শিরোনাম
শুক্রবার, ২৭ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা
করোনার সঙ্গে লড়াই

হোটেল যখন হাসপাতাল

আবদুল কাদের

হোটেল যখন হাসপাতাল

বিশ্বব্যাপী চলছে করোনাভাইরাসের তান্ডব। করোনায় আক্রান্ত রোগীর চাপ সামলাতে বিলাসবহুল হোটেল, রেস্তোরাঁ, ক্যাফেগুলো হয়েছে অস্থায়ী হাসপাতাল। এসব হাসপাতালে যুক্ত করা হয়েছে আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম। চিকিৎসকদের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে সেবা দিয়ে যাচ্ছে সেনাবাহিনীও।

 

বর্তমান বিশ্বের মহামারী COVID-19 বা করোনাভাইরাস। উৎপত্তিস্থল চীন হলেও বিশ্বের অন্তত ১৯৮টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে এ ভাইরাস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) বিবৃতি মতে, করোনাভাইরাস কভিড-১৯ অতি দ্রুত সংক্রমিত হয়। ফলে বিশ্বে আক্রান্তের সংখ্যাও বেশি। বিশ্বের অনেক দেশে চিকিৎসার স্থান অর্থাৎ হাসপাতালগুলোতে ইতিমধ্যে দেখা দিয়েছে বেড সংকট। ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ হোটেলগুলোকে হাসপাতালে রূপান্তরিত করছে। যদিও হোটেলগুলোকে হাসপাতালে পরিণত করার পথ দেখায় ভাইরাসটির উৎপত্তিস্থল চীন। সেই পথেই হাঁটছে পরবর্তীতে আক্রান্ত হওয়া দেশগুলো। দেশটির করোনা ছড়িয়ে পড়ার প্রধান কেন্দ্র উহান শহরে শুরু থেকে এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়। শহরটির সব হোটেলকে চীন সরকার হাসপাতালে পরিণত করে। সেখানে আধুনিক সব চিকিৎসা সরঞ্জাম ও চিকিৎসকদের নিয়োগ দিয়ে স্থানটিকে হাসপাতালে পরিণত করা হয়। পরবর্তী সময়ে স্পেন, ইরান, ফ্রান্স, পর্তুগাল, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অনেক বড় বড় শহর একই উদ্যোগ নেয়। তবে এসব শহরের হোটেলগুলো বাণিজ্যিকভাবে ভাড়া নিয়ে হাসপাতালে পরিণত করার সিদ্ধান্ত নেয় দেশগুলোর সরকার। অনেক দেশের হোটেল মালিক এবং আতিথেয়তা সংস্থাগুলো মহামারী পরিস্থিতি সামাল দিতে নিজ উদ্যোগে হোটেল কক্ষ দিচ্ছেন স্থানীয় সরকার এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে। অনেক দেশ খোলা আকাশের নিচে কিংবা স্টেডিয়ামে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। ব্রাজিলের ২০টি ক্লাব তাদের স্টেডিয়ামকে অস্থায়ী হাসপাতাল বানানোর জন্য স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেছে। এ ছাড়া, ব্রাজিলের সাও পাওলোয় ২০০ শয্যার অস্থায়ী হাসপাতাল নির্মাণের কাজও চলছে। একইভাবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের একটি স্টেডিয়ামও অস্থায়ী হাসপাতালে রূপান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন স্থানীয় সরকার। এদিকে ভাইরাসটির উৎপত্তিস্থল চীনের সীমান্তঘেঁষা রাশিয়ায় এখনো ভয়াবহ আকার ধারণ করেনি কভিড-১৯। তবুও দেশটিতে প্রস্তুতির কমতি নেই। বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণে চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। একইভাবে করোনা রোগী না থাকা সত্ত্বেও প্রাদুর্ভাব মোকাবিলার প্রস্তুতি হিসেবে নেপালের সেনাবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ে কোয়ারেন্টাইন-জোন তৈরি করা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার এর মধ্যে সেনাবাহিনীর সহায়তায় উত্তরা ফ্ল্যাট প্রকল্পসহ কয়েকটি স্থানে প্রবাসীসহ অনেককে কোয়ারেন্টাইনে রাখার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে।

স্পেন

প্রাণঘাতী করোনায় ইতালির পর ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ স্পেন। দেশটিতে সর্বশেষ আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৪৯ হাজার ৫১৫ জন। প্রতি ঘণ্টায় সংক্রমণ এবং মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকায় স্পেন সরকার চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করে স্পেন সরকার। কয়েক দিনের ব্যবধানে দেশটির জনপ্রিয় রেস্তোরাঁগুলো এখন পরিণত হয়েছে অস্থায়ী হাসপাতালে। স্পেনের মাদ্রিদ শহরে তৈরি করা হচ্ছে অস্থায়ী এমন বহু হাসপাতাল। স্পেনের প্রথম হোটেল হিসেবে গ্র্যান হোটেল কোলোনকে হাসপাতালে রূপান্তরিত করা হয়েছে; যা স্পেনের রাজধানীর অন্যতম বৃহত্তম গ্রেগরিও ম্যারাওঁ হাসপাতাল থেকে মাত্র ১০ মিনিটের দূরত্বে অবস্থিত। এ ছাড়া রাজধানী মাদ্রিদের ম্যারিওট অডিটোরিয়াম হোটেলসহ আরও প্রায় ৪০টি হোটেলকে অস্থায়ী হাসপাতালে পরিণত করার প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে। এগুলো হাসপাতালে রূপান্তরিত হলে প্রায় ৯ হাজার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী ভর্তি করা সম্ভব হবে।

ইরান

ইরান COVID-19 -এ আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা দুই হাজার ছাড়িয়েছে। সমগ্র বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্তে মৃত্যুর সংখ্যায় ইতালি, স্পেন, চীনের পরেই ইরানের অবস্থান। পরিস্থিতি মোকাবিলায় ইরান সরকার এবং ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। দেশটিতে কভিড-১৯  আক্রান্তের চাপ বেড়ে যাওয়ায় সেনাবাহিনী বিভিন্ন প্রদেশে অস্থায়ী হাসপাতাল নির্মাণ করছে। ইতিমধ্যে রাজধানী তেহরানের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা এলাকায় ২০০০ বেডের অস্থায়ী হাসপাতালে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিতে ইরানের শপিং মলগুলো খালি করে তৈরি করা হয়েছে বিশেষায়িত হাসপাতাল। এসব হাসপাতালে ভেন্টিলেশনসহ আধুনিক সরঞ্জামের পাশাপাশি বাড়ানো হয়েছে আইসিইউ ব্যবস্থা। ইরানের শপিং মল ইরান মলের প্রধান আলী আনসারি বলেন, করোনাভাইরাস মোকাবিলায় চীনের পদক্ষেপ শিক্ষণীয়। চীনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আমরাও অস্থায়ী হাসপাতাল নির্মাণ করছি।

 

ফ্রান্স

বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসের নাকাল ফ্রান্স। দেশটিতে বাড়ছে আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা। ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবিলায় একরকম যুদ্ধ ঘোষণা করেছে ম্যাক্রোঁ সরকার। এ জরুরি অবস্থায় অস্থায়ী হাসপাতাল নির্মাণসহ সব ধরনের সহযোগিতায় মাঠে নেমেছে দেশটির সেনাবাহিনী। হাসপাতাল ও আশপাশের ভবনের খোলা আকাশের নিচেও তৈরি করা হচ্ছে করোনাভাইরাসের চিকিৎসা কেন্দ্র। ফ্রান্সের নগর ও গৃহায়ণের দায়িত্বে থাকা মন্ত্রী জুলিয়েন ডেনারম্যান্ডি মহামারী পরিস্থিতি মোকাবিলায় হোটেল মালিকদের কাছে হোটেলের কক্ষের অনুরোধ করেন। ইউরোপের বৃহত্তম আতিথেয়তা সংস্থা অ্যাকর ফ্রান্সে নার্সিং স্টাফ, গৃহহীনসহ যে কোনো ব্যক্তির জন্য এর ৪০টি হোটেল খোলে। যেখানে প্রায় ৬০০ আলাদা কক্ষের ব্যবস্থা রয়েছে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বলেন, আগামী এক মাস আমাদের জন্য কঠিন সময়। এ সময় সবার সমন্বয় এবং সহযোগিতা প্রয়োজন।

 

যুক্তরাষ্ট্র

যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্যের সব কটিতেই হানা দিয়েছে ভয়ানক করোনাভাইরাস। প্রতিদিনই বাড়ছে করোনা আক্রান্ত রোগী এবং মৃতের সংখ্যা। এমন সংকটাপূর্ণ পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য সচিব বলেন, সারা দেশে খালি হোটেলগুলো হাসপাতালে চিকিৎসা দিতে আনা রোগীদের চাপ কমিয়ে আনতে সহায়তা করবে। সে লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বড় শহর নিউইয়র্কের হোটেলগুলোকে পর্যায়ক্রমে হাসপাতালে পরিণত করার উদ্যোগ নিয়েছে স্থানীয় সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে তারা দেড় হাজার কক্ষ ভাড়া নিয়ে হাসপাতাল তৈরির জন্য হোটেল মালিকদের সঙ্গে চুক্তি করেছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে শুধু নিউইয়র্ক শহরে এক লাখ ১০ হাজার শয্যার প্রয়োজন হতে পারে। নিউইয়র্কের আরও তিনটি হোটেলের আংশিক নিয়ে ২৫০টি কক্ষকে হাসপাতালের শয্যায় পরিণত করেছে। অন্যদিকে ক্যালিফোর্নিয়া, কিং কাউন্টি এবং ওয়াশিংটনে অস্থায়ী হাসপাতালের জন্য হোটেল স্পেস ক্রয় এবং লিজ দিচ্ছে সেখানকার হোটেল কর্তৃপক্ষ। পেন্টাগন বলছে, করোনার এ মহামারী যুক্তরাষ্ট্রে অন্তত সাত মাস থেকে যেতে পারে। জুন-জুলাইয়ের আগে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরছে না যুক্তরাষ্ট্র।

 

যুক্তরাজ্য

যুক্তরাজ্যে দ্রুত সংক্রমিত হচ্ছে করোনাভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা। সেই সঙ্গে বাড়ছে মৃত্যু মিছিলও। ইতিমধ্যে দেশটিতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা ৪৬৫ জনে পৌঁছেছে। এমন সংকটময় মুহূর্তে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় প্রয়োজন অস্থায়ী হাসপাতাল। সে কথা ভেবেই যুক্তরাজ্য সরকার পূর্ব লন্ডনের এক্সেল সেন্টারকে প্রায় ৪ হাজার শয্যাবিশিষ্ট অস্থায়ী হাসপাতালে রূপান্তরের দিকে নজর দিচ্ছে। যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি দল এই ১১ হাজার বর্গমিটারের এ প্রদর্শনী স্থানটি পরিদর্শন করেছে। যুদ্ধকালীন সময়ে মোবাইল হাসপাতাল স্থাপনে সশস্ত্র বাহিনীর অনেক অভিজ্ঞতা রয়েছে। অপরদিকে দুটি বিশাল প্রমোদতরীকে অস্থায়ী হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহার করার কথাও ভাবছে যুক্তরাজ্য সরকার। ইতিমধ্যেই দেশটির সরকারের কাছে এ প্রস্তাব পাঠিয়েছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম জানায়, স্প্রিট অব ডিসকভারি ও সাগা স্যাফায়ার নামে দুটি প্রমোদতরী টেমস নদীতে নোঙর করা আছে। দেশটিতে কভিড-১৯ রোগী হাসপাতালের ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি হয়ে গেলে এ দুটি জাহাজ ভাসমান হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। তবে এ বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর