শনিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনার লড়াইয়ে বিশ্ব

তানভীর আহমেদ

করোনার লড়াইয়ে বিশ্ব

ভ্যাকসিন, ওষুধের খোঁজে মরিয়া গবেষকরা

সারা বিশ্বে করোনার ৭০টি ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ করছেন গবেষকরা। করোনাকে ঠেকাতে এসব ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ফলাফল একেকটি একেক পর্যায়ে রয়েছে। মোট চারটি ধাপের ইতিবাচক ফলাফল মিললে তবেই বাজারে সেই ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে। এর মধ্যে কোনো কোনোটি তৃতীয় ধাপে পরীক্ষার পর্যায়ে রয়েছে। মোট তিনটি ভ্যাকসিন মানুষের শরীরে প্রয়োগ করা হয়েছে। বিশ্বের ২০টি দেশে করোনার ভ্যাকসিন নিয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ হচ্ছে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই ১৮টি ভ্যাকসিন তৈরির কাজ চলছে। এছাড়া আশা জাগিয়েছে যুক্তরাজ্য, জার্মানি, স্পেন, চীন, জাপান, অস্ট্রেলিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশ। ভ্যাকসিনের পাশাপাশি করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দিতে দ্রুত ওষুধের খোঁজও চলছে। ভ্যাকসিন ও ওষুধের খোঁজে বিশ্বজুড়ে অন্তত ২০০টি গবেষণা, পরীক্ষা চালাচ্ছে বিশ্বের শীর্ষ বিজ্ঞানী ও ওধুষ তৈরি প্রতিষ্ঠানগুলো। বিশ্বের প্রথমসারির গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও ওষুধ কোম্পানিগুলোর এমন মরিয়া পদক্ষেপ আগে দেখেনি বিশ্ব। এসব গবেষণায় করোনাকে ঠেকাতে যেসব ভ্যাকসিন ও ওষুধের খোঁজ মিলছে তাতে আশান্বিত হওয়া যায়। করোনার সঙ্গে লড়াইয়ে চিকিৎসকরা ওষুধ ও ভ্যাকসিন দুটিরই খোঁজ করছেন।

ওষুধগুলোকে বলা হচ্ছে অ্যান্টিভাইরাল। গুরুত্বপূর্ণ অ্যান্টিভাইরাল নিয়ে যারা কাজ করছেন তাদের তালিকায় রয়েছে জিলেড সায়েন্স ইনকর্পোরেশন। তারা রেমডেসিভির নিয়ে কাজ করছেন। এপ্রিলে তারা ওষুধটির একাধিক ট্রায়াল দিয়েছে। এরই মধ্যেই গত ১৬ এপ্রিল ওষুধটির এক পর্যায়ের ফলাফল হাতে পাওয়া গেছে। করোনা আক্রান্ত রোগীরা এ ওষুধটি ব্যবহারের পর পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেছেন। আরও শতাধিক রোগীর ওপর ওষুধটি প্রয়োগ করে পূর্ণ ফলাফলের জন্য এপ্রিলের শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এছাড়া বিশ্বজুড়ে আলোচিত হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন নিয়ে আরও গবেষণা চালাচ্ছে তেভা ফার্মাসিউটিক্যালস, সানোফি, নোভার্টিজ এজি, নেটকো ফার্মা, মায়লান, বায়ার এজিসহ অনেক ওষুধ কোম্পানি। ওষুধটি নিয়ে ইতিমধ্যে পক্ষে-বিপক্ষে নানা যুক্তি পাওয়া যাচ্ছে। ওষুধটির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও কার্যকরী ফলাফল নিয়ে তাই বিস্তারিত গবেষণা চালানো হচ্ছে। ফুজিফিল্ম হোল্ডিং করপোরেশনের অ্যাভিগান আশার আলো দেখিয়েছেন। দেশে দেশে ওষুধটির প্রয়োগ ও কার্যকারিতা পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে ৮০ জন রোগীর ওপর এটি প্রয়োগ করা হয়েছিল। তারা সবাই দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠেন। এর আগে ওষুধটি চীনের উহান ও শেনঝেন অঞ্চলের অন্তত ৩৪০ জন করোনা রোগীর শরীরে প্রয়োগ করা হয়। তারা মাত্র চার দিনের মধ্যেই করোনামুক্ত হয়েছিলেন। জাপানের তাকিদা ফার্মাসিউটিক্যালস ব্লাড প্লাজমা থেরাপি দুর্দান্ত কাজ করেছে করোনা রোগীদের ওপর। করোনা থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা মানুষের শরীরের রক্ত থেকে অ্যান্টিবডি সংগ্রহ করে রোগীর ওপর প্রয়োগে সফলতা পাওয়া গেছে। জাপান এ বছরের শেষদিকে করোনা আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় ব্লাড প্লাজমা থেরাপির অনুমোদন দিতে পারে।

ভ্যাকসিনের খোঁজে আশা জাগিয়েছে নোভাএক্স ইনকর্পোরেশন। তারা ভাইরাসের প্রোটিন স্পাইক রুখে দিয়ে অ্যান্টিবডি তৈরিতে সাহায্য করবে এমন ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ করছেন। ইতিমধ্যে প্রাণীর শরীরে প্রয়োগে এটির ফলাফল ইতিবাচক এসেছে। মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে তারা ১৩০ জন মানুষের শরীরে এ ভ্যাকসিনের পরীক্ষা চালাবেন। ভ্যাকসিনটি নিয়ে আশাবাদী অনেকেই। চীনের একটি মিলিটারি দলের সহায়তায় কানসিনো বায়োলোজিকস ইনকর্পোরেশন একটি করোনার ভ্যাকসিন তৈরি করেছে। এপ্রিলের শুরুতেই তারা ভ্যাকসিনটির পরীক্ষা চালিয়ে সফল হয়েছে। পরবর্তী ধাপের পরীক্ষার জন্য তারা প্রস্তুতি নিচ্ছে। এছাড়া আরেকটি ভ্যাকসিন দ্বিতীয় ধাপে ২৭৩ জনের শরীরে ভ্যাকসিন পরীক্ষা চালিয়েছে চীন। চীনের স্টেট কাউন্সিলের জয়েন্ট প্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোল  মেকানিজমের পক্ষ থেকে জানানো হয়, তারা বর্তমানে তিনটি ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল নিয়ে কাজ করছে। প্রথম ভ্যাকসিনটির ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা চালানো হয় মার্চের শেষে। তখন সুরক্ষার বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। ১২ এপ্রিল দ্বিতীয় পর্যায়ের পরীক্ষায় ভ্যাকসিনের কার্যকারিতায় জোর দেওয়া হয়েছে। এর ফলাফল পেলে তৃতীয় ধাপে ভ্যাকসিনটির পরীক্ষা চালানো হবে। এ ভ্যাকসিনটি মানবদেহে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরিতে সহায়তা করবে। করোনাভাইরাসের ভাইরাল অংশ এস জেনেটিক সিকুয়েন্সের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করবে ভ্যাকসিনটি। জার্মানিও করোনার ভ্যাকসিন তৈরিতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছে। বায়োঅ্যান্ডটেক ও ফিজার কোম্পানি দুটো মিলে গত মাসে একটি ভ্যাকসিন তৈরি করেছে। এ মাসেই এটির ক্লিনিক্যাল ফলাফল পাওয়া যাবে। এদের পাশাপাশি মর্ডানা, জনসন অ্যান্ড জনসন, ইনোভিওসহ আরও শীর্ষ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান করোনার ভ্যাকসিনের তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা এ বছরেই করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। মানব দেহে করোনার টিকা পরীক্ষা শুরুর ঘোষণা দিয়েছে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি।

তারা আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যেই করোনাভাইরাসের টিকা তৈরি করতে পারবেন বলে বিশ্বাস করেন। বিভিন্ন প্রাণীর মধ্যে টিকাটির পরীক্ষামূলক ব্যবহারে সফলতা পাওয়া গেছে। আগামী সপ্তাহ থেকে মানবদেহে এটির পরীক্ষা শুরু হতে যাচ্ছে। বেশিরভাগ ভ্যাকসিন ১৮ মাস সময় নিয়ে বাজারে আসার কথা বলা হলেও সেটি ১২ মাস বা এক বছরে তৈরির জন্য প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। মানুষের শরীরে তিনটি ভ্যাকসিনের পরীক্ষা চালানো হয়েছে। এ মাসে আরও ক্লিনিক্যালে ফল পাওয়ার পর মানুষের শরীরে ভ্যাকসিন প্রয়োগের ঘোষণাও এসেছে কয়েকটি ভ্যাকসিনের। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, অন্তত এক বছরের আগে করোনার টিকা আবিষ্কারের কোনো সম্ভাবনা নেই। রাতারাতি কিছুর প্রত্যাশা না করাই ভালো।

লকডাউনে সবচেয়ে কঠোর নাইজেরিয়া

দেশে দেশে লকডাউনে কঠোর ভূমিকায় রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বারবার সতর্ক ও জরিমানা করার পর যারা লকডাউন মানছে না তাদের ঘরে রাখতে মরিয়া হয়ে উঠেছে কিছু দেশ। সে তালিকায় রয়েছে নাইজেরিয়া। এরই মধ্যে আল জাজিরা জানিয়েছে, দেশটিতে নিরাপত্তাবাহিনীর হাতে প্রাণ  গেছে ১৮ জনের।

তারা লকডাউন অমান্য করে বাইরে বেরিয়েছিল। করোনা ঠেকাতে কারফিউ জারি করা হয়েছে সেখানে। তবুও অনেকে কারফিউ ভেঙে বাইরে বেরোচ্ছেন। এর আগেই তাদের ঠেকানোর কঠোর হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছিল। দেশটির মানবাধিকারকর্মীরা হত্যাসহ আরও কিছু অভিযোগের কথা জানায় আল জাজিরাকে। নাইজেরিয়ায় গতকাল পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ১২ জন। হিসাবটাই বলে দিচ্ছে, দেশটিতে যতজন না করোনায় মারা গেছে তার চেয়ে বেশি মারা গেছে নিরাপত্তাবাহিনীর হাতে। কারফিউ অমান্য করে বাইরে বেরোলেই এখন প্রাণ সংশয় তৈরি হয়েছে সেখানে।

ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে যে দেশগুলো

রাজধানীতে বিধিনিষেধ প্রত্যাহার ফিনল্যান্ডে

করোনাভাইরাস প্রতিরোধে জন্য ফিনল্যান্ডে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল। করোনা পরিস্থিতির উন্নতির পর শুধু রাজধানী অঞ্চল থেকে তা প্রত্যাহার করে নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। করোনাকে ঠেকাতে প্রায় তিন সপ্তাহ মানুষের চলাচল ঠেকাতে এসব নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল।

রাস্তা অবরোধ করে রাখা হয় তখন। রাজধানী অঞ্চল উইসিমা থেকে দেশের অন্য অংশের ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। কঠোর নিষেজ্ঞা ও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলায় সেখানে করোনার প্রকোপ কমতে শুরু করে। প্রতিদিনই সেখানে সুস্থ হয়ে ওঠার মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। কমছে নতুন সংক্রমণ।

 

অস্ট্রিয়ায় খুলেছে দোকানপাট

অস্ট্রিয়ায় করোনা আতঙ্ক ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরছে। লকডাউন শিথিল করে নেওয়ায় মুখে মাস্ক আর সামাজিক দূরত্ব মেনে সাধারণ মানুষ বাইরে বের হতে পারছেন।

করোনায় পুরো ইউরোপে যখন মৃত্যুর মিছিল তখন সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য সচেতনতা ও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার প্রচেষ্টায় অস্ট্রিয়া পাচ্ছে করোনাজয়ের স্বাদ। খুলে দেওয়া হয়েছে হাজার হাজার দোকানপাট। অফিসগুলোও খুলছে ধীরে ধীরে। রাস্তায় বাড়ছে পরিবহন। দেশটির সরকার বলছে, ধীরে ধীরে পুরো দেশ আগের মতোই সচল হবে। মে মাসের মাঝামাঝিতে হোটেল-রেস্টুরেন্ট খুলে দেওয়া হবে। জুনের শুরুর দিকে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার বাধাধরা নিয়ম তুলে নেওয়া হবে। তখন বিয়ে, উৎসব, কনসার্ট, খেলাধুলার মতো জমায়েতে ফিরতে পারবেন তারা। তবে সে পর্যন্ত মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলায় সবাইকে বাধ্য করা হবে।

 

ডেনমার্কে স্কুলে ফিরেছে শিশুরা

করোনাভাইরাসের সঙ্গে লড়াইয়ে সফল হয়েছে ডেনমার্ক। সেখানে নার্সারি ও স্কুলগুলো ১১ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের জন্য খুলে দেওয়া হচ্ছে। ইউরোপের প্রথম দেশ হিসেবে শিক্ষার ওপর থেকে বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করে তারা। ইউরোপে লকডাউন আরোপ করা প্রথম  দেশগুলোর একটি ডেনমার্কে গত ১২ মার্চ থেকে স্কুল বন্ধ ছিল। ডেনমার্কের পৌরসভাগুলোর অর্ধেক স্কুল চালু করা হয়েছে। অপরদিকে কোপেনহেগেনের ৩৫ শতাংশ স্কুল চালু করা হয়েছে। বাকি স্কুলগুলো ২০ এপ্রিলের মধ্যে খুলে দেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে। স্কুল খুলে দিলেও দেশটির জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মেনা চলা ও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।

 

জনগণের আচরণে মুগ্ধ হয়ে লকডাউন শিথিল

ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় পর্তুগালে করোনায় সংক্রমণের হার অনেক কম। দেশের জনগণ সরকারের বিধিনিষেধ মেনে চলায় সুফল মিলেছে সেখানে। গত ১৮ মার্চ দেশটিতে লকডাউন নির্দেশনা জারি করা হয়। তবে জনগণের দারুণ ব্যবহার ও নিয়মানুবর্তিতার কারণে এ নির্দেশনা কিছুটা শিথিল করেছে সরকার।

 

জার্মানিতে শিথিল বিধিনিষেধ

করোনাভাইরাসের সঙ্গে দীর্ঘ লড়াইয়ের পর বিধিনিষেধ শিথিল করতে যাচ্ছে জার্মানিও। শর্ত সাপেক্ষে লকডাউন ও বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার পরিকল্পনার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। মে মাসের ৩ তারিখ পর্যন্ত সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে হবে সেখানে। ৪ মে থেকে ধীরে ধীরে স্কুল খুলবে। তবে বড় ইভেন্ট যেমন কনসার্ট, সভা, ফুটবল, কনফারেন্স ইত্যাদি কমপক্ষে আগস্টের ৩১ তারিখ পর্যন্ত নিষিদ্ধ থাকবে।

 

স্পেনে কাজে ফিরল ৩ লাখ কর্মী

করোনায় বিপর্যস্ত দেশগুলোর একটি স্পেন। নতুন আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সেখানে কমছে। ১৪ এপ্রিল দেশটিতে জরুরি সেবা খাতে নেই, এমন প্রায় তিন লাখ কর্মী কাজে যোগ দিয়েছেন।

টানা কয়েক দিন মৃত্যুহার ও সংক্রমণ কমে যাওয়ার পর লকডাউন শিথিলের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। যারা কাজে যোগ দিয়েছেন তাদের মধ্যে আছেন নির্মাণকর্মী এবং ম্যানুফাকচারিং খাতের শ্রমিকেরা। তবে দোকান, বার বা রেস্টুরেন্ট বন্ধ রয়েছে। লকডাউন শিথিল করা হলেও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে স্পেনে।

 

মানবতার অনন্য নজির সুইডেনের রাজকন্যা

করোনা আক্রান্ত রোগীদের পাশে থেকে সেবা দেওয়ার জন্য হাসপাতালে ছুটে গেছেন সে দেশের রাজকন্যা সোফিয়া। নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে করোনা রোগীদের সেবায় সহায়তা করার জন্য অনলাইনে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তিনি। বর্তমানে তিনি সোফিয়াহেমেট হসপিটালে করোনা রোগীদের সহায়তায় নিয়োজিত আছেন। জানা গেছে, করোনা রোগীদের সরাসরি চিকিৎসা-সংক্রান্ত বিষয়ে তিনি জড়িত নন। হাসপাতালের নার্স ও ডাক্তারদের সহায়তা করছেন তিনি। কারণ, ওই হাসপাতাল করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছে। চিকিৎসাসেবাকর্মীদের সহায়তার জন্য সপ্তাহে অন্তত ৮০ জনকে প্রশিক্ষণ দেবেন তিনি; অনলাইনে নেওয়া প্রশিক্ষণ তিনি অন্যদের দেবেন। তার কাছ থেকে প্রশিক্ষণ পেয়ে অন্যরা ডাক্তার ও নার্সদের সহায়তা করবে।

রাজপরিবার থেকে জানানো হয়েছে, আমরা যে বিশাল সংকটের মধ্যে পড়েছি তা থেকে উত্তরণে রাজকন্যা যুক্ত হয়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের লড়াইয়ে সহায়তা করতে চায়।

করোনা ঠেকাতে রোল মডেল

ভারতে কেরালা মডেল

এতদিন করোনাকে ঠেকানোর উদাহরণ হিসেবে দক্ষিণ কোরিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রিয়ার কথা বলা হতো। এখন বিশ্বজুড়ে আলোচনা হচ্ছে ভারতের রাজ্য কেরালাকে নিয়ে। কেরালা দেখিয়ে দিয়েছে কীভাবে করোনাকে থামাতে হয়। জানুয়ারি মাসের শেষেদিকে ভারতে প্রথম করোনা আক্রান্তের খোঁজ  পাওয়া যায় কেরালা রাজ্যে। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত কেরালার মোট ৩৮৭ জন আক্রান্তেরে মধ্যে ২০০-এর কাছাকাছি সুস্থ হয়েছেন। প্রাণ হারিয়েছেন তিনজন। বিবিসি কেরালার এ চমকপ্রদ লড়াইয়ের সফলতার কারণ হিসেবে বলছে দ্রুত বড় প্রস্তুতি নেওয়ার সুফল। চীনের উহান থেকে প্রথম যে বিমানে করে আটকে পড়া ভারতীয়দের ফিরিয়ে আনা হয়েছিল, সেখান থেকেই সতর্কতা শুরু করেছিল তারা। বিমানবন্দরেই প্রত্যেকের তাপমাত্রা মাপা হয়। যাদের সামান্য উপসর্গও দেখ গেছে তাদেরই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। মধ্যপ্রাচ্য ও চীনে পড়াশোনা করছে কেরালার বহু শিক্ষার্থী। এদের সবার পরীক্ষা হয়েছে। অসুস্থতার লক্ষণ দেখা দিলেই কোয়ারেন্টাইনে রেখে চিকিৎসা করা হয়েছে। যারা ভ্রমণ ইতিহাস, রোগ গোপন করেছিলেন তাদের লালা নিয়ে পরীক্ষা করে খুঁজে বের করা হয় করোনা আক্রান্তদের। এরপর খুঁজে বের করা হয়েছে তারা কাদের সঙ্গে মিশেছেন। এ কাজ করতে গিয়ে ১৭ জনের একটি টিম কাজ ভাগ করে মাঠে নেমে পড়েন। তাদের দারুণ সমন্বয় থাকায় করোনা ছড়িয়ে পড়ার আগেই রোগী খুঁজে বের করা হয়। এ কারণেই করোনায় যখন পুরো ভারত কাঁপছে তখন কেরালা হয়ে উঠেছে রোল মডেল।

প্রশংসিত গ্রিসের লড়াই

ইউরোপে করোনার সঙ্গে লড়াইয়ে সবচেয়ে সফল বলা হচ্ছে গ্রিসকে। এ লড়াইয়ে একসঙ্গে কাজ করে বিশ্ববাসীর প্রশংসা কুড়াচ্ছে গ্রিসের সরকার ও জনগণ। গতকাল পর্যন্ত গ্রিসে আক্রান্তের সংখ্যা মাত্র ২ হাজার ২০৭ জন। মারা গেছে ১০৫ জন। গ্রিস একদম শুরু থেকেই করোনার ব্যাপারে ছিল সতর্ক। প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী পাওয়ার আগেই তারা সন্দেহজনক ব্যক্তির করোনা পরীক্ষা করা শুরু করে। চীন ও ইউরোপের যেসব দেশে করোনা ছড়িয়ে পড়েছিল সেখান থেকে আসা ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে করোনা পরীক্ষা করা হয়। সামান্য অসুস্থতা থাকলেও তাদের কোয়ারেন্টাইন করে ফেলা হয়েছিল। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কথা বারবার প্রচার করা হয় সেখানে। এসবই করা হয়েছিল দেশটিতে করোনা রোগী খুঁজে পাওয়ার আগেই। এরপর এথেন্সে প্রথম করোনা রোগী খুঁজে পাওয়ার ৪ দিনের মধ্যে সব দোকান বন্ধ করে দেওয়া হয়। ৭ দিনের মাথায় অপ্রয়োজনীয় চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় সেখানে। প্রথম যেদিন গ্রিসে করোনা আক্রান্ত একজনের মৃত্যু হয় তখনই দেশটির সব স্কুল, সিনেমা হল, কনসার্ট, বার-রেস্টুরেন্ট, দোকান বন্ধ করে দেওয়া হয়। জরুরি কয়েকটি অফিস ছাড়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোও বন্ধ করে মানুষকে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার কথা বলা হয়। এরপর ১৩ দিন পরেই পুরো দেশ লকডাউন করে দেয় গ্রিস। মাস্ক পরা, সামজিক দূরত্ব রক্ষা করায় কঠোর ছিল সেখানকার পুলিশ। অপ্রয়োজনে বাইরে বেরোলেই ১৫০ ইউরো পর্যন্ত জরিমানা করা হয়েছে। শপিংমলে যারা জরুরি কেনাকাটায় গেছেন তাদের ১৫ বর্গফুটের মধ্যেই কেউ দাঁড়াতে পরেনি। সামাজিক দূরত্ব রাখায় দেশটির জনগণ দারুণ সহযোগিতা করেছেন। যে কোনো স্বাস্থ্য সমস্যায় রোগীর কাছে পৌঁছে যাচ্ছেন ডাক্তাররা। সেখানে ঘরে বসেই পাচ্ছেন ডাক্তারের পরামর্শ ও প্রেসক্রিপশন। করোনা ছড়িয়ে পড়ার আগেই তার গলা চেপে ধরে সফল হয়েছে গ্রিস।

যে নার্সের জন্য কাঁদছে সবাই

করোনা আক্রান্তদের সেবা দিতে গিয়ে নিজেই সেই রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হলো তাকে

করোনার সঙ্গে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। তারা জীবন বাজি রেখে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন। বিশ্বজুড়ে ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জামের সংকট থাকার পরও তারা মরিয়া মানুষের সেবায়। এ লড়াইয়ে প্রাণ হারিয়েছেন অনেকে। তাদেরই একজন মেরি অ্যাগিওয়া অ্যাগিয়াপং। পেশায় নার্স। বয়স মাত্র ২৮ বছর। ইংল্যান্ডের শহর লুটনের লুটন অ্যান্ড ডানস্ট্যাবল হাসপাতালে করোনা রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। তিনি গর্ভবতী হলেও করোনা রোগীদের চাপ থেকে ঘরে বসে থাকতে পারেননি। পেটের সন্তান কিছুদিনের মধ্যে পৃথিবীতে আসছে জেনেও কাজ থামাননি। 

টানা কাজ করতে গিয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরীক্ষা করার পর জানা গেল তিনি করোনা আক্রান্ত। করোনা আক্রান্তদের সেবা দিতে গিয়ে নিজেই সেই রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হলো তাকে। তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটলে ডাক্তাররা সিদ্ধান্ত নিলেন তার জরুরি সিজারিয়ান অপারেশনের। জরুরি অস্ত্রোপচার করা হয় তার। অ্যাগিয়াপং জন্ম দিলেন এক ফুটফুটে কন্যা সন্তানের। কিন্তু সন্তান জন্মদানের কিছুক্ষণ পরই মারা যান তিনি। তার মৃত্যুর পর যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের প্রধান নির্বাহী ডেভিড কার্টার বলেন, ‘মেরির নবজাতক বাচ্চার বেঁচে থাকা হচ্ছে এ গভীর অন্ধকার সময়ে এক আলোকবর্তিকা।’ অ্যাগিওয়া অ্যাগিয়াপং-এর পরিবারের পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হয় তার ব্যাপারে গোপনীয়তা রক্ষা করার বিষয়ে। এ কারণে তার  কোনো ছবি প্রকাশ করা হয়নি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর