শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

মোবাইলের দিনবদল

তানভীর আহমেদ

মোবাইলের দিনবদল

শুরুর কথা

যোগাযোগ ব্যবস্থায় এখন মোবাইলের গুরুত্ব অনেক। সারা বিশ্বে মানুষের হাতে হাতে পৌঁছে গেছে মোবাইল সেবা। চাইলেই মোবাইলের মাধ্যমে হাজার হাজার মাইল দূরের মানুষের সঙ্গে কথা বলতে পারেন যে কেউ। মোবাইল ছাড়া আমাদের দৈনন্দিন জীবন ভাবাই যায় না।

মোবাইলে ইন্টারনেট প্রযুক্তি যোগ হওয়ার পর থেকে দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে তাই মোবাইলের বিশেষ অপরিহার্যতা রয়েছে। এখন মোবাইল দিয়ে শুধু কথা বলা যায় না বরং এতে যোগ হয়েছে সর্বশেষ প্রযুক্তির সব আবিষ্কার। ক্যামেরা যোগ হওয়ায় ছবি তোলা, ভিডিও করা ও সেটা আদান-প্রদান সম্ভব হচ্ছে। স্মার্টফোন বাজারে আসার পর থেকে মোবাইলকে ‘মাল্টিমিডিয়া’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এখন একটি মোবাইল একটি মিনি কম্পিউটারের মতো সব কাজই করতে পারে।

কিন্তু মোবাইলের এই উৎকর্ষের পেছনে রয়েছে দীর্ঘ গবেষণা ও গবেষকদের অক্লান্ত শ্রমের ইতিহাস। শুরুর দিকে যে যন্ত্রের মাধ্যমে কথা আদান-প্রদান করা সম্ভব হয়, তা আলাদা একটি শক্তিসম্ভার সমেত বয়ে নিয়ে বেড়াতে হতো। গাড়িতে রেডিও ট্রান্সমিশনের সফলতার পর ‘কার টেলিফোন’-এর দেখা পাওয়া যায়। ১৯৪২ সালের দিকে হাতে বহন উপযোগী মোবাইল তৈরি সম্ভব হলেও সেটি ‘প্রাইভেট মোবাইল’ ছিল না। নেটওয়ার্কিংয়ের মাধ্যমে মোবাইল ট্রান্সমিশনের অধ্যায়টি মোবাইল জগতে গুরুত্বপূর্ণ। তবে ১৯৭৩ সালের পর থেকে আজকের দিনের মোবাইলের পথ চলায় গতি যোগ হয়। এরপর এসেছে মেসেজিং, ছবি প্রেরণ, ই-মেইল, মোবাইল ইন্টারনেট, ক্যামেরা মোবাইল, ফ্লিপ ফোন, টাচস্ক্রিন সেবা। সে ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে। যত সামনের দিকে আমরা যাচ্ছি তত আধুনিক মোবাইল প্রযুক্তি আমাদের হাতে আসছে। সামনের দিনে মোবাইলকে আরও উচ্চ প্রযুক্তিসমৃদ্ধ, দীর্ঘস্থায়ী ও ব্যবহারবান্ধব করার দিকেই চলছি আমরা।

 

হাতে বহনযোগ্য প্রথম মোবাইল

১৯৭৩ সালের আগে মোবাইল ফোন সংযুক্ত থাকত গাড়ি বা কোনো বাহনের সঙ্গে। কিন্তু নিজের সঙ্গে মোবাইল বহনের প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছিল বিভিন্ন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান। ১৯৭৩ সালের ৩ এপ্রিল মটরোলা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের মার্টিন কুপার প্রদর্শন করেন হাতে বহন-উপযোগী একটি মোবাইল সেট। বর্তমানে আমরা যে মোবাইলের আদল দেখছি তার গোড়াপত্তন ঘটে। মটরোলার এই সেট থেকে প্রথম ফোনটি করা হয় ড. জোয়েলের কাছে। এই মোবাইল সেটটির প্রটোটাইপ দেখানো হয় যার ওজন ছিল ১.১ কেজি। ২৩ সেন্টিমিটার লম্বা, ১৩ সেন্টিমিটার গভীর এবং ৪.৪৫ সেন্টিমিটার প্রশস্ত। প্রটোটাইপটি দিয়ে সর্বোচ্চ ৩০ মিনিট কথা বলা যেত। ৩০ মিনিট কথা বলার পর সেটটি বন্ধ হয়ে যেত। পুনরায় চার্জ দিতে কমপক্ষে ১০ ঘণ্টা সময় লাগত। মটরোলার চিফ পোর্টেবল কম্যুনিকেশন ছিলেন জন এফ মিচেল। তার অবদানের কথা ভুলে গেলে চলবে না। হাতে বহন-উপযোগী এই মোবাইল সেটটি মোবাইল দুনিয়া বদলে দেয়। ব্যক্তিগত ব্যবহার ও বাণিজ্যিক ব্যবহারের উপযোগী এই সেটটি তৈরির পেছনে অনেক শ্রম দিয়েছেন জন এফ মিচেল। যাই হোক, হাতে বহনযোগ্য মোবাইল তৈরিতে তার অনুপ্রেরণা ও মার্টিন কুপারের ডিজাইন ও প্রযুক্তির সম্মিলন অসম্ভবকে সম্ভব করে। পরে ১৯৮৩ সালে ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহার উপযোগী মোবাইল ফোন সেটটি  বাজারে ছাড়ে মটরোলা।

 

বিংশ শতাব্দীর অন্যতম জনপ্রিয় সেট

১৮৭৬ সালে মার্কিন উদ্ভাবক আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল বৈদ্যুতিক তারের মাধ্যমে মুখের কথা পাঠানোর যন্ত্রের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্যাটেন্ট বা সরকারি সনদ লাভ করেন। এর ২০ বছরের মধ্যে টমাস ওয়াটসন, এমিল বার্লিনার, টমাস আলভা এডিসন ও অন্যদের গবেষণার ফলশ্রুতিতে টেলিফোন যন্ত্রের নকশা এমন একটি স্থিতিশীল রূপ নেয় যা পরবর্তী প্রায় এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে মৌলিকভাবে অপরিবর্তিত থাকে। ১৯৪৭ সালে ট্রানজিস্টরের আবির্ভাবের পর ধাতব তার ও ভারী ওজনের যন্ত্রপাতির পরিবর্তে হালকা ওজন ও ঘনবিন্যস্ত বর্তনীসমৃদ্ধ টেলিফোন তৈরি করা শুরু হয়। ইলেকট্রনিক প্রযুক্তিতে উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আরও বেশ কিছু বুদ্ধিমান বৈশিষ্ট্য টেলিফোনে যুক্ত হয়।

 

মোবাইলে এতদূরে কথা পৌঁছায় কীভাবে?

মোবাইল ফোন অপারেটররা মোবাইল সুইচিং সেন্টার থেকে মোবাইলে কথা বা তথ্য আদান প্রদান নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এ জন্য তারা নিজস্ব একটি ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করেন। দেশজুড়ে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি গ্রহণ ও প্রেরণের জন্য তারা নেটওয়ার্ক টাওয়ার স্থাপন করেন। আপনি যখন মোবাইলে কথা বলেন মোবাইল সেই শব্দ ইলেকট্রিক সিগন্যাল থেকে বদলে রেডিও তরঙ্গ তৈরি করে। নেটওয়ার্ক টাওয়ার সেটি গ্রহণ করে, মোবাইল সুইচিং সেন্টার থেকে আপনি যাকে কল করেছেন তার নিকটবর্তী নেটওয়ার্ক টাওয়ারে পাঠিয়ে দেয়। সেই নেটওয়ার্ক টাওয়ার থেকে রেডিও তরঙ্গ যাকে কল করেছেন তার মোবাইলে পৌঁছে যায়। মোবাইল রেডিও তরঙ্গ, ইলেকট্রিক সিগন্যালকে বদলে শব্দে ও কথায় বদলে শোনায়।

 

 

বাংলাদেশে মোবাইল ফোন

বাংলাদেশে মোবাইল ফোন প্রথম চালু হয় ১৯৯৩ সালের এপ্রিল মাসে। হাচিসন বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেড (এইচবিটিএল) ঢাকা শহরে অগচঝ  মোবাইল প্রযুক্তি ব্যবহার করে মোবাইল ফোনসেবা শুরু করে।

 

 

 

 

ভবিষ্যতের বিস্ময়

ভবিষ্যতের মোবাইল ফোন সেট অসামান্য প্রযুক্তিনির্ভর হবে তা নিশ্চয় বলতে হবে না। শুধু কথা বলা, মেসেজ আদান-প্রদান করার বাইরে নেক্সট জেনারেশন ‘ফাইভ জি’ ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা থাকবে। এ ছাড়া ভিডিও কলিং সেবা সবার হাতে পৌঁছে যাবে। মোবাইল সেট বাঁকানো যাবে ইচ্ছামতো। প্রজেক্টরের কাজ করা যাবে ছোট এই মোবাইল দিয়েই।

 

 স্পর্শ সক্রিয় মোবাইলের কিবোর্ড বাতাসে ভাসমান অবস্থায় ব্যবহার করা সম্ভব হবে। এ ছাড়া শিগগিরই ঘড়ি বা চশমার সঙ্গে সংযুক্ত মোবাইল সেবা পাওয়া যাবে। ‘গ্লোসি মোবাইল’ বা কাচের মতো স্বচ্ছ মোবাইলের কথা অহরহ শোনা যায়। যার এক পাশ থেকে অন্য পাশ পরিষ্কার দেখা যায়।

 

এ ধরনের মোবাইল প্রযুক্তি খুব বেশি দূরে নয়। কিন্তু শুধু ডিজাইন নয় অভাবনীয় উন্নত প্রযুক্তির দেখা মিলবে অদূর ভবিষ্যতে। হাতের স্পর্শ ছাড়া শুধু মুখের কথা বা চোখের ইশারায় কাজ করতে সক্ষম এমন মোবাইল সেট তৈরির স্বপ্ন রয়েছে প্রযুক্তি নির্মাতাদের। এসব প্রযুক্তিনির্ভর মোবাইল নিজে থেকেই আপনাকে জানাবে নির্দিষ্ট গন্তব্যের মানচিত্র, আবহাওয়া-বিষয়ক বার্তা। ভবিষ্যতের মোবাইল শুধু মোবাইল ফোন ছাড়াও একটি কম্পিউটারের বিকল্প হিসেবে কাজ করতে সক্ষম হবে বলে মনে করা হয়।

 

 

মো বা ই লে র  বি ব র্ত ন

 

১৯২১

মোবাইল প্রযুক্তির অনবদ্য আবিষ্কারের বছর। শিকাগো পুলিশ এএম ব্যান্ড রেডিওর মাধ্যমে একটি তরঙ্গ প্রেরণের পরীক্ষা করে। তখন থেকেই আজকের মোবাইলের স্বপ্ন বাস্তবে নামিয়ে আনার পথ দেখে। সময়ের বিবর্তনে যা উন্নততর হয়েছে।

 

 

 

১৯৪০

বার্তা পাঠানোর প্রযুক্তির বেশ কিছুটা আধুনিকায়ন ঘটে। যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী রেডিও সিগন্যাল পাঠানোর কাজে লাগায় এই প্রযুক্তিকে। যুদ্ধে ঘোড়ার পিঠে বহন করে এই তরঙ্গ প্রেরণের মাধ্যমে মোবাইল যোগাযোগ করা হয়।

 

 

 

১৯৪২

মটরোলা প্রথম নিয়ে আসে পাঁচ পাউন্ড ওজনের একটি ‘হ্যান্ডি টকি’। যন্ত্রটি যুদ্ধে ব্যবহৃত  হয়, এটাই প্রথম কোনো মোবাইল সেট, যা খালি হাতে বহন সম্ভব হয়।

তবে এটি দিয়ে মাত্র এক মাইল দূরত্বের মধ্যে কথা বলা যেত।

 

 

১৯৫৬

মোবাইলে বাণিজ্যিক রূপ দেখা যায়। যুক্তরাজ্যের পোস্টমাস্টার জেনারেল রেগিনল্যান্ড ব্লেবিনসকে এই মোবাইল ব্যবহার করতে দেখা যাচ্ছে। প্রথম গাড়িতে সংযুক্ত টেলিফোনের মাধ্যমে কথোপকথনের সূচনা। তবে এ যন্ত্রটি আকারে অনেক বড় ছিল।

 

 

 

১৯৭২

এর আগে গাড়িতে সংযুক্ত রেডিও তরঙ্গ প্রেরণের মাধ্যমে মোবাইলে কথোপকথন সম্ভব হলেও এবার নিজের সঙ্গে বহনযোগ্য ইউনিট নেওয়া সম্ভব হয়। ছবিতে লন্ডনে ছোট ব্যাগের মতো এই ইউনিটটি কাঁধে নিয়ে এক মডেল। 

 

 

 

১৯৯২

‘কমুনিকেটর ডিভাইস’ আইবিএম মোবাইল দুনিয়ায় প্রথম টাচস্ক্রিন বা স্পর্শে সক্রিয় প্রযুক্তির সঙ্গে মানুষকে দেখা করিয়ে দেয়। আইবিএম সাইমন পার্সোনাল থেকে মোবাইল কল করা ছাড়াও ইমেইল, ফ্যাক্স এবং মেসেজ পাঠানো সম্ভব হয়।

 

 

 

১৯৯৯

নোকিয়া বাজারে নিয়ে আসে ৩২১০ ও ৭১১০ মডেলের দুটি মোবাইল। ৩২১০ দিয়ে প্রথম ছবি মেসেজ ‘হ্যাপি বার্থডে’ পাঠানো সম্ভব হয়। এ ছাড়া ৭১১০ মডেলটি দিয়ে দুনিয়া পরিচিত হয় ডাচের সঙ্গে। আধুনিক মোবাইলের অন্যতম অনুষঙ্গ এতে যোগ হওয়ায় মোবাইল ইন্টারনেটের বৈপ্লবিক প্রযুক্তি মোবাইলের ভবিষ্যতে নতুন মাত্রা যোগ করে।

 

 

২০০৭

মোবাইল দুনিয়ায় তোলপাড় করে অ্যাপলের থ্রিজি সংবলিত আইফোন। প্রযুক্তিবিদ স্টিভ জবসের আইফোনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক ছিল আগামী প্রজšে§র ইন্টারনেট সুবিধার এই মোবাইল সেবা। মোবাইলে যুগান্তকারী এই প্রযুক্তি সেবা বিশেষভাবে আলোচিত হয়।

 

 

 

২০১৯

২০১৯ সালে বাজারে আসে আইফোন১১। এ ফোনে রয়েছে এ১৩ বায়োনিক চিপসেট।  রয়েছে আল্ট্রা ওয়াইড ল্যান্স  সংবলিত ডুয়েল রিয়ার ক্যামেরা স্মার্টফোন ইতিহাসে সবচেয়ে দ্রুতগতির সিপিইউ ও জিপিইউ রয়েছে এই মোবাইলে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর