বৃহস্পতিবার, ২ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

নববর্ষে যত অঘটন

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

নববর্ষে যত অঘটন

ইতিহাসের আলোয় দেখা নববর্ষ

আজ থেকে প্রায় ৪ হাজার ২০ বছর আগে অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ২ হাজার সালে তৎকালীন মেসোপটেমিয়া (বর্তমান ইরাক) অঞ্চলে নতুন বছর উদযাপনের প্রথা চালু হয় বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়। খ্রিস্টপূর্ব ১৫৩ সালে তৎকালীন রোমান শাসন ব্যবস্থায় সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামের নাম ছিল ‘কনসালস’। এই কনসালসের অভিষেক হতো তৎকালীন নতুন বছরের প্রথম দিন। ফলে এই দিনে উৎসবের আয়োজন করা হতো রোমে। সপ্তদশ শতকে তৎকালীন ‘নেদারল্যান্ডসে নতুন বছরে উপহার সামগ্রী প্রদানের প্রথা চালু হয়। প্রায় একই সময়ে ইংল্যান্ডেও এই প্রথা প্রচলনের তথ্য রয়েছে। খ্রিস্টান ধর্ম মতে, মহাপ্রভু যিশুর জন্মের পর ধর্মযাজকরা শিশু যিশুর জন্য উপহার নিয়ে আসতেন। সেই ধারাবাহিকতায় বড় দিন এবং নতুন বছরকে কেন্দ্র করে উপহার প্রদানের প্রচলন আজও বিদ্যমান।

নতুন ইংরেজি বছরের সঙ্গে নতুন ক্যালেন্ডারের যোগসূত্র রয়েছে। রোমান শাসক জুলিয়াস সিজার খ্রিস্টপূর্ব ৪৫ সালের ১ জানুয়ারি তার নামের আদলে ‘জুলিয়ান ক্যালেন্ডার’ চালু করেন। বর্তমানে পৃথিবীর বুকে অধিকাংশ দেশে ইংরেজি গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার চালু রয়েছে। ১৫৮২ সালের অক্টোবরে ইতালির অভ্যন্তরে পৃথক ধর্মরাষ্ট্র বা পাপাল স্টেটের প্রধান এবং ক্যাথলিক গির্জার প্রধান ধর্মগুরু ত্রয়োদশ পোপ গ্রেগরি গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার চালু করেন।

ব্যাবিলন সভ্যতার সময় অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ৪ হাজার বছর আগে তৎকালীন ব্যাবিলনে (বর্তমান ইরাক) নতুন বছরে আগের সমস্ত ধন ফেরত দেওয়ার প্রথা চালু ছিল। ইহুদি ধর্মাবলম্বীরা নতুন বছরের শুরুতে কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং অন্যদের এ দিন ক্ষমা করে দেয়। স্কটল্যান্ডের রেওয়াজ হলো নতুন বছরে প্রতিবেশীদের বাড়িতে বেড়ানো এবং তাদের মঙ্গল কামনা করা। তবে নেচে গেয়ে কিংবা মাত্রাতিরিক্ত মদ খেয়ে নববর্ষ উদযাপনের নেপথ্যে রয়েছে কেবলই বাণিজ্যিক স্বার্থ। একই কথা বলা চলে নববর্ষের নতুন শুভেচ্ছা কার্ড দেওয়ার ক্ষেত্রে। আর এ ক্ষেত্রে আধুনিক সংস্করণ হলো ক্লাব, রেস্তোরাঁ, তারকা হোস্টেল ও বিনোদন কেন্দ্রে নববর্ষ উপলক্ষে বিশেষ খাবার-দাবার ও পানীয়, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ডিজে পার্টি, কনসার্ট ও কাউন্ট ডাউন। নতুন বছরকে ঘিরে নতুন নতুন পরিকল্পনাও করেন কেউ। আবার নতুন লক্ষ্যমাত্রাও নির্ধারণ করা হয়। তবে নতুন বছরে নতুন কিছু অর্জন বা বিসর্জনের জন্য রেজুলুশন বা শপথ নেওয়া বহুল প্রচলিত একটি প্রথা, তবে মজার ব্যাপার হলো ব্রিটিশ মনোবিজ্ঞানী রিচার্ড ওয়াইজম্যান ৩ হাজার মানুষের ওপর গবেষণা করে দেখেছেন যে, শতকরা ৮২ জন নতুন বছরের রেজুলুশন বা শপথকৃত অর্জন বা বিসর্জন লাভ করতে পারেনি, যদিও তাদের মধ্যে শতকরা ৫২ জন এ বিষয়ে নতুন বছরে কাক্সিক্ষত অর্জন বা পরিবর্তনের বিষয়ে দৃঢ় বিশ্বাসী ও আত্মপ্রত্যয়ী ছিলেন। তবে আনন্দ উদযাপন কিংবা নিছক বিনোদনের জন্য আলোকসজ্জা ও ঘরে ঘরে উৎসব আজ শহরের জীবনে নববর্ষের আগমনকে রাঙিয়ে তোলে।

 

ভিড়ে পদদলিত ২০ প্রাণ-হংকং

১৯৯৭ সালের ১ জুন ১০০ বছরের লিজের মেয়াদ শেষে হংকং ব্রিটিশ কর্তৃত্ব থেকে মুক্ত হয় এবং নিজস্ব অধিকার বজায় রেখে পুনরায় চীনের বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চলে পরিণত হয়। পরিসংখ্যান অনুসারে হংকংয়ের ৯২ শতাংশ মানুষের আদি নিবাস চীনে। চীনের হান উপজাতির লোকেরাই মূলত হংকংয়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় বলে বিবেচিত। প্রথাগতভাবে চীনের মতো হংকংয়েও চায়নিজ নিউ ইয়ার বা চায়নিজ নববর্ষ পালিত হয়। তবে ব্রিটিশ শাসনের প্রভাব এবং চীনে পরিবর্তনের ধারা সূচিত হওয়ার কারণে ইংরেজি নববর্ষ পালনেরও সূচনা হয় হংকংয়ে। এ উপলক্ষে রাতের হংকং বর্ণিল হয়ে ওঠে। বড় বড় শপিংমল, রেস্তোরাঁ এবং পাড়া-মহল্লায়ও ইদানীং ইংরেজি নতুন বছর উদযাপনের ঢেউ লক্ষ্য করা যায়। মেট্রোরেলসহ গণপরিবহনগুলো সারা রাত চলে। ফলে বাড়ি ফেরার তাড়া বোধ না করে উৎসব উদযাপনে নিশ্চিন্তে মেতে ওঠে হংকংবাসী।

রাত ১০টা থেকে দ্রুতই বদলাতে থাকে হংকংয়ের চিত্র। বর্ণিল আলোর খেলা আর আতশবাজির শব্দ বাড়তে থাকে রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। টুসিম সা টুসি স্টার ফেরি টার্মিনালে রাত ১০টায়ই জমতে শুরু করে নিউ ইয়ার কনসার্ট। ঠিক মধ্যরাতে হংকং কনভেনশন ও এক্সিবিশন সেন্টারে সংগীত আর সুরের বিকট আওয়াজ আর আতশবাজির চোখ ধাঁধানো উৎসবে বিলবোর্ডে ভেসে ওঠে নতুন বছর আগমনের বার্তা। আমেরিকার নিউইয়র্ক যেমন নববর্ষে সবাইকে মাতিয়ে তোলে, তেমনি হংকংয়ের টাইমস স্কয়ারও জাগিয়ে রাখে হংকংবাসী এবং পর্যটকদের। তবে হংকংয়ে কর্মরত বিদেশি বা প্রবাসীদের নজর থাকে ল্যান কুয়াই ফং নাম এল খ আকৃতির রাস্তার দিকে। এই রাস্তার দুই পাশে রয়েছে আকর্ষণীয় ক্লাব, রেস্তোরাঁ এবং পানশালার (বার) সমাহার।

১৯৯৩ সালের ১ জানুয়ারি মধ্যরাতে (নববর্ষে) ল্যান কুয়াই ফংয়ের প্রায় সব কটি রেস্তোরাঁ, ক্লাব ও বার কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। মধ্যরাতে নতুন বছরের কাউন্ট ডাউন শুরু হতেই একসঙ্গে সব উৎসবপ্রেমী রাস্তায় নেমে আসে। তারা একে অপরের দিকে বিয়ার (পানীয়) ছুড়ে মারাসহ নানা ধরনের হইহুল্লড়ে মেতে ওঠে। এ সময় কিছুটা আতঙ্কও শুরু হয় ভিড়ের তীব্রতার কারণে। এরই মধ্যে রাস্তার একটি ঢালু অংশ অতিক্রম করার সময় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় পরিস্থিতি। ফলে কিছু মানুষ নিচে পড়ে যায় এবং পদদলিত হতে থাকে। ভিড় ঠেলে কাউকে উদ্ধার করাও কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে ঘটনাস্থলেই মারা যান উৎসবে আসা দেশ বিদেশের ২০ জন। আহত হন ১০০ জনেরও বেশি। পরে জানা যায় যে, নববর্ষের এই উৎসবে প্রায় ২০ হাজার উৎসুক জনতা শামিল হয়েছিলেন, যাদের অনেকেই নববর্ষ এলে আজও আতঙ্ক ও করুণ স্মৃতিতে ভোগেন।

 

জঙ্গি হামলার শিকার ২০ জন সানগিল-আফগানিস্তান

১৯৭৮ সালের এপ্রিলে প্রেসিডেন্ট দাউদ খানকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে আফগানিস্তানে এক অরাজকতাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। এই অভ্যুত্থানের নেপথ্যে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রত্যক্ষ মদদ ছিল বলে তথ্য রয়েছে। এক বছরের মাথায় সোভিয়েত সৈন্যরা সরাসরি আফগানিস্তানে অবস্থান করে এবং তাদের পছন্দের সরকার ক্ষমতায় বসায়। এই সরকারের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মাঠে নামায় ইসলামী জঙ্গি বাহিনী। এই জঙ্গিরা মুজাহিদিন, তালেবান, ইসলামিক স্টেট (আইএস) প্রভৃতি নামে লড়াই চালিয়ে যায়। আফগান-সোভিয়েত এই যুদ্ধ চলে প্রায় ১১ বছর। বিশেষ চুক্তির পর ১৯৮৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সোভিয়েত সৈন্যদের শেষ দল আফগানিস্তান ত্যাগ করলেও নানা কারণে আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, রক্তপাত, গৃহযুদ্ধ, গুপ্ত হামলা, রকেট হামলা ইত্যাদি লেগেই থাকে। বিশেষত নারী অধিকার, নারী শিক্ষা এবং বিনোদনের প্রশ্নে চরম রক্ষণশীলতার নীতি অনুসরণ করে ইসলামী জঙ্গিরা, যা ক্ষেত্র বিশেষে আজও বিদ্যমান। এই রক্ষণশীলতা পরবর্তীতে সামাজিক অনুষ্ঠানেও ভর করে। ফলে যেসব অনুষ্ঠানে নারী-পুরুষ সবাই যোগ দেয় সেখানেও হামলা হতে থাকে। এমনি এক প্রেক্ষাপটে আফগানিস্তানে ইংরেজি নববর্ষ পালনের কথা কেউ ভাবতেও পারে না। তবে নববর্ষের দিন বিয়ের অনুষ্ঠানেও যে হামলা হতে পারে, তা ছিল কল্পনার বাইরে।

আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ন্যাটো বাহিনীর সৈন্যরা দীর্ঘ ১২ বছর আফগানিস্তানে অবস্থান করে। ১ জানুয়ারি ২০১৫ সালে ন্যাটো বাহিনী আফগান সরকারি বাহিনীর কাছে সব দায়িত্ব হস্তান্তর করে। ঠিক এই দিনই তালেবান জঙ্গিরা দক্ষিণ আফগানিস্তানের হেলমান্দ প্রদেশের সানগিন নামক স্থানে আফগানদের একটি সেনা সদর দফতরে আক্রমণ চালায়। এই অঞ্চলের আধিপত্য নিয়ে দীর্ঘদিন ন্যাটো নেতৃত্বাধীন ব্রিটিশ ও মার্কিন সৈন্যদের সঙ্গে জঙ্গিদের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। ফলে ন্যাটো নিয়ন্ত্রণ অবসানের পরক্ষণেই তাদের দোসর আফগান সরকারি সৈন্যদের আক্রমণ করে তালেবানরা। তীব্র যুদ্ধের এক পর্যায়ে তালেবানরা ঢুকে পড়ে পার্শ্ববর্তী একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে। এ সময় সমগ্র অতিথি এবং আত্মীয়রা বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে ব্যস্ত ছিল। কঠোর পর্দা মেনে অনুষ্ঠানস্থলের পাশেই একটি দালানে অবস্থান করছিল শতাধিক নারী ও শিশু। এ সময় আফগান সৈন্যদের বিরুদ্ধে আক্রমণরত তালেবানদের সঙ্গে থাকা একটি রকেট আঘাত করে নারী ও শিশুভর্তি সেই দালানে। বিষয়টি পরিকল্পিত না দুর্ঘটনাজনিত, তা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। তবে নিশ্চিত তথ্য হলো এই রকেট বিস্ফোরিত হলে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান কমপক্ষে ২০ জন, যার অধিকাংশই নারী। এ সময় অ্যাম্বুলেন্স যোগে ৪৫ জনকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। এই করুণ ঘটনা আজও কাঁদায় আফগানবাসীদের। তাই ইংরেজি নববর্ষ স্বজনহারাদের জীবনে নিয়ে আসে এক হৃদয় বিদারক আর্তনাদ।

 

গুজবের বলি ৩৬ জন-সাংহাই

চীনের অন্যতম প্রসিদ্ধ শহর সাংহাই। এই শহরের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে হোয়াংহো নদী। নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে সুউচ্চ অনেক দালান কোঠা, দেশ-বিদেশের বহু প্রতিষ্ঠান এবং নামি-দামি ব্যক্তির বসবাস এই নদীকে ঘিরে। নদীতীরের একটা বড় অংশজুড়ে গড়ে উঠেছে ‘দি বান্ড’ নামের এক খোলা চত্বর। দেশ-বিদেশের পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত থাকে দি বান্ড চত্বর প্রায় বছরজুড়েই। আর বিশেষ বিশেষ উৎসবে সাংহাইয়ের সব রাস্তাই যেন এসে মিলে দি বান্ডে। উৎসব আনন্দে দি বান্ড নজর কাড়ে সবার। দীর্ঘদিনের রক্ষণশীলতা কাটিয়ে চীনের দরজা জানালা যখন খুলে দেওয়া হয়, তখন পাশ্চাত্য সংস্কৃতিও ঢুকে পড়ে চীনে। এরই ধারাবাহিকতায় ঘটা করেই ইংরেজি বর্ষবরণ উদযাপিত হতে থাকে সাংহাইসহ চীনের প্রধান প্রধান শহরে। আর সাংহাইয়ের উৎসব মানেই দি বান্ডে আনন্দের জোয়ার। ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর রাতে এমনি আনন্দে ভাসছিল দি বান্ড নামের নদী তীর। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বয়সের মানুষের উপস্থিতিতে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠে দি বান্ড চত্বর। সংবাদ মাধ্যমের ধারণা, সে রাতে প্রায় তিন লাখ মানুষের সমাগম ঘটে দি বান্ড এবং তার আশপাশের এলাকায়।

পুরনো বছরের বিদায় ঘণ্টা বাজতে তখনো বাকি। সবাই চেষ্টা করছিল যথাসম্ভব নদীর তীরে পৌঁছতে এবং কিছুটা উঁচু জায়গায় স্থান পেতে যাতে উৎসবের বর্ণিল আলোর খেলা এবং লেজার শো ভালোভাবে দেখা যায়। এমন সময় গুজব রটে যে, ভিড় বেশি হওয়ার কারণে আলোর খেলা ও লেজার শো বাতিল করা হয়েছে। ফলে একদল মানুষ নিরাশ হয়ে দি বান্ড এলাকা ছেড়ে যাওয়ার উদ্যোগ নেয়। আরেকদল দর্শক এই গুজবে কান না দিয়ে চেষ্টা করে ক্রমাগত সামনে এগিয়ে চলার। এতেই শুরু হয় হুড়োহুড়ি। রাত সাড়ে ১১টা থেকে প্রায় ২০ মিনিট চলে এই হুড়োহুড়ি। রাত ১১টা ৫০ মিনিটে ‘দি বান্ডের চেন ই-স্কয়ারের একটি ভবনের চতুর্থ তলায় অবস্থিত পানশালার (বার) জানালা থেকে কিছু রঙিন কাগজ ছুড়ে দেওয়া হয় মানুষের ভিড়ের ওপর। এতে শুরু হয় নানা ধরনের গুজব। কেউ ভাবে এগুলো এক ধরনের বিল, যার আর্থিক মূল্য রয়েছে। কারও মতে, এগুলো মূল্যবান কুপন। আবার বাতাসে মার্কিন ডলার ছুড়ে দেওয়া হচ্ছে বলেও কেউ কেউ বিশ্বাস করে বসে। যে যা-ই বিশ্বাস করুক না কেন, একখ- রঙিন কাগজ ধরার তীব্র প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে সবাই। এতেই বাধে বিপত্তি। নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় পরিস্থিতি। হুড়োহুড়ির মধ্যে মানুষের পায়ের নিচে পড়ে প্রাণ হারাতে থাকে হতভাগ্যরা। পরিস্থিতি এমন আকার নেয় যে, পুলিশ বা উদ্ধার কর্মীদের পক্ষেও ঘটনাস্থল চিহ্নিত করা, ঘটনাস্থলে পৌঁছান এবং আহত বা নিহতদের উদ্ধার করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর পুলিশ এবং স্বেচ্ছাসেবীরা অনেক দূর থেকে হাত ধরে ধরে একেকটি গলি বা গ্যাপ তৈরি করে, যার মধ্য দিয়ে হতাহতদের উদ্ধার অভিযান শুরু হয়। অ্যাম্বুলেন্স ঢোকার ব্যবস্থা হলে দ্রুত হয় উদ্ধার অভিযান। সবার সম্মিলিত চেষ্টায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলেও ঘটনাস্থলেই পাওয়া যায় ৩৬ জনের মৃতদেহ, যারা মূলত মানুষের পায়ের নিচে পিষ্ট হয়ে প্রাণ হারায়। অন্যদিকে মারাত্মক আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় আরও ৪৭ জনকে।

 

আরও কিছু অঘটন  

২০০১ সালকে স্বাগত জানাতে জমে উঠেছিল নেদারল্যান্ডসের ভোলেনদাম শহর, শহরের একটি দালানে এক সারিতে ছিল ৩টি ক্যাফে, দালানের সবচেয়ে উপরের তলায় এই তিন ক্যাফেতে সে রাতে ১৩ থেকে ২৭ বছর বয়সী প্রায় ৩৫০ জন তরুণ-তরুণী এবং যুবক-যুবতী আনন্দ আড্ডায় মেতে ছিল। এমনি এক প্রেক্ষাপটে মধ্যরাতের কাউন্ট ডাউনের পর পর (‘ক্যাফে ডি হেমেলে’ হেমেল অর্থ স্বর্গ) প্রথম আগুনের সূত্রপাত হয়। জানা যায়, তারাবাতির মতো এক ধরনের আতশবাজি জ্বালানো হয়েছিল ক্যাফের ভিতর, সেখান থেকেই ঘর সাজানোর জন্য ব্যবহৃত কাগজের ডেকোরেশন সামগ্রী এবং ছাদ থেকে ঝুলানো ঝাড়ে প্রথমে আগুন লাগে এবং দ্রুতই তা ভয়াবহ আকার ধারণ করে।

পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ও দ্রুত বের হওয়ার পর্যাপ্ত পথ না থাকায় আগুনে পুড়ে ও দম বন্ধ হয়ে মারা যান ১৪ জন। আর ৪০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৭৫২ ডিগ্রি ফরেন হাইট) তাপমাত্রায় অগ্নিদগ্ধসহ ২০০ জনসহ মোট ২৪১ জন হাসপাতালে ভর্তি হন। তদন্তে গাফিলতি প্রমাণিত হওয়ায় জেল হয় ক্যাফের মালিক ও ম্যানেজারের। আর দায় নিয়ে পদত্যাগ করেন স্থানীয় মেয়র এবং প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা।

৩১ ডিসেম্বর ২০০৭ সালে ফিলিপাইনের তুরো, বকু এবং বুলাকানে একই সঙ্গে আগুন লাগে আতশবাজি রাখা কয়েকটি গুদামে। চীনের মতো ফিলিপাইনেও একদল সনাতনী মানুষ মনে করে যে, উচ্চ শব্দ তথা বাজির তীব্র শব্দে দূরে সরে যায় যাবতীয় অপশক্তি। তাই নতুন বছরে সব অপশক্তিকে দূরে রাখার তীব্র প্রতিযোগিতায় নামতে দেখা যায় তাদের। তাই আতশবাজি তৈরি ও মজুদের হিড়িক পড়ে নতুন বছর শুরুর আগে আগে। এমনিভাবে প্রচুর আতশবাজির মজুদ গড়ে তোলা হয়েছিল মোটামুটিভাবে নিম্নআয়ের মানুষের বসবাসের এলাকা হিসেবে পরিচিত তুরো, বকু এবং বুলাকানে। পাশাপাশি অবস্থিত এই তিনটি এলাকায় প্রথম গুদামে আগুন লাগার পর পর দ্রুত পুড়ে যায়। অধিকাংশের মতে, অসাবধানতাবশত সিগারেটের অবশিষ্ট অংশ নিক্ষেপ থেকে আগুনের সূত্রপাত ঘটে। আবার কেউ কেউ ধারণা করেন পরীক্ষামূলকভাবে বাজি ফোটানো অথবা রাসায়নিক বিক্রিয়ায় আগুন লাগে। এই আগুনে অনেক এলাকা এবং তিনটি গাড়ি পুড়লেও কারও মৃত্যু ঘটেনি। পার্শ্ববর্তী একটি খোলা ট্রাক টার্মিনালে দ্রুত আশ্রয় নেওয়ায় প্রাণের ঝুঁকি হ্রাস পায়। তবুও ৭ জন আহত হয় নতুন বছর শুরুর আগেই। ফিলিপাইনে আতশবাজি থেকে আগুনের আরও ঘটনা ঘটে ১৯৮৮, ২০০৪, ২০০৭ এবং ২০১৫ সালে। বর্তমানে এ বিষয়ে কড়াকড়ি আরোপ করেছে ফিলিপাইন সরকার। নববর্ষের ঠিক একদিন আগে, ২০০৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর রাতে আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনোস আইরেস শহরের ‘রিপাবলিকা ক্রমানন’ নামের নাইট ক্লাবে ঘটে দেশটির অন্যতম শোকাবহ ঘটনা। দোতলা এই ক্লাবটিতে নববর্ষ উপলক্ষে আয়োজন করা হয়েছিল এক কনসার্ট। এই কনসার্টে গান পরিবেশন করছিল ব্যান্ড দল ক্যলিজেরস, যার বিখ্যাত গান ‘আগুনের দিন’। এই ব্যান্ডের গান চলাকালেই আগুন ধরে যায় নাইট ক্লাবে। যার ফলে ১৯৪ জন করুণ মৃত্যুর শিকার হন এবং ১৪৩২ জন নানাভাবে আহত হন। ঘটনার তদন্তে জানা যায়, এই কনসার্টস্থলে ১ হাজার ৫০০ ধারণক্ষমতা থাকলেও প্রায় ৩ হাজার জন সমবেত হয়েছিল। নববর্ষ উপলক্ষে ক্লাবের ছাদ থেকে ফ্লোর পর্যন্ত সাজানোর জন্য যা কিছু ব্যবহৃত হয়, তার প্রায় সবই ছিল দাহ্য পদার্থ। বিনা টিকিটে প্রবেশ বন্ধের জন্য ক্লাবের ৬টি দরজার ৪টিই বন্ধ ছিল সেই রাতে। এ সময় একদল তরুণ ক্লাবের ভিতরেই তারাবাতির মতো আতশবাজি জ্বালানোর ফলে ছাদ থেকে ঝুলানো ঘর সাজানোর নেটে আগুন লেগে যায়। নেট অত্যন্ত দাহ্য হওয়ায় কু-লি পাকিয়ে সারা ক্লাবে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। আগুনের লেলিহান শিখা, ধোঁয়া, বিষাক্ত গ্যাস এবং প্রচন্ড ভিড়ের চাপে এ সময় ১৯৪ জন মারা যান এবং ১৪৩২ জন বিভিন্ন মাত্রায় আহত হন। তবে সবচেয়ে করুণ বিষয় হলো, ক্লাব কর্তৃপক্ষ মা-বাবার সঙ্গে আসা শিশুদের জন্য ক্লাবের বাথরুমের আকার পরিবর্তন করে অপেক্ষাগার তৈরি করেছিল। প্রাণ হারানোদের মধ্যে অনেকেই ছিল সেই অপেক্ষাগারে থাকা শিশু। এ ছাড়াও অপ্রাপ্ত বয়স্ক অনেক কিশোর-কিশোরীরও মৃত্যু ঘটে এই করুণ ঘটনায়। তদন্ত শেষে দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়ায় ক্লাবের মালিক শীর্ষ ব্যবসায়ী ওমর চাবানকে ২০ বছরের কারাদ- দেওয়া হয়। তদন্তে প্রমাণিত হয় ব্যান্ড দলের সদস্যরা দর্শকদের আতশবাজি জ্বালাতে উৎসাহ দেয়। তাই ব্যান্ডের ম্যানেজার ও ৬ শিল্পীকে প্রথমে ১১ বছর এবং পরে তা কমিয়ে ৭ বছর কারাদন্ড দেওয়া হয়। এ ছাড়াও নানা মেয়াদে কারাবরণ করেন আরও ৫ জন।

 

বিনোদনের স্বর্গভূমিতে প্রাণ হারায় ২০ জন-ব্যাংকক

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই পৃথিবীর মানুষের কাছে বিনোদনের অন্যতম আকর্ষণ হয়ে ওঠে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংকক। বিশেষত প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে যারা পানীয় (মদ) এবং সঙ্গিনীর সঙ্গ প্রত্যাশা করেন, তাদের অবশ্যম্ভাবী গন্তব্য ব্যাংকক। বিনোদন পিপাসুদের আকৃষ্ট করতে ব্যাংককে গড়ে উঠেছে অসংখ্য পানশালা (বার), নাইট ক্লাব, ক্যাসিনো এবং রেস্তোরাঁ। এর অনেকগুলোর মূল আকর্ষণ খোলামেলা পোশাকে কর্মী, এজেন্ট এবং নৃত্যশিল্পীদের উপস্থিতি। একটি কথা প্রচলিত আছে, ব্যাংককে কখনো রাত হয় না। কারণ সারা রাতই আনন্দ-বিনোদনে মেতে থাকে ব্যাংকক। আর এই আনন্দের মাত্রা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায় ইংরেজি নববর্ষকে কেন্দ্র করে। তবে ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি নববর্ষের রাতটি ছিল ব্যতিক্রম। এ দিন ব্যাংককের ওয়াথানা এলাকায় সানটিকা ক্লাবে সংঘটিত অগ্নিকা-  স্তব্ধ করে দেয় সমগ্র ব্যাংককের আনন্দ আয়োজন।

সেই রাতে পুরনো বছরকে বিদায় আর নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে সানটিকা ক্লাবে জড় হয়েছিল ১৩টি দেশের প্রায় ১ হাজার মানুষ। মধ্য রাতে কাউন্ট ডাউনের সঙ্গে সঙ্গে ক্লাবের বাইরে শুরু হয় আতশবাজির বিস্ফোরণ। ক্লাবের ভিতরেও হাতে ধরে তারাবাতির মতো আতশবাজি জ্বালিয়েছিলেন কেউ কেউ। কারও মতে, বাইরের আতশবাজির আগুনের ফুলকি ছাদে পড়ায় প্রথমে ক্লাবের চালে আগুন লাগে। আবার কারও মতে, ক্লাবের ভিতরে জ্বালানো তারাবাতির মতো আতশবাজি থেকেই ডেকোরেশনের জন্য ব্যবহৃত মরিচ বাতির তারে আগুনের সূত্রপাত ঘটে এবং ক্রমেই তা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ক্লাবে থাকা কাগজের ডেকোরেশন সামগ্রী আলোকসজ্জার তার, আতশবাজির বারুদ, প্লাস্টিক সামগ্রী, ছাদ ও ফলস সিলিংয়ের জন্য ব্যবহৃত দাহ্য সামগ্রী প্রভৃতির কারণে আগুনের তীব্রতা এবং ধোঁয়া বৃদ্ধি পায়, ফলে আগুনে পুড়ে এবং ধোঁয়ার দম বন্ধ হয়ে মারা যান ৬৬ জন আর আহত হন ২২২ জন। আহতদের ১৯টি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। নিহতদের মধ্যে ২৮ জন থাই এবং একজন সিঙ্গাপুরের নাগরিকের মৃতদেহ শনাক্ত করা সম্ভব হয়। বাকিদের পোড়া চেহারা বা শরীর দেখে তাদের চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি।

পরবর্তীতে তদন্তে জানা যায়, মূলত রেস্তোরাঁর অনুমতি নিয়ে অবৈধভাবে গড়ে ওঠে এই সানটিকা ক্লাব, রেস্তোরাঁ হিসেবে মধ্য রাতের আগেই তা বন্ধ করার কথা ছিল। ক্লাব কর্তৃপক্ষ তা না করে বরং অপ্রাপ্ত বয়স্কদেরও ক্লাবে ঢুকতে দেয় এবং তারাবাতি জ্বালানোর অনুমতি দেয়। ক্লাবে আগুন নিভানোর সামগ্রী ছিল মাত্র একটি। আর ডাকাতির ভয়ে বেশ কিছু দরজা বন্ধ করা ছিল। বিচার শেষে ক্লাবের মালিক এবং আলো ও সাউন্ড সিস্টেম সরবরাহকারীর জেল ও জরিমানা হয়। এই ঘটনার পর সানটিকা ক্লাব বন্ধ হয়ে যায়। কাকতালীয় হলেও সত্য যে, সেই রাতের অনুষ্ঠানের নাম ছিল সান্টিকা’জ লাস্ট নাইট (সান্টিকার শেষ রাত) আর যে ব্যান্ড দল এই রাতে সান্টিকায় গান পরিবেশন করছিল, তাদের নাম ছিল বার্ন বা পোড়া।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর