বুধবার, ১৮ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনাতঙ্ক

রকমারি ডেস্ক

করোনাতঙ্ক

মহামারী, বিশ্বজুড়ে উৎকণ্ঠা

এরই মধ্যে করোনাকে মহামারী ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সারা বিশ্বে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে। আর এর প্রভাব পড়েছে মানুষের জীবনযাত্রায়। চীন থেকে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসে দুনিয়াজুড়ে মৃতের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। আন্তর্জাতিক জরিপ সংস্থা ওয়ার্ল্ড ওমিটারস ডট ইনফো’র হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশ সময় ১৭ মার্চ সকাল পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে এ ভাইরাসে সাত হাজার ১৭৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা এক লাখ ৮৩ হাজার ৬৫ জন। চিকিৎসা গ্রহণের পর সুস্থ হয়ে উঠেছে ৭৯ হাজার ৮৯১ জন। উৎপত্তিস্থল চীনে সরকারি হিসাবেই এখন পর্যন্ত এ ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ৮০ হাজার ৮৮১। এর মধ্যে তিন হাজার ২২৬ জনের মৃত্যুর কথা স্বীকার করেছে দেশটির কর্তৃপক্ষ। চিকিৎসা গ্রহণের পর সুস্থ হয়ে উঠেছে ৬৮ হাজার ৬৮৮ জন। ইতালিতে আক্রান্তের সংখ্যা ২৭ হাজার ৯৮০। এর মধ্যে ২ হাজার ১৫৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। চিকিৎসা গ্রহণের পর সুস্থ হয়ে উঠেছে ২ হাজার ৭৪৯ জন। ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় উপরের সারিতে থাকা অন্য দেশগুলোর মধ্যে ইরান, দক্ষিণ কোরিয়া, স্পেন, জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, সুইজারল্যান্ড ও যুক্তরাজ্যের নাম উল্লেখযোগ্য।

ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ইতালিতে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে প্রায় সব দোকানপাট। ভারতও প্রায় সব ধরনের ভিসা বন্ধ করেছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, করোনাভাইরাস মহামারীর জের ধরে শিগগিরই বিশ্ব অর্থনীতিতে ঘনিয়ে আসতে পারে বিপর্যয়। শুরু হতে পারে ভয়াবহ মন্দা।

 

 

প্লেগ থেকে করোনা

—————————

রোগের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব

প্রাকৃতিকভাবে নয়, যুক্তরাষ্ট্র কিংবা চীনের গবেষণাগারেই তৈরি হয়েছে করোনা। এমন গুজব হরহামেশাই ছড়াচ্ছে। কেবল করোনা নয়, যুগে যুগে বিশ্বব্যাপী ছড়ানো সব মারণব্যাধি নিয়েই এমন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বিস্তার লাভ করেছে।

 

প্লেগের কারণ ইহুদিরা

১৪ শতকে ইউরোপে প্লেগ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে। এর উৎপত্তি সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকলেও সারা বিশ্বে গুজব ছড়িয়ে পড়ে ইহুদিরা পরিকল্পিতভাবে এই রোগ ছড়িয়েছে। প্লেগের পেছনে ইহুদিদের দায়ী করে বিভিন্ন জায়গায় তাদের ওপর নির্যাতন শুরু হয়। জোরপূর্বক উচ্ছেদও করা হয় অনেককে।

 

স্প্যানিশ ফ্লু জার্মানির অস্ত্র

১৯১৮ থেকে ১৯২০ সালে স্প্যানিশ ফ্লু প্রায় আড়াই কোটি থেকে পাঁচ কোটি মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়। ১৯৩০ সাল পর্যন্ত এই ভাইরাসের উদ্ভব রহস্য হয়েছিল। অনেকে মনে করতেন জার্মান সেনাবাহিনী অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের জন্য এই জীবাণু আবিষ্কার করে।

 

এইডস ছড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র

১৯৮০-র দশকে যুক্তরাষ্ট্রে এইডস ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে ১৯৮৩ সালে গুজব ছড়ায় ফোর্ট ড্রেট্রিক-এ জীবাণু অস্ত্র হিসেবে মার্কিনিরা এইচআইভি উদ্ভাবন করেছিল, যা পরবর্তীতে প্রয়োগ করা হয় বন্দী, সংখ্যালঘু আদিবাসী সম্প্রদায় এবং সমকামীদের ওপর। এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বটি আজও জনপ্রিয়।

 

 

ইবোলার দায় যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের

নব্বইর দশকে এইডস অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসতে শুরু করে। কিন্তু এ সময় আফ্রিকায় নতুন করে ইবোলা ছড়িয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্র এইডস ছড়িয়েছে এমন ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকরা এবার দাবি করল ইবোলার জন্যও তারাই দায়ী। এবার সঙ্গে জড়ানো হয় ব্রিটেনকে।

 

পেন্টাগনের পোকা প্রকল্প

২০১৯ সালে রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান ক্রিস স্মিথ দাবি করেন পেন্টাগন এঁটেল পোকাসহ বিভিন্ন কীটের মাধ্যমে জীবাণু অস্ত্র তৈরির প্রকল্প চালিয়েছে। এই গবেষণা চলেছে ১৯৫০ সাল থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে।

 

কোভিড-১৯ কৃত্রিমভাবে ছড়ানো

বিভিন্ন রোগের কারণ হিসেবেই যুক্তরাষ্ট্রের গোপন জীবাণু অস্ত্র কর্মসূচির কথা বারবার সামনে আসে। তেমনি দাবি নভেল করোনাভাইরাস চীনের কোনো গবেষণাগারে কৃত্রিম উপায়ে তৈরি করা হয়েছে। সেখান থেকেই তা পরে সারা বিশ্বে ছড়িয়েছে। কারও কারও দাবি যুক্তরাষ্ট্রই এটি তৈরি করে চীনে পাঠিয়েছে। যদিও এর পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই।

 

 

করোনায় যেভাবে মৃত্যু হয়

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কিছু রোগী ‘সেপসিস’ পরিস্থিতিতে পড়ে মারা যাচ্ছে। ‘সেপসিস’ এমন একটি অবস্থা যখন প্রাণঘাতী কোনো জীবাণু একজন মানুষের দেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। এর ফলে শরীরের টিস্যুর ক্ষতি, বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিকল হওয়া এবং সবশেষে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে থাকে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ল্যানসেট ম্যাগাজিনে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে এক চতুর্থাংশ মৃত্যুর কারণ ‘সেপসিস’ বা ‘রোগপ্রতিরোধহীনতা’। ২০১৭ সালে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে মারা গেছেন চার কোটি ৮৯ লাখ মানুষ।

ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, এইডসের মতো রোগীদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা লোপ পাওয়ার আশঙ্কা থাকে। করোনাভাইরাসের মৃত্যুরও বড় কারণ সেপসিস পরিস্থিতি।

আগে থেকেই বিভিন্ন রোগাক্রান্তরা এই ঝুঁকিতে সবচেয়ে বেশি থাকছেন। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চীনে করোনাভাইরাসে যারা মারা গেছেন তাদের মধ্যে তেরো দশমিক দুই ভাগই হৃদরোগে ভুগছিলেন। নয় দশমিক দুই ভাগের ডায়াবেটিস ছিল। আট দশমিক চার ভাগের ছিল উচ্চ রক্তচাপ। আট ভাগের দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসকষ্ট আর সাত দশমিক ছয় ভাগের ছিল ক্যান্সারের সমস্যা। ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া অথবা ছত্রাক বিভিন্ন অণুজীব সেপসিস পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। এর পেছনে যেসব রোগ ভূমিকা রাখে তার মধ্যে রয়েছে নিউমোনিয়া, ক্ষত সংক্রমণ, মূত্রনালির সংক্রমণ। পাশাপাশি ইনফ্লুয়েঞ্জাসহ অন্যান্য মৌসুমি ভাইরাস; যেমন করোনাভাইরাস, ইবোলা, ইয়েলো ফিভার, ডেঙ্গু, সোয়াইন ফ্লু অথবা বার্ড ফ্লু ভাইরাসও রোগীর রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাকে নষ্ট করে দিতে পারে। শরীরের কিছু পরিবর্তনও এক্ষেত্রে দায়ী হতে পারে। রক্ত চাপ কমে যাওয়া ও সেই সঙ্গে হৃৎস্পন্দন বৃদ্ধি পাওয়া, জ্বর, ঘন ঘন শ্বাস নেওয়া, হঠাৎ প্রচ- অসুস্থবোধ হওয়া; এমন সব পরিস্থিতিও সেপসিসের লক্ষণ। অনেক ক্ষেত্রেই রোগীর এমন পরিস্থিতি ধরা পড়ে দেরিতে। এক্ষেত্রে রোগীকে হাসপাতালে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতে হয়। নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা, শরীরে রক্ত সঞ্চালন ব্যবস্থা ও ‘ভেন্টিলেশন’ নিশ্চিত করতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে রোগীকে কৃত্রিম কোমায় রাখা হয়। রোগীর অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সচল রাখতে দিতে হয় বিভিন্ন থেরাপি। করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রেও সেপসিসের কারণেই সবার মৃত্যু হচ্ছে।

তাই সেপসিস যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসা করানোই উত্তম। যত আগে তা ধরা পড়বে এবং চিকিৎসা করানো হবে তত বেঁচে

থাকার সম্ভাবনা বাড়বে।

 

একবার হলে দ্বিতীয়বার হতে পারে?

করোনাভাইরাস কারও একবার হলে আবার তার হওয়ার আশঙ্কা থাকে কি না, অনেকেরই এ প্রশ্ন। এর সংক্রমণ থেকে পুরোপুরি মুক্তির উপায় নিয়েও চিন্তার শেষ নেই। সম্প্রতি যুক্তরাজ্য সরকারের প্রধান বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা স্যার প্যাট্রিক ভ্যালান্স ও বরিস জনসনের প্রধান চিকিৎসক ক্রিস হুইটি জনসাধারণকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছেন। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ভাইরাস একবার যাদের আক্রমণ করে, তাদের কিছুটা সংক্রমণরোধী ক্ষমতা তৈরি হয়। এতে আবার তাদের সংক্রমণ ঘটনার ঘটনা বিরল। দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত মাসে জাপানের কর্তৃপক্ষ এক রোগীর করোনাভাইরাস থেকে সেরে ওঠার পর আবার ভাইরাস সংক্রমণের লক্ষণ জানালে এ নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়। বিজ্ঞানীরা এই সংবাদ শুনে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। তারা যথেষ্ট অস্বস্তিতেও পড়েন।

যুক্তরাজ্যের লিডস ইউনিভার্সিটির ভাইরোলজি বিশেষজ্ঞ মার্ক হ্যারিস বলেন, জাপানের ওই ঘটনার ক্ষেত্রে পুনরায় রোগ সংক্রমণের ঘটনাটির মতো ঘটনা খুবই কম ঘটে। তবে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রাণীর (বাদুড়) করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে ক্রমাগত সংক্রমণের কিছু প্রমাণ রয়েছে।

গার্ডিয়ান জানিয়েছে, ভ্যালান্সকে জাপানের ওই ঘটনার উদাহরণ দিয়ে প্রশ্ন করা হয়, অনেক মানুষের ক্ষেত্রে পুরোপুরি প্রতিরোধী হয়ে ওঠার বিষয়টি অর্জনযোগ্য নয় বলেই দেখা যাচ্ছে। এর জবাবে যুক্তরাজ্যের এ বিশেষজ্ঞ বলেন, কিছু লোক দ্বিতীয়বার সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়। তবে এটি একটি বিরল ঘটনা। এটি করোনাভাইরাসে ঘটবে, তার কোনো প্রমাণ দেখা যায়নি।

অধ্যাপক হুইটি ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, রোগে দীর্ঘমেয়াদি প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি না হলেও কিছুটা স্বল্পমেয়াদি ক্ষমতা তৈরি হয়। ব্রাইটন এবং সাসেক্স মেডিকেল স্কুলের সংক্রামক রোগের ইমেরিটাস অধ্যাপক জন কোহেন বলেছেন, ‘করোনাভাইরাস দুবার হওয়ার আশঙ্কা থাকে কি না, এ প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে, আমরা এখন পর্যন্ত জানি না। কারণ, আমরা এখন পর্যন্ত সংক্রমণের বিরুদ্ধে কোনো অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করে দেখিনি। তবে আমরা শিগগিরই তা পরীক্ষা করে দেখব।’ জন কোহেন বলেন, অন্যান্য ভাইরাল সংক্রমণের ওপর ভিত্তি করে বলা যায়, একবার কেউ সংক্রমিত হলে তারা সাধারণত প্রতিরোধী হয়ে ওঠে এবং পরে আর তাদের সংক্রমণ ঘটে না। তবে সব সময় এর ব্যতিক্রম থাকবে। তবে এটি অবশ্যই যুক্তিসংগত প্রত্যাশা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর