বুধবার, ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

কম সময়ে নির্মাণ বিস্ময়

তানভীর আহমেদ

কম সময়ে নির্মাণ বিস্ময়

অবিশ্বাস্য নির্মাণ দক্ষতায় চীনের তুলনা হয় না। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় চীন দুটি হাসপাতাল বানিয়ে ফেলে। একটির কাজ শেষ হয় দুই দিনে, অন্যটি দশ দিন। অত্যাধুনিক এই হাসপাতালে শুরু হয়েছে রোগীর চিকিৎসা।

৪৮ ঘণ্টায় নির্মাণ, ১০ দিনে প্রস্তুত

চীনের সেই হাসপাতালে চলছে চিকিৎসা

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের জন্য দুটি হাসপাতাল নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিল চীন। এর মধ্যে একটি হাসপাতাল দুই দিনে বানিয়ে ফেলে চীন। অন্যটি তৈরি হয় ১০ দিনে। চীনের অবিশ্বাস্য নির্মাণ দক্ষতার কথা অজানা নয় কারও। কিন্তু এবার চীন যা করে দেখাল তা পুরো বিশ্বের কাছে অনুকরণীয় হয়ে রইল। মধ্য চীনে তৈরি একটি এক হাজার শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল এরই মধ্যে উদ্বোধনও করা হয়েছে। সেখানে ভর্তি হয়েছে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী। মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় নির্মিত হাসপাতালটি করোনাভাইরাসের উৎপত্তিস্থল উহান শহর থেকে ৪৬ মাইল দূরে অবস্থিত। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে চীনের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসা বিশাল একদল প্রকৌশলী এই হাসপাতালটি নির্মাণ করেন। হাসপাতালটিতে পানি, বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট এবং বিছানার ব্যবস্থা করে আরেকটি হাসপাতালের কাজ শেষ হয় ছয় দিনে। সেটি উদ্বোধন করা হয় ১০ দিনের মাথায়। হুশেনশান হাসপাতালটির আয়তন ২৫ হাজার বর্গমিটার। এক হাজার রোগী একসঙ্গে এখানে চিকিৎসা নিতে পারবেন। উহান শহরে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকলে গত ২৪ জানুয়ারি এই হাসপাতালটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। পুরো বিশ্ব চীনের এই নির্মাণ দক্ষতা দেখার জন্য মুখিয়ে ছিল। চীনের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন সরাসরি নির্মাণ প্রক্রিয়া দেখার সুযোগ তৈরি করে দেয়। টেলিভিশনে হাসপাতাল নির্মাণের এই দৃশ্য দেখেছে প্রায় চার কোটি মানুষ। লাইভ সম্প্রচারে দেখা যায়, নির্মাণসামগ্রী আর বড় বড় ক্রেন দিয়ে কীভাবে শত শত প্রকৌশলী একটানা কাজ করে গেছেন। এক সেকেন্ডও কাজ বন্ধ থাকেনি। শিফট বদল করে প্রকৌশলীরা কাজ করলেও নির্মাণ যন্ত্র কখনো ঘুমায়নি। টেলিভিশনে লাইভ সম্প্রচারে নির্মাণে ব্যবহৃত ক্রেন, বুলডোজার ও ডিগারের মতো যন্ত্র রীতিমতো তারকাখ্যাতি পেয়েছে। স্থানীয়রা চীনের সিমেন্ট মেশানোর একেকটি মেশিনের নাম দিয়েছে- দ্য সিমেন্ট কিং, বিগ হোয়াইট র‌্যাবিট এবং দ্য হোয়াইট রোলার। শহরে কর্মরত স্বাস্থ্যকর্মীদের সহায়তা করতে এবং শহর থেকে দূরে অবস্থিত নতুন হাসপাতালে কাজ করার জন্য উহানে এসেছে চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির চিকিৎসক দলগুলো। অত্যাধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম দ্বারা সাজানো হয়েছে নবনির্মিত হাসপাতালটি। এই হাসপাতালে নতুন করোনাভাইরাস আক্রান্তদের চিকিৎসা দেওয়া হবে। চীনের সশস্ত্র বাহিনীর এক হাজার ৪০০ মেডিকেল কর্মী হাসপাতালটিতে কাজ করবে।

 

১৯ দিনে ৫৭ তলা দালান বানানো শেষ

চীনের মিনি স্কাই সিটি। ১৯ দিনে ৫৭ তলা এই দালানটি বানিয়ে সবাইকে বিস্মিত করেন চীনের প্রকৌশলীরা। অতি দ্রুত তৈরিÑ এমন তিনটি দালান বানানো নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ব্রড গ্রুপ। চীনের হুনান প্রদেশের রাজধানী চ্যাংশায় এই অ্যাপার্টমেন্ট ভবনটি নির্মাণ করে। ভবনটির ৯৫ শতাংশই পূর্বে তৈরিকৃত উপাদান দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে।

৫৭ তলা ভবনটির উচ্চতা ২০০ মিটার। নির্মাণ এরিয়া ১ লাখ ৮০ হাজার বর্গমিটার। ভবনটিতে রয়েছে ৮০০ আবাসিক অ্যাপার্টমেন্ট। এখানে থাকতে পারবে ৪ হাজার লোক। এ ছাড়া রয়েছে ৩ দশমিক ৬ কিলোমিটার পায়ে হাঁটার পথ। আয়তাকার দালানটি তৈরি হয়েছে মূলত কাচ ও স্টিল দিয়ে। প্রতিদিন তিনতলা করে দালানটি নির্মাণ করা হয়। প্রথাগত নিয়মে ইটের ওপর ইট গেঁথে বহুতল তৈরি হয়। কিন্তু এমন প্রযুক্তিতে এই অট্টালিকা তৈরি হয় যাতে একটি ব্লকের সঙ্গে আরেকটি ব্লক জুড়ে দেওয়া হয়। এই পদ্ধতিতে কারখানায় নির্মাণ করা হাজারো স্টিল মডিউল জোড়া লাগিয়ে ছোট একটি আকাশছোঁয়া নগরী কয়েক দিনেই নির্মাণ করা সম্ভব। ছোট শিশুদের মেশানো খেলনার মতো কারখানায় তৈরি করা ব্লুক জোড়া লাগিয়ে ভবনটি তৈরি করা হয়। ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রে এই প্রথা বেশ জনপ্রিয়। প্রথমে বিল্ডিংটির ডিজাইন করা হয়েছিল ৯৭ তলার জন্য এবং ২০১৪ সালের গোড়ার দিকে এর কাজ শুরুও হয়েছিল এবং মাত্র সাত দিনে ২০ তলার নির্মাণ কাজ সম্পন্নও করা হয়েছিল। কিন্তু নিকটবর্তী এলাকায় বিমানবন্দর থাকায় বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মিনি স্কাই সিটির আকাশছোঁয়ার লক্ষ্যমাত্রা ৯৭ তলা থেকে কমিয়ে ৫৭ তলা স্থির করা হয়।

সনাতন পদ্ধতিতে কাজ করলে ৫৭ তলার এই ভবনটি তৈরি করতে সময় লাগত অন্তত দুই বছর। ভবনটি ৯ মাত্রার ভূমিকম্পেও টিকে থাকতে সক্ষম। মিনি স্কাই সিটি ভবনটির ‘স্কাই স্ট্রিটের’ আদলে নির্মিত,  যেখানে প্রতিটি তলা উল্লম্বভাবে যুক্ত। নির্মাণের অভিনবত্বের জন্য এ দালানের চারপাশের বাতাস হবে বিশুদ্ধ। এতে ব্যবহৃত কাচ শক্তি সংরক্ষণে সহায়ক এবং অন্য ভবনের তুলনায় এখানে কার্বন-ডাই অক্সাইড নিঃসরণ ১২ হাজার টন কম হবে।

 

সেতু তৈরিতে সেরা

চীন সমুদ্রের ওপর ৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এক সেতু বানিয়ে পুরো দুনিয়ায় তোলপাড় ফেলে দিয়েছিল। সেই সেতু চীনের প্রধান শহরকে ম্যাকাও আর হংকংয়ের সঙ্গে জুড়ে দেয়। সেতুটি বানাতে নয় বছর লাগলেও এমন সেতু পৃথিবীর মানুষ দ্বিতীয়টি দেখেনি। নদীর ওপর ব্রিজ বা সেতু বানানোর বহু ক্যারিশমা চীনের দখলে থাকলেও মাত্র দুই মাসে সমুদ্রতীরে অবিশ্বাস্য এক সেতু বানিয়ে বিশ্ববাসীকে চমকে দিয়েছিল জাপান। তবে এ নিয়ে যতটা না আলোচনা হয়েছিল তা পেছনে পড়ে যায় সেতুটি এক দিন ভূমিধসে ক্ষতিগ্রস্ত হলে।

পাহাড় থেকে মাটি ধসে পড়ে সেতুটি মাঝ বরাবর ভেঙে যায়। সেদিন জাপানের সংবাদমাধ্যম ছাড়াও আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় সেই ভাঙা সেতুর ছবি আর খবর প্রকাশ পায়। তবে চার মাসের ব্যবধানে শুধু ভাঙা অংশটুকুর বিকল্প বানিয়ে ফেলেন জাপানের প্রকৌশলীরা। অনেকে পুরো সেতু এক দিনে বানানোর কথা বললেও, সেটি আসলে সত্যি নয়।

 

সাত দিনেই রাস্তা ঠিক জাপানে

জাপানের ব্যস্ত শহর ফুকোওকার প্রধান সড়ক। রাস্তা থেকে একটু দূরে রেলস্টেশন। তাই মানুষের আনাগোনা বেশি। ব্যস্ত শহরে হঠাৎ বিকট শব্দ। বোমা ফাটা অথবা দালান ধসে পড়ার মতো শব্দ। রাস্তার নিচের মাটি সরে যাওয়ায় বিশাল এক গর্ত সৃষ্টি হলো। মুহূর্তেই রাস্তা বন্ধ হয়ে গেল। হাজার হাজার গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। মানুষের দুর্ভোগ বিবেচনা করে নগর কর্তৃপক্ষ দ্রুত রাস্তাটি সংস্কারের ঘোষণা দেয়। সেই ঘোষণা কথার কথা নয়। মাত্র দুই দিনে রাস্তাটির আশি শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়। ৪৮ ঘণ্টা পর রাস্তার গর্তটি মাটি, পাথর দিয়ে ভরাট করে ফেলেন প্রকৌশলীরা। তারপর কংক্রিটের ঢালাই দিয়ে রাস্তাটি পুরো আগের চেহারায় ফিরিয়ে আনা হয়। রাস্তাটি ভেঙে যাওয়ার পর বিদ্যুৎ, গ্যাস, টেলিফোন ও পানি সরবরাহ বিচ্ছিন্ন হলেও দুই দিনে সব ঠিক হয়ে যায়। রাস্তায় গাড়ি চলতে শুরু করে সাত দিন পর।

সাত দিন আগের ছবি ও সাত দিন পরের ছবি জুড়ে দিয়ে একটি খবর প্রকাশ করে দ্য গার্ডিয়ান। তারা রাস্তাটির এই ধসে যাওয়া চিত্র দিয়ে খবর দিয়েছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় ‘সিঙ্কহোল’। কিন্তু সেটি এখন অদৃশ্য! না, আসলে সেটি অদৃশ্য নয়। জাপান রাস্তাটি এমনভাবে ঠিক করে যে, রাস্তা সংস্কারের এক বিন্দু ছাপ চোখে পড়েনি কারও। ওই গর্তটি ছিল ৩০ মিটার বাই ২৭ মিটার। গভীর ছিল ১৫ মিটার। রাস্তাটি ভেঙে পড়ায়, রাস্তার নিচে থাকা সব ধরনের গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ, টেলিফোন-ইন্টারনেটের তার কেটে যায়। এসব ঠিক করতে এক দিন বেশি লেগে যায় বলে জানায় স্থানীয় সংবাদমাধ্যম। বালু-সিমেন্ট দিয়ে গর্তটি ভরাট করেন প্রকৌশলীরা। শতাধিক প্রকৌশলী ও নির্মাণ কর্মী একটানা ছয় দিন কাজ করে রাস্তাটি সাত দিনের মাথায় মানুষের জন্য খুলে দেয়। জাপানের নির্মাণ বিশেষজ্ঞদের একটি দল এই অবিশ্বাস্য সংস্কার ছয় দিনে করলেও সাধারণত এক মাসেও এমন গর্ত ঠিক করার উদাহরণ নেই বিশ্বের কোথাও।

 

তিন বছরে নিউইয়র্কের চেয়েও তিনগুণ বড় শহর বানায় চীন

জনসংখ্যার চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে চীন। দ্রুত শহর বানানোর টার্গেট নিয়ে মাস্টারপ্ল্যান করে তারা। মাত্র দশ বছরের ব্যবধানে একের পর এক শহর বানিয়ে তারা সবাইকে বিস্মিত করে। সেই মাস্টারপ্ল্যানে ছিল শিওনগান। বেইজিংয়ের দক্ষিণে মাত্র ৬২ কিলোমিটার দূরে এই শহরটি তৈরি করতে চীনের সময় লাগে মাত্র ৩ বছর। আগে পরিকল্পনা থাকলেও ২০১৪ সালে সেটি গোপনীয়তার সঙ্গে বাস্তবায়ন শুরু হয়।

মিডিয়ায় এ নিয়ে বড় খবর প্রকাশ না পেলেও ২০১৭ সালে এই শহরের চিত্র বিশ্ববাসীর সামনে আসে। বিশ্বাস করা কঠিন হলেও, সত্যিটা হলো এই অল্প সময়ের ব্যবধানের নিউইয়র্কের চেয়ে প্রায় তিনগুণ বড় এই শহর বানিয়ে ফেলে চীন। পুরো মাস্টারপ্ল্যান এখনো বাস্তবায়ন না হলেও আগামী চীনের ব্যবসায়িক কেন্দ্র হতে যাচ্ছে এই শহর। শিওনগানের নতুন এলাকা হিসেবে এর নামকরণ করা হয়েছে। এরই মধ্যে নতুন শহরটিকে আরও জাঁকজমকপূর্ণ করে তুলতে বিনিয়োগকারীরা উঠেপড়ে লেগেছেন। নতুন শহর তৈরি এমন অবিশ্বাস্য উদাহরণ চীনের অনেক রয়েছে। মাত্র কয়েক মাসের হিসাব থেকে শুরু করে বছর না ঘুরতেই গোটা শহর বানিয়ে ফেলেছে চীন।

বছরে আটটি করে বিমানবন্দর বানানোর দৃষ্টান্তও চীনের হাতে। দ্রুত গতিতে গ্রাম পাল্টে শহর তৈরির এমন উদাহরণ বিশ্বের অন্য কোথাও নেই। চীন নতুন নতুন শহর গড়ে তোলায় শুধু গ্রাম বা দূরের এলাকা বেছে নেয় এমনটি নয়, পুরনো শহর পুরোটা ভেঙে নতুন করে গড়ে তুলেছে এক বছরের ব্যবধানে এমন দৃষ্টান্তও চীনের কাছেই আছে।

 

১৫ দিনে প্রস্তুত ৩০ তলা হোটেল

চীনের আকাশছোঁয়া দালান তৈরির একটি প্রতিষ্ঠান ব্রড গ্রুপ। ১৫ দিনে ৩০ তলা হোটেল বানিয়ে তারা সবার নজর কাড়ে। প্রতিষ্ঠানটি দাবি করেছে, তাদের প্রযুক্তি মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বিস্ময়কর আবিষ্কার। ১ লাখ ৮৩ হাজার বর্গফুটের এই দালান এতটাই মজবুত যে, ৯ মাত্রার ভূমিকম্প এটি সইতে পারবে। ব্রড গ্রুপের প্রকৌশলী ও নির্মাণ কর্মীরা দালানটি বানানোর শুরুতেই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, তারা দ্রুত ও মানসম্পন্ন একটি দালান বানিয়ে সবার জন্য উদাহরণ তৈরি করবেন। হোটেলটি রয়েছে চীনের হুনান প্রদেশে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর