শনিবার, ৬ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

কোন দেশে করোনার কী অবস্থা

আবদুল কাদের

কোন দেশে করোনার কী অবস্থা

করোনাভাইরাস থাবা বসিয়েছে সমগ্র বিশ্বে। মরণঘাতী এই রোগে বেসামাল বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলো। প্রতিদিনই দীর্ঘতর হচ্ছে সংক্রমণ আর মৃত্যুর মিছিল। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে বিশ্বের অনেক দেশ ইতিমধ্যে শিথিল করছে অভ্যন্তরীণ জরুরি অবস্থা। তাতে কোথাও সংক্রমণের সংখ্যা বাড়ছে, আবার কোথাও কমছে। বিশ্বে করোনাভাইরাসের মহামারীর বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরা হলো আজকের রকমারিতে।

 

বিশ্বজুড়ে মৃতের সংখ্যা চার লাখ ছুঁই ছুঁই

চীন থেকে করোনাভাইরাসের শুরু। এরপর সংক্রমিত হলো পাশের রাষ্ট্র হংকং ও দক্ষিণ কোরিয়া। মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে মরণঘাতী ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ল সমগ্র বিশ্বে। জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির তথ্য বলছে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বিশ্বজুড়ে মৃতের সংখ্যা চার লাখ ছুঁই ছুঁই। এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পুরো বিশ্বে এখন এই ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৬৭ লাখেরও বেশি। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রেই মৃতের সংখ্যা প্রায় দুই লাখের কাছাকাছি। চীনের সরকারি গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যু হয়েছিল গত ১১ জানুয়ারি। এরপর থেকে ২১০টিরও বেশি দেশ ও এলাকা এই ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছে। আর দীর্ঘতর হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল।

এ পর্যন্ত ৩টি দেশে মৃতের সংখ্যা ৩০ হাজার ছাড়িয়েছে। যদিও এসব দেশের মধ্যে মৃতের সংখ্যায় খুব একটা পার্থক্য নেই। তবে এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে লাতিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিল। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আর মৃত্যু দুটোই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দেশটিতে। অন্যদিকে দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যায় যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে গেল মেক্সিকো। একদিনের ব্যবধানে দেশটিতে মারা গেছে প্রায় ১ হাজার ৯২ জন। এদিকে ইউরোপের দেশ ইতালি এবং স্পেনের অবস্থা অনেক স্থিতিশীল। সংক্রমণ আর মৃত্যু কমেছে ইতালিতে। তবে স্পেনে ষষ্ঠবারের মতো বাড়ছে জরুরি অবস্থার মেয়াদ। জার্মানিতে লকডাউন শিথিল করায় বাড়ছে সংক্রমণ। একদিনের ব্যবধানে দেশটিতে করোনা শনাক্ত হয়েছে ২১৩ জনের। এশিয়ার দেশ ভারত একদিনে সংক্রমণের রেকর্ড গড়েছে। ৯ হাজারের বেশি করোনা শনাক্ত হয়েছে দেশটিতে। আর সর্বমোট করোনাভাইরাস সংক্রমণের হারে চীনকে ছাড়িয়ে গেছে পাকিস্তান। এদিকে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশে করোনা রোগীর সংখ্যা বাড়ছে দ্রুত।

ফ্রান্স, চিলি, কানাডা, ইরান, সৌদি আরবসহ বিশ্বের অসংখ্য দেশের অবস্থা অনেকটা স্থিতিশীল। কোথাও কোথাও সংক্রমণের হার খুবই সীমিত। যদিও বিশ্বজুড়ে অনেক দেশই ইতিমধ্যে শিথিল করেছে অভ্যন্তরীণ জরুরি অবস্থা। কোনো কোনো দেশ ইতিমধ্যে খুলে দিয়েছে সীমান্ত। তবে বিশ্বজুড়ে অনন্য নজির হয়ে থাকল ইউরোপের দেশ সুইডেন। কোনোরকম অবরুদ্ধ অবস্থা ছাড়াই আক্রান্ত দেশগুলোর তুলনায় দেশটিতে নিম্নমুখী সংক্রমণের হার।

 

যুক্তরাষ্ট্রে আবারও ভয়ঙ্কর হচ্ছে করোনা পরিস্থিতি

জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাসের প্রথম রোগী শনাক্ত হয়। এরপর রোগীর সংখ্যা হাজার ছাড়ায় ৫০তম দিনে। পরে এক লাফে রোগী ছাড়িয়ে যায় ৫ হাজার। মার্চ মাসের শেষ থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে সংক্রমণের হার। এপ্রিল ও মে, সর্বোচ্চ সংক্রমণ আর মৃত্যুতে পৃথিবীর সব দেশকে ছাড়িয়ে যায় দেশটি। এ ছাড়া করোনাভাইরাসে মৃত্যু ও আক্রান্তে আগে থেকেই শীর্ষে যুক্তরাষ্ট্র। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী দেশটির মোট করোনা আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ১৯ লাখ ২৪ হাজার ৫১ জন। এর বিপরীতে দেশটি এখন পর্যন্ত প্রায় ১ কোটি ৯৫ লাখ ৬৮ হাজার ৬৯টি করোনা পরীক্ষা চালিয়েছে। আর দেশটিতে বর্তমানে মৃতের সংখ্যা এক লাখ ১১ হাজার ছুঁই ছুঁই। কয়েকদিনের মধ্যে সংখ্যাটিকে ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। করোনার এমন সংকটময় মুহূর্তে শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তার হাতে জর্জ ফ্লয়েড নামের কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তির মৃত্যুতে বিক্ষোভে ফুঁসছে গোটা যুক্তরাষ্ট্র। দেশব্যাপী অব্যাহত রয়েছে বিক্ষোভ আর প্রতিবাদ। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ওয়াশিংটন ও নিউইয়র্ক শহরে কারফিউ অমান্য করে বিক্ষোভ করছে প্রতিবাদকারীরা। এ সময় বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভের সময় লুটপাট ও ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে। এর আগে করোনাভাইরাস মহামারী নিয়ন্ত্রণে জারি করা অবরুদ্ধ অবস্থার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি অঙ্গরাজ্যের হাজার হাজার মানুষ। ‘স্টে অ্যাট হোম’ নির্দেশনা অমান্য করেই রাস্তায় নেমেছিল তারা। বাল্টিমোরভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয় জনস হপকিন্স জানিয়েছে, এমনিতেই দেশটিতে মোট আক্রান্ত বিশ্বের মোট আক্রান্তের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ! এমন পরিস্থিতি বিরাজমান থাকলে ভবিষ্যতে করোনা সংক্রমণের হার বা রিপ্রোডাকশন রেট ছাড়িয়ে যেতে পারে পূর্বের সব রেকর্ড। এতে ভাইরাস আরও ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা। তবে সুখবর হলো- প্রথমবারের মতো একদিনে নিউইয়র্ক সিটিতে নতুন করে কারও মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। গত মার্চের মাঝামাঝিতে সেখানে করোনার প্রাদুর্ভাবের পর এই প্রথম কেউ করোনায় মারা যায়নি। অন্যদিকে করোনা আক্রান্ত সুস্থ ব্যক্তির প্লাজমা দিয়ে চালানো পরীক্ষা সফল হয়েছে। আশার কথা হচ্ছে প্লাজমা দেওয়ার ফলে কোনো রোগীর শরীরে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি।

 

ব্রাজিলে প্রতিদিনই নতুন রেকর্ড

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো ব্রাজিলেও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনেক আগে থেকেই কভিড-১৯ সম্পর্কে সতর্ক করে আসছিল। লাতিন আমেরিকার এই দেশটি করোনা বিশ্বেও বর্তমান হটস্পট হিসেবে বিবেচিত। প্রতিদিনই আক্রান্ত ও মৃত্যুতে সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন রেকর্ড। কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না ব্রাজিলের করোনা পরিস্থিতি। দিন যত যাচ্ছে দীর্ঘতর হচ্ছে দেশটির মৃত্যুর মিছিল। সাম্প্রতিককালে একদিনে রেকর্ড ১ হাজার ৩০০-এর বেশি মানুষের মৃত্যু দেখেছে ব্রাজিল। শুধু মৃত্যু নয়, দুই-তিন দিন ধরে বেড়েই চলেছে দৈনিক সংক্রমণের হারও। দেশটিতে একদিনে সর্বোচ্চ ৩০ হাজারেরও বেশি সংক্রমণের রেকর্ড হলো মাত্র দুই দিন আগে। সব মিলিয়ে ৯ লাখ ৩০ হাজারের বেশি পরীক্ষার পর বেরিয়ে আসে প্রায় ৫ লাখ ৯৭ হাজার ২০০ করোনা আক্রান্ত। আর দেশটিতে এখন পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৩২ হাজার ৮০০-এর বেশি মানুষের। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক জরিপে বলা হয়েছে, ব্রাজিলে এভাবে চলতে থাকলে আগস্টের মধ্যে মৃতের সংখ্যা ছাড়াতে পারে এক লাখ। শুধু তাই নয়, এ অবস্থায় গোটা লাতিন আমেরিকার চেহারাই আরও ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে। গেল মে মাস থেকেই ব্রাজিলে করোনাভাইরাস সংক্রমণ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। সর্বোচ্চ সংক্রমণের তালিকায় দেশটি এখন সমগ্র বিশ্বে দুই নম্বরে অবস্থান করছে। দেশ যখন সংকটে তখন খোদ প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারোকে নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। দেশটির প্রেসিডেন্টই করোনাভাইরাস মহামারীকে গুরুত্ব দিতে নারাজ। তার দাবি, মহামারীর চেয়ে অর্থনৈতিক সংকট ভয়াবহ। এমনকি দেশটির প্রেসিডেন্ট বিতর্কিতভাবে সামাজিক দূরত্বের নিয়মগুলো নিয়ে বিদ্রƒপ করছেন। তিনি মহামারীকে ‘সামান্য একটি ফ্লু’ হিসেবে বর্ণনা করেন। এমন ভয়ানক পরিস্থিতিতে অর্থনীতির স্বার্থে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্রাজিল সরকার। প্রথমদিকে ব্রাজিলের আমাজন বনের মাঝে অবস্থিত শহর মানাউশেওতে করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। এরপর পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ হয় রিও ডি জেনিরোতে। একই পরিস্থিতি আরেক শহর সাও পাওলোতেও। এমতাবস্থায় দেশটিতে কভিড-১৯ পরীক্ষার উদ্যোগ নিয়েছে আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো।

 

আরও অবনতি হবে রাশিয়ার

করোনা প্রাদুর্র্ভাবের শুরুতে রাশিয়ার অবস্থা অনেকটা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও হঠাৎ করেই লাগামহীন হয়ে পড়েছে দেশটির করোনা সংক্রমণ হার বা কভিড-১৯ রিপ্রোডাকশন রেট। দুই মহাদেশে অবস্থান করা দেশটিতে প্রতিদিনই আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। ভারতের মতো রাশিয়াতেও প্রতিদিন নতুন রোগী শনাক্ত হচ্ছে প্রায় আট হাজার করে। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত রাশিয়ায় করোনা রোগীর সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ ৫০ হাজারের দোরগোড়ায়। যে হারে সংক্রমণ বাড়ছে, ভবিষ্যতে এই সোভিয়েত ইউনিয়ন অর্থাৎ রাশিয়াই হতে পারে করোনাভাইরাসের পরবর্তী হটস্পট। এমনটাই মানছে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন এবং দেশটির নামজাদা বিশেষজ্ঞরা। আর দেশটিতে এখন পর্যন্ত ৫ হাজার ৫০০-এর কাছাকাছি মৃত্যু হয়েছে। করোনা নিয়ন্ত্রণে ইউরোপ ও পশ্চিমা দেশগুলো হিমশিম খেলেও রাশিয়ার শুরুর চিত্র দেখে অনেকেই দেশটির প্রকৃত অবস্থা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে আসছিল। তবে হঠাৎ করেই রাশিয়ায় করোনার আক্রমণ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে বলে জানায় কর্তৃপক্ষ। নতুন সংক্রমণের হার রেকর্ড পরিমাণ বাড়ায় দেশটির সরকার জনসাধারণের চলাচলে কঠোর নিয়ন্ত্রণ শুরু করেছে। সামনের দিনগুলোয় করোনা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন।

 

