রবিবার, ১২ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা
এমন আগুন কখনো দেখেনি কেউ

অস্ট্রেলিয়ায় বুনো দাবানল

সাইফ ইমন

অস্ট্রেলিয়ায় বুনো দাবানল

ভয়াবহ দাবানলে জ্বলছে অস্ট্রেলিয়া। মাইলের পর মাইল বন পুড়ে শেষ। কয়েক মাসে এতে ধ্বংস হয়েছে ২ হাজার বাড়িঘর। শুধু তাই নয়, এই কয় মাসে মারা গেছে কমপক্ষে ৫০ লাখ পশু-পাখি; যা কয়েক দশকেও পূরণ হওয়ার নয়। অবস্থা দিন দিন ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। এর পর কিছুটা বৃষ্টি হওয়ায় অগ্নিনির্বাপণকারীরা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে দেখানো হচ্ছে, বনের পাশে থরে থরে পড়ে আছে আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া পশুর মৃতদেহ। আহত প্রাণীরা মানুষের পা জড়িয়ে ধরছে বন থেকে বেরিয়ে।  আমাজন জঙ্গলের অগ্নিকান্ডের চেয়ে ভয়াবহ এ দাবানল...

 

১৩৫ স্থানে জ্বলছে আগুন

বনে নিজেদের আবাস আর সঙ্গী হারিয়ে দিশাহারা বন্যপ্রাণীগুলো; রয়েছে বিরল প্রজাতির নানা পশুপাখি

ভয়ঙ্কর আগুনে পুড়ছে অস্ট্রেলিয়া। মাইলের পর মাইল বন পুড়ে শেষ। কয়েক মাসে এতে ধ্বংস হয়েছে ২ হাজার বাড়িঘর। মারা গেছে কমপক্ষে ৫০ লাখ পশু-পাখি। বনের পাশে থরে থরে পড়ে আছে আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া পশুদের মৃতদেহ। অনেক স্থানে বন থেকে বেরিয়ে নিরীহ প্রাণীরা বাঁচার জন্য মানুষের পা জড়িয়ে ধরছে। অনেকে বলছেন, আমাজন জঙ্গলে যে অগ্নিকান্ড হয়েছিল, তার চেয়েও ভয়াবহ এ দাবানল। এদিকে তাপমাত্রা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আরও তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। এতে আবার আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। দুটি দাবানল নতুন করে এক ‘মহা’ অগ্নিকুন্ডে রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ১২০টি জায়গায় আগুন জ্বলছে। দেশটির মানুষের দাবি, তারা মহাদুর্যোগে পড়েছে।অস্ট্রেলিয়া বিবর্ণ আকার ধারণ করেছে আগুনে পুড়ে। এ যেন ধ্বংসের এক মহাযজ্ঞ। আগুনের লেলিহান শিখা একের পর এক এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে। বনের গাছ থেকে শুরু করে বসতবাড়ি কিছুই রক্ষা পাচ্ছে না দাবানলের ভয়ঙ্কর থাবা থেকে। নিউ সাউথ ওয়েলস এবং কুইন্সল্যান্ডের দুর্গত এলাকার বাসিন্দারা চরম আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। দাবানলের গ্রাস থেকে বাঁচতে চরম অনিশ্চয়তা নিয়ে অনেকেই ছাড়ছেন এলাকা। বন্ধ রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। নিউ সাউথ ওয়েলস এবং কুইন্সল্যান্ডে দুই প্রদেশের অন্তত ১৩৫টি স্থানে এখনো আগুন জ্বলছে। এর মধ্যেই পুরো সাউথ ওয়েলসে জারি করা হয়েছে জরুরি অবস্থা। এদিকে দেশটির কর্তৃপক্ষ সতর্ক করে বলেছে, যে কোনো সময় দেশটির আরও জায়গায়ও দাবানল ছড়িয়ে পড়তে পারে। কেবল মানুষ নয়, দাবানলের গ্রাসের শিকার হচ্ছে বিলুপ্তপ্রায় এসব বিরল প্রজাতির অনেক বন্যপ্রাণী। বনে নিজেদের আবাস আর সঙ্গী হারিয়ে দিশাহারা তারা। এদিকে জানুয়ারি মাস থেকে শুরু হয়েছে তীব্র বাতাস। যা থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়ছে আরও দ্রুত। গত সপ্তাহ থেকে পশ্চিমাঞ্চলে ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার বেগে বাতাস বয়ে যেতে শুরু করলে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। অস্ট্রেলিয়ার আবহাওয়া অধিদফতর বলছে, এই বাতাসের প্রবাহ অব্যাহত থাকবে এবং পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে উঠতে পারে। এক সংবাদ সম্মেলনে অস্ট্রেলিয়ার পশ্চিমাঞ্চলীয় অগ্নিনির্বাপক সংস্থার কমিশনার ওয়েনে গ্রেগসন বলেছেন, ইয়ারলুপ শহরে দাবানলের অবস্থা গুরুতর। এখানে আগুন মোকাবিলা সত্যিই কঠিন। দায়িত্ব পালনের সময় অগ্নিনির্বাপক কর্মীরা আহত হচ্ছেন। এ ছাড়া সংস্থার একটি ট্রাকও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার প্রায় ৫৮ হাজার হেক্টর এলাকাজুড়ে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। দাবানল নিয়ন্ত্রণে বিমান, হেলিকপ্টার, পানিবাহী গাড়ি ব্যবহারের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থাই প্রয়োগ করছেন তারা।

 

পাঁচ মাস  ধরে জ্বলছে

দীর্ঘ পাঁচ মাস ধরে জ্বলছে অস্ট্রেলিয়ার আগুন। ভয়াবহ এ দাবানলে অস্ট্রেলিয়ার শত শত বাড়ি ভস্মীভূত হয়েছে। পার্থের দক্ষিণে ইয়ারলুপ শহরে অনেকে নিখোঁজ রয়েছেন বলেও জানা গেছে।  এদিকে তীব্র ঝড়ে পিঞ্জারা শহরের একটি পুনর্বাসন  কেন্দ্রও আক্রান্ত হয়েছে। এমন ভয়াবহ আগুন কখনো কেউ দেখেনি অস্ট্রেলিয়ায়। বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে দেশের মানুষ আর অবলা বণ্যপ্রাণী। সেখানকার বিদ্যুৎ ব্যবস্থাও ধসে পড়েছে। এখনো আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি।

 

 

 

ইচ্ছাকৃত

প্রায় পাঁচ মাস ধরে জ্বলছে অস্ট্রেলিয়ার একপ্রান্ত। আগুন ও তাপপ্রবাহে অস্ট্রেলিয়া এখন জাতীয় সংকটের মুখোমুখি। এরই মধ্যে ২৪ জনের বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃতভাবে দাবানল ছড়ানোর অভিযোগ এনেছে পুলিশ। নিউ সাউথ ওয়েলস পুলিশ জানিয়েছে, বিধ্বংসী দাবানলের জেরে পুড়ে ছাই হয় এই এলাকার বিস্তীর্ণ জায়গা। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ভিক্টোরিয়া ও নিউ সাউথ ওয়েলস। তাপপ্রবাহ আর অনিয়ন্ত্রিত দাবানলের মধ্যেই ইচ্ছাকৃতভাবে আগুন ছড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে। গত সোমবার ২৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। এ ঘটনায় ১৮৩ জনের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে ৪০ জন নাবালক। স্টেটমেন্টে লেখা হয়েছে, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অপরাধজনিত চার্জ নেওয়া হয়েছে। চলতি মৌসুমের দাবানলের জেরে পুরো অস্ট্রেলিয়ায় ইতিমধ্যেই ২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় নিউ সাউথ ওয়েলস প্রদেশের প্রত্যন্ত এলাকা থেকেও আরও দুজন নিখোঁজ রয়েছে। সোমবার ওই প্রদেশের কিছু অংশে প্রবল বর্ষণের খবর মিললেও মেলবোর্ন ও সিডনির মতো শহরে যে বৃষ্টি হয়েছে তার সঙ্গে মিশে ছিল ধোঁয়া। তার ওপর আগামী বৃহস্পতিবার থেকে তাপমাত্রা বাড়তে পারে বলে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে জানানো হয়েছে। সোমবার তাই এনএসডব্লিউ প্রদেশের প্রিমিয়ার গ্ল্যাডিস বেরেজিক্লিয়ান জানান, ‘গাছাড়া মনোভাবের কোনো জায়গা নেই। কারণ এখনো ১৩৫টির মতো দাবানল জ্বলছে। যার মধ্যে প্রায় ৭০টি অনিয়ন্ত্রিত। প্রাণ গেছে অগণিত বন্যপ্রাণীর। অস্ট্রেলিয়ায় তীব্র থেকে তীব্রতর হওয়া এই দাবানল নিয়ে আতঙ্কে রয়েছে সবাই। এদিকে বাতাসের গতি অনেক বেশি থাকায় পূর্ব উপকূলীয় রাজ্যগুলোয় জারি রয়েছে সতর্কতা। নিউ সাউথ ওয়েলস ও ভিক্টোরিয়ায় নতুন করে আগুন ছড়িয়েছে কয়েকটি এলাকায়। কেবল নিউ সাউথ ওয়েলসেই শতাধিক স্থানে জ্বলছে আগুন। উদ্ধারে কাজ করছে নিরাপত্তা বাহিনী। প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন জানিয়েছেন, নিউ সাউথ ওয়েলস উপকূলে প্রস্তুত আছে দুটি উদ্ধারকারী জাহাজ। বেশিরভাগ শহরেই তাপমাত্রা পৌঁছেছে ৪০ ডিগ্রির ওপরে। দাবানল নিয়ন্ত্রণে সহায়তায় যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা থেকে বিশেষ দল পৌঁছেছে।

 

ধোঁয়াময় নগরী ক্যানবেরা

অস্ট্রেলিয়ায় দাবানলের তা-ব চলছেই যা ছড়িয়ে পড়তে পারে আরও অনেক জায়গায়। দাউ দাউ করে জ্বলছে চারদিক। নিউ সাউথ ওয়েলস এবং ভিক্টোরিয়াজুড়ে নিখোঁজ রয়েছে অন্তত ১৭ জন। রাজ্যটিতে সপ্তাহব্যাপী জরুরি অবস্থা চলছে। আকাশ হয়ে উঠছে যেন রক্তরাঙা। একদিকে পরিস্থিতি সামাল দিতে দিতেই পুড়ছে আরেক দিক। সেই ভয়াবহতা এখন গ্রাস করছে রাজধানী ক্যানবেরা। ধোঁয়ার কারণে বায়ুদূষণের মাত্রা চরম অবস্থায় পৌঁছেছে। এখন বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ পর্যায়ে পৌঁছেছে এই নগরী। কেবল বাইরেই নয় বাড়ি, অফিস, শপিংমল সব জায়গাতেই একই পরিস্থিতি। অসুস্থরা এ বায়ুদূষণে আরও ক্ষতির মুখে রয়েছে এবং এ অবস্থা কতদিন বিরাজ করবে তাও কারও জানা নেই। ধোঁয়ার কারণে ব্যাহত হচ্ছে দাবানলে আটকাপড়া মানুষদের উদ্ধারকাজও। গত পরশু ও গতকাল ভিক্টোরিয়া এবং নিউ সাউথ ওয়েলসে একটু করে বৃষ্টি হচ্ছে। ফলে তাপমাত্রা ও বাতাসের গতি কিছুটা কমে গেছে। তবে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও কর্তৃপক্ষ সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, বিপদ সহসাই কাটবে না।

 

হাজার হাজার মানুষ পালিয়ে যাচ্ছে

অস্ট্রেলিয়ায় বুনো আগুনের কারণে ভিক্টোরিয়া রাজ্য থেকে হাজার হাজার বাসিন্দা ও ছুটি কাটাতে আসা মানুষজনকে রাজ্য ছাড়ার নির্দেশ দেয় কর্তৃপক্ষ। অন্যান্য জায়গার স্থানীয়দেরও দ্রুত সরে যাওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে প্রশাসন। সেখানে তাপমাত্রা এখন ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেছে। এ বছর আগুনে সেখানকার মোট ৯১৬টি বাড়ি ধ্বংস হয়েছে। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আরও অন্তত ৩৬৩টি বাড়ি। নিউ সাউথ ওয়েলসের প্রধানমন্ত্রী গ্লাডিস বেরেজিকলিয়ান বলেছেন, আবহাওয়া সহনীয় হয়ে এলে সড়ক পরিষ্কার ও বিদ্যুৎ পুনরায় চালুর চেষ্টা করবেন কর্মীরা। বিবিসি অনলাইনের তথ্য মতে, এখন সবচেয়ে বড় বুনো আগুনটি জ্বলছে নিউ সাউথ ওয়েলসের সিডনি শহরের কাছাকাছি। সেখানে প্রায় আড়াই লাখ মানুষ একটি পিটিশনে স্বাক্ষর করেছিলেন যেন নতুন বছরের আগের রাতে আতশবাজি অনুষ্ঠান বাতিল করা হয় এবং এর খরচ আগুনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ব্যয় করা হয়। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরেই রয়েছে। ইস্ট গিপসল্যান্ডে ব্রুথেন, বুচান আর বোনাং শহরের কাছে তিনটি বুনো আগুন জ্বলছে, যা আরও বেড়ে যাওয়ার পূর্বাভাস রয়েছে। কর্মকর্তারা বলছেন, আগুনগুলো উপকূলের দিকে চলে যেতে পারে এবং উপকূল এলাকা থেকে অঞ্চলটিকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পারে। মি. ক্রিস, ভিক্টোরিয়া রাজ্যের জরুরি ব্যবস্থাপনা কমিশনার বলেছেন, মেলবোর্নের পূর্ব দিকে, ইস্ট বায়র্নসডেল এলাকার আশপাশের প্রায় ২৮০ কিলোমিটার এলাকায় থাকা প্রত্যেকের সরে যাওয়া উচিত।

সর্বশেষ খবর