বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

বিশ্বব্যাপী বড়দিনের বর্ণিল ব্যঞ্জন

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

বিশ্বব্যাপী বড়দিনের বর্ণিল ব্যঞ্জন

শুরুর কথা

সমগ্র বিশ্বের কোটি কোটি ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী এবং ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ প্রতি বছর ২৫ ডিসেম্বর ক্রিসমাস পালন করে থাকে। বাংলাদেশ ক্রিসমাস ‘বড়দিন’ নামে পরিচিত। খ্রিস্টান ধর্মমতে এই পবিত্র দিনে মহাপ্রভু যিশু তার কুমারী মা মেরির কোলে স্রষ্টার বিশেষ কুদরতে জন্মগ্রহণ করেন। বিশ্বের অনেক দেশেই সরকারি ছুটির তালিকায় থাকে এই দিন। তা ছাড়া স্কুল-কলেজ ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বহু প্রতিষ্ঠানই বড়দিন এবং নববর্ষ মিলিয়ে দীর্ঘদিনের বার্ষিক ছুটি পালন করে। মূল ধর্ম বিশ্বাস এক হলেও প্রথাগতভাবে বিভক্তি বা মতভেদ রয়েছে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে। তাই নানা আনুষ্ঠানিকতায় পালিত হয় বড়দিন। আর উৎসবের শুরু এবং শেষও হয় ভিন্ন ভিন্ন সময়ে। তবে ২৫ ডিসেম্বরে মহাপ্রভু যিশুর আগমনের বিষয়ে একমত সব ধারা বা উপধারার খ্রিস্টান সম্প্রদায়। তাই বিশ্ব ২৫ ডিসেম্বরে সাজে নতুন রূপে। এই দিনের প্রার্থনায় বিগত দিনের পাপ মোচনের পাশাপাশি নতুন বছরের জন্য মঙ্গল কামনা করা হয় প্রতিটি গির্জায়।

 

বড়দিনকে ঘিরে কয়েকটি উৎসব

ফিলিপাইনের সান ফার্নান্দো শহরটির অন্যতম পরিচয় ‘ফিলিপাইনের ক্রিসমাস ক্যাপিটাল’ নামে। প্রতিবছর বড়দিনের পূর্ববর্তী শনিবার এখানে উদযাপিত হয় আলোকোজ্জ্বল ফানুস ওড়ানোর উৎসব। এই উৎসবে এলাকার ১১টি গ্রামের মানুষ সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও বিস্তৃত আলোকসজ্জিত ফানুস তৈরি ও ওড়ানোর তীব্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। শুরুর দিকে মাত্র দেড়ফুট ব্যাসের ফানুস বানানো হতো এক ধরনের কাগজ দিয়ে। আর মোমবাতি জ্বালিয়ে তা আলোকিত করা হতো। বর্তমানে বিভিন্ন উপাদান দিয়ে এই ফানুস তৈরি হয়। যার বিস্তৃতি প্রায় ২০ ফুট ছাড়িয়ে যায়। আর মোমবাতির বদলে হরেক রকম কৃত্রিম বাতি রঙিন করে তোলে ফিলিপাইনের রাতের আকাশ।

১৯৬৬ সাল থেকে সুইডেনের গেফেল ক্যাসেল স্কয়ারে ক্রিসমাস বা বড়দিনের আগমন উপলক্ষে নির্মিত হয় প্রায় ১৩ মিটার বা চারতলার সমান উঁচু বিশেষ ধরনের ছাগলের প্রতিকৃতি। ধর্মীয় কিংবদন্তি মতে, প্রাচীনকালে ‘থর’ নামক এক দেবতা ইউলি গোট নামক বিশেষ দুটি ছাগলের বাহনে চড়ে ঊর্ধ্বাকাশে গমন করে। পরবর্তীতে চাষিরা তাদের উৎপাদিত শর্ষের শেষ অংশ এই ইউলি গোটের নামে উৎসর্গ করত। আর শহরে বড়দিনের আগে নির্মিত হতো ইউলি গোটের বিশাল প্রতিকৃতি। পরবর্তীতে এই প্রতিকৃতি পুড়িয়ে ফেলার তথ্য পাওয়া যায় একাধিক সূত্রে।

অস্ট্রেলিয়ার ঐতিহ্যমতে ধর্মযাজক সেইন্ট নিকোলাস বড়দিন উপলক্ষে শান্ত, ভদ্র ও আদরণীয় শিশুদের বিভিন্ন উপহার দিয়ে থাকে। আর ‘ক্রামপাস’ নামক তার এক বিপথগামী খারাপ সঙ্গী এ সময় দুষ্টু বাচ্চাদের বস্তায় ঢুকিয়ে নিয়ে যায়। ঐতিহ্যকে অনুসরণ করে অস্ট্রেলিয়ার তরুণদের একাংশ ডিসেম্বরের গোড়া থেকেই ক্রামপাস বা ভূত বা শয়তান সেজে রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ায় এবং শিশুদের ভয় দেখায়।

জাপানে সাদামাটাভাবেই পালিত হতো বড়দিন। উপহার প্রদান আর কিছু আলোকসজ্জার মধ্যেই সীমিত ছিল বড়দিনের আনুষ্ঠানিকতা। কিন্তু ইদানীংকালে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পারিবারিকভাবে বা দলবেঁধে কেন্টাকি ফ্রাইড চিকেন বা কেএফসির খাবার খাওয়া। কেএফসি জাপান এ উপলক্ষে হরেক স্বাদের খাবার তুলে ধরে উৎসবপ্রিয় জাপানি খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সামনে।

আইসল্যান্ডের শিশুরা বড়দিনের ১৩ দিন আগ থেকেই জানালার বাইরের অংশে তাদের সবচেয়ে ভালো জুতা রেখে দেয়। তাদের বিশ্বাস এই ১৩ দিনের ১৩টি বিশেষ চরিত্র বা জোকার সমগ্র আইসল্যান্ড ঘুরে বেড়াবে আর রাতের বেলায় শান্ত, ভদ্র ও লক্ষ্মী বাচ্চাদের জুতায় সুন্দর সুন্দর আপেল রেখে যাবে আর দুষ্টু বাচ্চাদের জুতায় থাকবে শুধু পচা আলু। একইভাবে জার্মানির শিশুরাও জুতাভর্তি উপহারের আশায় থাকে বড় দিনের প্রাক্কালে। তাদের বিশ্বাস সেইন্ট নিকোলাস নামের ধর্মযাজক ভালো বাচ্চাদের জুতা উপহার সামগ্রী যেমন  কয়েন, চকলেট, কমলা ও খেলনা দিয়ে ভরিয়ে দেবে। আর সেইন্ট নিকোলাসের দুষ্টু সঙ্গী কেèচ রুপ্রিচ আসে নোংরা দাড়ি নিয়ে তার পরনে থাকে গাঢ় রঙের পোশাক। আর হাতে থাকে লাঠি বা ছোট চাবুক, যা দুষ্টু বাচ্চাদের শাস্তি দিতে ব্যবহৃত হয়।

আধুনিক এই যুগে নরওয়ের গোঁড়া খ্রিস্টান সম্প্রদায় বিশ্বাস করে বড়দিনের মৌসুমে জিন, ভূত, প্রেতাত্মা বা অশরীরী কেউ ঘর পরিষ্কার করার ঝাড়– খুঁজে বেড়ায় এবং এই ঝাড়ুতে চড়ে ঘুরে বেড়ায়। এখনো এসব মানুষ বড়দিনের সময় অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে অতীব নিরাপদ ও গোপন স্থানে তাদের ঘর পরিষ্কার করার ঝাড়ু লুকিয়ে রাখে।

ভেনিজুয়েলাতে বড়দিনের সঙ্গে রোলার স্কেটিংয়ের এক অকল্পনীয় যোগসূত্র তৈরি হয়েছে। দেশটির কেরাকাস অঞ্চলে বড়দিনের শুরুতেই রোলার স্কেটিং করেই চার্চে যায় এবং প্রার্থনা শেষে একই কায়দায় বাড়িতে ফিরে ঐতিহ্যবাহী খাবারের অনুষ্ঠানে যোগ দেয়। রোলার স্কেটিংয়ের এই চাপ সামাল দিতে পুলিশের পক্ষ থেকে বেশ কিছু রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়।

বড়দিনের আগে কম্বোডিয়ায় উদযাপিত হয় ‘লিটল কেন্ডেলস ডে’ বা ছোট মোমবাতির দিন। এই দিনে এবং দিবাগত রাতে খ্রিস্টান সম্প্রদায় তাদের বাড়ির সামনের অংশ বারান্দা, জানালা ইত্যাদি মোমবাতি ও কাগজের সাহায্যে তৈরি লণ্ঠন দিয়ে সাজিয়ে তোলে। বর্তমানে প্রযুক্তির উৎকর্ষে মোমবাতি বা লণ্ঠনের বদলে রংবেরঙের বাতিতে সেজে ওঠে কম্বোডিয়ার গ্রাম বা শহরের বিস্তীর্ণ এলাকা। অনেক এলাকায় অনুষ্ঠিত হয় আলোকসজ্জার প্রতিযোগিতা।

কানাডার অন্যতম শহর টরেন্টোর সুখ্যাতি রয়েছে ঘোড়ায় চড়ে বিশেষ ধরনের আলো বহন ও শোভাযাত্রার মাধ্যমে বড়দিনের ছুটির ক্ষণ শুরু করা। ১৯৬৭ সালে টরেন্টোর নবনির্মিত সিটি হল এবং নাথান ফিলিপস স্কয়ারের প্রদর্শনী উপলক্ষে একটি শোভাযাত্রা হয়। পরবর্তী বছরগুলোতে এই শোভাযাত্রা প্রতি বছরই হতে থাকে এবং ক্রমেই তা একটি ঐতিহ্যে পরিণত হয়। বর্তমানে বিদ্যুৎসাশ্রয়ী প্রায় ৩০ লাখ এলইডি বাল্ব দিয়ে নাথান ফিলিপ স্কয়ার সাজানো হয়। এই আলোকমালা নতুন বছরের আগমন পর্যন্ত প্রতি রাত ১১টা অবধি প্রজ্বলিত থাকে। এ সময় আতশবাজি পোড়ানো এবং ঘরের বাইরে আইস স্কেটিংয়ের ধুম পড়ে যায়।

জেরুজালেমের ১০ কিলোমিটার দক্ষিণে অর্থাৎ প্যালেস্টাইনের পশ্চিমতীরে ব্যাথলে হেম খ্রিস্টান ধর্মের প্রবর্তক যিশুখ্রিস্টের জন্মস্থান হিসেবে বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ। তাই বড়দিন উদযাপনের আয়োজনটাও এখানে ভিন্নতর। এই আয়োজন শুরু হয়ে যায় অক্টোবর মাসে গাছের পরিচর্যা আর গাছ সাজানোর মধ্য দিয়ে। এ সময় প্রায় ৮০০ লাইটপোস্টের প্রতিটিতে একটি করে কৃত্রিম ক্রিসমাস ট্রি লাগানো হয়। বিপণিবিতানে চলে বিশেষ বিক্রি উৎসব। অন্যদিকে নাটিকা আকারে রোজ গার্ডেনে মঞ্চস্থ হয় যিশুখ্রিস্টের জন্মের কাহিনি।

নাজারাথ থেকে বেথলে হেম পর্যন্ত ১০ মাইলজুড়ে অনুষ্ঠিত হয় শান্তিপূর্ণ শোভাযাত্রা। বেথলে হেমের এই জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন দেখতে ভিড় জমায় সারা বিশ্বের অসংখ্য পর্যটক ও ধর্মপ্রিয় খ্রিস্টান সম্প্রদায়। খ্রিস্টানদের মধ্যে বিভিন্ন মতাবলম্বী ভিন্ন ভিন্ন রীতিতে ভিন্ন দিনে বড়দিন পালন করে বলে বেথলে হেমে দীর্ঘদিন ধরে চলে উৎসবের পালা।

ইতালির রাজধানী রোমের মাঝখানে বিশ্বের সবচেয়ে ছোট আয়তনের এবং সবচেয়ে কম জনসংখ্যার স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ ভ্যাটিকান সিটি। তবে ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের পবিত্রতম গির্জা এবং তাদের ধর্মীয় গুরু বা পোপের আবাসস্থল হিসেবে এই শহরের গুরুত্ব অনেক বেশি। সারা বিশ্বের ধর্মপ্রাণ ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের ভিড় জমে ভ্যাটিকান সিটির বড়দিনের বিশেষ প্রার্থনায়। বড়দিন উপলক্ষে বিশেষ বাণী প্রদান করেন ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের এই নেতা। এরপর ঐতিহ্য অনুসারে পোপ অন্যান্য পোপের এক বিশাল বহর নিয়ে জাঁকজমকপূর্ণ পোশাকে ঐতিহাসিক গির্জায় প্রবেশ করেন এবং গির্জায় প্রবেশের দুর্লভ সুযোগপ্রাপ্তদের উপস্থিতিতে বিশেষ প্রার্থনা করেন ও সারা বিশ্বের মঙ্গল কামনা করেন।

 

দেশে দেশে ক্রিসমাস ট্রি

গাছের ওপরে কখনো একজন স্বর্গীয় দূতের মূর্তি আবার কখনো একটি তারা স্থাপন করা হয়, যার সঙ্গে রয়েছে বড়দিনের উৎপত্তি সংক্রান্ত ধর্মীয় বিশ্বাস

বড়দিনের আরেকটি আকর্ষণ হলো ক্রিসমাস ট্রি। বড়দিন উপলক্ষে বিশেষ ধরনের পাইন জাতীয় চিরসবুজ গাছ সাজানো হয়, যা উপরের দিকে তীক্ষ এবং নিচের দিকে ছড়ানো থাকে। বর্তমানে কৃত্রিমভাবে এই গাছ সাজানো হলেও এই প্রথার বাস্তব উৎপত্তি ঘটে উত্তর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। এসব দেশে উচ্চ শ্রেণির খ্রিস্টান সম্প্রদায় বড়দিন উপলক্ষে তাদের বাসগৃহে সুন্দর ও মানানসই আকৃতির ক্রিসমাস ট্রি স্থাপন করতেন। এই গাছ রঙিন কাগজের ফুল, ঝালর, আপেল, ওয়েফার ইত্যাদি দিয়ে সাজানো হতো। অষ্টাদশ শতকে ক্রিসমাস ট্রি সাজাতে নানা বর্ণের আলোক বাতি বা লাইট ব্যবহার শুরু হয়। পরবর্তীতে রঙিন ফিতা বা রিবনের সাহায্যে ক্রিসমাস ট্রিতে জিনজার ব্রেড, চকলেট ও অন্যান্য মিষ্টিসামগ্রী ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। গাছের ওপরে কখনো একজন স্বর্গীয় দূতের মূর্তি আবার কখনো একটি তারা স্থাপন করা হয়, যার সঙ্গে রয়েছে বড়দিনের উৎপত্তি সংক্রান্ত ধর্মীয় বিশ্বাস। এই ক্রিসমাস ট্রি স্থাপন এবং তা সরানোর জন্য বিশেষ দিনক্ষণ বেছে নেওয়া হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে খ্রিস্টান ধর্ম মতানুসারে বিশেষ ধর্মীয় মৌসুম শুরুর প্রথম রবিবারে ক্রিসমাস ট্রি স্থাপন করা হয়। আবার বড়দিনের পূর্ব মুহূর্তেও ক্রিসমাস ট্রি স্থাপনের রেওয়াজ রয়েছে। আর বড়দিন উদযাপনের ১২তম রাতে এই গাছ সরানো হয়। রাতটিকে ঘিরে উৎসবেরও আয়োজন হয় বহুদেশে। অনেকের বিশ্বাস হলো ক্রিসমাস ট্রি একটি স্বর্গীয় গাছের প্রতীক আর আপেল হলো সেই নিষিদ্ধ ফল। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই ঘরের গ-ি পেরিয়ে ক্রিসমাস ট্রি হিসেবে বাগান বা জনসমাগমের স্থলে সাজাতে দেখা যায়। আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ভবন হোয়াইট হাউসের দক্ষিণের বাগানে ১৯২৩ সাল থেকে একটি গাছকে ‘ন্যাশনাল ক্রিসমাস ট্রি’ হিসেবে সাজানো হয় এবং বিশেষভাবে আলোকিত করা হয়। এ ছাড়াও আটলান্টায় মেকিজ গ্রেট ট্রি, নিউইয়র্কের রকফেলার সেন্টার ক্রিসমাস ট্রি এবং অস্ট্রেলিয়ার এডিলেড শহরের ভিক্টোরিয়া স্কয়ারে বিশাল আকৃতির ক্রিসমাস ট্রি দেখা যায়। জার্মান লোকগাথা অনুসারে একদা একদল উপাসক ঝড়, দুর্যোগ ও বিপদ থেকে মুক্তির আশায় এবং ‘থর’ নামক দেবতাকে তুষ্ট করতে সুসজ্জিত একটি ওক গাছের নিচে নাচতে থাকে ও একটি শিশুকে বলি দিতে বা কোরবান দিতে উদ্যত হয়। সেইন্ট বেনিফেইস নামক একজন ধর্মযাজক বলি দিতে উদ্যতদের হাত থেকে ধারালো কুঠার নিয়ে নেন এবং যিশুখ্রিস্টের নামে এক কোপে ওক গাছটি কেটে ফেলেন। এই ওকগাছের পেছনেই ছিল বর্তমান ক্রিসমাস ট্রি সদৃশ্য বিশেষ গাছের চারা। সেইন্ট বেনিফেইস উপস্থিত সবাইকে আহ্বান জানিয়ে বলেন, এই গাছই হোক সত্যিকারের ঈশ্বরের প্রতীক, যার পাতা চিরজীবী ও চিরসবুজ, আর গাছের তীক্ষè উপরিভাগ স্বর্গের দিকে তাক করানো, সেই থেকে যিশুখ্রিস্টের নামে ‘ক্রিসমাস ট্রি’ সাজানোর প্রথা চালু হয় বলে অনেকের বিশ্বাস।

 

শিশুদের আকর্ষণ সান্তাক্লজ

পৃথিবীর সব দেশেই বড়দিনের অপরিহার্য অনুষঙ্গ হলো লাল রঙের বিশেষ পোশাক পরিহিত চরিত্র শান্তাক্লজ। অবশ্য বিভিন্ন দেশে ভিন্ন নামেও পরিচিত এই চরিত্র, যার অন্যতম ফাদার ক্রিসমাস, সেইন্ট নিকোলাস, সেইন্ট নিক, ক্রিস ক্রিংগেল এবং শুধু শান্তা। পাশ্চাত্যের খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের রীতি অনুসারে শান্তাক্লজ বলতেই চোখে ভাসে সাদা দাড়ি গোঁফের এক প্রবীণ ব্যক্তি। যার পরনে থাকে উজ্জ্বল লাল রঙের কোট। এই কোটের হাতল, বোতামের সারি এবং নিচে থাকে সাদা বর্ডার, একই রকম সাদা বর্ডার থাকে লম্বা লাল টুপির নিচে। পায়েও থাকে লম্বা গামবুট। মাঝে মাঝে গোল ফ্রেমের চশমা পরেন বুড়ো শান্তাক্লজ। এই শান্তাক্লজের উৎপত্তি বা পরিচয় নিয়ে বেশকিছু উপন্যাস পাওয়া যায়। বর্তমানে শান্তাক্লজের যে চরিত্র আমরা দেখতে পাই, তার উৎপত্তি চতুর্থ শতকে। এ সময় গ্রিক ধর্মযাজক সেইন্ট নিকোলাস মায়রা সভ্যতা অঞ্চলে বা বর্তমান তুরস্কে বিভিন্ন উপহার নিয়ে বড়দিনের আগেই শিশুদের সামনে হাজির হতেন বলে কিংবদন্তি রয়েছে। ব্রিটিশ কিংবদন্তিতে একই ধরনের চরিত্রের নাম ফাদার ক্রিসমাস। বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস এবং লুক্সেমবার্গে পরোপকারী ভাষায় ডাকা হয় (সিন্টারক্লাস, নামে, যার উৎপত্তি সেইন্ট নিকোলাস নাম থেকেই)। জার্মান লোকগাথায় ‘ওদিন’ নামক এক দেবতার বিরুদ্ধে লড়াই করেন এবং মানুষের মঙ্গল এবং রোগমুক্তি দান করেন। এই দেবতার চেহারাও ছিল শান্তাক্লজেরই মতো। শিশুতোষ বর্ণনা মতে, শান্তাক্লজ বাস করেন বরফের দেশ উত্তর মেরুতে। তার রয়েছে বিশাল এক কারখানা, সেখানে সারা বছর সবুজ বা লাল পোশাক পরা তীক্ষè কানের একদল কর্মী শিশুদের উপযোগী বিভিন্ন উপহার-  যেমন খেলনা, চকলেট ইত্যাদি তৈরি করে। সেখান থেকে বড়দিনের আগে শান্তাক্লজ আটটি বল্গা হরিণে টেনে চলে এমন একটি বাহনে পৃথিবীময় ঘুরে বেড়ায়, সারা বছর যে শিশুরা ভালো কাজ করেছে এবং ভালো ব্যবহার করেছে, তাদের শান্তাক্লজ খেলনা ও চকলেট উপহার দেন। অনেক শিশুই ঘুম থেকে উঠে বালিশের নিচে খেলনা বা চকলেট পেলেই তা শান্তাক্লজের উপহার বলে ধরে নেয় এবং আরও এক বছর ভালোভাবে চলার শপথ নেয়। অন্যদিকে যে শিশুরা দুষ্টুমি করে, তাদের ভাগ্যে উপহারের বদলে জুটে শুধু কয়লা। এই ভয় অনেক শিশুকেই সৎপথে চলতে সহায়তা করে। ইউরোপের বহু দেশেই ধারণা করা হয় যে, বাড়ির চিমনি দিয়েই ঘরে প্রবেশ করে শান্তাক্লজ। শান্তাক্লজকে আপ্যায়নেরও কমতি থাকে না। বিভিন্ন দেশে শান্তাক্লজকে দুধ, বিস্কুট, বিশেষ ধরনের পানীয়, পুডিং, জাউ প্রভৃতি দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। শান্তাক্লজের হাসিটিও নজর কাড়ে সবার। অল্পতেই হোঃ হোঃ  হোঃ করে হেসে ওঠেন শান্তাক্লজ আর তা দেখে শিশুরাই হেসে উঠে। শান্তাক্লজকে নিয়ে চিঠিও লিখে অনেক শিশু। পশ্চিমা বিশ্বে শান্তাক্লজকে নিয়ে শোভাযাত্রাও দেখা যায় অনেক দেশে। বিভিন্ন বিপণিবিতান এবং তারকা বিশিষ্ট হোটেলে জীবন্ত শান্তাক্লজ সাজানো হয় বড়দিন উপলক্ষে। যার সঙ্গে থাকা থলে ভর্তি খেলনা ও চকলেট শিশুদের বিতরণ করে। এ ছাড়াও শান্তাক্লজের মূর্তি বা মডেল শোভা পায় অসংখ্য দোকান, অফিস, বসতবাড়ি ও বিনোদন কেন্দ্রে।

 

বাংলাদেশে বড়দিন

উদার ও পরমতসহিষ্ণু ধর্মীয় সম্প্রীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশে বড়দিনের উদযাপন হয় ঘটা করেই। যদিও দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় দশমিক পাঁচ শতাংশ খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী, তবুও সরকার এই দিনটিকে সরকারি ছুটি হিসেবে গণ্য করে। বড় শহর, তারকা বিশিষ্ট হোটেল, শপিংমল প্রভৃতি বড়দিনের বিশেষ সাজে সেজে ওঠে। এ সময় অন্যতম আকর্ষণ থাকে বর্ণিল আলোক ঝরনা, কৃত্রিম বরফ ও ক্রিসমাস ট্রি এবং সাদা তুলায় তৈরি কৃত্রিম বরফ। বড় বড় হোটেলে শান্তাক্লজ সাজিয়ে শিশুদের উপহার দিতেও দেখা যায়। শহরে থাকা খ্রিস্টানদের অনেকেই নাড়ির টানে গ্রামে ফেরেন এবং নিজ সম্প্রদায়ের সঙ্গে বড়দিনের উৎসবে মেতে ওঠেন। নতুন পোশাক পরিধান, উপহার আদান-প্রদান এবং নিজ নিজ বাড়িঘর, অফিস ও গির্জা সাজানো বড়দিনের অন্যতম অনুষঙ্গ। প্রথা অনুযায়ী বড়দিনের প্রার্থনায় গির্জায় যোগ দেন সবাই। এ সময় সমবেত কণ্ঠে তারা গেয়ে ওঠেন শুভ বড়দিনের ধর্মীয় গান। গির্জায় প্রার্থনা শেষে দিনে এবং রাতে চলে পিঠা-পুলিসহ নানা উপকরণে ঐতিহ্যবাহী খাবারের আয়োজন। পাশ্চাত্যের আদলে নানা আকৃতির সুসজ্জিত কেক কেটে বড়দিন পালন করতে দেখা যায়। এ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও অন্য নেতারা বাণী প্রদান করেন।

সর্বশেষ খবর