শনিবার, ১৪ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

খ্যাতিমান যুদ্ধ সাংবাদিক

রণক ইকরাম ও তানভীর আহমেদ

খ্যাতিমান যুদ্ধ সাংবাদিক

সাংবাদিকতাকে বলা হয় মহান পেশা। আর এ ক্ষেত্রে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মৃত্যুঝুঁকি পর্যন্ত নিতে হয় সাংবাদিকদের। আর মৃত্যুঝুঁকির বিষয়টি একেবারে জেনে-বুঝেই আসেন যখন কোনো সাংবাদিক যুদ্ধক্ষেত্র বা যুদ্ধের ঘটনা কভার করেন।

যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সংবাদ প্রেরণের দায়িত্ব নিয়ে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যে সাংবাদিকরা কাজ করেন তাদেরই বলা হয় যুদ্ধ সাংবাদিক। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তারা শুধু সর্বশেষ সংবাদই পাঠান না, প্রেরণ করেন যুদ্ধের ছবিও। তাদের সংবাদ আর ছবিগুলো শুধু যুদ্ধচিত্রই নয়, ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে অসামান্য মর্যাদা লাভ করে। সারা বিশ্বেই যুদ্ধ সাংবাদিকদের খ্যাতি ছড়িয়ে আছে। সাহসী ও খ্যাতিমান কয়েকজন যুদ্ধ সাংবাদিককে নিয়েই রকমারির আজকের আয়োজন।

 

রবার্ট ফিস্ক

রবার্ট ফিস্ক। এই ব্রিটিশ সাংবাদিক বিশ্বজুড়ে খ্যাতি লাভ করেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুদ্ধাভিযানের সংবাদ সংগ্রহ এবং নিরপেক্ষতার সঙ্গে তা পরিবেশনার জন্য। তার সাংবাদিকতার যাত্রা শুরু হয় কৈশোরেই। মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি রিপোর্টার হওয়ার ব্যাপারে মনস্থির করে ফেলেন। ছাত্রজীবন থেকেই সাংবাদিকতা শুরু করেন ফিস্ক। প্রথমে ‘সানডে এক্সপ্রেস’র ডায়েরি কলামে লেখালেখি করতেন। পরবর্তীতে তিনি যোগ দেন ‘দ্য টাইমসে’। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত টাইমসের বেলফাস্ট প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন তিনি। এরপর পর্তুগালের কারনেশন (সাদা বা গোলাপি) বিপ্লব কভার করতে চলে যান। তারপর তাকে মধ্যপ্রাচ্য সংবাদদাতা হিসেবে নিয়োগ করা হয়। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন ফিস্ক। এরপর তার ঠিকানা হয় দ্য ইনডিপেন্ডেন্ট পত্রিকায়। ১৯৮৯ সালের ২৮ এপ্রিল ইনডিপেন্ডেন্টে তার প্রথম রিপোর্ট প্রকাশ পায়। তিনি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন ঘটনা ও বিষয় নিয়ে সংবাদ সরবরাহ করে খ্যাতি লাভ করেন। যেসব যুদ্ধের খবর সংগ্রহ করে তিনি বিশ্ববাসীর কাছে সম্মানের পাত্র হন তার মধ্যে রয়েছে- লেবাননে ইসরায়েলি আগ্রাসন (১৯৭৮-৮২), ইরানের বিপ্লব (১৯৭৯), ইরাক-ইরান যুদ্ধ (১৯৮০-৮৮), আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসন (১৯৮০), উপসাগরীয় যুদ্ধ (১৯৯১)। ২০০৮ খ্রিস্টাব্দ অবধি তিনি ৩২ বছরে কমপক্ষে ১১টি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সংবাদ সংগ্রহ করেছেন। একুশ শতাব্দীর প্রথম দশকে তিনি নিরপেক্ষতার সাংবাদিক প্রতীকে পরিণত হয়েছেন। নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ ও সাহসিকতার জন্যই তিনি সমধিক খ্যাত। তিনি বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত ওসামা বিন লাদেনের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন একাধিকবার। তিনিই একমাত্র বিদেশি সাংবাদিক যিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনবার ওসামা বিন লাদেনের সাক্ষাৎকার নিতে সক্ষম হন। তিনি যুদ্ধ সাংবাদিকতায় অসামান্য অবদান রাখায় পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। তিনি পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছেন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ১৯৯৮ সালে দিয়েছে ওভার অল মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড। সাতবার তাকে দেওয়া হয়েছে ব্রিটিশ ইন্টারন্যাশনাল জার্নালিস্ট অব দ্য ইয়ার অ্যাওয়ার্ড। ১৯৮৬ সালে তিনি জাতিসংঘ প্রেস অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সাংবাদিকতার জন্য ১৯৯৬ সালে তাকে জন্স হপকিনস সিআইএএস-সিআই পুরস্কার দেওয়া হয়। যুদ্ধের সংবাদ কভার করতে গিয়ে বহুবার হুমকির মুখে পড়েন ফিস্ক। আহতও হয়েছেন প্রথিতযশা এই সাংবাদিক। ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় আর্টিলারির আঘাতে আহত হলে তার শ্রবণশক্তি অনেকাংশে নষ্ট হয়ে যায়। এ ছাড়া বিদেশি গুপ্তচর সন্দেহে দুবার অপহরণ চেষ্টার হাত থেকে বেঁচে যান তিনি। আফগানিস্তান যুদ্ধের সময় পাকিস্তানে অবস্থানকালে আফগান শরণার্থীরা তাকে পিটিয়ে আহত করেছিল।

