মঙ্গলবার, ১৯ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

চেতনার বাতিঘর আনিসুজ্জামান

চেতনার বাতিঘর আনিসুজ্জামান

আনিসুজ্জামানের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন সামিয়া রহমান

জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান (১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৭-১৪ মে, ২০২০) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি একাধিক সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধাপরাধ বিচারের ক্ষেত্রে তাঁর ছিল অগ্রণী ভূমিকা। শিক্ষা ও গবেষণায় তিনি একাধিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছিলেন। টেলিভিশন চ্যানেল নিউজ টোয়েন্টিফোরের ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। সেখানে তাঁর সঙ্গে কথা বলেন সামিয়া রহমান

 

আপনার ‘কাল নিরবধি’ বা ‘আমার একাত্তর’ এ বইগুলোয় আপনার জীবনের কথা বলেছেন। আমাদের দর্শক জানতে চায় আমরা যদি সেই ১৯৩৭ সাল থেকে শুরু করি, শেখ আবদুর রহিম আপনার দাদা, এ টি এম মোয়াজ্জেম হোসেন আপনার বাবা, মা সিদ্দিকা খাতুন। সেই সময় থেকে আপনার গল্পগুলো শুনি।

চব্বিশ পরগনা গ্রামে আমাদের বাড়ি। আমি কখনো সেখানে থাকিনি। আমার জন্ম কলকাতায়। কলকাতায় একটানা সাড়ে ১০ বছর থেকেছি। খুলনায় এক বছরের কিছু বেশি, তারপর ঢাকায়। এই হচ্ছে আমার গোড়ার দিকের বৃত্তান্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৫৯ থেকে ’৬৯ পর্যন্ত ছিলাম। তারপর ১৬ বছর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারপর আবার ঢাকায় ফিরে আসি।

 

আপনার দাদা ‘মুসলমান হিতৈষী’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তিনি হজরত মুহাম্মদ (সা.) জীবনচরিত্র, ধর্মনীতি নিয়ে বই লিখেছিলেন। আপনার মা এবং বোন কবিতা লিখতেন। এই লেখালেখিটা কি উত্তরাধিকারসূত্রে?

মা অল্পস্বল্প গদ্য লিখেছেন। আমার বড় বোন কবিতা লিখতেন। মানে বাড়িতে একটা সাহিত্যচর্চার আবহ ছিল বলা যেতে পারে। কতখানি উত্তরাধিকারসূত্রে বলা মুশকিল। কেননা আমার আব্বা তো এ পথে যাননি। তবে একটা প্রেরণা নিশ্চয় কাজ করেছে এর পেছনে, কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত করেছে বলে মনে হয় না।

 

আমি জানতে চাই আপনার জীবনে কার প্রভাব বেশি মা-বাবা না আপনার দাদার?

আমার জীবনে মায়ের প্রভাব বোধহয় বেশি। দাদাকে তো আমি দেখিইনি। আব্বার নৈকট্য লাভ করেছি। কিন্তু আমার মনে হয় মায়ের যে জীবনাচরণ এবং আমাকে যে শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা তিনি করেছেন, তা আমার জীবনে বেশি কার্যকর হয়েছে।

 

আমি একটা ঘটনা শুনেছিলাম যে, আপনি তখন ঢাকা ইউনিভার্সিটির টিচার। বাসায় এসে দেখলেন- আপনার মা পত্রিকা পড়তে খুব পছন্দ করতেন কিন্তু তিনি আর পড়তে পারছিলেন না।

এটি মায়ের অভ্যাস ছিল, একেবারে পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠা থেকে শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত খুঁটিয়ে পড়া। ১৯৬৩ সালে তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাড়ি ফিরে দেখি মায়ের কথাবার্তাগুলো এলোমেলো।

 

তখন তাঁর বয়স কত ছিল?

তাঁর বয়স তখন হবে তখন ৫০ বছর। কাগজ হাতে নিয়ে আবার সরিয়ে রাখছেন পড়তে পারছেন না। তার পরই তো ধরা পড়ল যে স্ট্রোকের মতো হয়েছে, স্মৃতি ধ্বংস হচ্ছে। ডাক্তাররা বললেন আবার বর্ণপরিচয় থেকে শেখাবার চেষ্টা করতে। আমি শেখাবার চেষ্টা করতাম কিন্তু তিনি হেসে বই সরিয়ে দিতেন। কিছু কিছু কথা মনে থাকত। আমার ছোট ভাইয়ের নামটা মনে থাকত। আবার আমাকে খুঁজতেন। ওষুধ খেতেন আমার হাতে। আর কিছু সাবস্ক্রিউশন করতেন যেমন মুরগি না বলে পাখি বলছেন। এ রকম কিছু শব্দ বলছেন। ওই অবস্থায় বছর দেড়েকের একটু বেশি থেকে মারা যান।

আপনি ১৫ বছর বয়সে একুশের প্রচারপত্র লিখেছিলেন। ওই বয়সে এই সচেতনতাটা কেমন করে এসেছিল?

আমি তখন পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের দফতর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছি। যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক অলি আহাদ বললেন প্রচার পুস্তিকা লিখতে। প্রথমে আমার মনে হয়েছিল আমি কী জানি যে লিখব। উনি বললেন যা জানেন লিখেন, আমি সংশোধন করে দেব। এখন ভাবতে খুব গৌরববোধ করি যে, আমার হাত দিয়েই বায়ান্ন সালের অসহযোগ আন্দোলন সম্পর্কে প্রথম প্রচার পুস্তিকা লেখা হয়।

 

আপনার জীবনে কিছু মানুষের অনেক প্রভাব আছেÑ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, শহীদ মুনীর চৌধুরী স্যারের কথা বলি কিন্তু আরেকজনের কথা আমি একটু বলতেই চাই, তিনি হচ্ছেন সিদ্দিকা জামান বেবী, আপনার স্ত্রী। আমি সেই মানুষটার গল্প শুনতে চাই।

আহম্মেদ হোসেন আমার বন্ধু ছিল স্কুল থেকে। তার মামাতো বোন সিদ্দিকা। মামাতো বোনের প্রতি তার একটু দুর্বলতাও ছিল। কিন্তু সে যখন আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়, তখন তাকে ছাপিয়ে আমাদের ঘনিষ্ঠতা বেড়ে গেল। টেলিফোনে কথা হতো বেশি, দেখা হতো কম।

 

স্যার, আমি এবার ওই প্রসঙ্গে আসতে চাই। আপনার শিক্ষক ছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, শহীদ মুনীর চৌধুরী। আপনার ছাত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই মানুষগুলোকে কীভাবে দেখেছেন?

আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয় ঢুকলাম তখন বাংলা বিভাগের প্রধান ছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্। তিনি সরাসরি আমাদের ক্লাস নেননি। আমার যখন দ্বিতীয় বর্ষ তখন তিনি অবসর নিয়ে চলে গেলেন পাকাপাকিভাবে। কিন্তু ওই অল্প সময়ের মধ্যে তখন শিক্ষক এবং ছাত্রের সংখ্যা ছিল খুব কম। আমাদের ভাগে বোধহয় ছয়জন শিক্ষক। আমরা যখন ভর্তি হলাম তখন সবাই বলল এবার বাংলা বিভাগে অনেক ছেলেমেয়ে ভর্তি হয়েছে। অনেক মানে ১০ জন। আমাদের আগের বছরে দুজন ছিলেন। ফলে শিক্ষক ছাত্রের মধ্যে একটা সহজ সম্পর্ক, অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারত। তা ছাড়া শহীদুল্লাহ্ সাহেব আমাদের পরিবারকে চিনতেন। কাজেই আমার প্রতি বিশেষ প্রীতি ছিল তাঁর। শহীদুল্লাহ্ সাহেবের পরে যিনি বিভাগের প্রধান হলেন অধ্যাপক মুহম্মদ আবদুল হাই। তিনি বিভাগে একটা গবেষণার পরিম-ল তৈরি করেন। আমি যখন অনার্স শেষ বর্ষে, তখন তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কী করতে চাও ভবিষ্যতে?

আমি বললাম, স্যার আমি শিক্ষকতা করতে চাই।

তিনি বললেন আগে গবেষণা কর, পরে শিক্ষক হবে।

আমি বললাম, ঠিক আছে। এম এ যখন ভাইভা পরীক্ষা দিলাম, তারপর তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কী করবে?

আপনি যখন বলছেন গবেষণাই করব।

কী বিষয়ে?

আমি দুটো বিষয় বললাম। তার মধ্যে তিনি একটা বেছে দিলেন এবং আমাকে বললেন, একটু অপেক্ষা কর। বাংলা একাডেমির গবেষণা বৃত্তির বিজ্ঞাপন বেরোবে। তখন তুমি ওটার জন্য আবেদন কোরো। আমি আবেদন করলাম, বৃত্তি পেলাম। ওই বৃত্তির কাজ শেষ হতে যখন ১১ দিন বাকি তখন এসে আবার আমাকে বললেন, বিভাগে শিক্ষক নেই তুমি এখনই জয়েন কর। এটা নিয়ে বাংলা একাডেমিতেও অসন্তোষ হয়েছিল। বাংলা একাডেমির পরিচালক ছিলেন ড. মুহম্মদ এনামুল হক। বাংলা একাডেমির কার্যকরী সংসদে যাঁরা ছিলেন তাঁরা বললেন যে, এনামুল হক আমাকে ছুটি দিয়ে অন্যায় করেছেন। এবং আমি স্বেচ্ছাচারিতার পরিচয় দিয়েছি এটা আমার বর্তমান নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষকে জানানো হোক। তাঁরা ইউনিভার্সিটিকে চিঠি লিখলেন। ভাইস চ্যান্সেলর চিঠি পেয়ে হাই সাহেবকে ডাকলেন, জিজ্ঞেস করলেন কী ব্যাপার। হাই সাহেব ব্যাখ্যা করলেন। ব্যাপারটা ওখানে চাপা পড়ে গেল। হাই সাহেবের কাছে আমি ঋণী, তিনি না হলে আমার হয়তো গবেষণায় আসা হতো না।

 

আপনার কাছে আমরা এত ভালো ভালো গবেষণা পেয়েছি...

যা-ই করেছি ভালো হোক মন্দ হোক- এটা আমার প্রেরণায় করেছি। আর মুনীর চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা খুব বন্ধুর মতো ছিল। ইংরেজি এবং বাংলা দুই-ই পড়ার সুযোগ হয়েছে আমার। অসাধারণ ভাবগম্ভীর ছিলেন। এত চমৎকার করে কথা বলতেন! সবাই ওঁর দিকে তাকিয়ে থাকতাম।

 

আপনার তো একটা বই আছে তাঁর ওপর লেখা।

আমি তাঁর একটা জীবনী ও সাহিত্যকর্মের ওপর বই লিখেছি। সেটি তাঁর সম্পর্কে প্রথম বই। হুসানুল ইসলাম বইটি আলোচনা করতে গিয়ে বলেছিলেন, এটা কালি কলমে লেখা নয়, ভালোবাসা দিয়ে লেখা। সেটা কিছুটা সত্যি যে, তাঁর জীবনদৃষ্টি আমাকে অনেক বেশি প্রভাবিত করেছে।

 

আর একটি বিষয়ে জানতে চাই আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আপনার ছাত্রী ছিলেন, তাঁকে কীভাবে দেখেছেন?

শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী ছিল। যে সময় হাসিনা আমাদের ছাত্রী ছিল তখন শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারে। স্পষ্ট ছিল এটা যে, একটা প্রতিকূল সময়ের মধ্য দিয়ে সে পড়ালেখা করেছে। একটা গুণের কথা বলব তা হচ্ছেÑ কখনো তার ওই রকম কোনো মনোভাব আমি দেখিনি, সে যে একটা ছাত্র সংগঠনের বড় রকম প্রতিনিধি। মানে অহংকারী, উদ্ধত মনোভাব দেখিনি। সহপাঠীদের সঙ্গে বা বিভাগের অন্য ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে সহজ সম্পর্ক ছিল। তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল বেবী মওদুদ। বেবী মওদুদ তখন ছাত্র ইউনিয়ন করে। হাসিনা ছাত্রলীগের নেতা। তবে তাদের ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব খুব নিবিড় হয়েছিল। তাদের ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব এত নিবিড় হয়েছিল যে ভাবা যায় না। তার মানে সে মানবিক গুণটা দেখতে পেত রাজনীতির বাইরে; এটা একটা বড় গুণ আমি বলব। তিনবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরও হাসিনা তার দুই শিক্ষক রফিকুল ইসলাম ও আমাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করে যা আমাদের মর্ম স্পর্শ করে।

 

তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে আপনার কীভাবে পরিচয়?

তাজউদ্দীনের সঙ্গে পরিচয় যখন আমি যুবলীগ করি তখন। ১৯৫১ সালের ডিসেম্বরের ঘটনা। তখন থেকেই পরিচয়। কিছুদিন শিক্ষকতায় থাকলেন তারপর জেলে গেলেন, আমি ঢাকার বাইরে গেলাম। কিন্তু যোগাযোগ কখনো ছিন্ন হয়নি।

 

আপনি কি তাঁর বক্তৃতা লিখে দিতেন?

এটা পরে, যখন তিনি প্রধানমন্ত্রী মুজিবনগর সরকার হয়ে কথা বলতেন তখন।

 

কিন্তু তিনি বাংলা-ইংরেজিতে তুখোড় ছিলেন।

ভাষার ওপর অসাধরণ দখল ছিল। অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ আর আমি দুজনই মিলে কাজটা করতাম। যেটা হতো আমরা তিনজনেই বসে প্রধানমন্ত্রীর কথা শুনতাম। তিনি কী বলতে চান। তারপর হয় সারওয়ার মুরশিদ সাহেব ইংরেজি টাইপ করতেন। আর আমি বাংলা ভাষায় করতাম।

 

আপনার আত্মজীবনী তো একটি ইতিহাস। সে ইতিহাসের একটি অংশ জানতে চাই। একটি দুর্ঘটনার পর বঙ্গবন্ধু আপনাকে দেখতে এসেছিলেন, কী ঘটেছিল?

আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় যোগ দিতে যাচ্ছিলাম, কুমিল্লার চান্দিনার কাছে গিয়ে কিছুটা নিজের ভুলেই দুর্ঘটনা ঘটল। আমি গাড়ির সামনে রাস্তা থেকে ছিটকে ধান খেতের মধ্যে পড়ে গেলাম। আমার কলারবন ভাঙল কিন্তু টের পাইনি প্রথমে। আমাদের উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হলো কুমিল্লা সিএমএইচে। হুমায়ূন আহমেদের বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ তখন ডিএইচপি ছিলেন। সিএমএইচে আমার যে এক্স-রে করা হলো তাতে কলারবন ভাঙাটা ধরা পড়েনি। কিন্তু আমি বেশ কষ্ট পাচ্ছি যন্ত্রণায়। ডাক্তারকে বলছি বা তখন তাঁরা ছেড়ে দিয়েছেন সিএমএইচে আমি বার্ডের গেস্টহাউসে আছি। তখন ডাক্তার বললেন, চলেন দেখি একটা এক্স-রে করি। এক্স-রে করে তিনি বললেন, আপনি এত মৃদুভাবে বলছেন আমি কীভাবে বুঝব আপনার কলারবন ভেঙে গেছে! তারপর যা হোক ব্যান্ডেজ করে ঢাকায় এলাম। ঢাকায় সার্জন আহমেদ মামুনকে দেখালাম। এ দুর্ঘটনার খবর পেয়ে বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দীন আহমদকে নিয়ে আমাকে দেখতে এলেন  নীলক্ষেতের বিশ্ববিদ্যালয় টিচার্স কোয়ার্টারে। তো ১৯৬৯ সালে সবাই তো একসঙ্গে ঘুরত এবং স্লোগান দিত- ‘আসাদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না/জেলের তালা ভাঙব শেখ মুজিবকে আনব’। বঙ্গবন্ধু যখন বেরিয়ে যাবেন তখন আমার বড় মেয়ে আমার কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, আসাদ আসেনি। ওরা এ স্লোগান দেওয়ায় আসাদ আর মুজিবের নাম খুব কাছাকাছি হয়ে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার মেয়ে কী বলে? আমি বললাম, ও জানতে চাচ্ছে যে আসাদ আসছে কিনা। তিনি হেসে নত হয়ে গাল ধরে বললেন, ওরা তো আমার কাছে এই কৈফিয়ত চাইতেই পারে। আসাদ যে আত্মাহুতি দিয়েছেন সে সম্পর্কে তাঁর নিজের দায়িত্ববোধÑ তাঁকে মুক্ত করার জন্য আসাদ প্রাণ দিয়েছেন। এটা নিজে ভোলেননি, তিনি তাঁর প্রতি একটা ঋণ উপলব্ধি করতেন এটা একটা বড় ব্যাপার ছিল।

 

মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনাদের ভূমিকা এবং মুজিবনগর সরকারে আপনার অংশগ্রহণ কেমন ছিল?

মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রথম এক মাস আমি দেশে ছিলাম। তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতাম। ২৬ এপ্রিল ’৭১ আগরতলা চলে যাই। ওখান থেকে মে’র মাঝামাঝি কলকাতায়। আমি পরিবার নিয়ে গিয়েছিলাম। আমার সঙ্গে শ্যালকের পরিবারও ছিল। আমরা কলকাতার বাড়িতে উঠি আর কলকাতার বিশ্ববিদ্যালয় সহায়ক সমিতির সঙ্গে যোগাযোগ করি। তাঁরা আমাকে রীতিমতো কাজে লাগিয়ে দেন শরণার্থী শিক্ষকদের ব্যাপারটা দেখার জন্য। এবং এ অবস্থা ঠিক হয় যে, বাংলাদেশের সকল পর্যায়ের শরণার্থী শিক্ষককে নিয়ে আমরা একটি সমিতি করব। ড. মল্লিক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন। তিনি সভাপতি হবেন, আমি সাধারণ সম্পাদক। এ রকম অবস্থায় তাজউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে দেখা হলো। আমি আসলে আগরতলা থেকে তাহের উদ্দিন ঠাকুরের মাধ্যমে খবর পাঠিয়েছিলাম যে আমি আসছি। কিন্তু পরে বুঝলাম যে তাহের উদ্দিন ঠাকুর খবরটা তাকে দেননি। ফলে আমার আসার কথাটা জানতে পারেননি। যখন জেনেছেন তখন এ রকম একটা ব্যবস্থা হয়ে গেছে। তিনি আমাকে দেখে বললেন যে, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কাজ করতে হবে। আমি বললাম, আমি তো কথা দিয়েছি। তো তিনি বেশ বেদনার্ত কণ্ঠেই বললেন, আপনি আমার সঙ্গে থাকবেন না? বললাম, আমি যেখানে থাকি আপনি যখনই ডাকবেন আসব। তারপর অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ চৌধুরীকে চেয়ারম্যান করে প্ল্যানিং কমিশন করা হলো। এর সদস্য ছিলেন ড. খান সারওয়ার মুরশিদ, ড. মোশাররফ হোসেন, ড. স্বদেশরঞ্জন বোস এবং আমি। তো তখন আমাদের বলা হয়েছিল তিন ধরনের পরিকল্পনা করতেÑ একটা দীর্ঘমেয়াদি, একটা মধ্যমেয়াদি, একটা স্বল্পমেয়াদি। আমরা কমিশন থেকে বললাম যে, শুধু স্বল্পমেয়াদি করব। দেশ স্বাধীন হলে পরিবর্তিত অবস্থায় কী করতে হবে তা আমরা ঠিক করব। আমরা বর্তমান অবস্থার ভিত্তিতে স্বাধীন হওয়ার পর কী করতে হবে, এগুলো আমরা করব।

 

আমাদের সংবিধানের বাংলা অনুবাদ করেছিলেন আপনি।

১৯৭২ সালে বাংলাদেশ গণপরিষদ সংবিধান রচনার জন্য একটি কমিটি তৈরি করে, আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন তার আহ্বায়ক হন। কামাল হোসেন এ দায়িত্ব পেয়ে আমাকে খবর দেন চট্টগ্রামে- আপনি চলে আসেন আপনাকে এর বাংলা করতে হবে। তখন আমি আমার স্কুলজীবনের সহপাঠী নেয়ামত বাসির - সে ছিল গণপরিষদের বিতর্ক শাখার সহসম্পাদক এবং ওই শাখার আরেকজন শামসুদ্দিন - এ দুজনকে নিয়ে কাজটা করি। তবে এ কথা বলতে হবে যে, কামাল হোসেন ইংরেজি খসসা করেছেন, আমরা তার বাংলা করেছি।

 

স্বাধীনতার পর আপনাকে শিক্ষা সচিবের দায়িত্ব নিতে বলা হয়েছিল, আপনি নেননি কেন?

সেটা আরও পরে, ১৯৭৪ সালে। আমরা যেদিন কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের চূড়ান্ত রিপোর্ট উপস্থিত করতে যাই বঙ্গবন্ধুর কাছে, সেদিন তিনি আমাকে প্রস্তাব দেন। তখন কবীর চৌধুরী সাহেব শিক্ষা সচিবের দায়িত্ব ছেড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসবেন এ রকম একটা পরিস্থিতি। আমার আবার সেপ্টেম্বরে এক বছরের জন্য লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা। আমি তখন বললাম যে, দেখুন, প্রথম কথা হচ্ছে আমি এ কাজের উপযুক্ত নই। কেননা প্রশাসন আমার ধাতেই সইবে না। আর দ্বিতীয় হচ্ছে, আমি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা গবেষণার সুযোগ পেয়েছি। এটা হাতছাড়া করতে চাই না। তিনি বললেন, আচ্ছা, তুমি আরেকটু ভাব। আমাকে কালকে বোলো। আমি আবার পরদিন গেলাম। এর মধ্যে আমি তাজউদ্দীন সাহেবকে বলেছিলাম যে আপনি একটু বঙ্গবন্ধুকে বোঝাবেন।

তিনি বললেন, বঙ্গবন্ধু যদি কথাটা তোলেন তবেই আমি বলব, না হয় বলব না। তিনি ওই দিনই দেখা করতে গেলেন, বঙ্গবন্ধু কথাটা তুললেন না। তখন তাজউদ্দীন সাহেব আমাকে বললেন, একজন ভালো শিক্ষককে খারাপ আমলা করে লাভ কী। তাতেও কিছুটা কাজ হলো। তো বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন, তুমি লন্ডন থেকে ফিরে আমার সঙ্গে দেখা কোরো। আমি লন্ডন থেকে ফিরি ১৩ আগস্ট, ১৯৭৫; আমার আর শেষ দেখা হয়নি।

 

এরপর আপনাকে সমালোচনা ও নিন্দার মুখোমুখি হতে হয়েছিল ইউনিভার্সিটিতে আমি যতটুকু যানি স্যার।

যেটা হলো সেটা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর, সব দিকেই একটা পরিবর্তনের ছাপ এসেছিল। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা গেল যাদের আমরা কেউই চাইনি তারা কোনো অসুবিধার সম্মুখীন হননি। তারা তখন আমাদের বিরুদ্ধে লেগে গেলেন। তারা আমার বিরুদ্ধে বললেন, আপনি ভারত থেকে এসেছেন ভারতে ফিরে যান ইত্যাদি। তা ছাড়া অনেক সময় অনেক মানুষের দুর্ব্যবহার বা নিন্দা এমনকি হত্যার হুমকি শুনতে হয়েছে।

 

আপনি জীবনের যে কাজগুলো করেছেন এগুলো আমাদের বাংলাদেশের ইতিহাসে দলিল হয়ে আছে। কিন্তু স্যার আমি যদি জানতে চাই আপনি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আন্দোলন থেকে শুরু করে ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে সবকিছুর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সেই স্বপ্নের বাংলাদেশ সেই বাংলাদেশ এখন কেমন আছে?

আসলে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলাম সেই বাংলাদেশ আমরা কখনো গড়ে তুলতে পারিনি, এখনো পারিনি। বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে সাম্প্রদায়িক ঘটনা বেশ ঘটেছে। এটা আমরা কখনো আশা করিনি। আর আশা করিনি বাংলাদেশের সামরিক শাসন। সেটা তো আমরা প্রায় ১৫-১৬ বছর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ করেছি। আমাদের যে অভিজ্ঞতা তা আমাদের প্রত্যাশার সঙ্গে মেলেনি এবং আজকেও যে আমরা সেই...

 

রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম কি আসলে জঙ্গিবাদের সূচনা করছে বলে আপনি মনে করছেন?

আমার মনে হয় না, কিন্তু এটা নিশ্চয়ই জঙ্গিবাদকে উৎসাহিত করছে। তারা একটা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই যে বলা যে, দেশের বেশির ভাগ মানুষ মুসলিম। এ সুযোগটা তারা পাচ্ছে ধর্মের সঙ্গে রাজনীতি যুক্ত করার কারণে। জঙ্গিবাদ পৃথিবীর নানা জায়গায়ই দেখা দিচ্ছে। আমাদের এখানে জঙ্গিবাদ একটা ভালো ক্ষেত্র পেয়ে গেল, রাজনীতির সঙ্গে ধর্মকে যুক্ত করায়।

 

আমি জামায়াত প্রসঙ্গে আপনার কাছে একটু জানতে চাইব। কারণ আপনি বলেছিলেন যে, জামায়াতকে সরকার নিষিদ্ধ করছে না কেন?

এই মানুষটি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন না। কিন্তু তিনি ভীষণভাবে রাজনীতিসচেতন ছিলেন। আসলে এ কথাটা আমাকে একজন বলেছিলেন যে আপনারা জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে চাইছেন! তো এটা তো বিএনপির সুবিধা হয়ে যাবে। এরা জায়গা না পেয়ে বিএনপিতে চলে যাবে। আমার জব ছিল যে জামায়াত এবং বিএনপির মধ্যে এখন তো একটা মৈত্রী আছে। সুতরাং নতুন করে কী হবে? কিন্তু যেহেতু জামায়াত যে সন্ত্রাসী কাজকর্ম বেশি করে এটা প্রমাণিত হয়েছে। তার পরও আমরা কিছু কিছু ঘটনা দেখেছি।

সে কারণে আমরা মনে করি যে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা দরকার। আর জঙ্গিবাদের সঙ্গে সম্পর্কের যে কথাটা হলোÑ আমি আবারও বলি যে, জঙ্গিবাদ যেহেতু একটি আন্তর্জাতিক ব্যাপার হয়ে গেছে। আমাদের দেশে দেখা দিতই। কিন্তু রাজনীতির সঙ্গে জড়ানো বা সম্পর্ক থাকায় এটা একটি উর্বর ক্ষেত্র পেয়ে গেল। এটাই আমার অভিমত।

 

স্যার, আমি যদি বলি বাকস্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতার কথাÑ বাংলাদেশে কতটুকু আছে?

আমরা সবাই তো কথা বলছি। কথা বলায় স্বাধীনতা নেই তা বলা যাবে না। এতগুলো সংবাদপত্র, এতগুলো টেলিভিশন চ্যানেল, এতগুলো বেতার! এই সম্প্রতি তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কিত ৫৭ ধারা নিয়ে যে তুমুল তর্ক হচ্ছে এবং আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, অত্যন্ত মামুলি কারণে এই ধারায় মামলা হচ্ছে, মানুষকে হয়রানি করা হচ্ছে; সুতরাং এটা দেখলে তো মনে হয় যে এমন একটা আইন হলো যা বাকস্বাধীনতাকে খর্ব করছে। গণতন্ত্রে দ্বিমত তো থাকেই, অনেক মতই থাকে। কিন্তু পারস্পরিক সহানুভূতিশীলতা না থাকলে গণতন্ত্র সামনে এগোতে পারে না। তার অভাব বোধ করছি।

 

আপনি যে গণতন্ত্রের দ্বিমতের কথা বললেন, গণতন্ত্র আমরা যতটুকু পড়েছি বা জেনেছি যে গণতন্ত্র তখনই শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় যখন শক্তিশালী বিরোধী দল থাকে। না হলে তো একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। আমাদের দেশে এখন কি কোনো শক্তিশালী বিরোধী দল আছে?

এ মুহূর্তে নেই। আমি বলছি কথাটা, আমাদের এখানে সংসদে জাতীয় পার্টি বিরোধী দলে আছে কিন্তু জাতীয় পার্টির সদস্যরা মন্ত্রিত্বও গ্রহণ করেছেন। কাজেই এখানে একটা বিরোধিতা আছে। আর বড় বিরোধী দল যেটা বিএনপি, সেটা তো নির্বাচনে না গিয়ে সংসদের বাইরে। কাজেই, সংসদ যে রাজনীতির একটা মূল কেন্দ্র হতে পারত তা হচ্ছে না। সংসদ অকার্যকর আমি তা বলব না, আমি বলব, রাজনীতির মূল কেন্দ্র হিসেবে সংসদের যে ভূমিকা তা পালন করা যাচ্ছে না এই কারণে।

 

বাংলা বানানের ক্রমাগত পরিবর্তন হচ্ছে। ঈদ বানানটি হচ্ছে ইদ। এ পরিবর্তন আসলে কতটুকু সঠিক?

১৯৩৬ সালে একবার বানান সংস্কার হয়েছিল। দুঃখের বিষয়, তা আমরা ভালোভাবে নিতে পারিনি। তারপর যা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে যে বাংলা আকাদেমি তারা বাংলা সংস্কার করেছে, ঢাকায় আমরা বাংলা একাডেমিতে বাংলা বানান সংস্কার করেছি। এ দুটোর মধ্যে অনেক মিল আছে। কিছু কিছু গরমিল আছে। এ ছাড়া আবার দেখা যায়, পশ্চিমবঙ্গে বিশেষ করে এতগুলো সংস্কার হওয়ায় সবার মধ্যে বিভ্রান্তি আসে। সেটা ঠিক যদি বানান সংস্কারের মূল ব্যাপারটা বোঝা যায়, তাহলে আমার মনে হয় বিভ্রান্তিটা হবে না।

 

আমরা যারা বাংলা সাহিত্য বা বাংলা ভাষার শিক্ষার্থী নই বা বিষয়টি ওইভাবে পড়ে আসিনি। আপনি বললেন যে, মূল বিষয়টি বোঝা যায় বা আমাদের পক্ষে তো মূল বিষয়টি বোঝা সম্ভব নয়।

না, সেটাই। এটা আমাদের দায়িত্ব হবে সবাইকে বুঝিয়ে দেওয়া। কেন বানান সংস্কার হলো। যেমন আপনি কথাটা বললেন, আগে যেটা ঈ ছিল এখন সেটা ই হয়েছে। বানানগুলো নিয়ে ’৩৬ সালেই বলা হয়েছে যে এগুলোর বিকল্পে ই-কার হবে। তারা বলেছেন যে ঈ-কারও চলবে আবার ই-কারও চলবে। আমরা বললাম যে, একটাই নেওয়া হোক- ই-কার। এটাই যদি সবাইকে বোঝানো যেত ভালো করে তাহলে এ বিভ্রান্তিটা হতো না।

 

সেই পরিবর্তনটা আমরা মেনে নিয়েছি। ইদানীং আবার ঈ-কার ঈদটা যখন ই-কার হয়ে যায় তখন আমরা একটু কনফিউজ হয়ে যাই।

শহীদ -কার এগুলো লাগে, আমরা এটাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি, আরবি উচ্চারণের সঙ্গে সংগতি রেখন্ডীকার করা হয়েছিল। কিন্তু এই বিদেশি ভাষার উচ্চারণের সঙ্গে সংগতি রেখে আমরা যেসব বানান দেখি তা নয় আর কি।

 

আগামীর বাংলাদেশ নিয়ে আপনার স্বপ্ন কী।

দেশকে নিয়ে ওটাই স্বপ্ন যে, মুক্তিযুদ্ধের সময় যে দেশ ভেবেছিলাম, আমাদের সংবিধান রচনার সময় বা গ্রহণ করার সময় যে দেশ ভেবেছিলাম, একদিন না একদিন আমরা তা অর্জন করব। নিজেকে নিয়ে মনে হয় যে আমার কিছু কাজ অসমাপ্ত আছে বিশেষ করে পুরনো বাংলা গদ্যের একটা সংকলন করতে চাই। অনেকদিন ধরে চেষ্টা করছি কিন্তু কাজটা এগোচ্ছে না।

 

স্যার, আপনার জন্য অনেক শুভ কামনা। আপনার অসমাপ্ত কাজগুলো অবশ্যই সমাপ্ত করুন।

সর্বশেষ খবর