রবিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

সাগরে হারিয়ে যাওয়া জাহাজ

সাইফ ইমন

সাগরে হারিয়ে যাওয়া জাহাজ

বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের রহস্যময় সব অন্তর্ধানের কারণ নিয়ে অনেক তত্ত্ব দাঁড় করানো হয়েছে। কেউ বলেছেন, ওখানকার সমুদ্রে বা আকাশে আস্ত একটা ফাটল আছে। প্রকৃতির সেই রহস্যময় ফাটলে পড়ে বিমান বা জাহাজ হারিয়ে যায় চিরকালের মতো। কেউ বলেন, অজানা এক সভ্যতার কথা, যেখানে আগুনের গোলা লাফিয়ে ওঠে। তবে সত্য ঘটনা যাই ঘটুক, শুধু বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল নয়, পৃথিবীর নানা জায়গায় ঘটেছে জাহাজ হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা। প্রায় তিন মিলিয়ন জাহাজ সাগরে নানা সময়ে হারিয়ে গেছে বা ডুবে গেছে। সমুদ্রের ঢেউয়ে নয় বরং রহস্যজনকভাবে হারিয়ে যাওয়া বা ডুবে যাওয়া এ রকম কিছু জাহাজ নিয়ে আজকের রকমারি...

 

ইন দ্য হার্ট অব দ্য সি

এসেক্স

টাইটানিক বিপর্যয়ের প্রায় ১০০ বছর আগে প্রশান্ত মহাসাগরের দক্ষিণাংশে রহস্যজনকভাবে ডুবে গিয়েছিল ‘এসেক্স’ নামের একটি জাহাজ। হলিউডে এ নিয়ে একটি চলচ্চিত্রও রয়েছে। রন হাওয়ার্ড পরিচালিত চলচ্চিত্রটির নাম ‘ইন দ্য হার্ট অব দ্য সি’। অনেকেই হয়তো চলচ্চিত্রটি দেখে থাকবেন। মূল কাহিনি এসেক্সের অন্তর্ধান নিয়ে। জাহাজটি কেন ডুবেছিল তা নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনা হয়েছিল ১৮২০ সালের দিকে। তারপর সেই কাহিনি একদিন লোকমুখে ঘুরতে ঘুরতে হারিয়ে যায়। এ ঘটনা নিয়ে একটি উপন্যাসও রয়েছে। মার্কিন ঔপন্যাসিক হারম্যান মেলভিলের ‘মবি ডিক’ উপন্যাসের উপজীব্য বিষয় ছিল এটি। এসেক্স ছিল তিমি শিকারের জাহাজ। তিমি শিকারিদের জগতে ‘লাকি’ বলে সুনামও ছিল জাহাজটির। শেষ যাত্রায় জাহাজটির ক্যাপ্টেন ছিলেন জর্জ পোলার্ড। তার সুনাম ছিল অনেক। পুরো ঘটনার সাক্ষী ছিল ১৪ বছরের এক কেবিন বয়। তার নাম টমাস নিকারসন। ম্যাসাচুসেটসের নানটাকেট বন্দর থেকে ১৮১৯ সালের ১২ আগস্ট এসেক্স শেষ যাত্রা শুরু করে। দক্ষিণ আমেরিকার তিমি অধ্যুষিত সমুদ্রে গিয়ে তিমি শিকার ও তিমির তেল সংগ্রহ ছিল এর উদ্দেশ্য। ১৮২০-এর জানুয়ারিতে এসেক্স কেপ হর্নে পৌঁছে। হঠাৎ জাহাজিদের মধ্যে অশুভ চিহ্ন দেখার গুজব রটে। যা আজও রহস্যাবৃত।

 

মাঝ সাগরে মনুষ্যবিহীন জাহাজ

মেরি সেলেস্ট

জাহাজ নিয়ে যত রহস্যময় ঘটনা আছে তার মধ্যে ‘মেরি সেলেস্ট’ জাহাজ অনতম। কী হয়েছিল ওই জাহাজের, যা আজও পৃথিবীতে অন্যতম রহস্যময় ঘটনা হিসেবে উল্লেখযোগ্য। ওই জাহাজটির প্রথম নাম ছিল ‘আমাজন’। ১৮৬০ সালের শেষ দিকে নোভা স্কোশিয়ার ‘বে অব ফান্দি’র পাড়ে স্পেন্সার দ্বীপে জাহাজটি তৈরি হয়। পরবর্তীকালে জাহাজটি মার্কিন এক বণিকের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। তখন এর নতুন নাম রাখা হয় ‘মেরি সেলেস্ট’। ১৮৭২ সালের ৭ নভেম্বর ক্যাপ্টেন বেঞ্জামিন ব্রিগস তার স্ত্রী, সন্তান এবং সাতজন নাবিককে নিয়ে নিউইয়র্ক থেকে জিনোয়ার উদ্দেশে যাত্রা করেন। মাঝপথে প্রবল ঝড় এবং ভয়ঙ্কর ঢেউয়ের মুখোমুখি হতে হয় মেরিকে। এত বিপদে পড়েও কোনোরকম ক্ষতি হয়নি মেরির। ১৮৭২ সালের ৫ ডিসেম্বর পর্তুগালের তট থেকে প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার দূরে আটলান্টিক মহাসাগরে আজর দ্বীপের কাছে ব্রিটিশ জাহাজ ‘দ্য গ্রাসিয়া’ দেখতে পায় মেরিকে। ফাঁকা জাহাজ দেখে সন্দেহ হয় গ্রাসিয়ার নাবিকদের। দেখা যায়, জাহাজটিতে ছয় মাসের খাবার থেকে শুরু করে নাবিকদের জামাকাপড় সবই সঠিক অবস্থায় রয়েছে। নেই শুধু কোনো মানুষের চিহ্ন। আশ্চর্যজনকভাবে নিখোঁজ ছিল একটি লাইফ বোটও। গ্রাসিয়ার ক্যাপ্টেন পরে জানিয়েছিলেন, এই ভুতুড়ে জাহাজে তিনি বা তার সহকর্মী কাউকেই দেখতে পাননি।

 

এখনো রহস্য হয়েই আছে

ইউএসএস

এ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী সমুদ্রে ডুবে গেছে প্রায় তিন মিলিয়ন জাহাজ! হাজার বছরের এই জাহাজডুবির ইতিহাস মানুষের মুখে মুখে ঘুরে-ফিরে জন্ম দেয় রূপকথায়। এমনই এক জাহাজ  ইউএসএস। যুক্তরাষ্ট্রের নৌ-ইতিহাসে সবচেয়ে মারাত্মক আর্থিক ক্ষতি ইউএসএস সাইক্লপস জাহাজ নিখোঁজ হয়ে যাওয়া। অতিরিক্ত ম্যাঙ্গানিজ আকরিক ভর্তি জাহাজটি ১৯১৮ সালের ৪ মার্চ বার্বাডোস দ্বীপ থেকে যাত্রা শুরুর পর এর একটি ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায় এবং ৩০৯ জন ক্রুসহ নিখোঁজ হয়। যদিও কোনো শক্ত প্রমাণ নেই; তবু অনেক কাহিনি শোনা যায়। কেউ বলেন, ঝড় দায়ী। কেউ বলেন, সমুদ্রে ডুবে গেছে। আবার কেউ এ ক্ষতির জন্য শত্রুপক্ষকে দায়ী করেন। উপরন্তু, সাইক্লপসের মতো আরও দুটি ছোট জাহাজ প্রোটিউস এবং নেরেউস দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে নিখোঁজ হয়। সাইক্লপসের মতো এ জাহাজ দুটিও অতিরিক্ত আকরিকে ভর্তি ছিল। এখনো রহস্যই হয়ে আছে ইউএসএস।

 

রহস্যঘেরা ফ্লাইং ডাচম্যান

ভুতুড়ে জাহাজের কথা এলেই লোক কাহিনিনির্ভর যত গুঞ্জন রয়েছে তার মধ্যে বিখ্যাত দ্য ফ্লাইং ডাচম্যান। লোকমুখে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত কাহিনি থেকে জানা যায়, ‘দ্য ফ্লাইং ডাচম্যান’ জাহাজের ক্যাপ্টেন ছিলেন হেনড্রিক ভ্যানডার ডেকেন। হেনড্রিক ১৬৮০ সালে জাহাজটি আমস্টার্ডাম থেকে বাটাভিয়ার (ডাচ ইস্ট-ইন্ডিয়া পোর্ট) দিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন। যখন জাহাজ আফ্রিকার কেপটাউনে পৌঁছায়, ততক্ষণে আবহাওয়া খারাপ হয়ে পড়েছিল। তা দেখে জাহাজের অন্য নাবিকরা হেনড্রিককে জাহাজ ছাড়তে নিষেধ করলেন। কিন্তু হেনড্রিক সবার নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে জাহাজ ভাসালেন কেপটাউনের উত্তাল সাগরের বুকে। তার এই পাগলামি দেখে নাবিকদের মধ্যে বিদ্রোহী দল গড়ে ওঠে। কিন্তু বিদ্রোহী দলের নেতাকে হেনড্রিক গুলি করে মেরে ফেলেন। এই খুনের রেশ ধরেই প্রেতাত্মা ভর করে জাহাজটিতে; এমনই বলা হয়। নাবিকরা মনে করেন, ফ্লাইং ডাচম্যান সমুদ্রে কোনো অমঙ্গল বা ঝড়ো হওয়ার পূর্ব-সংকেত হিসেবে দেখা দেয় মানুষকে সতর্ক করার জন্য।

 

ফ্লোর ডি লা মার

এই জাহাজটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে কলঙ্কজনক অধ্যায়। ১৫১১ সালে সুমাত্রার উত্তর তীরের সাগরে হারিয়ে যায় ফ্লোর ডি লা মার নামের জাহাজটি। পর্তুগিজরা যখন বাণিজ্যের অনুমতি চেয়ে মালয়েশিয়ার রাজার কাছে প্রত্যাখ্যাত হয় তখন তারা জাহাজটি লুটতরাজ শুরু করে। তারা তিন দিনে ৬০ টন সোনা, রাজার পারিবারিক সোনার সিংহাসন ও মূল্যবান মণিমুক্তাখচিত রাজকীয় তাজ, রাজভান্ডারের সোনার মোহর, ২০০ বাক্স ডায়মন্ড, মণিমুক্তা, পান্না ইত্যাদি লুট করে। তারা এসব মূল্যবান ধনরত্ন ফ্লোর ডি লা মার জাহাজে বোঝাই করে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু মানুষের অভিশাপ লেগেছিল তিন বিলিয়ন ডলারের দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ট্রেজারে। তাই আর গন্তব্যে পৌঁছতে পারেনি জাহাজটি। অভিশাপেই জাহাজটি চিরতরে হারিয়ে যায়। আজও জাহাজটির সব ধনসম্পদ অজ্ঞাত কোনো জায়গায় আছে বলে অনেকের ধারণা। অনেকেই এর সন্ধানে ডুব দিয়েছেন নানা সময়ে কিন্তু কোথাও পাওয়া যায়নি জাহাজটির কোনো অংশ। একেবারে যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে অভিশপ্ত জাহাজটি।

 

সাবমেরিনের অন্তর্ধান

দ্য হানলে

জাহাজটি মূলত একটি সাবমেরিন। রণতরীটির নাম এইচএন হানলে। ইতিহাসে জাহাজটি বেশ উন্নত একটি রণতরী হিসেবে পরিচিত। তবুও তিন তিনবার জাহাজটি ডুবে যাওয়ার সম্মুখীন হয়। ১৮৬৩ সালে প্রথম পানিতে নামে হানলে। মিত্রপক্ষ থেকে শুরু করে সোভিয়েত ইউনিয়নের অবরোধ ভাঙার চেষ্টায় লিপ্ত শার্লেস্টন হারবার পর্যন্ত কতজন যে জাহাজটির সওয়ার হয়েছেন, তার হিসাব নেই। প্রথমবার তো এক জলাবদ্ধ জায়গায় অদৃশ্য কিছু শেকড়-বাকড় রণতরীটিকে টেনে নেয় পানির নিচে। সেবার নাকি পাঁচজন কর্মী মারা যান। অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করা হয় জাহাজটিকে। কয়েক মাস পর আটজন ক্রু নিয়ে  ফের বিপদের সম্মুখীন হয় এইচএন হানলে। আবারও খুঁজে বের করে ১৮৬৪ সালে জাহাজটিকে কাজে নিযুক্ত করা হয়। এবার ইউএসএস হোসাটোনিককে ধাক্কা দিয়ে ডুবিয়ে পাঁচজনকে হত্যা করে এইচএন হানলে। এ দুর্ঘটনা অবশ্য হানলের নাবিকদের জন্যই আত্মঘাতী হিসেবে প্রতীয়মান হয়। ধ্বংসাবশেষ শিকারিরা প্রায় ২২ বছর আগে খুঁজে বের করে হানলেকে, ভিতরে ছিল আট নাবিকের কঙ্কাল। কিন্তু আজও এইচএন হানলে ডুবির ঘটনা রহস্য হয়েই আছে।

 

দ্য ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার শিপ

ফিলাডেলফিয়া

রহস্যে ঘেরা আরেকটি জাহাজ দ্য ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার শিপ। ৯/১১-এর পর, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের গ্রাউন্ড জিরোয় কাজ করার সময় নির্মাণ শ্রমিকরা একটি কাঠের জাহাজের সন্ধান পান। টুইন টাওয়ারের ঠিক দক্ষিণ দিকে অবাক করা এ ঘটনাটি ঘটে। কেউ জানে না, কোত্থেকে এখানে এলো জাহাজটি! প্রায় চার বছর পর আমেরিকার প্রতœতাত্ত্বিকরা জাহাজটি সম্পর্কে কিছু তথ্য উদ্ধার করেন। সম্ভবত জাহাজটি ১৭৭০ সালে নির্মাণ করা হয়েছিল। ধারণা করা হয়, এটি ফিলাডেলফিয়ায় তৈরি করা হয়েছিল। কারণ সে সময় কেবল ফিলাডেলফিয়ায় এ ধরনের জাহাজ বানানোর চল ছিল। কিন্তু প্রশ্ন হলো, জাহাজটি নিউইয়র্কে এলো কীভাবে? এর মালিকই বা কে ছিলেন? সে সব প্রশ্নের উত্তর আজও মানুষের কাছে অজানা। অনেক গবেষক মনে করেন, দুর্ঘটনাবশত ম্যানহাটনের কাছাকাছি কোথাও ডুবে গিয়েছিল জাহাজটি। আবার এমনও হতে পারে, প্রাচীন বিশ্বাস অনুযায়ী টুইন টাওয়ারের স্থায়িত্ব বাড়ানোর জন্য কেউ হয়তো মাটির নিচে পুঁতে রেখেছিল জাহাজটি।

 

চারটি ইংরেজ জাহাজের আক্রমণের শিকার

সান জোস

স্প্যানিশ রণতরী সান জোস। জাহাজটি সে সময়ের উন্নত রণতরীগুলোর একটি। কিন্তু অবাক করা তথ্য হলো-প্রায় ৩০৭ বছর নিখোঁজ ছিল জাহাজটি। নিখোঁজের সময় জাহাজে ছিল অঢেল গুপ্তধন, যা অষ্টাদশ শতাব্দীতে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতো। ১৭০৮ সালে জাহাজটি স্পেন থেকে আমেরিকায় যাচ্ছিল। পথিমধ্যে চারটি ইংরেজ জাহাজের সৈন্যদল জাহাজটিতে আক্রমণ চালায়। সেই যুদ্ধে প্রাণ হারান প্রায় ৬০০ নাবিক। দুর্দান্ত সব সমরাস্ত্র আর দক্ষ নাবিক থাকা সত্ত্বেও কীভাবে আর কেন সান জোস সমুদ্রে হারিয়ে যায়, যা আজও সবার কাছে অজানা এক রহস্য। কেউ কেউ বলেন, সম্ভবত জাহাজটির পাউডার রুমে আগুন ধরেছিল। অনেকে আবার মনে করেন, ইংরেজদের গোলাবারুদের সামনে টিকতেই পারেনি স্প্যানিশরা। সে যা-ই হোক না কেন, ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে উদ্ধার করা হয় জাহাজটি। তবে জাহাজটির গুপ্তধন আর মালিকানা নিয়ে বাঁধে বিরোধ। কলম্বিয়ার সরকার জাহাজটি উদ্ধার করতে সরকারি-বেসরকারি পার্টনারশিপের ঘোষণা দিয়েছিল। অপরদিকে স্প্যানিশ সরকারও ভাগ ছাড়তে নারাজ। আবার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও জাহাজটি নিজেদের দাবি করে। এ নিয়েই শুরু হয়েছে নতুন রহস্য।

সর্বশেষ খবর