মৃত্যুর মিছিল থেমেছে স্পেনে

পয়লা ফেব্রুয়ারি স্পেনে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে করোনা রোগীর সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যায়। এরপর লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আর দীর্ঘতর হতে থাকে মৃত্যুর মিছিল। মার্চ মাসে ইউরোপের ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় স্পেন চলে আসে দ্বিতীয় স্থানে। দেশটির ৮৬ বছরের রাজকন্যা মারিয়া টেরসাসহ বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এখন পর্যন্ত স্পেনে করোনাভাইরাস রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ২ লাখ ৮৭ হাজার ৪০৬ জন। আর দেশটিতে এখন পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে প্রায় ২৭ হাজার ১২৮ জনের। অবশেষে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ইউরোপের এই স্প্যানিশ রাজ্য এখন বিশ্বের অন্যতম সংক্রমণহীন দেশে পরিণত হয়েছে। দেশটিতে গেল কয়েকদিনে করোনা সংক্রমণের মাত্রা বা রিপ্রোডাকশন রেট ছিল শূন্যের কোঠায়। শুধু তাই নয়, দেশটিতে এখন নেই কোনো করোনায় আক্রান্ত মৃত্যুও। দেশটির সংক্রমণের মাত্রা কমে যাওয়ায় খুলে দেওয়া হয়েছে রাস্তাঘাট। চালু হয়েছে কল-কারখানা। স্প্যানিশ সরকারের পক্ষ থেকে উৎপাদন, নির্মাণসহ সব প্রতিষ্ঠান এবং অফিসে সবাইকে কাজে ফেরার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

 

যুক্তরাজ্যে নতুন করে সংক্রমণ

যুক্তরাজ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর মিছিল কমলেও আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিদিন গড়ে দুই হাজার থেকে যাচ্ছে। মার্চ মাসের শুরুতে দেশটিতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলেও মার্চের তৃতীয় ও চতুর্থ সপ্তাহে সংক্রমণের হার দ্রুত বিস্তার লাভ করতে থাকে। এরপর এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে সংক্রমণের হার লাখ ছাড়িয়ে যায় খুব সহজেই। সঙ্গে বাড়তে থাকে মৃত্যুর মিছিলও। শুধু তাই নয়, ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ মৃত্যু দেখে এই দেশটি। আর বিশ্বপর্যায়ে করোনাভাইরাস সংক্রমণে মৃত্যুতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পায় যুক্তরাজ্য। ইউরোপের এই দেশটিতে এখন পর্যন্ত মৃত্যু হয় প্রায় ৪০ হাজার ৮০ জনের। আর দেশটিতে করোনাভাইরাস রোগীর সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ২ লাখ ৮২ হাজার ৬৬৬ জন। এপ্রিলের শেষ দিকে কয়েকদিন শান্ত থাকার পর আবার মে মাসে দেশটি দেখে সর্বোচ্চ মৃত্যুর মিছিল। তবে জুন মাসের শুরুতে দেশটিতে মৃত্যুর হার কমলেও প্রতিদিন কমপক্ষে ২ হাজার মানুষ করোনাভাইরাস সংক্রমতি হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, অবরুদ্ধ অবস্থা শিথিল করার পরই বাড়তে থাকে নতুন সংক্রমণের হার।

 

ইতালিতে শূন্যে নেমে আসবে সংক্রমণ

চীনে করোনাভাইরাসের উৎপত্তি হলেও এর ভয়াবহতা দেখেছে ইউরোপের দেশ ইতালি। ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে প্রথম করোনা শনাক্ত হলেও মার্চ মাসে দেশটি দেখেছে সর্বোচ্চ সংক্রমণ আর মৃত্যুর মিছিল। অনেক চেষ্টা করেও দেশটিতে থামানো সম্ভব হয়নি সংক্রমণের ঊর্ধ্বমুখিতা। দেশজুড়ে অবরুদ্ধ অবস্থা আর কারফিউর মতো কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও মেলেনি সুফল। তবে বর্তমানে দেশটির করোনা পরিস্থিতি অনেকটা স্থিতিশীল। সাম্প্রতিককালে দেশটির করোনাভাইরাস সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা দারুণভাবে কমে এসেছে। গত বৃহস্পতিবার নতুন করোনা রোগী শনাক্ত হয় মাত্র ১৭৭ জন। আর একদিনে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ গেছে ৮৮ জনের। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ইতালিতে করোনাভাইরাস রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ২ লাখ ৩৪ হাজার ২০০ জন। আর দেশটিতে এখন পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৩৩ হাজার ৮০০-এর বেশি মানুষের। তবে চিকিৎসা শেষে এখন পর্যন্ত বাড়ি ফিরেছে প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার ৯০০ জন। তিন মাস আগে প্রথম যে দেশে অবরুদ্ধ অবস্থা আরোপ করা হয়েছিল সেই ইতালিতে এখন তোলা হয়েছে নিষেধাজ্ঞা। এখন থেকে আর চলাচলের কোনো বাধা থাকবে না। ইতালি থেকে এখন ইইউ, শেনগেন এবং ব্রিটেনে যাতায়াত করা যাবে।

 

ভারতে দিন দিন বাড়ছে করোনা সংক্রমণ

এশিয়ার বৃহত্তম দেশ ভারতে করোনাভাইরাস সংক্রমণের হার সবচেয়ে বেশি। চার দিন ধরে দেশটিতে নতুন রোগী শনাক্ত হচ্ছে প্রায় আট হাজার করে। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ভারতের করোনা রোগীর সংখ্যা প্রায় ২ লাখ ৩৬ হাজার। যে হারে সংক্রমণ বাড়ছে, তাতে দেশটিতে বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। আর দেশটিতে এখন পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৬ হাজার ৬০০-এর বেশি। তবে সুখবর হলো- চিকিৎসায় এখন পর্যন্ত সুস্থ হয়েছেন প্রায় ১ লাখ ৮ হাজার ৩৬৪ জন। সম্প্রতি সংক্রমণের হারে ইতালি, জার্মানি ও ফ্রান্সকে টপকে বিশ্ব পর্যায়ে ষষ্ঠ স্থানে উঠে এসেছে ভারত। দেশটির রাজ্যগুলোর মধ্যে করুণ হাল মহারাষ্ট্রের। এখানেই করোনা সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। দ্বিতীর আর তৃতীয় স্থানে যথাক্রমে রয়েছে তামিলনাড়– ও দিল্লি। তার পরই রয়েছে গুজরাট। যদিও ধীরে ধীরে দেশটিতে জনজীবন স্বাভাবিক হয়ে আসছে। প্রাথমিকভাবে ধর্মীয় স্থান, হোটেল-রেস্তোরাঁ, বিপণিবিতান খোলার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। অভ্যন্তরীণ বিমান পরিষেবা, মেট্রো রেল, সিনেমা হল, ধর্মীয় বা সামাজিক- রাজনৈতিক জমায়েতে থাকছে নিষেধাজ্ঞা। রাত্রিকালীন কারফিউর সময় কমিয়ে আনা হয়েছে রাত ৯টা থেকে ভোর ৫টা। আগামী মাসে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোও খুলে দেওয়া হতে পারে।

 

পরিস্থিতি সামলে নিয়েছে জার্মানি

ফ্রান্স আর সুইজারল্যান্ডের সীমান্ত ঘেঁষা জার্মানি এখন সংক্রমণে বিশ্ব পর্যায়ে অষ্টম স্থানে। বিশেষজ্ঞদের মতে, খুব সম্ভবত দেশটির আরোপিত অবরুদ্ধ অবস্থার কারণেই কমে এসেছে করোনাভাইরাস সংক্রমণের হার। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, জার্মানির স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সন্দেহাতীতভাবে বিশ্বের যে কোনো দেশের থেকে শক্তিশালী। দেশটি এখন পর্যন্ত ৪ কোটি ৩৮ লাখের বেশি পরীক্ষা করে ১ লাখ ৮৪ হাজার ৫০০-এর মতো রোগী শনাক্ত করেছে। দ্রুত রোগী শনাক্ত হওয়ায় নিরাময়ও দ্রুত সম্ভব হচ্ছে। দেশটিতে এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে মারা গেছেন প্রায় ৮ হাজার ৭০৩ জন। আর সুস্থ হয়ে এখন পর্যন্ত বাড়ি ফিরেছেন ১ লাখ ৬৭ হাজার ৮০০ জন। জার্মানির ১৬টি রাজ্যে আরোপিত অবরুদ্ধ অবস্থা শিথিল করা হয়েছে। ফলে দেশটির জনসাধারণ ফিরে পাচ্ছে স্বাভাবিক ছন্দ। স্বাস্থ্যবিধি মানার বাধ্যবাধকতা মেনেই খুলতে দেওয়া হচ্ছে রেস্তোরাঁ ও বার। কয়েকটি শহরে ব্যায়ামাগার এবং পানশালা খুলে দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ধীরে ধীরে খুলে দেওয়া হবে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। তবে জাদুঘর, চিড়িয়াখানা ও বিনোদন কেন্দ্রগুলো খুলতে পারে আগামী আগস্ট মাসের শুরুতে।

 

করোনার হটস্পট পেরু

করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে শুরু থেকেই কঠোর অবস্থানে পেরু। বাড়িতে থাকার নির্দেশনা, সীমান্ত যোগাযোগ বন্ধ এমনকি কারফিউও জারি করা হয় লাতিন আমেরিকার দেশটিতে। তবু ঠেকানো যায়নি করোনার বিস্তার। ব্রাজিলের মতো পেরুতেও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা। দেশটির প্রেসিডেন্ট মার্চের মধ্যভাগ থেকে জারি করেন জরুরি অবস্থা। বন্ধ করা হয় সীমান্ত যোগাযোগের সব রকম ব্যবস্থা।

জনসাধারণের সবাইকে দেওয়া হয় সেলফ কোয়ারেন্টাইনে থাকার নির্দেশনা। শুধু তাই নয়, এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে দেশটিতে বাধ্যতামূলকভাবে বাড়িতে থাকার নির্দেশনা কার্যকরও করা হয়। বিশ্ব পর্যায়ে দেশটির অবস্থান এখন নবম। দেশটিতে এখন পর্যন্ত ১১ লাখ ১৫ হাজারের বেশি পরীক্ষা করে ১ লাখ ৭৮ হাজার ৯১৪ জনের মতো রোগী শনাক্ত করেছে। পেরুর সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, দেশটির ৮৫ শতাংশ ভেন্টিলেটরসহ আইসিইউ বেডগুলোতে রোগী ভর্তি। এখন পর্যন্ত দেশটিতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে প্রায় ৪ হাজার ৮৯৪ জন। সামনের দিনগুলোতে অসুস্থদের সেবা না দিতে পারা নিয়ে আশঙ্কা করছে দেশটির সরকার। বিশেষজ্ঞদের মতে, এখন পরিস্থিতি কেবল স্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থা নয় বরং স্বাস্থ্যগত বিপর্যয়ে পৌঁছেছে।

 

তুরস্কেও বাড়ছে সংক্রমণ

করোনা সংক্রমণের বিচারে বিশ্ব পর্যায়ে তুরস্কের অবস্থান দশম। মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে তুরস্কে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। চীন এবং যুক্তরাজ্যের তুলনায় বেশ দ্রুত গতিতে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে দেশটিতে। প্রথম শনাক্তের পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ২২ লাখের বেশি মানুষের করোনা টেস্ট করা হয় তুরস্কে। আর প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসেবে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই রাস্তাঘাট, মেট্রো, বাস, ট্রামে জীবাণুনাশক স্প্রে শুরু করে দেশটির সরকারি কর্মকর্তারা। শুধু কী তাই! জীবাণুনাশক ছিটানো হয় অলিগলি সব খানে। কিন্তু তাতেও রক্ষা হয়নি, এখন পর্যন্ত দেশটিতে করোনা রোগীর সংখ্যা ১ লাখ ৬৮ হাজার ৪০০ জন। আর প্রাণ হারায় প্রায় ৪ হাজার ৬৫১ জন। তবে শুরুর দিকে তুরস্কেও অবরুদ্ধ অবস্থা ছিল না। তুরস্কে যখন সংক্রমণের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছিল তখন দেশটিতে বেশ কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়।

এর মধ্যে ছিল- গণপরিবহনসহ বিভিন্ন জায়গায় বাধ্যতামূলক মাস্ক ব্যবহার, রেস্টুরেন্ট ও কফি-শপ বন্ধ করা, জনবহুল জায়গায় শপিং বন্ধ রাখা এবং মসজিদে জমায়েত বন্ধ করা। এ ছাড়া ছুটির দিনগুলোতে দেওয়া হয়েছে কারফিউ।

 

 

সর্বশেষ খবর