সোমবার, ১১ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনার যত বিপরীত কারবার

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

করোনার যত বিপরীত কারবার

কোনো যাত্রী ছাড়াই উড়েছে বিমান

বিমানে ভ্রমণের জন্য একটি টিকিট কিনতে কয়েক মাস আগে থেকে বুকিং দিতে থাকেন যাত্রীরা। অনেক সময় চড়া মূল্যেও টিকিট কিনতে বাধ্য হন। করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর ইউরোপজুড়ে বেশ কিছু বিমান সংস্থা ফ্লাইট পরিচালনা করলেও কোনো যাত্রী ছিল না। ফ্লাইট পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ভাষায় এগুলো ছিল ‘ঘোস্ট ফ্লাইট’ বা ভূতের ফ্লাইট। ইংল্যান্ডের সবচেয়ে জনপ্রিয় পত্রিকা দি সানডে টাইমস তার ৬ মার্চ ২০২০ তারিখের প্রতিবেদনে এই ঘোস্ট ফ্লাইট বা ভুতুড়ে ফ্লাইটের সংবাদ প্রসঙ্গে লিখেছে, ইউরোপের বিভিন্ন বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের নিয়ম হলো প্রদত্ত সূচি বা শ্লট অনুসারে বিমান পরিচালনা করা অথবা সেই সূচি বা শ্লট ছেড়ে দেওয়া। আমেরিকার নিউইয়র্ক পোস্ট ৯ মার্চ ২০২০ তারিখের প্রতিবেদনে ব্যাখ্যা দিয়ে লিখেছে, ইউরোপীয় কমিশন গাইড লাইন অনুযায়ী বিমান পরিচালনার ক্ষেত্রে ‘৮০/২০ আইন’ অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক। এই আইনানুসারে কোনো বিমান সংস্থাকে নির্দিষ্ট কোনো বিমানবন্দর সপ্তাহে যে কয়েকবার ওঠানামা করার সূচি বা শ্লট দেয়, তার কমপক্ষে ৮০ শতাংশ ব্যবহার করতে না পারলে জরিমানা গুনতে হয় এবং সেই সূচি বা শ্লট প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য বিমান সংস্থাকে ছেড়ে দিতে হয়। তাই শুধু সূচি বা শ্লট টিকিয়ে রাখতে ব্রিটিশ এয়ারলাইন্সসহ ইউরোপের বেশ কিছু এয়ারলাইন্স একেবারে যাত্রীশূন্য অবস্থায় ফ্লাইট পরিচালনা করতে বাধ্য হয়। নিউইয়র্ক পোস্টের মতে, ঘোস্ট ফ্লাইট পরিচালনা করতে গিয়ে একটি বিমানকে প্রতি মাইলের জন্য পাঁচ গ্যালন দামি তেল (জেড ফুয়েল) খরচ করতে হয়েছে। স্টাফদের ভাতা, বিমানবন্দর খরচ, রক্ষণাবেক্ষণ, বীমাÑএসব তো আছেই। পক্ষান্তরে যাত্রী না থাকলেও প্রতি সিটের জন্য বিমান থেকে নির্গত কার্বন-ডাই অক্সাইডের পরিমাণ ছিল এক টনের অর্ধেক। পরিস্থিতির আরও অবনতি হলে পৃথিবীজুড়ে থাকা বিমান সংস্থা, বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ অনির্দিষ্টকালের জন্য সব নিয়মিত ফ্লাইট বন্ধের ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়।

 

