সোমবার, ৬ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

কোয়ারেন্টিনো থেকে কোয়ারেন্টাইন

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

কোয়ারেন্টিনো থেকে কোয়ারেন্টাইন

৬০০ বছর আগের কথা

১৪০০ শতকের মাঝামাঝিতে ইউরোপ এবং এশিয়ায় মানুষের জীবনযাত্রা প্রায় চার বছরের জন্য অচল করে দিয়েছিল ভয়ঙ্কর মহামারী ব্ল্যাক প্লেগ। মধ্য এশিয়া থেকে এই রোগ মূলত ইঁদুরের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এশিয়া এবং ইউরোপের অধিকাংশ দেশে। ১৩৪৭ থেকে ১৩৫১- এই চার বছরে ব্ল্যাক প্লেগে অসুস্থদের চিকিৎসা এবং মৃতদের সৎকারে সাধারণ জনগণ তেমন কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় এ সময় প্রকৃত মৃতের সংখ্যা নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। তবে বিভিন্ন সমীক্ষায় মৃতের সংখ্যা সাড়ে ৭ কোটি থেকে ২০ কোটি পর্যন্ত দাবি করে। অধিকাংশের মতে, এ সময় ইউরোপের জনসংখ্যা প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কমে যায় এবং ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ ইউরোপবাসী ব্ল্যাক প্লেগে আক্রান্ত হয়। মধ্যপ্রাচ্যসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশেও একই হারে আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। সুনির্দিষ্টভাবে মিসরে ৪০ শতাংশ মানুষ প্লেগে প্রাণ হারায় বলে গ্রন্থে প্রকাশ।

বর্তমান মহামারীর সময়ে ইতালির নাম যেভাবে উচ্চারিত হচ্ছে, তখনো ইতালির নাম উচ্চারিত হয়েছিল ইতালির বন্দরে নোঙর করা জাহাজ থেকে ব্ল্যাক প্লেগ ছড়ানোর খবরে। ইতালি ভাষায় একটি শব্দ হলো ট্রেনটিনো যার অর্থ ৩০। আর কোয়ারেন্টাইনো শব্দের অর্থ ৪০। মূল ইতালীয় শব্দ কোয়ারেন্টাইনো থেকে পরবর্তীতে ইংরেজি কোয়ারেন্টাইন শব্দের উৎপত্তি, যার বাংলা অর্থ সঙ্গ বা সাহচর্য রোধ করা বা পৃথক হয়ে থাকা। ইতিহাস মতে জাহাজের যাত্রী, মালামাল বা বর্জ্যরে মাধ্যমে সম্ভাব্য ব্ল্যাক প্লেগের বিস্তার ঠেকাতে সে সময় সন্দেহভাজন জাহাজকে প্রথমত ৩০ দিন পরে ৪০ দিন বহির্নোঙরে নিঃসঙ্গ অবস্থায় থাকতে হতো, যা কোয়ারেন্টাইন নামে পরিচিতি পায়। অপরদিকে বর্তমান ক্রোয়েশিয়ার ডুবরভনিক অঞ্চল তখন রাগুসা নামে একটি নগর রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত ছিল। এই নগর রাষ্ট্রে পরবর্তীতে ৪০ দিনের জন্য অসুস্থদের পৃথক রাখার আদেশ জারি হয়, যার নাম দেওয়া হয় কোয়ারেন্টাইন। নগরীর প্রধান স্বাস্থ্য, কর্মকর্তা ও চিকিৎসক জ্যাকব নগরীর দেয়ালের বাইরে অসুস্থ রোগীদের থাকার ব্যবস্থা করেন। ইতালিতে ভিসকাউন্ট বার্নাবো নামের শাসক নগরীর বাইরের একটি মাঠে অসুস্থদের হয় মরার জন্য, না হয় সুস্থ করার জন্য স্থানান্তরের নির্দেশ দেন। বলা হয় তখন থেকেই কোয়ারেন্টাইন শব্দের পরিচিতি ও প্রয়োগ বাড়তে থাকে।

হরেক রকম কোয়ারেন্টাইন

প্রাণিবিজ্ঞানে কোয়ারেন্টাইন একটি পরিচিত শব্দ। এক চিড়িয়াখানা থেকে অন্য চিড়িয়াখানায় পশুপাখি স্থানান্তর, বন-জঙ্গল থেকে নতুন পশুপাখি সংগ্রহ কিংবা কোনো আবদ্ধ স্থান থেকে জঙ্গল বা অরণ্যে পশুপাখি অবমুক্ত করার আগে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পশুপাখিকে পৃথক রেখে নজরদারিতে রাখা হয়। এ সময় পশুপাখির কোনো রোগ না থাকলে তা নিরাপদ বিবেচনা করে পরবর্তীতে পদক্ষেপ নেওয়া হয়। দুগ্ধ খামার এবং পশুপালন খামারে নতুন পশু আনার পর তা নির্দিষ্ট দিন পর্যন্ত কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয় অন্য পশুর নিরাপত্তার স্বার্থে। ১৪শ শতকে ব্ল্যাক প্লেগ ছড়ানোর সময়ে ইতালিতে সন্দেহভাজন বা সম্ভাব্য ভাইরাস আক্রান্ত কোনো যাত্রী বা ক্রু কোনো জাহাজে থাকলে জাহাজটিকে বহির্নোঙরে ৪০ দিন অবস্থান এবং ফিউমিগেশন তথা নানা পদ্ধতি বিশেষত বাষ্প ও জীবাণু ধ্বংসের ওষুধ ছিটিয়ে জীবাণুমুক্ত করার পদ্ধতি প্রবর্তিত হয়, যা সমুদ্রবিদ্যায় কোয়ারেন্টাইন নাম পরিচিত। এ বছর ৮ মার্চে ৩৫০০ পর্যটকবাহী প্রমোদতরী দ্য গ্র্যান্ড প্রিন্সেসে ২১ যাত্রী করোনাআক্রান্ত বলে ধারণা করা হয়। ফলে জাহাজটিকে সানফ্রান্সিসকো থেকে ২৫ মাইল দূরে গভীর সমুদ্রে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়। মহাশূন্য থেকে প্রত্যাবর্তনের পর প্রত্যেক নভোচারীকে বাধ্যতামূলকভাবে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়। পৃথিবীর সেরা মহাশূন্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল অ্যারোনটিকস অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (নাসা) তত্ত্বাবধানে স্থির এবং চলমান কোয়ারেন্টাইন স্টেশন রয়েছে বেশ কয়েকটি। কম্পিউটার বিজ্ঞানে কোনো ফাইল কম্পিউটার ভাইরাসে আক্রান্ত হলে তা বিনাবিচারে মুছে ফেলা ডিলিট করার বদলে একটি স্পেশাল ডাইরেক্টরিতে সংরক্ষণের প্রথা প্রচলিত আছে, যা কোয়ারেন্টাইন নামে পরিচিত। এতে কম্পিউটারে ভাইরাস ছড়ানোর আশঙ্কা কমে যায়। উদ্ভিদবিদ্যায় বিশেষ কোনো গাছ রোগাক্রান্ত হলে বা গাছে পোকার আক্রমণ ঘটলে ওই গাছটিকে আলাদা করা হয় রোগবিস্তার রোধকল্পে। উদ্ভিদ বিজ্ঞানের ভাষায় এ প্রক্রিয়ার নাম প্লান্ট কোয়ারেন্টাইন। হাইওয়েতে ওজন মাপার যে স্টেশন বা ওজন পরিমাপক যে ব্রিজ থাকে, তার পাশেই আলাদা একটি স্থান ঘিরে রাখা হয়। বেশি ওজনের ট্রাক বা নিষিদ্ধ পণ্যবাহী ট্রাক ওই এলাকায় অন্য যানবাহন থেকে আলাদা করা হয়।

ধর্মের সঙ্গে কোয়ারেন্টাইনের মিল

চিকিৎসা বিজ্ঞানে ৪০ দিন পর মাতৃগর্ভে ভ্রুণের ব্রেইনের সংগঠন ও হৃৎপিন্ডের অস্তিত্ব লাভের কথা বলা হয়েছে। ফলে ৪০ দিনের কোয়ারেন্টাইন তখন থেকেই প্রচলিত

৩০ দিনের ট্রেনটিনো থেকে ৪০ দিনের কোয়ারেন্টাইনো হওয়ার নেপথ্যে বেশ কিছু কারণ ছিল বলে ধারণা করা হয়। প্রাথমিকভাবে ৩০ দিনে সম্পূর্ণ সুস্থ বা জীবাণুমুক্ত হওয়ার জন্য যথেষ্ট বিবেচিত না হওয়ায় এই আলাদা থাকার সময়সীমা বাড়িয়ে ৪০ দিন করা হয়। ৪০ সংখ্যাটির সঙ্গে আবার ধর্মীয় সংযোগ খুঁজে পান অনেকে। এর অন্যতম ৪০ বছর বয়সে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুয়ত লাভ। হজরত ঈসা (আ.) খ্রিস্টান ধর্ম মতে যিশুখ্রিস্ট; ৪০ দিন ৪০ রাত রোজা রেখেছিলেন বলে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রন্থে উল্লেখ আছে। পবিত্র কোরআনের দ্বিতীয় সূরা বাকারার ৫১নং আয়াত এবং সপ্তম সূরা আরাফের ১৪২নং আয়াতে হজরত মুসা (আ.)-এর ৪০ দিন ইবাদতের কথা বলা হয়েছে। তাফসির মতে, সিনাই পাহাড়ে ৪০ দিন ইবাদত করে তিনি মহান আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ লাভ করেন। সূরা মায়িদার ২৬ নম্বর আয়াতে হজরত মুসা (আ.)-এর কথায় তাঁর সম্প্রদায় অবিশ্বাস করায় তাদের ৪০ বছর উদ্ভান্তের মতো ঘুরে বেড়ানোর কথা বলা হয়েছে। ৪০ বছর বয়সে একজন মুসলমানের পরিপূর্ণভাবে আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণ করা বাঞ্ছনীয় বলে পবিত্র কোরআনের ৪৬নং সূরা আহকাফের ১৫নং আয়াতে উল্লিখিত। বর্তমান বিশ্বে ব্যাপক জনপ্রিয় তবলিগ জামাতে ৪০ দিনের জন্য মহান আল্লাহর রাস্তায় সময় দেওয়া তথা দীনের সঠিক তথ্য সবাইকে জানানোর জন্য নিবেদিত হওয়ার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়, যা চিল্লা নামে পরিচিত। চিকিৎসা বিজ্ঞানে ৪০ দিন পর মাতৃগর্ভে ভ্রুণের ব্রেইনের সংগঠন ও হৃৎপিন্ডের অস্তিত্ব লাভের কথা বলা হয়েছে। ফলে ৪০ দিনের কোয়ারেন্টাইন তখন থেকেই প্রচলিত।

কোয়ারেন্টাইনের সময় কী করা যায়

বিশ্বের সব দেশ এবং স্বাস্থ্য সংস্থা এই কোয়ারেন্টাইন তথা সংকটকালে গুজবে কান না দিয়ে সঠিক তথ্যে আস্থা রাখার পরামর্শ দিচ্ছে। সঠিক তথ্যের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ, রেডক্রস ও রেডক্রিসেন্ট, সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল ও প্রিভেনশন প্রভৃতির নাম সুপারিশ করা হয়েছে। দিনরাত করোনার খবর শোনা, দেখা বা পড়া বাদ দিয়ে পছন্দমতো গান বা কবিতা শোনা, মুভি, খেলা, ডকুমেন্টরি দেখা এবং বই বা ম্যাগাজিন পড়ার পরামর্শ কম বেশি সব সমাজবিজ্ঞানীর। সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন-সিডিসি (যুক্তরাষ্ট্র) এ সময় সারাক্ষণ কম্পিউটার, বই বা মোবাইলে ডুবে না থাকার পরামর্শ দিয়েছে। বিশেষত সব ধরনের মাদক থেকে দূরে থেকে ঘরে বসেই ফ্রি হ্যান্ডব্যায়াম, যোগব্যায়াম, সময়মতো ঘুম এবং ভারসাম্যপূর্ণ খাবার গ্রহণ বিশেষ জরুরি। আপনার যা করতে ভালো লাগে বা যা কিছু করে আপনি আনন্দ পান, তা-ই করুন। বন্ধু ও পরিবার-পরিজনের সঙ্গে কথা বলুন এবং যে কোনো বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকলে তা অন্যের সঙ্গে আলোচনা করে মন হালকা করুন এবং পরামর্শ নিন। এ সময় শিশু বিশেষত কিশোর-কিশোরীরা (টিনএজ) নানা ধরনের বিরক্তিতে ভুগতে পারে এবং অন্যদের বিরক্ত করতে পারে। ছোট বাচ্চারা যেমন বেশি কান্নাকাটি করতে পারে তেমনি কিশোর-কিশোরীরাও বেয়াদবি করা, বেশি বেশি খাবার গ্রহণ বা ক্রমাগত খাবারের জন্য বায়না, মাথাব্যথা বা শরীর ব্যথা অনুভব করার মতো সমস্যায় ভুগতে পারে। সিডিসি অভিভাবকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে শিশুদের সঙ্গে সময় নিয়ে গল্প করা এবং নিজেকে তাদের সামনে উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপনের দিকনির্দেশনা দিয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য বিষয়ক বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় সংবাদ মাধ্যম সিএনবিসি ২০ মার্চ ২০২০ তারিখে এশিয়া প্যাসেফিক অঞ্চলের রিপোর্টার ক্যারেন গিল ক্রিস্টের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। অন্যান্য উপদেশের সঙ্গে ক্যারেন গিল ক্রিস্ট প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে পোশাক পাল্টিয়ে ওই দিনের জন্য একটা রুটিন বা পরিকল্পনা করার ওপর গুরুত্ব দেন। ধর্মীয় গুরুরা বলছেন, ধর্ম চর্চার এটাই উত্তম সময়। অর্থসহ ধর্মগ্রন্থ ও সহায়ক বই পড়ার এই সুযোগ কাজে লাগানো উচিত। রমজান মাসের শেষ ১০ দিন একাকী ঘরে বা মসজিদে ইতেকাফ, তথা ধর্মচর্চা করার বিধান রয়েছে ইসলাম ধর্মে। এই সুযোগে নফল ইতেকাফ করার পরামর্শও দিচ্ছেন ধর্মীয় নেতারা। চাকরিপ্রত্যাশী বা চাকরি পরিবর্তনে আগ্রহীরা এই অবসরে নিজের জীবনবৃত্তান্ত নতুন ও আকর্ষণীয় করে সাজাতে পারেন। যে ক্ষেত্রে (সেক্টরে) কাজ করতে চান, সেই ক্ষেত্রের খুঁটিনাটি জেনে নিন। চাইলে নতুন ভাষায় কিংবা পুরনো ভাষার দক্ষতা বাড়াতে পারেন ঘরে বসেই। শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলা শেখার এখনই সময়। কম্পিউটারের অনেক কোর্স অনলাইনে ঘরে বসেই করতে পারেন। যুক্ত হতে পারেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, অনলাইন ব্যবসা এবং আউট সোর্সিংয়ের মতো পেশায়। শুরু করুন গঠনমূলক লেখালেখি। লিখতে লিখতেই হাত পাকা হয়ে যাবে। আন্তর্জাতিক রেডক্রস দিয়েছে দারুণ টিপস। প্রাথমিক চিকিৎসা এবং লাইফ স্কিল নিজে শিখুন এবং পরিবারের সবাইকে শিখিয়ে দিন। বিপদে কাজে লাগবে। বয়োজ্যেষ্ঠরা অ্যালবাম খুলে দেখে নিতে পারেন অতীতের সেই দিনগুলো। পুরনো সঙ্গী, বন্ধু ও পরিজনদের আগের ছবি হয়তো অনেক কথাই বলবে।

মানবদেহে কোয়ারেন্টাইনের প্রভাব

বিশ্বের প্রাচীন এবং বহুল প্রচারিত ও নির্ভরযোগ্য স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রকাশনা দ্য লেনচেট বিগত ১৪ মার্চ ২০২০ তারিখের সংখ্যায় কোয়ারেন্টাইনে থাকা সাধারণ মানুষ এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে এক উদ্বেগজনক তথ্য দিয়েছে। দি লেনচেটের দৃষ্টিতে কোয়ারেন্টাইনে থাকা মানুষের মাঝে হতাশা, দুশ্চিন্তা, মন খারাপ, অনিদ্রা, অর্থনৈতিক সংকটের ভয়, রেগে যাওয়া, অনুভূতিগত সমস্যার মতো মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। এর মধ্যে অতীতের অভিজ্ঞতার ৭৩ শতাংশের মন খারাপ থাকা এবং ৫৭ শতাংশের রেগে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। দি লেনচেট অতীতে সার্স আক্রান্ত রোগীদের থেকে বাঁচার জন্য কোয়ারেন্টাইনে থাকা মানুষের ওপর পরিচালিত জরিপের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছে, কোয়ারেন্টাইনের কারণে ২০ শতাংশ মানুষ ভীতসন্ত্রস্ত, ১৮ শতাংশ নার্ভাস, ১৮ শতাংশ বিষণœ ছিল এবং ১০ শতাংশ অপরাধবোধে ভুগছিল। এর বিপরীতে ৫ শতাংশ মানুষ আনন্দ এবং ৪ শতাংশ স্বস্তিতে সময় পার করেছে। কোয়ারেন্টাইনে থাকা ১০৫৭ জনের ওপর পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, সার্স ভাইরাসের সময় কাশিজনিত রোগীদের বা কাশিআক্রান্ত রোগী থেকে দূরে ছিল ৫৪ শতাংশ মানুষ, জনসমাগম এড়িয়ে চলেছে ২৬ শতাংশ এবং সাধারণ চলাচলের স্থান বা পাবলিক প্লেস এড়িয়ে চলেছে ২১ শতাংশ। কোয়ারেন্টাইনে থাকা স্বাস্থ্যকর্মীদের মাঝেও নানা ধরনের মানসিক সমস্যা লক্ষ্য করা যায়। এ সমস্যা সমাধানের জন্য সাধারণভাবে দি লেনচেট কোয়ারেন্টাইনের মেয়াদ যথাসম্ভব ছোট রাখা, জনগণকে সব সময় পরিস্থিতি সম্পর্কে জানানো, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহ নিশ্চিত করা, সামাজিকভাবে এবং তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে অবাধ যোগাযোগ নিশ্চিত করা প্রভৃতির ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। দি চাইনিজ সাইকোলজিক্যাল সোসাইটি এ বছর ফেব্রুয়ারির প্রথমভাগে ১৮ হাজার  চীনা নাগরিকের ওপর জরিপ চালিয়ে দেখেছে, তাদের মধ্যে ৪২.৬ শতাংশ সাম্প্রতিক সময়ের কোয়ারেন্টাইনের সময় উদ্বেগের মধ্যে সময় কাটিয়েছে। (সূত্র : দি জাপান টাইমস ১ মার্চ ২০২০)

স্বনামধন্য আন্তর্জাতিক গবেষণা, ব্যবসা ও তথ্য প্রতিষ্ঠান ব্লুমবার্গ সম্প্রতি (৩১ মার্চ ২০২০) কোয়ারেন্টাইনের পর গৃহবিবাদ ও বিবাহবিচ্ছেদ বৃদ্ধির দুঃসংবাদ দিয়েছে। চীনে সম্প্রতি যে কোয়ারেন্টাইন ও লকডাউন ঘটেছে, তারপর বিবাহবিচ্ছেদের হার ২৫% বৃদ্ধি পেয়েছে বলে একটি আইনি প্রতিষ্ঠানের বরাতে জানিয়েছে ব্লুমবার্গ। সাংহাই শহরের এই আইনি প্রতিষ্ঠানের প্রধান স্টিভ লি’র মতে, দাম্পত্য জীবনের বাইরে মানুষের দম ফেলার জায়গা বা স্পেস প্রয়োজন। চায়নার অনলাইন বার্তা সংস্থা সিক্সথ টোনের বরাতে ব্লুমবার্গ আরও বলছে, উহান প্রদেশ থেকে করোনাভাইরাস ছড়ানোর প্রেক্ষাপটে ফেব্রুয়ারি মাসে কোয়ারেন্টাইনে ছিল চায়নার বেশ কিছু অঞ্চল। এ সময় কেবল একটি এলাকাতেই ফেব্রুয়ারি ২০১৯-এর তুলনায় পুলিশের খাতায় ফেব্রুয়ারি ২০২০-এ গৃহবিবাদ ও ঘরের সহিংসতা বা ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সার্স ভাইরাসের কারণে ২০০৪ সালে হংকংয়ে কোয়ারেন্টাইন বলবৎ করা হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে ২০০২ সালের তুলনায় ২০০৪ সালে হংকংয়ে বিবাহবিচ্ছেদে বাড়ে ২১ শতাংশ (সূত্র ব্লুমবার্গ)। এ সংক্রান্ত আরও উদ্বেগজনক খবর এসেছে আমেরিকা থেকে। নিউইয়র্কের ডিভোর্স অ্যাটর্নি বা বিবাহবিচ্ছেদে অভিজ্ঞ আইনজীবী উইলিয়াম ডি জাবেল বলেছেন, কোয়ারেন্টাইন ও লকডাউনের সময় তিনি এবং অন্য আইনজীবীরা বিবাহবিচ্ছেদ সংক্রান্ত আইনি প্রক্রিয়া শুরুর যে অনুরোধ ও টেলিফোন কল পেয়েছেন তা সাধারণ সময়ের চেয়ে ৫০ শতাংশ বেশি।

(সূত্র : পেইচ সিক্স ডটকম এবং রেডিও ডটকম)

বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে কোয়ারেন্টাইন

যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যভিত্তিক বিজ্ঞানবিষয়ক ওয়েব পোর্টাল এবং প্রকাশনা সংস্থা লাই-ই সায়েন্সের মতে, সংক্রমণের মাধ্যমে বিস্তার ঘটাতে পারে এমন রোগে আক্রান্ত কোনো মানুষ বা পশুপাখির সংস্পর্শ বা সাহচর্যে আসা কোনো ব্যক্তি বা পশুপাখিকে পৃথক করে রাখার প্রক্রিয়াকে কোয়ারেন্টাইন বলা যেতে পারে। সাধারণত ওইসব ব্যক্তি বা পশুপাখি থেকে রোগ বিস্তারের আশঙ্কা ও ঝুঁকি কমানো বা রোধ করার জন্য কোয়ারেন্টাইন করা হয়। লাই-ই সায়েন্সের ব্যাখ্যা মতে, শুধু অসুস্থ ব্যক্তিই নয়, যিনি আপাতদৃষ্টিতে সুস্থ, তার দ্বারাও সংক্রমণ ছড়াতে পারে। তাই ব্যক্তির ভ্রমণ এবং পারিবারিক ইতিহাসকর্ম ও বসত পরিবেশ বিবেচনা করে যে কাউকেই কোয়ারেন্টাইনে রাখার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংগঠন সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এবং প্রিভেনশন (সংক্ষেপে সিডিসি) সংক্রমণ রোগ বিস্তার রোধে আইসোলেশন এবং কোয়ারেন্টাইন, উভয় বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছে। সিডিসির মতে, আইসোলেশন হলো একজন সংক্রমিত রোগীকে সাধারণ বা সুস্থ মানুষ থেকে আলাদা করে ফেলা। আর কোয়ারেন্টাইন হলো সাধারণ ও সুস্থ মানুষকে আলাদা করে রাখা এবং চলাচলের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। সমাজে ব্যাপকহারে সংক্রমণজনিত রোগ ছড়িয়ে পড়লে এভাবে সাধারণ মানুষের ওপর নজরদারি করা যায় এবং কেউ অসুস্থ হলে তাকে আলাদা করে বা আইসোলেশনে পাঠিয়ে রোগের বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

সর্বশেষ খবর