 

রবার্ট ক্যাপা

তিনি ছিলেন পাঁচটি যুদ্ধের খবর সংগ্রহ করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন হাঙ্গেরিয়ান ফটো সাংবাদিক। ক্যামেরা প্রসঙ্গে তার বিখ্যাত দর্শন ছিল ‘You have to get closer to the thing you are trying to capture in your camera.’ ইতিহাসের কিংবদন্তিতুল্য এই সাংবাদিক স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের সময় তোলা তার আয়রনিক ছবির কারণে সবার কাছে বিখ্যাত হয়ে আছেন। তার জš§ ১৯১৩ সালের ২২ অক্টোবর হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে। ৪০ বছর বয়সে ভিয়েতনামের থাই বিনে ১৯৫৪ সালের ২৫ মে তার মৃত্যু হয়।

 

মার্গারেট ব্রুক হোয়াইট

মার্গারেট ব্র“ক হোয়াইট চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম যুদ্ধের খবর সংগ্রহকারী নারী হিসেবে। তার আগ পর্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ সংবাদ সংগ্রহের জন্য কেবল পুরুষদেরই যোগ্য মনে করা হতো। কিন্তু মার্গারেট ব্র“ক হোয়াইট মানুষের সেই বদ্ধমূল ধারণা গুঁড়িয়ে দেন। তিনিই ছিলেন প্রথম বিদেশি ফটোগ্রাফার, যাকে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভিতরকার ছবি তোলার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। এই আমেরিকান ফটো সাংবাদিক আরেকটি কারণে বিখ্যাত। পৃথিবীর ইতিহাসে যে কজন সাংবাদিক এ উপমহাদেশ বিভাজনের সময়টুকুতে খবর ও ছবি সংগ্রহের কাজে যুক্ত ছিলেন, হোয়াইট তাদের অন্যতম। বিশেষ করে পাক-ভারত বিভাজনের সময় তার তোলা অনেক বিখ্যাত ছবি রয়েছে। ১৯০৪ সালের ১৪ জুন নিউইয়র্কে জš§গ্রহণকারী হোয়াইট ৬৭ বছর বয়সে ১৯৭১ সালের ২৭ আগস্ট স্টামফোর্ডে মৃত্যুবরণ করেন।

 

এলিজা প্যারিস লভজয়

তিনি ছিলেন আধুনিক সাংবাদিকদের মধ্যে সর্বপ্রথম অপঘাতে মৃত্যুবরণকারী ব্যক্তি। একজন যুদ্ধ সাংবাদিক হিসেবে তার বিশ্বজুড়ে খ্যাতি রয়েছে। যুদ্ধ ময়দান থেকে সর্বশেষ খবর পৌঁছে দিতে তার অবদান কম নয়। পেশাগত দায়িত্ব পালনের কারণে তাকে শহীদ হতে হয়। এলিজা প্যারিস লভজয় ছিলেন দাস প্রথাবিরোধী একজন মানুষ। বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনেও তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি সাংবাদিকতার পাশাপাশি সমাজের প্রচলিত দাস প্রথার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। তার লেখনীতে তিনি দাস প্রথার বিরুদ্ধে দুর্বার বিপ্লবের আওয়াজ তোলেন। ১৮২৬ সালে ওয়াটারভিলে কলেজ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন লভজয়। দাস প্রথার বিরুদ্ধে তার সোচ্চার মতামত তাকে একটি জ্যাকসনবিরোধী সংবাদপত্রের সম্পাদক বানিয়ে দেয়।

১৮০২ সালের ৯ নভেম্বর মাইনেতে জš§গ্রহণকারী লভজয় বেঁচেছিলেন মাত্র ৩৪ বছর। দাস প্রথার বিরুদ্ধে তার আন্দোলনের সাফল্য দেখার আগেই ১৮৩৭ সালের ৭ নভেম্বর আততায়ীরা তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে।

 

সায়মন ড্রিং

কলম আর ক্যামেরা হাতে নিজের জীবনবাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে নিরীহ বাংলাদেশিদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন সাংবাদিক সায়মন ড্রিং। একাত্তর সালে সায়মন ড্রিংয়ের বয়স ছিল মাত্র ২৭ বছর। তিনি তখন নামকরা পত্রিকা ডেইলি টেলিগ্রাফের সাংবাদিক। অন্যদিকে তখন আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পাকিস্তানি সামরিক সরকার ২৫ মার্চ বিশ্বের বড় বড় সংবাদ মাধ্যমের ৪০ জন সাংবাদিককে বাংলাদেশে আসার অনুমতি দিয়েছে। সেই সুযোগে টেলিগ্রাফের সাংবাদিক হিসেবে বাংলাদেশে আসেন সায়মন ড্রিং। পাকিস্তানি সেনাদের নির্যাতনের চিত্র তিনি তুলে ধরেন বিশ্ববাসীর সামনে। এক সময় সাংবাদিকদের জন্য অবস্থা প্রতিকূলে চলে গেলে তিনি দেশত্যাগ না করে লুকিয়ে থাকেন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। তিনি ২৭ তারিখে পাকিস্তানি বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে আসেন শহরে। ঢাকার বুকে তখন হত্যা, ধ্বংস আর লুটপাটের চিহ্ন। পর্যাপ্ত ছবি আর প্রত্যক্ষ ছবিগুলো নিয়ে তিনি পালিয়ে চলে গেলেন ব্যাংককে। আর সেখান থেকে প্রকাশ করলেন ‘ট্যাংকস ক্রাশ রিভল্ট ইন পাকিস্তান’। বিশ্ববাসীর সামনে তিনি তুলে ধরলেন নির্মম বাস্তবতাকে। তার পাঠানো খবরেই নড়েচড়ে বসল পুরো বিশ্ব।

 

