শনিবার, ২৮ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

যুদ্ধক্ষেত্রে জীবাণুর যন্ত্রণা

২৬ মার্চ ১৯৭৫-এ বিশ্বের প্রায় সব দেশ ‘বায়োলজিক্যাল ওয়েপন কনভেনশন’ স্বাক্ষর করে এবং কখনো জীবাণু ব্যবহার করে মানুষ হত্যা বা শত্রু ধ্বংস না করার অঙ্গীকার করে। এর ঠিক ৪৫ বছর পর গত ২৪ মার্চ আমেরিকার আদালতে চীনের উহান প্রদেশে বায়োলজিক্যাল ওয়েপন করোনাভাইরাস ব্যবহার এবং সেখান থেকে বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের বিস্তার ঘটার অভিযোগ দায়ের করা হয়। ২০ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণও দাবি করা হয় চীনের কাছে। এমন এক প্রেক্ষাপটে বায়োলজিক্যাল ওয়েপন বা জীবাণু-অস্ত্রের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

 

ইতিহাসের পাতা থেকে

মানবসভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই পশু ও মানুষ হত্যার জন্য বিষ প্রয়োগের ঘটনা ঘটতে থাকে। তবে বিষের মাধ্যমে শত্রু নিধনে শুরুর সঠিক তারিখ বা সময় নির্ধারণ কষ্টসাধ্য। কারণ প্রাচীনকালের অনেক যুদ্ধের ইতিহাস যথাযথভাবে সংরক্ষিত হয়নি। আবার ইতিহাস বিকৃতিও ঘটেছে বহু ক্ষেত্রে। বিষয়টিকে আরও জটিল করেছে বিষ ও জীবাণুর সম্মিলিত ব্যবহার। ধারা যাক ১১৫৫ সালের কথা। সে সময় ইতালির রোমের পবিত্র সম্রাট ছিলেন ফ্রিডেরিক বারবারোসা। নিজ যোগ্যতা ও দাপটের কারণে জার্মানিসহ আশপাশের বহু অঞ্চল তাকে রাজা বা সম্রাট হিসেবে মেনে নেয়। কথিত আছে শত্রু নিধনের জন্য তিনি ইতালিতে পানির কূপে মৃত মানবদেহ ফেলে রাখতেন। সেই পানিতে জীবাণু জন্মাত এবং এই পানি ব্যবহার করে প্রাণ হারাত তার শত্রুরা। ১৩৪৬ সালে কৃষ্ণসাগর পরিবেষ্টিত ক্রিমিয়ার পানির কূপে মঙ্গলরা প্লেগ আক্রান্ত রোগীর দেহ ফেলে দিত শত্রুদের ঘায়েল করার জন্য। ফরাসি শত্রুদের শায়েস্তা করার জন্য ১৪৯৫ সালে স্পেনের ছদ্মবেশী ব্যবসায়ীরা মদে কোষ্ঠ রোগীদের রক্ত মিশিয়ে ফরাসিদের পরিবেশন করত। ১৬৫০ সালে পোল্যান্ডে শুরু হয় গুলির সঙ্গে পাগলা কুকুরের থুথু বা লালা মিশিয়ে শত্রুর দিকে ছোড়া। ১৭৬৩ সালে ব্রিটেনে ঠাঁই নেওয়া আমেরিকানদের মাঝে বণ্টন করা হয় গুটি বসন্তে আক্রান্ত রোগীদের কম্বল।

ফরাসি সম্রাট এবং বিশ্ব কাঁপানো সেনানায়ক লেপোলিয়ন বোনাপাট ইতালির মান্তোয়া এলাকায় ১৭৯৭ সালে তার শত্রুদের মধ্যে ম্যালেরিয়া ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। তাই পুরো এলাকা পানিতে ডুবিয়ে মশার বিস্তার ঘটিয়েছিলেন। আমেরিকার গৃহযুদ্ধের একপর্যায়ে ১৮৬৩ সালে কনফেডারেটস নামে পরিচিত বাহিনী ইয়েলো ফিডার ও গুটিবসন্তে আক্রান্ত রোগীদের কাপড় বিক্রি করত তাদের শত্রু ইউনিয়ন ট্রুপসদের মাঝে। হুমায়ূন আহমেদের ‘আগুনের পরশমণি’ সিনেমার একটি দৃশ্যে চা বিক্রেতা সালেহ আহাম্মেদকে দেখা যায় নিজের থুথু চায়ে মিশিয়ে পাকিস্তানিদের পরিবেশন করতে।

জানা যাক জীবাণু  অস্ত্র সম্পর্কে

পরিকল্পিতভাবে জীবাণু প্রয়োগ বা জীবাণুর বিস্তার ঘটিয়ে শত্রুদের ঘায়েল করার কৌশলকে ইংরেজিতে ‘বায়োলজিক্যাল ওয়ার’ বা জীববিদ্যা সম্পর্কিত যুদ্ধ বলা হয়। সংক্ষেপে যাকে জৈবযুদ্ধ বলা যায়। আর যে প্রক্রিয়ায় তা প্রয়োগ বা ছড়ানো হয়, তা পরিচিত হয়েছে বায়োলজিক্যাল ওয়েপন বা জীববিদ্যা সম্পর্কিত অস্ত্র, তথা জৈব বা জীবাণু অস্ত্র নামে ফেডারেশন অব আমেরিকান সায়েন্টিস্টস’-এর মতে বায়োলজিক্যাল ওয়েপন ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার মতো অতি ক্ষুদ্র বিষাক্ত জীবাণু ছড়ায় যার ফলে মানুষের মাঝে রোগ ও সংক্রমণের বিস্তার ঘটে। মানুষ ছাড়াও পশুপাখি, গাছপালা, মাঠের ফসল, জলাশয়ের পানি প্রভৃতির ভিতরেও বায়োলজিক্যাল ওয়েপন ক্ষতিকর জীবাণুর বিস্তার ঘটাতে পারে। যুদ্ধক্ষেত্র বা পরিকল্পিত এলাকায় এভাবে জীবাণু প্রয়োগের ফলে মানুষ, পশুপাখি, মাছ প্রভৃতির মধ্যে দ্রুত রোগ ছড়ানো, অস্বস্তি সৃষ্টি করা এমনকি গণহারে মৃত্যু ঘটানো সম্ভব। এ ছাড়া গাছ মড়ক বা মাঠের ফসলত্ব নষ্ট হতে পারে বায়োলজিক্যাল ওয়েপন ব্যবহার করার ফলে। ২০০১ সালে আমেরিকায় উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদদের কাছে পরিকল্পিতভাবে ‘অ্যানথ্রাক্স নামক জীবাণু মিশ্রিত চিঠি পাঠানোর ঘটনা উদঘাটন করে সে দেশের বিজ্ঞানীরা। এই আনথ্রাক্স আক্রমণে আমেরিকার ২২ জন ভিআইপি আক্রান্ত হন, যাদের মধ্যে পাঁচজনই মারা যান। পরবর্তীতে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার সংগ্রহে বায়োলজিক্যাল ওয়েপন থাকার তথ্য প্রকাশিত হলে নড়েচড়ে ওঠে সারা বিশ্ব। এ তথ্য গ্রহণযোগ্যতা পায় একটি চিঠির ভাষায়, যেখানে লেখা ছিল, ‘তোমরা আমাদের থামাতে পারবে না। আমাদের রয়েছে অ্যানথ্রাক্স। তোমরা এবার মরো, তোমরা কি ভিতু? আমেরিকার মৃত্যু চাই। ইসরায়েলের মৃত্যু চাই। আল্লাহ মহান’ ইত্যাদি।

যেভাবে যাত্রা জাপান থেকে

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কৌশল হিসেবে বায়োলজিক্যাল ওয়েপন বা জীবাণু প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়। এ প্রক্রিয়ার শুরু হয় জাপানি বায়োলজিক্যাল ওয়েপনের জনক শিরো ইশির হাত ধরে। ১৯৩০ সালে তিনি জাপানের আর্মি মেডিকেল কলেজে বায়োলজিক্যাল ওয়েপন অর্থাৎ জীবাণু দিয়ে শত্রু ধ্বংসের ওপর গবেষণা শুরু করেন এবং পরবর্তীতে জাপানের ‘বায়োওয়েপন প্রোগ্রাম’-এর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার অধীনে জাপানের ২৬টি কেন্দ্রে পাঁচ হাজার বিজ্ঞানী, চিকিৎসক ও অন্যান্য কর্মী কাজ করতেন। পরীক্ষার জন্য এ গবেষণা কেন্দ্র ২৫ ধরনের জীবাণু প্রয়োগ করে জেলখানায় বন্দী শত্রুপক্ষের কয়েদিদের ওপর। এতে ২৬টি কেন্দ্রের মধ্যে মাত্র একটি কেন্দ্রের পরীক্ষায় ৬০০ কয়েদির মৃত্যু ঘটে। অবশিষ্ট সব তথ্য গোপন করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে জাপানিরা চীনের এক হাজারেরও বেশি পানির কূপে কলেরা এবং ‘টাইফাস ফিভার’ নামক এক ধরনের জ্বরের জীবাণু ছেড়ে দেয় বলে তথ্য রয়েছে যা অস্বীকার করা হয়। প্লেগ রোগের জীবাণু ভর্তি বোমা ছোড়া হয় শহর এলাকা ও ধানখেতে। এসব জীবাণু বছরের পর বছর রোগ ছড়ায় চীনে। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলেও পরের বছরগুলোতে বিস্তার করতে থাকে এসব রোগ এবং ১৯৪৭ সালে চীনে এসব সংক্রমণ রোগে ৩০ হাজার মানুষ প্রাণ হারান। জীবাণু বোমার জাপানি জনক শিরোইশি সোভিয়েত ইউনিয়নেও একইভাবে জীবাণু অস্ত্র প্রয়োগ করে। এতে উভয় পক্ষেরই ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে। তবে সঠিক তথ্য গোপন করে উভয় পক্ষ। ১৯৯৫ সালে জাপানে ‘অম শিনরিকাইয়ো’ নামক এক উগ্রবাদী ধর্মীয় গোষ্ঠীর নাম সবার নজরে আসে। এ গোষ্ঠী বিশেষ উদ্দেশ্যে প্রথমে টোকিও শহরের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে অ্যানথ্রাক্স জীবাণু ছড়ায়। এতে সাফল্য না পেয়ে ১৯৯৫ সালে টোকিওর সাবওয়ে বা পাতাল পথে ‘শেরিন’ নামক এক প্রকার গ্যাস ছেড়ে দেয়। এতে ১২ জন যাত্রী মারা যান এবং পাঁচ হাজারেরও বেশি জাপানি অসুস্থ হন।

আড়ালে থাকে আমেরিকা

১৯৫১ সালে আমেরিকায় বসবাসরত আফ্রিকান বংশোদ্ভূতদের মাঝে গোপনে ছড়ানো হয় এক ধরনের ফাঙ্গাস। ভিয়েতনাম যুদ্ধে (১৯৫৫-১৯৭৫ সাল) অন্য মারণাস্ত্র এবং রাসায়নিক অস্ত্রের সঙ্গে বায়োলজিক্যাল ওয়েপন ব্যবহারের অভিযোগ ওঠে

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন অনেক জাপানি জীবাণু গবেষককে শাস্তি প্রদান করে। পক্ষান্তরে আমেরিকা গবেষণালব্ধ জ্ঞান ও তথ্য লাভের জন্য জাপানি জীবাণু গবেষকদের শাস্তির বদলে গোপনে লালন-পালন শুরু করে। ১৯৪১ সাল থেকে অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালেই আমেরিকা ‘বায়োলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার প্রোগ্রাম’ চালু করে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়া নাগাদ (১৯৪৫ সাল) প্রায় পাঁচ হাজার বিজ্ঞানী, ডাক্তার গবেষক ও কর্মী নিয়োগ করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে খোলা আকাশে, পশুর ওপর এবং কিছু স্বেচ্ছাসেবকের ওপর জীবাণু প্রয়োগ ও পরীক্ষা চালানো হয়। ১৯৫০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর আমেরিকার নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ আগুন নেভানোর কাজে ব্যবহৃত হোস পাইপের সান ফ্রান্সিসকোর আকাশে এক ধরনের জীবাণু ছেড়ে দেয় পরীক্ষার অংশ হিসেবে। সানফ্রান্সিস্কোর প্রায় আট লাখ জনগণ তখন এ বিষয়ে কিছুই জানতে পারেনি। বিশ্ববাসীও জানতে পারেনি এ পরীক্ষার ফলাফল। এভাবে আমেরিকা গোপনে ৩২৯টি পরীক্ষা চালায় বলে জানা যায়, পরবর্তীতে ১৯৬৬ সালের ৬ জুন নিউইয়র্কের সাবওয়ে বা পাতাল সড়কে ২১ সদস্যের একটি দল পরীক্ষামূলকভাবে পরপর কয়েকটি বৈদ্যুতিক ভাল্ব ভেঙে দেয়। এসব ভাল্বের প্রতিটির ওজন ছিল প্রায় ১৭৫ গ্রাম, যেখানে প্রায় ৮৭ ট্রিলিয়ন জীবাণু ভর্তি ছিল। বরাবরের মতো এ তথ্যও আড়াল করা হয় এবং এ সংক্রান্ত সব বিষয় গুজব বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়। ১৯৫১ সালে আমেরিকায় বসবাসরত আফ্রিকান বংশোদ্ভূতদের মাঝে গোপনে ছড়ানো হয় এক ধরনের ফাঙ্গাস। ভিয়েতনাম যুদ্ধে (১৯৫৫-১৯৭৫ সাল) অন্য মারণাস্ত্র এবং রাসায়নিক অস্ত্রের সঙ্গে বায়োলজিক্যাল ওয়েপন ব্যবহারের অভিযোগ ওঠে। একইভাবে কোরিয়ার যুদ্ধেও (১৯৫০-১৯৫৩ সাল) আমেরিকার বিরুদ্ধে বায়োলজিক্যাল ওয়েপন ব্যবহারের অভিযোগ করে চীন ও উত্তর কোরিয়া। কিন্তু কৌশলগত কারণে এসব কিছু আড়াল করে আমেরিকা।

 

কিউবার কান্না

পুঁজিবাদ তথা আমেরিকার বরাবরের শত্রু হিসেবে বিবেচিত হয় কমিউনিজমে বিশ্বাসী কিউবা। আমেরিকার সমুদ্রতীর থেকে মাত্র ৯০ মাইল দূরে আটলান্টিক সমুদ্রের অপর প্রান্তের দ্বীপ দেশ কিউবাকে নানাভাবে ঘায়েল করতে সচেষ্ট থাকে আমেরিকা। আমেরিকার বিরুদ্ধে কিউবা বায়োলজিক্যাল ওয়েপন ব্যবহারের অভিযোগ তুলেছে একাধিকবার, যা কখনো আমলে নেয়নি আমেরিকা। ১৯৬২ সালে কিউবার একটি গুদামভর্তি চিনিতে জীবাণু দিয়ে বিষাক্ত করার অভিযোগ ওঠে আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির (সিআইএ) বিরুদ্ধে। একই বছর (১৯৬২) কিউবায় কর্মরত কানাডার এক কৃষি কর্মকর্তা দাবি করেন, কিউবায় জনপ্রিয় টার্কি মুরগির উৎপাদন ব্যাহত করতে ‘নিউক্যাসেল ডিজিজ’ নামক রোগ ছড়াতে তাকে তৎকালীন পাঁচ হাজার মার্কিন ডলার দেওয়া হয়েছিল। তিনি রোগ ছড়াননি বলে দাবি করলেও পরবর্তী বছরগুলোতে কিউবায় টার্কি উৎপাদনে ব্যাপক ধস নামে নানাবিধ সংক্রামক রোগের কারণে। যার জন্য অভিযোগের তীর আমেরিকার দিকে। ১৯৭১ সালে কিউবার পশ্চিমাঞ্চলে দেখা দেয় ভয়াবহ ‘আফ্রিকান সোয়াইন ফিভার’। এ রোগের কারণে সংক্রমিত পাঁচ লাখ শূকর মেরে ফেলতে বাধ্য হয় কিউবা সরকার।

 কিউবার অর্থনীতি পঙ্গু করা এবং কিউবার কমিউনিস্ট নেতা ও প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রোর বিরুদ্ধে জনগণকে ক্ষেপিয়ে তুলতে সিআইএ আমেরিকার পানামা থেকে আফ্রিকান সোয়াইন ফিভারের জীবাণু পাঠায় এবং ছয় সপ্তাহের মধ্যে তা কিউবার পশ্চিমাঞ্চলে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ে বলে জানা যায়। ১৯৮১ সালে কিউবায় ডেঙ্গু রোগ ছড়িয়ে পড়লে তিন লাখ কিউবান আক্রান্ত হন এবং ১০১ জন শিশুসহ মোট ১৫৮ জন মৃত্যুবরণ করেন। এ রোগ বিস্তারের পেছনেও আমেরিকাকে দায়ী করে কিউবা। এ ছাড়া ফিদেল কাস্ত্রোকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুপ্তচরের মাধ্যমে তার প্রিয় চুরুটে (মোটা সিগারেট) বিষ মাখিয়ে তাকে পরিবেশনের একটি আমেরিকান চক্রান্ত ধরা পড়ে।

উহান নিয়ে উত্তপ্ত পরিস্থিতি

১৯৫৬ সালে চায়নিজ একাডেমি অব সায়েন্সেসের অধীনে উহান প্রদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘উহান মাইক্রোবায়োলজি ল্যাবরেটরি’। কালের বিবর্তনে এ প্রতিষ্ঠান ১৯৭৮ সালে ‘উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজি’ নাম ধারণ করে এবং জীবাণু, জীবাণুর বিস্তার ও জৈব নিরাপত্তা নিয়ে গবেষণা করতে থাকে। ২০০৫ সালে এ ইনস্টিউটসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠানের এক দল গবেষক তাদের গবেষণায় দেখতে পায় ঘোড়ার ক্ষুরের মতো দেখতে এক ধরনের বাদুড়ের শরীরে প্রকৃতিগতভাবে সার্স করোনাভাইরাস জমা হয়। গবেষকরা চায়নার বিভিন্ন অঞ্চলে এ ধরনের কয়েক হাজার বাদুড়ের ওপর পরীক্ষা এবং ৩০০টি বাদুড়কে খাঁচায় আলাদা করে বিষয়টি নিশ্চিত করেন। একই ইনস্টিটিউট ২০১৫ সালে এ করোনাভাইরাস মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর বর্ণনা করে গবেষণালব্ধ তথ্য প্রকাশ করে। এ মারাত্মক ভাইরাস কীভাবে দ্রুত বিস্তার ঘটায় এবং পরিমাণে বা সংখ্যায় বৃদ্ধি পায় বা হাইব্রিড ভাইরাসে পরিণত হয়, তার ওপর চলতে থাকে ব্যাপক গবেষণা। এরই মধ্যে ২০১৯ সালে চীনের উহান প্রদেশে মানবদেহে এ করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব আবিষ্কৃত হয় এবং হাইব্রিড আকারে তা অতি দ্রুত পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়ে।

উহান থেকে করোনাভাইরাস ছড়ানোর পরিপ্রেক্ষিতে জেনে বা না জেনে অনেকেই অভিযোগের তীর ছোড়ে ‘উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজি’র দিকে। এমনও বলা হয়, এ ইনস্টিটিউটে বায়োলজিক্যাল ওয়েপন সংক্রান্ত গবেষণা চালাতে গিয়ে কোনো বিপত্তি ঘটে বা কোনো ছিদ্র বা লিকেজ দিয়ে জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে। এমন সন্দেহ বন্ধমূল হয় যখন আমেরিকার একটি ইংরেজি পত্রিকাসহ বিভিন্ন মিডিয়া বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা শুরু করে। তবে চীন বরাবরই বিষয়টি অস্বীকার করেছে। খোদ আমেরিকাসহ বিশ্বের বহু দেশের গবেষক, বৈজ্ঞানিক ও ডাক্তার করোনা বিস্তারের সঙ্গে উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজির যোগসূত্র মানতে নারাজ।

এরই মধ্যে চীন সরকার চায়না সেনাবাহিনী, উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজি ইনস্টিটিউটের পরিচালক সি জেংলি এবং চায়না সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল চেন ওয়েইর বিরুদ্ধে বায়োলজিক্যাল ওয়েপন উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় করোনাভাইরাস ছড়ানোর অভিযোগ আনা হয়। এ অভিযোগ এনেছেন আমেরিকার আইনজীবী লেরি ক্লেম্যান। তার আইনি প্রতিষ্ঠান ‘ফ্রিডম ওয়াচ’ এবং টেক্সাসের বাজ ফটোস কোম্পানি। এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২০ ট্রিলিয়ন ডলারের ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয়েছে। তাদের মতে, করোনাভাইরাস ব্যাপক হারে মানুষ হত্যার জন্য বায়োলজিক্যাল ওয়েপন হিসেবে নির্মিত হয়েছিল। এ বিষয়ে চীন কাউকে কথা বলতে দেয়নি। আইনজীবী লেরি আরও মনে করেন, আন্তর্জাতিক কোনো সন্ত্রাসী দলের হাতে তুলে দেওয়ার জন্যই এ বায়োলজিক্যাল ওয়েপন নির্মিত হচ্ছিল। এ বিতর্ক কতদূর গড়াবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়। তবে বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের প্রত্যাশা, বায়োলজিক্যাল ওয়েপন যেন কোনো দিনই না হয়। কারণ কোনো অবস্থায় তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেখতে চায় না সুস্থ মস্তিষ্কের কোনো মানুষ। মহান স্রষ্টা তার বিশ্বকে নিরাপদে রাখুক। আমিন।

 

বিশ্বকে নিরাপদ রাখতে বায়োলজিক্যাল ওয়েপন কনভেনশন

বায়োলজিক্যাল ওয়েপন বা জীবাণু অস্ত্রের আরেক নাম ‘গরিবের পারমাণবিক বোমা’। একটি পারমাণবিক বোমা যেমন মুহূর্তের মধ্যে একটি বিশাল মানবসভ্যতা ধ্বংস করে দিতে সক্ষম, ঠিক তেমনি একটি বায়োলজিক্যাল ওয়েপন বা জীবাণু-বোমাও পারে বিশাল জনপদের মানুষ, পশুপাখি, গাছপালা, মাঠের ফসল এমনকি জলাশয়ের মাছ ধ্বংস করে দিতে। তবে পার্থক্য হলো, পারমাণবিক বোমা তৈরিতে খরচ হয় অনেক বেশি। সে তুলনায় অনেক কম খরচেই তৈরি করা যায় জীবাণু বোমা। তাই বায়োলজিক্যাল ওয়েপনকে বলা হয় গরিবের পারমাণবিক বোমা। বিষয়টি অনুধাবন করে বিশ্বের পরাশক্তিগুলো নিজেরাই এ প্রাণঘাতী অস্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৯১৮ সাল) পর ১৯২৫ সালে সম্পাদিত হয় জেনেভা প্রটোকল। এ প্রটোকলে রাসায়নিক ও জীবাণুযুক্ত বা বায়োলজিক্যাল অস্ত্র ব্যবহার বন্ধের অঙ্গীকার করা হলেও তা মজুদ রাখা বা গবেষণা ও উন্নয়নে কোনো বাধা ছিল না। বিষয়টিকে মাথায় নিয়ে বায়োলজিক্যাল ওয়েপন কনভেশন তৈরিতে মাঠে নামে ব্রিটেন ও সমমনা আরও কিছু দেশ।

১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল এ কনভেনশনে স্বাক্ষর শুরু করে বিভিন্ন দেশ এবং ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ তা কার্যকর হয়। এ কনভেনশন মোতাবেক জীবাণুনির্ভর যে কোনো ধরনের অস্ত্র বা সরঞ্জামের ওপর গবেষণা, উৎপাদন, মজুদ কিংবা ক্রয়-বিক্রয় বা বিনিময় সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়। বিশ্বের পরাশক্তিসহ সব দেশ এ ‘বায়োলজিক্যাল ওয়েপন কনভেশন’-এ স্বাক্ষর করেছে এবং এ কনভেনশন মেনে চলতে অঙ্গীকারবদ্ধ।

 

রহস্যের আড়ালে রাশিয়া

বর্তমান ইকা রিনবার্গ এলাকায় অ্যানথ্রাক্স জীবাণুযুক্ত গোস্ত খেয়ে কমপক্ষে ৬৬ জন প্রাণ হারান ও অসুস্থ হন বহু রাশিয়ান। পরবর্তীতে জানা যায়, বায়োলজিক্যাল ওয়েপন তৈরির একটি কারখানায় এয়ার ফিল্টার খোলা এবং সময়মতো তা না লাগানোর কারণে এ সংক্রমণ ছড়ায়

ঠিক কবে থেকে পৃথিবীর বুকে বায়োলজিক্যাল ওয়েপন তথা জীবাণু-যুদ্ধের এক মহাযজ্ঞ শুরু করে সোভিয়েট রাশিয়া, তা আজও এক রহস্য। ‘বায়ো প্রিপারাট’ নামের প্রকল্প চালু করে এক সময় নিয়োগ দেওয়া হয় ৫০ হাজার বিজ্ঞানী, ডাক্তার, কর্মকর্তা ও কর্মচারী। এ বিশাল বহর বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে বিভিন্ন গবেষণা কেন্দ্র চালু করে এবং অ্যানথ্রাক্স, গুটিবসন্ত ও প্লেগ রোগ ছড়ানোর যাবতীয় আয়োজন করে। এ জীবাণু মিসাইলের মাধ্যমে রাশিয়ায় বসেই আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালাস্টিক মিসাইলের মাধ্যমে হাজার হাজার মাইল দূরে নিক্ষেপেরও ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৭১ সালে তদানীন্তন সোভিয়েট ইউনিয়নের আরালাস্ক অঞ্চলের কাজাখ শহরে ব্যাপকহারে গুটিবসন্ত ছড়িয়ে পড়ে।

এতে আক্রান্ত প্রতি ১০ জনের তিনজন প্রাণ হারান। এ জন্য দায়ী করা হয় স্থানীয় এক গবেষণা কেন্দ্রকে। সমুদ্র তীরবর্তী একই গবেষণা কেন্দ্রের আশপাশে পরবর্তীতে ব্যাপকহারে প্লেগ ছড়িয়ে পড়লে একজন গবেষক ও বহু জেলের মৃত্যু ঘটে। ১৯৭৯ সালে রাশিয়ার তৎকালীন এসভার্দলোভস্ক; বর্তমান ইকা রিনবার্গ এলাকায় অ্যানথ্রাক্স জীবাণুযুক্ত গোস্ত খেয়ে কমপক্ষে ৬৬ জন প্রাণ হারান ও অসুস্থ হন বহু রাশিয়ান। পরবর্তীতে জানা যায়, বায়োলজিক্যাল ওয়েপন তৈরির একটি কারখানায় এয়ার ফিল্টার খোলা এবং সময়মতো তা না লাগানোর কারণে এ সংক্রামণ ছড়ায়। এমনিভাবে বহু ঘটনার সমারোহ এবং এ ব্যাপারে সরকারের নীরবতা বায়োলজিক্যাল ওয়েপন বিষয়ে রাশিয়াকে সবসময় রহস্যের আড়ালে রাখে।

সর্বশেষ খবর