমাকে মেরে ফেললে সে বাঁচবে না, তাকে দেখার কেউ নেই।’ তখন হত্যাকারীরা তাকে জিজ্ঞেস করে তার নাম কি, কী তার পরিচয়। উত্তরে তিনি তাঁর নাম সেলিনা পারভীন বলে জানিয়েছিলেন। সেলিনা পারভীনের এই কথাগুলো আমি নিজ কানে শুনেছি। তিনি বলেছিলেন, তিনি পেশায় একজন সাংবাদিক, একটি ছোট পত্রিকা তিনি চালান। তাঁকে ছেড়ে দিলে তিনি আর কখনো ঢাকায় আসবেন না এবং পত্রিকায় লেখালেখি করবেন না। তথাপিও ঘাতকরা তাঁকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। এরই মধ্যে আমাদের সঙ্গে আটক থাকা একটি ছেলে আশরাফুজ্জামান এবং মইন উদ্দিনকে লক্ষ্য করে বলে আশরাফ ভাই, মইন ভাই, আপনারা থাকতে আমাকে মেরে ফেলবে, আপনারা আমাকে রক্ষা করুন। এ কথা শোনার পর আশরাফুজ্জামান এবং মইন উদ্দিন দুজনই আমাদের থেকে একটু দূরে চলে যায়। এ সুযোগে আমি আমার হাতের বাঁধন খুলে চোখের কাপড় সরিয়ে নদীর দিক লক্ষ্য করে দৌড়ে পালাতে থাকি। আমার ধারণা ছিল ওরা আমাকে নির্ঘাত গুলি করবে এবং আমি গুলির আঘাতেই মৃত্যুবরণ করব, বেয়নেটের আঘাত আমাকে সইতে হবে না। আমি ৭/৮ মিনিট দৌড়ানোর পর ওরা বুঝতে পারে কোনো একজন বন্দী পালিয়ে যাচ্ছে। তখন তারা এলোপাতাড়ি গুলি শুরু করে। আমি পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতার কাটতে শুরু করি।

রাত তখন ভোর হয়ে আসছিল, চারদিকে সুনসান নীরবতা। আমি ধীরে ধীরে আরও বিলের ভিতরে সাঁতরিয়ে এগোতে থাকি। পাশের গ্রাম বসিলা থেকে ভোরের দিকে দুজন লোক এসে আমাকে উদ্ধার করার চেষ্টা করে। তাদেরকে আমার প্রথমে সন্দেহ হলে তারা তাদের গায়ের চাদর সরিয়ে দেখায় তাদের কাছে কোনো অস্ত্রশস্ত্র নেই। তারা আমাকে বলেন, বাবা আপনার কোনো ভয় নেই। আপনি আসেন আমরা আপনাকে উদ্ধার করতে এসেছি। এ অবস্থায় আমি তাদের কাছে যাই। তারা আমাকে উদ্ধার করে তাদের বাড়িতে নিয়ে যায় এবং তারা আমাকে পানতা ভাত, মুড়ি লাউ তরকারি দিয়ে খেতে দেয়।

আমি তাদেরকে কাছাকাছি কোনো মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পের ঠিকানা দিতে বললে তারা আটির বাজারে স্থাপিত মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে যাওয়ার রাস্তা দেখিয়ে দেয়। আটি বাজার মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে যাওয়ার পথে ১৫ ডিসেম্বর বিকাল ৩টা সাড়ে ৩টার দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে দেখা হয়। তাদেরকে আমি কাটাসুরে হত্যাযজ্ঞের ঘটনা সম্পর্কে বলি। তারা তখন বললেন আমরা ঢাকা অপারেশনে যাচ্ছি ফিরে এসে আপনার কাছ থেকে বিস্তারিত শুনব। বিকাল ৫টার দিকে মুক্তিযোদ্ধারা যখন ফিরো এলো তখন আমি তাদেরকে বিস্তারিতভাবে রায়েরবাজার কাটাসুরের হত্যাযজ্ঞের ঘটনাটি দেখার কথা বিবৃত করি।... পরদিন অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বর বিকাল বেলা শুনতে পাই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে মর্মে ঘোষণা করতে থাকেন। ১৭ ডিসেম্বর বেলা ১২টার দিকে আমি আমার ঢাকার নিজ বাসায় ফিরে আসি।

১৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ প্রথম দৈনিক বাংলায় রায়ের বাজারের ঘটনা বিবৃত করে আমার দেওয়া বক্তব্য ছাপা হয়। পরবর্তীতে যুক্তরাজ্যভিত্তিক টেলিভিশন নেটওয়ার্ক চ্যানেল ফোর-এর প্রস্তুতকৃত ডকুমেন্টারি ‘ওয়্যার ক্রাইম ফাইলে’ আমি আমার সাক্ষাৎকার দিই। এ ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মিডিয়াতে এবং জনসম্মুখে আমি এই হত্যাযজ্ঞে, আমার আটক হওয়া এবং ফিরে আসার ঘটনা বিবৃত করে বক্তব্য রেখেছি।”

যে কেউ এই প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীর বর্ণনা পাঠে বিষণœতায় ভারাক্রান্ত হবেন। শহীদদের স্বজনদের দেখার সুযোগ হয়নি কোথায় তাঁদের প্রিয়জনদের নিয়ে আটক করে নির্যাতন করা হয়, হত্যা করা হয় এবং কারা এসব নির্মম হত্যাকান্ডের হোতা ছিল। মৃত্যুকূপ থেকে ফিরে আসা একজন প্রত্যক্ষদর্শী পি.ডব্লিউ-২২ দেলওয়ার হোসেনের প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য থেকে এটি উঠে এসেছে যে, শহীদ মুনীর চৌধুরী, শহীদ মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, শহীদ সেলিনা পারভীনসহ অপহরণ করে আরও অনেককেই নিয়ে যাওয়া হয় মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে, যা ছিল আলবদর বাহিনীর হেডকোয়ার্টার। কুখ্যাত আলবদর আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মইন উদ্দিন কেবল নৃশংস নজিরবিহীন এই হত্যাযজ্ঞের তদারকিতে ছিল না, তারা প্রত্যক্ষভাবে বুদ্ধিজীবীদের পরিকল্পিত কিলিং মিশনের নেতৃত্ব দিয়েছিল। তারা ছিল ‘ডেথ স্কোয়াড’-এর সক্রিয় সদস্য। এই সত্যটিও উঠে এসেছে সাক্ষী দেলওয়ার হোসেনের সাক্ষ্যে।

উপসংহার :

বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশার উদ্দেশ্যই ছিল জাতিকে মেধাশূন্য করা। চূড়ান্ত বিজয়ের আগেই তাঁরা চলে গেছেন। এসব নির্মম সত্য উঠে এসেছে শহীদদের সন্তান, স্ত্রী ও স্বজনদের দেওয়া সাক্ষ্য থেকে। মহান বিজয়ের এই মাসে এই বর্বর সত্যকে প্রতিফলিত করার জন্যই এ লেখা। শহীদ বুদ্ধিজীবীরা চলে গেছেন। কিন্তু এখনো তাঁদের কর্ম, চেতনা ও আদর্শ এই বাংলার আলো-বাতাসে মিশে আছে, থাকবেও। তাঁদের অভাবে প্রতিটি শহীদ পরিবার হয়ে পড়ে অভিভাবকহীন, অসহায় ও চরমভাবে বেদনাক্রান্ত। অনেক সংগ্রাম করে প্রতিকূলতা অতিক্রম করে পথ চলতে হয়েছে প্রত্যেক শহীদ জায়াকে। তাঁরা বুকে অসীম বেদনার পাথর বেঁধে হাল ধরেন পরিবারের।

১৯৭১-এর ১৬ ডিসে¤¦র যেদিন দেশের আপামর জনগণ আনন্দ-উল্লাসের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার স্বাদ আস্বাদন করছিল ঠিক সেদিনই এই শহীদদের সন্তানরা, স্বজনরা জানলেন তাঁদের পিতা, ভাই, মা, স্বজন আর কোনো দিন ফিরে আসবেন না। শহীদ সেলিনা পারভীনের ছেলে সেদিন জানতে পারেন পৃথিবীতে তার বাবা ও মা বলতে আর কেউ রইল না। (তাঁর বাবা পূর্বেই মৃত্যুবরণ করেন)। সম্ভবত সাংবাদিক সেলিনা পারভীনই একমাত্র ‘মা’ যাকে আলবদররা নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। তাই শহীদ সেলিনা পারভীনের হত্যাকা-কে ট্রাইব্যুনাল আখ্যা দিয়েছে ‘মাতৃকুলের ওপর নির্মম আঘাত’ তথা ‘মাতৃহত্যা’ (ম্যাট্রিসাইড)।

ট্রাইব্যুনালের সামনে যখন শহীদদের সন্তানরা সাক্ষ্য দিচ্ছিলেন তখন জানা যায় তাঁরা প্রায় সবাই অত্যন্ত উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছেন। শহীদ বাবার আদর্শকে বুকে ধারণ করে, দেশে ও বিদেশে তাঁরা এখন সুপ্রতিষ্ঠিত। আমরা রায়ে এটি দৃশ্যমানভাবে ব্যক্ত করিনি যে, শহীদ জায়াগণ তাঁদের জীবনের সর্ব শক্তি ও ধৈর্য দিয়ে কীভাবে তাঁদের পিতৃহারা সন্তানদের মানুষ করেছেন, কেননা বিচারের জন্য এটি প্রাসঙ্গিক ছিল না। তবে আমরা তিনজন বিচারকই সেই মায়েদের প্রতি অন্তর নিঃসৃত শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছি। নির্মমতার পরিণতিতে শহীদ জায়ারা পরিবারের সবার দায়িত্ব নিয়ে যেভাবে ত্যাগ ও তিতিক্ষার পথ পরিক্রমা করেছেন সেটিও বিনম্র হৃদয়ে স্মরণ করেছি।

জাতির শ্রেষ্ঠ মেধাবী সন্তান শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স¥রণ করার পাশাপাশি জাতি স্যালুট জানায় সেই সকল শহীদদের সহধর্মিণীদের প্রতি যাঁরা অবর্ণনীয় বেদনা ও কষ্ট বুকে নিয়ে তাঁদের সন্তানদের মানুষ করেছেন। দেশ ও জাতির প্রত্যাশা, এসব শহীদের সন্তানরা প্রত্যেকে তাঁদের নিজ নিজ পিতার আদর্শ ও মাতার ¯েœহ ও ত্যাগকে সঙ্গী করে এ জাতিকে একটি সত্যিকারের অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল ও বিজ্ঞান মনস্ক জাতিতে পরিণত করার কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখবেন এবং জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। তাহলেই শুধু শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মা শান্তি পাবে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আদর্শ ও ত্যাগের মহিমা কোনো দিন ম্লান হবে না।  শত বেদনার মাঝেও তাঁদের বীরত্বপূর্ণ চেতনা, অদম্য আদর্শ, মেধা ও আত্মত্যাগ জাতিকে করবে অনুপ্রাণিত।  সবশেষে বিনম্র শ্রদ্ধা ও সম্মান শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি।  তাঁদের আত্মার শান্তি কামনা করছি।

 

সর্বশেষ খবর