রশিদ তালুকদার

যুদ্ধ সাংবাদিকদের কলম যুদ্ধের পাশাপাশি সমান গুরুত্ব নিয়ে লড়ে যান ক্যামেরা যোদ্ধারাও। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের সফল ক্যামেরা যোদ্ধা রশিদ তালুকদার। তার ক্যামেরায় বন্দী হয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বহু সাক্ষী-প্রমাণ। এ দেশের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের কথা উঠলেই এই ফটো সাংবাদিকের নাম উঠে আসে সবার আগে। তার ক্যামেরায় দেখা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আজও আমরা ৭১-কে দেখি। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছবি তুলেছেন শুধু দেশের জন্য। এই ক্যামেরাযোদ্ধা ১৯৬৯ সাল থেকে শুরু করে আজীবন ক্যামেরায় দেশ ও জাতির ইতিহাসকে ধারণ করেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিত্রগুলোই তার হাতে তোলা। তার তোলা ছবিগুলোতেই আমরা মূলত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন দৃশ্য দেখি। তার তোলা ছবি দেশ-বিদেশের অনেকের কাছে পরিচিত। তার ক্যামেরায় তোলা আছে বিভিন্ন মুহূর্তের অনেক বিরল ছবি। তার পেশাগত জীবনও অনেক বর্ণিল। ১৯৩৯ সালের ২৪ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনায় জš§ রশিদ তালুকদারের। রাজশাহীর স্টার স্টুডিওতে মরহুম  মোতাহার হোসেনের কাছে হাতেখড়ি হয়। মাসিক সর্বসাকুল্যে ৮০ টাকা বেতনে ১৯৫৯ সালে ফটো টেকনিশিয়ান হিসেবে যোগ দিলেন পিআইডিতে (প্রেস ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্ট)। তারপর ১৯৬১ সালে যোগ দেন দৈনিক সংবাদ-এ। ১৩ বছর দৈনিক সংবাদ-এ কাজ করেন। ১৯৭৫ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত একটানা ৩২ বছর দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় সিনিয়র ফটোসাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি বাংলাদেশ ফটো জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক ছিলেন। আলোচিত এই আলোকচিত্রীর ছবি নামে অথবা বেনামে সরকারি, বেসরকারি নানা প্রকাশনা, পোস্টার, ক্যালেন্ডার এবং অসংখ্য বইয়ে ব্যবহৃত হয়েছে।

দেশের বিখ্যাত এই আলোকচিত্রী নিজস্ব একটি একক অ্যালবামও প্রকাশ করতে পারেননি। তার কীর্তির মধ্যে আছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার পর তৎকালীন সামরিক কর্তৃপক্ষের অধীনে বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ’৭০-এর নির্বাচনের ফলাফল শোনার ছবি, ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেওয়ার দৃশ্য। এসবই এখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিত্র দলিল হিসেবে সমাদৃত।

 

কিশোর পারেখ

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যে কজন সফল ক্যামেরাযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধের চিত্র সেলুলয়েডবন্দী করেছিলেন তাদের একজন কিশোর পারেখ। কোনো সংবাদ সংস্থার নির্ধারিত অ্যাসাইনমেন্ট ছাড়াই তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ছবি তুলেছিলেন। মাত্র আট দিনে তার তোলা ৬৭টি ছবি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দলিল হয়ে আছে। ক্যামেরা হাতে এই সাহসী যুদ্ধ সাংবাদিকের জš§ ১৯৩০ সালে ভারতে। ১৯ বছর বয়সে প্রথম হাতে ক্যামেরা তুলে নেন। সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চলচ্চিত্র, তথ্যচিত্র ও স্থিরচিত্রের ওপর ডিগ্রি লাভের পর ফটো সাংবাদিকতা শুরু করেন। ১৯৬১ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত তিনি হিন্দুস্তান টাইমস-এ কাজ করেছেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর তার তোলা ছবিগুলো তার জীবনের সেরা ফটোগ্রাফির একটি মূল অংশ হিসেবে গণ্য। ঢাকায় অবস্থানকালীন একজন সিভিলিয়ান হয়ে সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রের ছবি তোলা খুব কঠিন ব্যাপার ছিল। তাই তিনি পাকিস্তান আর্মির পোশাক জোগাড় করে ঐতিহাসিক কাজগুলো সাহসিকতার সঙ্গে সম্পন্ন করেছিলেন। ছবি তুলতে গিয়ে তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে ধরাও পড়েছিলেন। এই যুদ্ধ সাংবাদিক ফটোগ্রাফারের ক্যারিয়ারের শুরুতে লাইফ ম্যাগাজিন এবং ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ফটোগ্রাফার্স অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত ইন্টারন্যাশনাল ফটোগ্রাফি কনটেস্টে সাতটি ক্যাটাগরির মধ্যে ছয়টি পুরস্কার জিতে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিতি লাভ করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় কিশোর যখন ট্রাভেল এবং ফ্যাশন ফটোগ্রাফিতে ব্যস্ত তখন হঠাৎ সিদ্ধান্ত নেন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসবেন।

তখনই প্রায় ৪০ রোল ফিল্ম জোগাড় করে তিনি ভারতে চলে আসেন। ৮ ডিসেম্বর তিনি বাংলাদেশে এসে পৌঁছান। এরপর ১৬ তারিখ বিজয় অর্জন পর্যন্ত কিশোর ছিলেন বাংলায়। এই সময়ের মাঝেই তিনি ৬৭টি অসাধারণ ছবি সংগ্রহ করেছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এত কম সময়ে এত সফল ফটোগ্রাফি আর কেউ করেননি।

 

পিটার অরনেট

যুদ্ধ সাংবাদিক পিটার অরনেট যুদ্ধের অসাধারণ সব ছবি তোলার জন্য সারা বিশ্বেই বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব। তিনি নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় সাংবাদিক। ভিয়েতনাম যুদ্ধ চলাকালীন তিনি মৃত্যুভয়কে পেছনে ঠেলে অসাধারণ সব ছবি তুলে আনেন। কাজের ক্ষেত্রে তার অসীম সাহসিকতা সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়। বিরল মুহূর্তগুলোকে ক্যামেরায় তুলে আনার ক্ষেত্রে তিনি অদম্য মেধা ও সাহসের পরিচয় দেন। প্রথম পারস্য উপসাগরীয় যুদ্ধের সময়ও তিনি সাহসিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। পিটার অরনেটের সবচেয়ে বড় সাফল্য আসে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পাঠানো অসাধারণ ছবিগুলো থেকে। এই ছবিগুলোকে এখনো বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত যুদ্ধছবি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। একজন যুদ্ধ সাংবাদিক হিসেবে পিটার অরনেটের সুনাম তাই দুনিয়াব্যাপী। ভিয়েতনাম যুদ্ধে তার ব্যতিক্রমী কাজের জন্য তিনি ১৯৬৬ সালে পুলিৎজার পুরস্কার লাভ করেন। তার জš§ ১৯৩৪ সালের ১৩ নভেম্বর নিউজিল্যান্ডের এভারটনে। যুদ্ধকালীন ফটো সাংবাদিকতার অন্যতম খ্যাতিমান ব্যক্তিদের তালিকায় স্থান পাওয়ার গল্প কারও অজানা নয়। বিশেষ করে ভিয়েতনাম যুদ্ধে তার তোলা ছবিগুলো সারা বিশ্বের মানুষের মাঝে যুদ্ধের ভয়ঙ্কর যে চিত্র তুলে ধরে সেটা ইতিহাসে চির অমলিন।

 

উইলফ্রেড ব্রুচেট

সর্বকালের সেরা সাংবাদিকের তালিকায় উইলফ্রেড ব্র“চেটের অবস্থান চতুর্থ। মজার ব্যাপার হলো-দুনিয়া কাঁপানো এই সাংবাদিক তার প্রথম জীবনে অনেক সংগ্রাম করেছেন। এমনকি ভ্যাকুয়াম ক্লিনার ও সেলসম্যানের কাজও করেছেন। ‘ডেইলি এক্সপ্রেস’ ছিল তার জীবনের প্রথম পত্রিকা, যার মাধ্যমে তিনি তার সাংবাদিকতার ক্যারিয়ার শুরু করেন। প্রথম সাংবাদিক হিসেবে হিরোশিমায় পারমাণবিক বোমার ভয়াবহ ক্ষতির চিত্র কভার করেন ব্র“চেট। বিশ্বজুড়ে তার এই কাজ দারুণ সাড়া ফেলে। ব্র“চেটের জš§ ১৯১১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর অস্ট্রেলিয়ায়। ১৯৮৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর এই খ্যাতিমান সাংবাদিক দুনিয়া থেকে বিদায় নেন।

 

 

সর্বশেষ খবর