বিনা পয়সায় বিমান টিকিট

বিশ্বের অন্যতম ‘বাজেট লাইন’ বা সাশ্রয়ী বিমান সংস্থা হিসেবে মালয়েশিয়া ভিত্তিক ‘এয়ার এশিয়া’ বিমান সংস্থার ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে। বছরজুড়েই নানা ধরনের প্রণোদনা বা ‘অফার’ দেওয়া এয়ার এশিয়ার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তবে বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে গত ৬ মার্চ ২০২০ তারিখের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এয়ার এশিয়া কর্তৃপক্ষ এশিয়ার বিভিন্ন জনপ্রিয় পর্যটন শহরে ভ্রমণের ক্ষেত্রে বিমান ভাড়া বা টিকিটের দাম না নেওয়ার ঘোষণা দেয়। এসব গন্তব্যে এয়ার এশিয়ার মাধ্যমে বিমান ভ্রমণ এবং হোটেলে থাকার সুযোগ নিলে বিমান ভাড়ার কোনো টাকা দিতে হবে না বলে ঘোষণা আসে সংস্থার সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে। এ ক্ষেত্রে কেবল হোটেলের বিল দিলেই চলবে। এয়ার এশিয়ার কর্ণধার (সিইও) ক্যারেন চ্যালের উদ্ধৃতি দিয়ে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, করোনা পরিস্থিতিতে মানুষের মনের অবস্থা এয়ার এশিয়া উপলব্ধি করে। তা কাটিয়ে উঠতে ভবিষ্যতের ভ্রমণসূচি এখনই ঠিক করা উচিত। তাই এই প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে, যা জুলাই পর্যন্ত বলবৎ থাকে। এর পাশাপাশি ছয় মিলিয়ন বা ৬০ লাখ টিকিট ছাড়া হয়েছে অতি সুলভমূল্যে। এর মধ্যে রয়েছে মাত্র ১২ রিংগিত (মালয়েশিয়ার মুদ্রা) খরচ করে রাজধানী কুয়ালালামপুর থেকে দেশের জনপ্রিয় পর্যটন শহর জোহর বারু, প্যানাং, লাংকাউই, কোটা বারু প্রভৃতিতে ভ্রমণের সুযোগ। অর্থাৎ বাংলাদেশি টাকায় মাত্র ২৩৪ টাকা খরচ করে বিমানে এক শহর থেকে অন্য শহরে যাওয়া যাবে। আর দেশ ছেড়ে সিঙ্গাপুর, জাকার্তা (ইন্দোনেশিয়া) ফুকেট (থাইল্যান্ড)-সহ অন্যান্য আরও কিছু গন্তব্যে বিমানে ভ্রমণ করতে গুনতে হবে মাত্র ৪৪ রিংগিত বা ৮৫৮ টাকা। (সূত্র : এয়ার এশিয়া প্রেস বিজ্ঞপ্তি ৬ মার্চ ২০২০)।

 

তেল নিলে পয়সা মেলে

পৃথিবীর বুকে খনিজ তেলের দখল নিয়ে কত যুদ্ধ আর কত মৃত্যু ঘটেছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান বের করা এককথায় দুঃসাধ্য। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৮) থেকে শুরু করে হালের ইরানের ওপর অবরোধ ও হরমুজ প্রণালিতে উত্তেজনার মূলে ছিল তেলের ওপর নিয়ন্ত্রণ। সাদ্দাম হোসেন, গাদ্দাফির মতো নেতাদের নাটকীয় উত্তরণ এবং হিরো থেকে জিরো হওয়ার নেপথ্যেও ছিল তেলে তেলেসমাতি। ‘ওয়েল ওয়ার’ বা তেল নিয়ে যুদ্ধ বলে একটি কথা প্রচলিত আছে সামরিক বিজ্ঞান ও সংঘাত নিরসন (কনফ্লিক্ট ম্যানেজমেন্ট) শাস্ত্রে। অথচ করোনার কারণে সেই তেলই আজ গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিনা পয়সায় তো বটেই, উল্টো টাকা বিলিয়েও ক্রেতা পাচ্ছে না তেল কোম্পানিগুলো। বিশ্বের প্রায় সব গণমাধ্যমেই এ খবরটি গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা হয়েছে। এর মধ্যে ওয়েল প্রাইস ডটকম গত ২৭ এপ্রিল লিখেছে, তেলের দাম আকাশ বা শূন্য থেকে কোনো অবলম্বন ছাড়াই নিচে নেমেছে বা ‘ফ্রি ফল’ করেছে।

তথ্য মতে, পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবারের মতো তেল কিনলে উল্টো ক্রেতাকেই টাকা দিয়েছে আমেরিকা। দেশটির তেলের মূল্য নির্ধারণী সূচক ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টার মেডিয়েট (ডব্লিউটিআই) এপ্রিলের শেষে শূন্যেরও নিচে চলে যায়। সূচক বা বেঞ্চমার্ক মূল্য এ সময় ব্যারেল প্রতি মাইনাস ৩৭ দশমিক ৬৩ ডলারে নেমে আসে। অর্থাৎ একজন ক্রেতা বা কোনো দেশ বা কোম্পানি যদি তেল কেনে, তবে কোনো মূল্য তো দিতে হবেই না, বরং, ক্রেতাকেই প্রতি ব্যারেলের জন্য ৩৭ ডলার ৬৩ সেন্ট বুঝিয়ে দিবে তেল বিক্রেতা কোম্পানি। বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে প্রকাশ করোনার কারণে উড়ছে না হাজার হাজার বিমান। স্থবির হয়ে পড়ে রয়েছে কোটি কোটি গাড়ি। পানিতে ভাসছে না জাহাজ। বন্ধ রয়েছে মিল, কলকারখানা সবই। কে নেবে এখন তেল? কি করবে তেল নিয়ে? এই প্রশ্ন যখন তেল উৎপাদক দেশ ও কোম্পানির কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে তখনই দেখা যায় তেল মজুদের জন্য যত সংরক্ষণাগার বা রিজার্ভার নির্মিত হয়েছিল, তা পূর্ণ হয়ে গেছে অবিক্রীত তেল জমতে জমতে। তেল বহনকারী যত ট্যাংকার ছিল, সেগুলো পূর্ণ করা হলেও ক্রেতা মিলছে না এই তেল কেনার জন্য। তাই বাধ্য হয়ে ক্রেতাদের উৎসাহ দিতে এবং তাদের সংরক্ষণাগার বা রিজার্ভারে তেল মজুদের জন্য উল্টো টাকা সাধতে থাকেন তেল উৎপাদকরা। পরবর্তীতে তেলের মূল্য একটু একটু করে বাড়লেও আমেরিকার বিজনেস নিউজের পে-চ্যানেল ও অনলাইন গণমাধ্যম ‘কনজিউমার নিউজ অ্যান্ড বিজনেস চ্যানেল’ (সিএনবিসি) এপ্রিলের ২ তারিখেই দিয়েছে এক দুঃসংবাদ। চ্যানেলের সিঙ্গাপুরস্থ এশিয়া প্যাসেফিক সদর দফতরের মার্কেটস এডিটর মিস উইঝেন লিখেছেন, নেগেটিভ বা শূন্য থেকে তেলের এই মূল্যবৃদ্ধি সাময়িক এবং সামান্য নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো। তেলে ও গ্যাসের বাণিজ্য ও মূল্য নিয়ে কাজ করা গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ভান্দা ইনসাইট প্রাইভেট লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও ভান্দা হেরি তার প্রায় দুই যুগের অভিজ্ঞতার আলোকে বলেছেন, তেলের চাহিদা বা তেল সংরক্ষণের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়নি বলে তেলের মূল্যবৃদ্ধি দীর্ঘায়িত হবে না। এই মূল্যবৃদ্ধি তেলের বাজারকে হয়তো শ্বাস নেওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। তবে পরিস্থিতির উন্নতি না ঘটলে তেলের মূল্য শূন্যে নামা বা আবারও নেগেটিভ হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

 

পানির চেয়েও দুধ সস্তা

ষাট ও সত্তর দশকে পঞ্চম বা ষষ্ঠ শ্রেণির পাটিগণিতে ১০ সের দুধে ১ সের পানি মিশালে দুধের ক্রয়মূল্যে বিক্রি করলে কত লাভ তা নির্ণয়ের অংক করান হতো। কারণ বরাবরই পানির মূল্য ছিল দুধের চেয়ে অনেক কম। সস্তায় কোনো কিছু বিক্রির ঘটনাতে পানির দরে বিক্রি বলে আখ্যায়িত করা হতো। এখন সাম্প্রতিক করোনার কারণে পানির চেয়েও কম দামে গরুর দুধ বিক্রি করতে বাধ্য হন খামারিরা। ১ মে ২০২০ বাংলাদেশ প্রতিদিনের নবম পাতায় বাগেরহাটে রাস্তার দুই পাশে ক্রেতার আশায় দুধ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা খামারিদের ছবি ছাপান হয়। খবরে প্রকাশ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান ও মিষ্টির দোকান বন্ধ থাকায় এবং সাধারণ মানুষ লকডাউনে ঘরে অবস্থান করায় দুধের লিটারপ্রতি মূল্য সর্বনিম্ন ১৫ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন খামারিরা। অথচ বাজারে মানসম্পন্ন এক লিটার পানির দাম ২০-২৫ টাকা। দুধ বিক্রির টাকায় শুধু গরুর খাদ্য কেনাও সম্ভব হচ্ছে না বলে জানান স্থানীয় খামারি ও প্রান্তিক কৃষকরা। একই চিত্র দুধের রাজধানীখ্যাত পাবনা জেলায়। বৃহত্তর পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায় সর্বনিম্ন ২০ টাকা লিটার দরে দুধ বিক্রির খবর গত ২ এপ্রিল ২০২০ তারিখে চেপেছে দি ফিন্যানসিয়াল এক্সপ্রেস। অনলাইনে ভারতের দি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের ২ এপ্রিল ২০২০ তারিখের প্রতিবেদনের দাবি পাবনা ও সিরাজগঞ্জে মিল্কভিটা ও অন্যান্য দুধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান দুধ সংগ্রহ বন্ধ করায় দুধের দাম নেমে এসেছে ১০-১৫ টাকায়। গর্ত করে বালির মধ্যে খামারিদের দুধ ফেলে দেওয়ার দৃশ্য ছেপেছে দি ডেইলি স্টার ৮ এপ্রিল ২০২০ তারিখের সংখ্যায়। শুধু বাংলাদেশই নয়, পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও প্রায় একই সমস্যার কথা উঠে এসেছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে। এর মধ্যে দুধের জন্য জগৎখ্যাত অস্ট্রেলিয়ার অললাইন গণমাধ্যম ফার্ম অনলাইনের ৮ এপ্রিল ২০২০ তারিখের এক প্রতিবেদনে করোনার কারণে দুধের মজুদ বেড়ে যাওয়া এবং অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে দুধের মূল্য অনেক নিচে থাকার আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন এ বিষয়ের অভিজ্ঞজনরা।

 

প্রবাসফেরতদের সঙ্গে দূরত্ব

আশি ও নব্বই দশকে প্রথমে ফকির আলমগীর এবং পরে খালিদ হাসান মিলু প্রবাসীদের নিয়ে একটি গান গেয়ে প্রবল সাড়া ফেলেছিলেন। গানের শুরুতে ছিল- ‘বিদেশ থেকে দেশে এলে, দশ গেরামের সোনার ছেলে, ভাই-বন্ধু সবাই বলে জামা কাপড় আনছনি, আর মা বলে, আমার জাদু ফিরা আইছনি...” সত্যিই সোনার ছেলে বলে গণ্য করা হতো প্রবাসীদের। বিয়ের পাত্র, সভা-সমিতির প্রধান অতিথি, মসজিদ, মাদ্রাসা ও ক্লাবের পৃষ্ঠপোষক, সব ক্ষেত্রে একজন বিদেশফেরত ছিল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। আর বিদেশ থেকে আসা মাত্র বিদেশি সাবান, শ্যাম্পু, নিডো, ট্যাঙ্ক, সিগারেট, পারফিউম, জামা-কাপড় ইত্যাদি দখলের আশায় প্রবাসফেরতদের চারপাশে ঘুর ঘুর করত আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব ও নিকটজনরা। সেই প্রবাসফেরতরাই করোনার কারণে যেন আজ কালো তালিকাভুক্ত ও অস্পৃশ্য। করোনার উৎপত্তি চীনের উহান অঞ্চলে। সেখান থেকে সরকার প্রথম দিকেই (১ ফেব্রুয়ারি ২০২০) ১৫ শিশুসহ মোট ৩১২ জনকে বিশেষ বিমানে ঢাকায় ফিরিয়ে আনে এবং আশকোনা হাজী ক্যাম্পে কোয়ারেন্টাইনে রাখে। প্রবাসফেরতদের নিয়ে আতঙ্কের শুরু সেখান থেকেই। চীনের উহান থেকে ইউরোপ-আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপকহারে ছড়াতে থাকে করোনা। ফলে একে একে সে সব দেশ থেকেও বাড়তে থাকে প্রবাসীদের দেশে ফেরার মাত্রা। এর মধ্যে ভয়াবহভাবে করোনায় জড়িয়ে পড়া দেশ ইতালি থেকে ১৪ মার্চ ২০২০ তারিখে দুটি ফ্লাইটে ৩৫১ জন ঢাকায় ফেরত আসেন। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো নানা অজুহাতে শত শত বাংলাদেশিকে তাদের নিজস্ব বিমানে ঢাকায় নামিয়ে দেয়। ফলে প্রবাসফেরতদের সংখ্যা দাঁড়িয়ে যায় কয়েক হাজারে। কিন্তু দেশে ফিরেই তাদের পড়তে হয় নানাবিধ বিড়ম্বনায়। প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষে অসুস্থ ও সন্দেহভাজনদের নির্ধারিত হাসপাতালে রেখে বাকিদের নিজ নিজ বাড়িতে সেলফ কোয়ারেন্টাইন ও আইসোলেশনে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়। ফলে জেলায় জেলায় যার যার ঘরে বসে থাকতে বাধ্য হন প্রবাসফেরতরা। এর মধ্যে শুধু চাঁদপুর জেলাতেই ১০৫৭ জন সেলফ কোয়ারেন্টাইনে ছিলেন মার্চ মাসের শুরুতে। (সূত্র : দি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ২ মার্চ ২০২০)। বিদেশ থেকে দেশে ফিরলেও তাদের নিয়ে আনন্দ-ফুর্তি এমনকি আগ্রহ দেখাতে আসছেন না কেউ বরং তাদের থেকে দূরে থাকাটাই শ্রেয় মনে করছেন সবাই। অনেক প্রবাসফেরতের বাড়িতে আবার স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি আর মহল্লাবাসী লাল পতাকা টাঙিয়ে সতর্ক করেছেন অন্যদের। এমন অবক্ষা-অনাদর মানতে পারছেন না কষ্ট করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা প্রবাসীরা।

 

প্রজার কথায় রাজার দ্বীপান্তর

প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত রাষ্ট্রদ্রোহী ও দাগী আসামিদের রাজার হুকুমে দ্বীপান্তর বা একটি দ্বীপে নির্বাসনে পাঠান হতো। ভারত উপমহাদেশে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ এমন দ্বীপান্তরের জন্য কুখ্যাত ছিল। পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও এমন অসংখ্য দ্বীপ রয়েছে, যেখানে রাজার হুকুমে জীবন কাটিয়েছে প্রজারা। করোনার কারণে প্রজার (ডাক্তার) পরামর্শে দ্বীপান্তরে গেছেন সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ। বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদ অনুসারে ৮৪ বছর বয়সী এই রাজা করোনার সময়টাতে আশ্রয় নিয়েছেন লোহিত সাগরের মাঝে এক নির্জন দ্বীপে নির্মিত প্রাসাদে। দেশটির মূল ক্ষমতাধর হিসেবে বিবেচিত ও বিতর্কিত ক্রাউন প্রিন্স বা রাজপুত্র ৩৪ বছর বয়সী মোহাম্মদ বিন সালমান তার মন্ত্রিপরিষদের অনেক সদস্য নিয়ে নির্জন সমুদ্র উপকূলে রয়েছেন বলেও গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ১২ মার্চের পর আর জনসম্মুখে দেখা যায়নি ব্রিটিশ রাজপুত্র ৭১ বছর বয়সী প্রিন্স চার্লসকে। মার্চের শেষে তার শরীরে করোনাভাইরাসের সন্ধান মেলে বলে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ। বিবিসির ২৬ মার্চের প্রতিবেদন অনুসারে প্রজার (ডাক্তার) পরামর্শে তিনি স্ত্রী ক্যামেলিয়া ও ব্যক্তিগত সহকারীদের নিয়ে সমুদ্রঘেরা স্কটল্যান্ডের বালমোরাল এস্টেটের একটি প্রাসাদে আইসোলেশনে রয়েছেন। দ্বীপান্তরিত না হলেও করোনার কারণে প্রজার (ডাক্তার) পরামর্শে কোয়ারেন্টাইন বা আইসোলেশন নামের বন্দিত্ববরণ করেছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর স্ত্রী সোফি ট্রুডো, অস্ট্রেলিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পিটার ডাটন, ইংল্যান্ডের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়কমন্ত্রী নোডিন ডারোস, ইরানের ভাইস প্রেসিডেন্ট এসাক জাহাঙ্গিরী ও স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ইরাজ হেরিচিসহ বিভিন্ন দেশের আরও অনেক রাষ্ট্রীয় কর্ণধার, জাতীয় নেতা ও জাতীয় পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি। এই মিছিলে আরও যুক্ত হয়েছেন বাংলাদেশের একজন সংসদ সদস্যের নাম। প্রতিদিনই এই তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। ফলে গণমাধ্যমে প্রকাশ পায় স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেড্রো সানচেজের স্ত্রী বেগোনা গোমেজ, ইরানের ভাইস প্রেসিডেন্ট মাসোমিহ এবতেখার, রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মিখাইল মিশু স্টিন, নাইজেরিয়ার প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধান আববা কাইয়ারিসহ অর্ধশত রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকের নাম, যারা প্রজার (ডাক্তার) পরামর্শে কোয়ারেন্টাইনে আছেন। আর মৃত্যুর মিছিলে যোগ দিয়েছেন আফ্রিকার দেশ বার্কিনা ফাসোর ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট রোজ মেরি কোম্পাওরি।

 

রোগীর ভুলে ডাক্তারের মৃত্যু

বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশে ডাক্তারের ভুলে রোগীর মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া যায়। এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক ভাঙচুর, মামলা-মোকদ্দমা, ডাক্তারের লাইসেন্স বাতিল ইত্যাদি ঘটনাও বিরল নয়। তবে এবারের করোনায় রোগীদের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বজুড়ে বিপুল সংখ্যক ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীর মৃত্যু গভীর চিন্তায় ফেলেছে বিশ্ববাসীকে। এ ডাক্তারদের প্রায় সবাই রোগীদের সংস্পর্শে এসে করোনায় আক্রান্ত হন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, রোগী ঠিকমতো তার সমস্যা প্রকাশ করতে পারছে না বা অজানা আতঙ্কে করোনার লক্ষণ গোপন করছে। ফলে ডাক্তাররা সাধারণ রোগীর মতো তাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা সেবা করতে গিয়ে করোনায় আক্রান্ত হয়ে পড়ছেন। নার্স, টেকনিশিয়ান, অ্যাম্বুলেন্স চালক, চিকিৎসা সহকারী বা প্যারামেডিকস এমনকি পরিচ্ছন্নতা কর্মীরাও সংক্রমিত হয়েছেন রোগীদের এসব ভুল ও অসাবধানতায়। বিশ্বে প্রকৃত পক্ষে কতজন ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী ও সেবাকর্মী করোনায় প্রাণ হারিয়েছেন, তার সঠিক তথ্য পাওয়া দুষ্কর। তবে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে যে চিত্র ইতিমধ্যে ফুটে উঠেছে, তা রীতিমতো আতঙ্কজনক। পৃথিবীর ইতিহাসে এভাবে ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মৃত্যু বিরল। ২৮ এপ্রিল ২০২০ তারিখে বিবিসি সংবাদ মাধ্যম শুধু ইংল্যান্ডে করোনায় প্রাণ হারানো শতাধিক ডাক্তার এবং স্বাস্থ্যকর্মীর নাম ও ছবি প্রকাশ করেছে। করোনাভাইরাসের উপত্তিস্থল চীনের উহান অঞ্চলে। এই শহরের কেন্দ্রীয় হাসপাতালে কাজ করতেন ৩৩ বছর বয়সী ডাক্তার লি ওয়েনলিয়াংগ। ২০১৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর তিনি প্রথম ভয়াবহ একটি ভাইরাস সম্পর্কে সহকর্মীদের সতর্ক করেন, যা পরবর্তীতে করোনা নামে শনাক্ত হয়। ৪ দিনের মাথায় উহান পুলিশ তাকে তলব করে এবং ইন্টারনেটে বানোয়াট মন্তব্যের দায়ে তাকে সতর্ক করে, তিরস্কার করে এবং ধমক দেয়। এরপর তিনি কাজে ফিরে রোগী দেখা শুরু করেন এবং একজন গ্লুকোমা রোগী করোনার উপসর্গ সঠিকভাবে না বলায় তার মাধ্যমে করোনায় আক্রান্ত হন ডা. লি ওয়েন লিয়াংগ। এভাবেই রোগীর ভুলে হালের আলোচিত ডাক্তার লি করোনার করাল থাবায় গত ৭ ফেব্রুযারি ২০২০ তারিখে প্রাণ হারান। সরকারি কড়া নিয়ন্ত্রণের কারণে চীনে করোনার কারণে মৃত ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সংখ্যা পাওয়া কঠিন। তবে গত মার্চ মাসের ৯ তারিখ অর্থাৎ করোনা ছড়ানোর শুরুর দিকেই বিজনেস ইনসাইডার সংবাদ মাধ্যম চীনে অনেক ডাক্তার বিশেষত তরুণ ডাক্তার প্রাণ হারিয়েছেন বলে তথ্য প্রকাশ করে। ঠিক এক মাসের মাথায় (৯ এপ্রিল ২০২০) আল জাজিরার প্রতিবেদনে ইতালিতে করোনায় ১০০ ডাক্তারের প্রাণহানির খবর আসে।

প্রায় একই সময় (৮ এপ্রিল) এএডটকম ডট টিআর একটি প্রতিবেদনে ফিলিপাইনে ২১ ডাক্তারের প্রাণ হারানোর খবর প্রকাশিত হয়। এভাবেই রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে বিশ্বময় প্রাণ হারাচ্ছেন ডাক্তার ও চিকিৎসাকর্মীরা। তাদের এই অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর ঢেউ লেগেছে বাংলাদেশেও। গত ১৫ ও ১৬ এপ্রিল দেশের সব গণমাধ্যমের শিরোনাম হয় সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের ডাক্তার মইন উদ্দিন। করোনা রোগীদের চিকিৎসা করতে গিয়ে তিনি নিজেই আক্রান্ত হয়ে একই মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। পরে তাকে রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং দেশবাসীকে কাঁদিয়ে ১৫ এপ্রিল তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। রোগীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের এ মৃত্যু মেনে নেওয়া সত্যিই কঠিন।

 

ফুল আছে কদর নেই

ফুল ভালোবাসে না এমন মানুষ পৃথিবীতে বিরল। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তার ‘ফুলের ফসল’ নামক কবিতায় লিখেছিলেন- ‘জোটে যদি মোটে একটি পয়সা, খাদ্য কিনিও ক্ষুধার লাগি; দুটি যদি জোটে, অর্ধেকে তার ফুল কিনে নিও, হে অনুরাগ॥’ তাই বিশ্বজুড়ে শত কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়। অনুষ্ঠান আয়োজন, অভিনন্দন ও স্বাগত জানানো কিংবা একটি সুন্দর পরিবেশ তৈরি করতে ফুলের পিছনে টাকা ব্যয় করতে কার্পণ্য করেন না শৌখিন মানুষ। বিশেষত ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবসে কিংবা নতুন বছরে ফুলের চাহিদা থাকে তুঙ্গে। কিন্তু করোনার কালো থাবা কেড়ে নিয়েছে ফুলের কদর। বাগানে ফুল ফুটেছে, প্রকৃতিতে বসন্তও এসেছে, অথচ ফুলের কদর নেই কোথাও। এমনকি করোনায় মৃতদের প্রতি পশ্চিমা সংস্কৃতিতে সাদা ফুল দেওয়ার চর্চাও যেন ভুলে গেছে মানুষ। হল্যান্ডের ‘আলসমার’ অকশানে ফুল বিক্রির সবচেয়ে বড় বাজার। প্রতিদিন নানা প্রজাতির কোটি কোটি ফুল বিক্রি হয় এখানে, যা আসে কেনিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে। এই বাজারে আজ ধস নেমেছে। নিউইয়র্ক টাইমসের ১২ এপ্রিলের প্রতিবেদনে প্রকাশ, মার্চ মাসের ১৩ তারিখের অকশানে টিউলিপ ফুলের দাম বারবার শূন্য দেখা যায় মনিটরে। এই দুঃখ সইতে না পেরে ১১০ বছরের পুরনো পারিবারিক ব্যবসায় মালিক ফ্র্যাংক বাজারে আনা ২ লাখ ফুল ধ্বংস করে ফেলেন। পত্রিকা মতে মার্চ মাসে ফ্রাংকের মতো অন্য চাষিরাও প্রায় ৪০ কোটি ফুল ধ্বংস করে, যার মধ্যে টিউলিপ ছিল ১৪ কোটি। সাধারণত মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে আন্তর্জাতিক নারী দিবস, ইস্টার এবং আন্তর্জাতিক মা দিবস থাকায় ফুল বিক্রির হার ও দাম সবচেয়ে বেশি থাকে। এ সময় হল্যান্ডের ফুলের বাজারে প্রতিদিন গড়ে ৩০ মিলিয়ন ডলার বা ২৬০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়, যা করোনা এবার হতে দেয়নি। বাংলাদেশে ফুলের রাজ্যখ্যাত যশোর ও ঝিনাইদহসহ বিভিন্ন জেলার চাষিরাও আজ ফুলের বাগান থেকে কিছুই পাচ্ছেন না। ফুলের পাইকারি বাজার গদখালীতে আজ কেবলই নীরবতা। কারণ বাগানে ফুল আছে কিন্তু ফুলের কদর নেই।

আরও কিছু বিপরীত চিত্র

বাংলা ভাষায় প্রচলিত একটি কথা হলো- ‘সাধ আছে সাধ্য নেই’ কিন্তু করোনায় সাধ্য বা সামর্থ্য আছে এমন অনেকের সাধই আজ হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। এমন সাধের অন্যতম স্বপ্ন পূরণের দেশ আমেরিকা কিংবা পৃথিবীর স্বর্গ বলে খ্যাত সুইজারল্যান্ড ভ্রমণ। এসব দেশে ভ্রমণের জন্য মুখিয়ে থাকেন ভ্রমণপিপাসু এবং বিত্তবানরা। করোনার ভয়াবহতায় এসব দেশে ভ্রমণ আজ যেন দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠেছে। অনেকের কাছে আজ বিত্ত বা সাধ্য আছে, অখন্ড অবসরও আছে, কিন্তু এসব দেশে ভ্রমণের সাধ নেই কারও।

করোনার কারণে মানুষের মনে সবচেয়ে বেশি দাগ কেটেছে উপাসনালয় বন্ধ হয়ে যাওয়া। দেশ-বিদেশের মন্দির, গির্জা বা প্যাগোডায় দেবদেবী, প্রভু-মহাপ্রভু অর্থাৎ উপাস্য আছেন, কিন্তু উপাসক বা পুজারী নেই। মূলত সরকারি নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ধর্মীয় আবেগকে নিয়ন্ত্রণ ছাড়া কোনো পথ খোলা ছিল না স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। মুসলমানদের মসজিদে ইমাম ও মুয়াজ্জিন থাকলেও মুসল্লি নেই। বিশেষত রমজান মাসে এই দৃশ্য ধর্মপ্রাণ মানুষের মেনে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর