শনিবার, ৭ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

ইতিহাসের গতি পাল্টে দেওয়া যত ভাষণ

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

ইতিহাসের গতি পাল্টে দেওয়া যত ভাষণ

সৃষ্টির পর থেকে ধাপে ধাপে বদলে গেছে পৃথিবী। পুরনো বৃত্ত ভেঙে সূচিত হয়েছে পরিবর্তন আর সৃষ্টি হয়েছে নতুন ইতিহাস। আবার ইতিহাসই সাক্ষ্য দেয়, পৃথিবীর বড় বড় বেশকিছু পরিবর্তনের নেপথ্যে রয়েছে এক বা একাধিক ভাষণ, কারণ বিশ্বে বিশেষ ক্ষেত্রে এমন ভাষণ কিংবা ভাষণে উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ যেন হয়ে ওঠে এক একটি মারণাস্ত্র কিংবা শক্তিশালী বোমার চেয়েও শক্তিধর কিংবা ভয়ঙ্কর। তাই এ ভাষণগুলোই পেরেছে ইতিহাসের গতি পাল্টে দিতে। পৃথিবীর অনেক রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতা, রাষ্ট্রনায়ক ও সামরিক জান্তা এমন কিছু ভাষণ দিয়েছেন যা তাদের ইতিহাসের অংশে পরিণত করেছে। আবার এমন কিছু ভাষণ আছে যা মানুষকে জীবন বিলিয়ে অধিকার আদায়ে উজ্জীবিত করেছে। ফলে পরিবর্তিত হয়েছে ইতিহাসের গতিধারা। জন্ম দিয়েছে নতুন দল, নতুন সমাজ, নতুন দেশ এমনকি নতুন জাতিসত্তা।

 

এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ১৯৭১

মাত্র ১০ দিন পর শুরু হবে জাতির জনক হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মবার্ষিকীর আনন্দযজ্ঞ। আর আগামী বছর স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপনের পাশাপাশি একটি ঐতিহাসিক ভাষণেরও সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হবে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে। ১৯৭১ সালের এ দিনে (৭ মার্চ) জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) মুক্তিকামী লাখো বাঙালি আর দেশ-বিদেশের শতাধিক গণমাধ্যমকর্মীর উপস্থিতিতে এক অভূতপূর্ব ভাষণ দেন। মাত্র  ১৮ মিনিটের এ ভাষণ কোনো কাগজ বা নোটের সাহায্য ছাড়া স্বতঃস্ফূর্তভাবে উচ্চারণ করেন জাতির পিতা। শব্দের বুনন, প্রাণের আবেগ আর দরাজ গলায় বর্ষিত এ ভাষণ যেন বুলেটের মতো বুকে প্রবেশ করে উজ্জীবিত করে সমগ্র বাঙালি জাতিকে। আর রকেট শেলের মতো বিদীর্ণ করে স্বৈরাচারী পাকিস্তানি শাসকদের হৃৎপিন্ড। কী ছিল না এই ভাষণে! ইতিহাসবেত্তার মতো বঞ্চনার ইতিহাস, মনস্তাত্ত্বিকের মতো স্বজন হারানোদের প্রতি সমবেদনা, দক্ষ প্রশাসকের মতো প্রশাসন ও সরবরাহ ব্যবস্থাপনার দিকনির্দেশনা, সর্বোপরি দক্ষ সেনানায়কের মতো যুদ্ধের কৌশলÑ একে একে সবই বলে গেছেন স্বাধীনতার এই রূপকার। বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা বলতে গিয়ে বারবার তার জীবনে নেমে এসেছে জেল, জুলুম আর হুমকি। এরই মাঝে অতি সাধারণ এক বাঙালি পরিবার আর প্রিয়তমা স্ত্রী ফজিলাতুননেছা ছিলেন তার অনুপ্রেরণার উৎস। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী এ ভাষণ শোনার জন্য উন্মুখ হয়েছিল গোটা জাতি। তার সুযোগ্য কন্যা বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক টেলিভিশন সাক্ষাৎ মতে, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ছিলেন বেশ বিচলিত। ’৭০-এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করা, ৩ মার্চ পূর্ব নির্ধারিত সংসদ অধিবেশন ভেঙে দেওয়া, দেশব্যাপী চলমান অসহযোগ আন্দোলন, হরতাল, জেলায় জেলায় হত্যাকা-, জনগণের প্রত্যাশা, সামরিক জান্তার জীবননাশ ও দেশদ্রোহিতার মামলার হুমকিÑ সব মিলিয়ে জীবনের এক কঠিন দিন পার করছিলেন জাতির জনক। এদিকে লাখো জনতা সকাল থেকেই মাতিয়ে তুলেছে রেসকোর্স ময়দান। কী করবেন বঙ্গবন্ধুÑ কী বলবেন এ নিয়ে রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা। এদিন দুপুরে ভাত খেয়ে বিছানায় গেলেন বঙ্গবন্ধু সামান্য বিশ্রামের জন্য। প্রিয়তমা স্ত্রী, যাকে তিনি রেনু বলে ডাকতেন, পাশে বসলেন নিজের পানের বাটা নিয়ে। সহজ-সরল এই গৃহবধূ নিজ স্বার্থ, সন্তানের ভবিষ্যৎ, পরিবারের নিরাপত্তাÑ এসব কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে ভাবলেন দেশের কথা। বঙ্গবন্ধুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, কাউকে ভয় করবে না। দেশের মানুষ তোমার দিকে তাকিয়ে আছে। তোমার যা বলা উচিত তা-ই বলবে, নিঃসংকোচে বলবে, নির্ভয়ে বলবে। সঞ্জীবনী সুধার মতো কাজ করল আজ বঙ্গমাতা উপাধি পাওয়া এই মহীয়সী নারীর অনুপ্রেরণা। চিরাচরিত রীতিতে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি আর কালো মুজিব কোট গায়ে চড়িয়ে বেরিয়ে পড়লেন বঙ্গবন্ধু। রেসকোর্স ময়দান তখন লাখো মানুষের এক জনসমুদ্র। চারদিকে গগনবিদারী স্লোগান। মঞ্চে উঠলেন বঙ্গবন্ধু। আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা আবদুর রাজ্জাকের বর্ণনামতে, স্লোগান-মুখরিত মঞ্চে বঙ্গবন্ধু সামনে এগিয়ে গেলেন। বললেন, ‘মাইকটা দে।’ তারপর শুরু করলেন তার কিংবদন্তিতুল্য ভাষণ। প্রথমে তুলে ধরলেন তার দুঃখভরা হৃদয়ের কথা। কারণ দেশের বিভিন্ন শহরের রাজপথ তখন রক্তে রঞ্জিত; বাতাসে বারুদ আর লাশের গন্ধ। দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল স্বাধীনতা, বেঁচে থাকা আর অধিকার আদায়ের করুণ আর্তনাদ। একে একে তুলে ধরলেন তার দেওয়া বিভিন্ন কর্মসূচি ও প্রস্তাব, যাতে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করেনি পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী। ’৫২ থেকে একে একে প্রায় প্রতিটি বছরে যে রক্তপাত ঘটেছে তারও বর্ণনা দিলেন। এ বর্ণনা থেকে বাদ যায়নি ইয়াহিয়া-ভুট্টোর ষড়যন্ত্রের কথাও। নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করে বলেন, প্রধানমন্ত্রিত্ব নয়, তিনি চান জনগণের অধিকার। এ অধিকার আদায়ে তিনি হরতাল ও সর্বগ্রাহী আন্দোলনের ডাক দেন। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার নির্দেশ দেন এবং তার অবর্তমানেও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। আর সবশেষে তার অগ্নিঝরা কণ্ঠে উচ্চারিত হয় স্বাধীনতার ঘোষণা- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’ মন্ত্রের মতো কাজ করে তার এই ঘোষণা। অচল হয়ে পড়ে সারা দেশ। শুরু হয় প্রতিরোধ। এরই ধারাবাহিকতায় ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ, ৩০ লাখ জীবন, লাখো নারীর সম্ভ্রম আর দেশের অমূল্য সম্পদের বিনিময়ে অর্জিত হয় আমাদের প্রাণপ্রিয় স্বাধীনতা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বঙ্গবন্ধু বন্দী থাকলেও তার ৭ মার্চের ভাষণ যেন প্রতিদিন বাজত মুক্তিযোদ্ধাদের কানে। তাই বঙ্গবন্ধু আজও জাগ্রত, শাশ্বত এবং চিরন্তন। দেশের গন্ডি পেরিয়ে ৭ মার্চের ভাষণ আজ বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। জাতিসংঘের অন্যতম অঙ্গসংগঠন ‘ইউনাইটেড ন্যাশনস এডুকেশনাল, সায়েন্টিফিক অ্যান্ড কালচারাল অর্গানাইজেশন’ (ইউনেস্কো) বাংলা ভাষায় প্রদত্ত জাতির জনকের ৭ মার্চ ১৯৭১-এর ভাষণ আনুষ্ঠানিকভাবে ‘মেমোরি অব ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্ট্রার’ এ অন্তর্ভুক্ত করেছে। এভাবে একটি দেশের স্বাধীনতার নেপথ্য শক্তি থেকে বিশ্বসম্পদে পরিণত হয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। কারণ এক কথায় বলতে গেলে একটি ভাষণ কীভাবে কোটি কোটি মানুষকে জীবন বিসর্জন দিয়ে স্বাধীনতা এনে দিতে পারে তার উদাহরণ ৭ মার্চের ভাষণ। ইতিহাসে বাংলাদেশ নামের একটি নতুন দেশের জন্ম। তাই ভাষণের কাছে ঋণী।’

 

আমার একটি স্বপ্ন আছে

মার্টিন লুথার কিং, ১৯৬৩

প্রাচ্যের মহাত্মাগাগ্ধীর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে পাশ্চাত্যে মানবাধিকার বিশেষত কৃষ্ণাঙ্গদের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার সফল আন্দোলন করে অমর হয়ে আছেন অফ্রিকার বংশোদ্ভূত কৃষ্ণাঙ্গ নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র। ১৯২৯ সালে তার জন্ম আমেরিকার জর্জিয়া রাজ্যের আটলান্টা শহরে। কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি শেতাঙ্গদের অবহেলা ও বৈষম্য বাল্যকাল থেকেই তাকে ভাবিয়ে তোলে। মাত্র ছয় বছর বয়সে তার প্রিয় শেতাঙ্গ বন্ধুকে তার বাবা কালো মার্টিন লুথার কিং থেকে আলাদা করে শুধু শ্বেতাঙ্গদের গড়া পৃথক স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। বাবার সঙ্গে জুতা কিনতে গেলে দোকানি তাদের কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য নির্দিষ্ট পেছনের চেয়ার দেখিয়ে দেন, যা তার বাবা প্রত্যাখ্যান করেন। মাত্র ৬ বছর বয়সেই তিনি তার বাবা কিং সিনিয়রকে কৃষ্ণাঙ্গদের ভোটাধিকারের জন্য সাংগ্রাম করতে দেখেন। তিনি প্রথম আলোড়ন তোলেন ১৯৫৫ সালে, যখন তার বয়স ২৬। ১৯ বছরের এক কৃষ্ণাঙ্গ স্কুলছাত্রী কলভিন এবং আরেক কৃষ্ণাঙ্গ নারী রোজা পার্কস পৃথক ঘটনায় প্রচলিত ও আরোপিত নিয়মে শ্বেতাঙ্গ বাসযাত্রীকে সিট ছেড়ে দিতে অস্বীকার করেন। রোজা পার্ককে এজন্য আটক করে আমেরিকার আলবেনিয়া রাজ্যের সন্টোগোমারি শহরের পুলিশ। এর প্রতিবাদে মার্টিন লুথার কিংয়ের নেতৃত্বে ৩৮৫ দিন বাস বয়কট চলে এবং আইনের দ্বারা এই কুপ্রথা বন্ধ হয়। এ সময় মার্টিন লুথার কিংয়ের বাড়ি বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়া হয়। ১৯৬১ সালে তিনি কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বৈষ্যম্যের বিরুদ্ধে অহিংস আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং এ জন্য কারাবরণ করেন। অহিংস আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে মার্টিন লুথার কিং বারবার প্রশাসনের নিপীড়নের শিকার হন। এভাবে ধারাবাহিক আন্দোলনের সূত্র ধরে ১৯৬৩ সালের ২৮ আগস্ট আমেরিকার ওয়াশিংটনে কৃষ্ণাঙ্গদের চাকরি ও মুক্তির দাবিতে এক বিশাল জনসভা এবং মার্চ বা মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি প্রথমদিকে ভেবেছিলেন হয়তো ১ লাখ কৃষ্ণাঙ্গের উপস্থিতি ঘটবে এই মার্চে। বাস্তবে তার চেয়ে অনেক বেশি কৃষ্ণাঙ্গ সমবেত হয় এই দিনে। এই সমাবেশে মার্টিন কৃষ্ণাঙ্গদের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠায় তার স্বপ্নের কথা বলেন। কিন্তু শেষদিকে কোনো লিখিত কাগজ ছাড়াই তার জাদুকরী কণ্ঠে লক্ষাধিক শ্রোতা-দর্শকের হৃদয়ে আলোড়ন তুলে তার স্বপ্নের জাল বুনেন, যা ছিল বস্তুত নিপীড়িত ও বঞ্চিত লাখো কোটি কৃষ্ণাঙ্গেরই স্বপ। পরবর্তীতে ইতিহাসের পাতায় এই ভাষণ ‘আই হেভ এ ড্রিম’ অর্থাৎ আমার একটি স্বপ্ন আছে নামে বিখ্যাত হয়ে ওঠে। তার অহিংস আন্দোলনকে শ্রদ্ধা জানিয়ে অন্তত ৫০টি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মান সূচক খেতাব, পুরস্কার ও ডিগ্রি প্রদান করে। ১৯৬৪ সালের ১৪ অক্টোবর তৎকালে কনিষ্ঠতম কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে নোবেল শান্তি পুরস্কার অর্জন করেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র।

 

মৃত্যু দেবে না স্বাধীনতা -তা বেছে নাও

এমিলিন প্যানখ্রাস্ট, ১৯১৩

পৃথিবীর বুকে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা, নারী-পুরুষের মাঝে সমতা প্রতিষ্ঠা এবং নারীর ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠার জন্য দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে হয়েছে। মাত্র ১০০-১৫০ বছর আগেও নারীর স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ, কাজ করা, পুরুষের সমান মজুরি ও সুযোগ-সুবিধা পাওয়া এবং নির্বাচনে ভোট প্রদানের বিষয়টিও মানতে নারাজ ছিল পুরুষ-শাসিত সমাজ। নারীর প্রতি এ বিদ্বেষমূলক দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দিতে যেসব অকুতোভয় নারী এগিয়ে এসেছিলেন, তাদেরই একজন এমিলিন প্যানখ্রাস্ট। নারীর ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় তার ভাষণ ‘...Choose between giving us freedoom or death অর্থাৎ ‘আমাদের মৃত্যু দেবে, না স্বাধীনতাÑ তা বেছে নাও’ কাঁপিয়ে দিয়েছিল বিংশ শতাব্দীর রাজনীতির ভিত।

এ মহীয়সী নারীর জন্ম হয়েছিল ১৮৫৮ সালের ১৫ জুলাই ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারের মস সাইড শহরে। জন্মের পর তার পারিবারিক নাম ছিল এমিলিন গাউল্ডেন। ১৮৭৮ সালে স্বামী রিচার্ড প্যানখ্রাস্টের সঙ্গে বিয়ের পর তার নাম হয় এমিলিন প্যানখ্রাস্ট। জন্মের পর থেকেই নারীর প্রতি বৈষম্য তার নজরে আসে। তাই ১৪ বছর বয়সেই তিনি নারীর অধিকার আদায় ও নারী-পুরুষ সমতার জন্য আয়োজিত বিভিন্ন আন্দোলনে অংশ নিতে শুরু করেন। ১৮৮৯ সাল এমিলিন ‘ওমেন্স ফ্রাঞ্চাইজ লিগ’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং বিবাহিত ও অবিবাহিত উভয় প্রকার নারীর ভোটাধিকারের আন্দোলন চালিয়ে যান। কিন্তু পুরুষ সমাজের চাপের মুখে এ আন্দোলন মুখথুবড়ে পড়ে। এরপর তিনি বামপন্থি আন্দোলনে বিশ্বাসী ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট লেবার পার্টিতে যোগদানের চেষ্টা করলে নারী হওয়ার কারণে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তাই বলে দমে যাননি এমিলিন প্যানখ্রাস্ট। ১৯০৩ সালে তার হাত ধরে জন্ম নেয় ‘ওমেন্স সোশ্যাল অ্যান্ড পলিটিক্যাল ইউনিয়ন’। এ ইউনিয়নের আন্দোলনে কেঁপে উঠে তৎকালীন ব্রিটিশ রক্ষণশীল সমাজ। তাই পুলিশি চাপে তাকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়। এরই মাঝে তাদের সন্তানদের আন্দোলনের জন্য তৈরি করেন এমিলিন। জেল তখন তার অনিবার্য ঠিকানা হয়ে ওঠে। কখনো কখনো মেয়েসহ তাকে জেলে যেতে হয়। এ অবিচারের প্রতিবাদস্বরূপ তিনি অনশন শুরু করেন। এর বিপরীতে তাকে অত্যাচার করে জোর করে খাবারের চেষ্টা চালানো হয়। এতেও ব্যর্থ হয়ে শাসকদল এক নতুন পদ্ধতি অনুসরণ করে। অনশনে তিনি মৃতপ্রায় হয়ে গেলে তাকে ছেড়ে দেওয়া হতো এবং খাবার খেয়ে তিনি স্বাভাবিক হলেই তাকে আবার বন্দী করা হতো । এমিলিনের ভাষায় এটা ছিল ‘ইঁদুর-বিড়াল’ খেলা। এভাবেই চলছিল আন্দোলন। এর ফলে আমেরিকার সীমানা পেরিয়ে এমিলিনের নামডাক ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে। ইংল্যান্ডের বাইরে আমেরিকায় তখন নারীরা এক অসহায় অবস্থায় দিনাতিপাত করছিল। তারাও পুরুষের অপশাসন, জোর-জুলুম এবং অধিকার হরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। এমনি এক প্রেক্ষাপটে আমেরিকার ‘ইকুইলিটি লিগ অব সেলফ সাপোর্টিং ওমেন’ নামক নিউইয়র্কভিত্তিক নারীবাদী সংগঠনের প্রেসিডেন্ট মিস হ্যারিয়েট স্ট্রান ব্ল্যাচের আমন্ত্রণে আমেরিকায় সফর শুরু করেন। ১৯৯৩ সালের নভেম্বর মাসের ১৩ তারিখ বহু নারী-পুরুষের উপস্থিতিতে এমিলিন প্যানখ্রাস্ট আমেরিকার কানেকটিকাট অঞ্চলের হার্টফোর্ডে এক ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। ভাষণের একটি অংশে সমবেত নারীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘মানুষের জীবন আমাদের কাছে অতি পবিত্র, কিন্তু আমরা বলি যদি কোনো জীবন বিসর্জন দিতে হয় তা আমাদের নারীদেরই দিতে হয়’। আমরা নিজে নিজে তা (জীবন বিসর্জন) করব না। কিন্তু আমাদের শত্রুদের আমরা এমন এক অবস্থানে নিয়ে যাব যেখানে তাদের পছন্দ (ঠিক) করতে হবে তারা আমাদের কী দেবেÑ স্বাধীনতা না মৃত্যু? অতি দীর্ঘ এ ভাষণের আরেকটি অংশে তিনি বলেন, আমরা ইংল্যান্ডের সরকারকে এমন এক অবস্থানে নিয়ে এসেছি, যেখানে তাদের ঠিক করতে হবে, তারা মেয়েদের মেরে ফেলতে চায় না ভোটের অধিকার দিতে চায়।

এমিলিনের এই ভাষণ ‘আমাদের স্বাধীনতা দাও নইলে মৃত্যু’ এই শিরোনামে বিশ্বকে কাঁপিয়ে তোলে। এ ভাষণের পরবর্তী বছর (১৯১৪ সাল) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে নারীদের অধিকার আন্দোলন কিছুটা আড়ালে চলে যায়। এমিলিন প্যানখ্রাস্ট এ সময় নারী সমাজকে নিয়ে সরকার তথা দেশের পাশে দাঁড়ান এবং যুদ্ধের মাঝেও কলকারখানায়  উৎপাদন চালু রাখতে সচেষ্ট থাকেন। পাশাপাশি চালিয়ে যান মেয়েদের ভোটাধিকার আদায়ের আন্দোলন। ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়। এ বছরেই ইংল্যান্ডে ২১ বছরের পুরুষ এবং ৩০ বছরের নারীদের ভোটাধিকার দেওয়া হয়। এতে সন্তুষ্ট হতে পারেননি এমিলিন। নারী-পুরুষের সমান ভোটাধিকার আদায়ে তিনি লড়াই অব্যাহত রাখেন। ১৯২৮ সালে ইংল্যান্ডের কনজারভেটিভ সরকার নারী-পুরুষের সমান ভোটাধিকার আইন প্রবর্তন করে। একই বছর, ১৪ জুন ১৯২৮ মৃত্যুবরণ করেন এই নারী নেত্রী। ১৯৯৯ সালে টাইমস ম্যাগাজিন বিংশ শতাব্দীর ১০০টি সেরা বা আকর্ষণীয় ভাষণ হিসেবে তার ‘স্বাধীনতা নয়তো মৃত্যু’ শিরোনামের ভাষণটিকে স্বীকৃতি দেয়। ২০০৭ সালে গার্ডিয়ান পত্রিকা এটিকে বিংশ শতাব্দীর সেরা ভাষণগুলোর একটি হিসেবে তিন পর্বে প্রকাশ করে। (সূত্র : দি গার্ডিয়ান, ২৭ এপ্রিল ২০০৭)।’

 

‘ভারত ছাড়’

মহাত্মা গান্ধী, ১৯৪২

পৃথিবীর বুকে ক্ষণজন্মা কয়েকজন মানুষের মধ্যে একজন মোহনদাস করম চাঁদ গান্ধী। যিনি মহাত্মা গান্ধী, গান্ধীজি কিংবা বাপুজি (গুজরাটি ভাষায় যার অর্থ বাবা) নামে বেশি পরিচিত। জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের ভাষায় প্রজন্মের পর প্রজন্ম আসবে, কিন্তু রক্তে-মাংসে গড়া এমন একজন মানুষ পৃথিবীর বুকে একদিন যে হেঁটেছিলেন তা হয়তো অনেকের ভাবতেও কষ্ট বা ভয় হবে। মহাত্মা গান্ধীর জন্ম ২ অক্টোবর ১৮৬৯ সালে ভারতের গুজরাটে পোরবন্দর এলাকার এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার গন্ডি পেরিয়ে তিনি লন্ডনে পাড়ি জমান এবং ইনার টেম্বল থেকে ‘বার এট ল’ সম্পন্ন করে ভারতে ফিরে আসেন। মাত্র ২১ বছর বয়সে তিনি আইন পেশায় যোগ দিলেও বিভিন্ন কারণে তিনি এক্ষেত্রে সাফল্য লাভে ব্যর্থ হন। ফলে বিকল্প ভাবনায় এক ভারতীয় ব্যবসায়ীর পক্ষে আদালতে দাঁড়াতে ১৮৯৩ সালে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় পাড়ি জমান। সেখানে তিনি তীব্র বর্ণবাদের শিকার হন এবং পৃথিবীময় ছড়িয়ে থাকা এ কুপ্রথা নিরসনে ব্রতী হন। এ ধারাবাহিকতায় তিনি ১৯১৫ সালে ৪৫ বছর বয়সে ভারতে ফিরে আসেন এবং ধীরে ধীরে ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস’ দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করে দারিদ্র্যবিমোচন, নারী অধিকার রক্ষা, জাতিগত মতভেদ দূরীকরণ, ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষা এবং সর্বোপরি ভারতের মাটিতে ভারতীয়দের শাসন প্রতিষ্ঠা বা ‘স্বরাজ’ আন্দোলনে যুক্ত হন। ১৯২১ সালে কংগ্রেসের নেতৃত্ব গ্রহণের পাশাপাশি তিনি তার বিলেতি স্যুট-টাই ছেড়ে নিজ হাতে চরকায় বোনা মোটা খাদি কাপড়ের ধুতি ও শাল তুলে নেন, যা ভারতের দরিদ্র কৃষকরা পরিধান করত। সেই সঙ্গে তিনি দামি খাবার ছেড়ে নিতান্ত সবজিভোজী হয়ে ওঠেন। ১৯৩০ সালে তিনি লবণের ওপর কর প্রত্যাহারের দাবিতে ৪০০ কিলোমিটার (২৪৮ মাইল) রোড মার্চের নেতৃত্ব দেন, যার মাধ্যমে ব্রিটিশদের ভারত ছাড়ার আন্দোলন সূচিত হয়। ইতিহাসের পাতায় এ আন্দোলন ধাপে ধাপে বেগবান হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। তবে এরই মাঝে ১৯৩৯ সালে ১ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। ইংল্যান্ড তখন মিত্রশক্তির অন্যতম অংশীদার। তাই পৃথিবীময় ছড়িয়ে থাকা ব্রিটিশ শাসিত সব অঞ্চল মিত্র শক্তিবিরোধী জার্মান-ইতালি-জাপান তথা এক্সিস ফোর্স বা অক্ষশক্তির লক্ষ্যে পরিণত হয়। ব্রিটিশ কলোনি বা উপনিবেশ হিসেবে ভারতে তখন নানা ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করতে থাকে। অপশক্তির অন্যতম জাপান এ সময় দক্ষিণ এশিয়ায় এক অপ্রতিরোধ্য বাহিনীতে পরিণত হয়। তারা বার্মা (বর্তমান মিয়ানমার) দখল করে ভারতে প্রবেশের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়। নেতাজি  সুভাষচন্দ্র বসু তখন ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ নামের বিশাল ভারতীয় স্বল্প প্রশিক্ষিত মুক্তিসেনা নিয়ে জাপানের পক্ষ অবলম্বন করেন। মিত্র শক্তির অপর দুই বৃহৎ অংশীদার আমেরিকা ও চীনও এ সময় ভারতের ভবিষ্যৎ বিষয়ে ব্রিটিশদের কাছে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দাবি করেন। মহাত্মা গান্ধী এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তার আন্দোলন বেগবান করেন। তবে এ আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে কেন্দ্র করে তখন কেউ লড়ছে গণতন্ত্র ও শান্তি রক্ষায়, কেউ ব্যস্ত নিজ ভূখ- রক্ষায় আবার কেউবা উন্মত্ত একের পর এক নতুন অঞ্চল দখলে। অথচ ভারতে তখন এক বিপরীত চিত্র। হিংসা নয়, বিদ্বেষ নয়, আক্রমণ নয়, ত্যাগ আর ধৈর্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে মহাত্মা গান্ধী ব্রিটিশদের বেকায়দায় ফেলেন। চরম অনাচার আর অত্যাচার সত্ত্বেও তিনি কোনো প্রকার সহিংসতায় না জড়িয়ে ব্রিটিশদের ভারত ছাড়ার আহ্বান জানাতে থাকেন। এমনি এক প্রেক্ষাপটে ১৯৪২ সালের ৮ আগস্ট মহাত্মা গান্ধী তৎকালীন বোম্বে (বর্তমান মুম্বাই) শহরের গাওলিয়া ট্যাঙ্ক ময়দানে এক ঐতিহাসিক বক্তৃতায় ব্রিটিশদের ভারত ছাড়ার তীব্র দাবি জানিয়ে এক ভাষণ দেন, যার মাধ্যমে ‘কুইট ইন্ডিয়া’ বা ‘ভারত ছাড়’ তথা ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলন নতুন মাত্রা লাভ করে। এই বক্তৃতায় তিনি বলেন, এই আন্দোলন ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নয়, শুধু ভারতের স্বাধীনতা প্রদানে এক অহিংস যুদ্ধ। এ বক্তৃতার পর আরও তিন বছর অর্থাৎ ২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৫ পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলে। কিন্তু গান্ধীর অহিংস আন্দোলন ব্রিটিশদের ভারতের স্বাধীনতা প্রদানে একসময় বাধ্য করে। বিশ্বযুদ্ধের দুই বছর পর ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ব্রিটিশ রাজত্বের অবসান ঘটে এবং স্বাধীন ভারতের জন্ম হয়। ভারতের স্বাধীনতা তাই মহাত্মা গান্ধী ও তার ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনের শুরুতে দেওয়া এই বক্তৃতার কাছে ঋণী। ১৯৩০ সালে তিনি টাইমস ম্যাগাজিনের ‘পারসন অব দ্য ইয়ার’ নির্বাচিত হন। নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য তিনি ৫ বার মনোনীত হলেও আন্তর্জাতিক চক্রান্তে তার আর নোবেল পাওয়া হয়নি। তবে ভারতের স্বাধীনতার পাশাপাশি পাকিস্তানের জন্ম এবং পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের মূলে রয়েছে মহাত্মা গান্ধীর ‘ভারত ছাড়’ ভাষণ।

 

জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা সরকার এবং জনগণের জন্য সরকার

আব্রাহাম লিংকন, ১৮৬৩

১৮৬৩ সালে সমগ্র আমেরিকা গৃহযুদ্ধে জর্জরিত ছিল। বর্ণবাদ, রক্ষণশীলতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং ধর্মীয় মতভেদসহ নানা কারণে আমেরিকার বিভিন্ন রাজ্যে গৃহযুদ্ধ ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। আমেরিকার এ ক্রান্তিকালে দেশের ১৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে কৃষাঙ্গ নেতা আব্রাহাম লিংকন এক সংকটময় সময় অতিবাহিত করেন। ১৮৬১ সালে দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র ২ বছরের মাথায় ক্রীতদাস প্রথা বিলুপ্তির প্রশ্নে আমেরিকা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। আব্রাহাম লিংকন এবং তার সমমনারা ছিলেন ক্রীতদাস প্রথার বিরুদ্ধে। এ পক্ষ তাদের আদর্শ এবং বিশ্বাসকে টিকিয়ে রাখতে একটি জোটবদ্ধ সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলেন, যা ‘ইউনিয়ন আর্মি’ নামে পরিচিতি পায়। আর অপরপক্ষে ছিল আমেরিকার ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যসহ দক্ষিণাঞ্চলের সৈন্যরা, যারা ‘কনফেডারেট আর্মি’ নামে পরিচিত ছিল। ১৮৬৩ সালের জুনের শেষে কনফেডারেট আর্মির কমান্ডার জেনারেল রবার্টই লি’র নেতৃত্বে আনুমানিক ৭৫ হাজার সৈন্য আমেরিকার পেনসিলভেনিয়া রাজ্যের গেটিসবার্গ শহর আক্রমণ করে। আর গেটিসবার্গের দখল ধরে রাখতে রুখে দাঁড়ায় ইউনিয়ন আর্মি কমান্ডার জেনারেল জর্জ জি মিয়াদির লক্ষাধিক সৈন্য। জুলাই মাসের ১, ২ ও ৩ তারিখে উভয়পক্ষের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। এ যুদ্ধে ইউনিয়ন আর্মির ৩ হাজার ১৫৫ জন মৃত্যুবরণ করেন। ১৪ হাজার ৫২৯ জন আহত হন এবং ৫ হাজার ৩৬৫ জন অপরপক্ষের হাতে যুদ্ধবন্দী হন। পক্ষান্তরে কনফেডারেট আর্মির হতাহতের সংখ্যা ছিল প্রায় ২৪ হাজার। আমেরিকার ইতিহাসে কোনো গৃহযুদ্ধে এমন হতাহতের ঘটনা এর আগে কখনোই ঘটেনি। ফলে শান্তিপ্রিয় মানবদরদি ও মানবাধিকারে বিশ্বাসী কৃষ্ণাঙ্গ নেতা ও প্রেসিডেন্ট পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও ঝুঁকিমুক্ত হওয়ার পরপরই ছুটে যান গেটিসবার্গ শহরে। সেখানে দেশের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারকারী সেনাদের সম্মানে ও স্মৃতিতে নির্মিত স্মৃতিসৌধ ‘সোলজার্স ন্যাশনাল সিমেট্রিতে’ শ্রদ্ধা নিবেদন করে এক আবেগময় এবং ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে থাকা এ ভাষণটি উচ্চারিত হয় ১৮৬৩ সালের ১৯ নভেম্বর বৃহস্পতিবার। রাষ্ট্র হিসেবে আমেরিকার জন্ম এবং সার্থকতা তুলে ধরতে তথা গণতন্ত্রের প্রকৃত সংজ্ঞা নিরূপণে তার এ ভাষণ আজও সর্বজন গৃহীত ও বিদিত। মাত্র ২৭১টি শব্দে তিনি আমেরিকার অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের এক অসাধারণ ব্যঞ্জনা প্রকাশ করেন। তিনি এ ঘটনার ৮৭ বছর আগে আমেরিকার রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের নেপথ্যের ‘সমতা’ ও ‘সমানাধিকার’-এর বিষয়টি তুলে ধরেন এবং তা বজায় রাখতে যুগে যুগে বিশেষত গেটিসবার্গের ৩ দিনের যুদ্ধে যে বিপুলসংখ্যক সেনা হতাহত হয়, তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন। তার বক্তব্যের শেষ ভাগে উচ্চারিত হয় ‘গণতন্ত্র’ নিয়ে তার আন্তরিক আশাবাদ। তিনি বলেন, ‘‘....Government of the people, by the people, for the people ” অর্থাৎ পৃথিবীর বুক থেকে জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা সরকার এবং জনগণের জন্য সরকার কখনো হারিয়ে যাবে না। এ ভাষণের পর আরও ২ বছর আমেরিকার গৃহযুদ্ধ চললেও পৃথিবীব্যাপী জনগণের সরকার তথা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় এ ভাষণ বিশেষ অবদান রাখে। এই বক্তব্যের মাধ্যমেই যেন পৃথিবীতে আধুনিক গণতন্ত্রের বীজ রোপিত হয়। সব রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তার এ উক্তিকে গণতন্ত্রের সঠিক ও সার্বিক সংজ্ঞা বলে একবাক্যে স্বীকার করেন। তার এ বক্তব্যে উদ্ধুদ্ধ হয়ে গণতন্ত্রপ্রেমীরা সারা বিশ্বে নিজেদের সরকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফলে একে একে স্বৈরাচার ও রাজতন্ত্রের পতন ঘটতে থাকে এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হতে পারে। তাই বলা হয় পৃথিবীর বুকে দাস প্রথার অবসান ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বীজ ১৮৬১ সালের ১৯ নভেম্বর আব্রাহাম লিংকনের হাতে গেটিসবার্গে রোপিত হয় মাত্র ২৭১টি শব্দ উচ্চারণের মধ্য দিয়ে। এ ভাষণ পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদকৃত অন্যতম ভাষণ। ১৯৭২ সালে ‘দি লিবার্টি অব কংগ্রেস’ পৃথিবীর ২৯টি বহুল প্রচলিত ভাষায় অনুবাদকৃত এ ভাষণের একটি সংকলন প্রকাশ করে।

সর্বশেষ খবর