শনিবার, ১৩ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনামুক্ত যত দেশ যেভাবে তারা মুক্ত

তানভীর আহমেদ

করোনামুক্ত যত দেশ যেভাবে তারা মুক্ত

করোনা জয়ের ঘোষণা করেছে তারা

নিউজিল্যান্ড

১৭ দিনে প্রায় ৪০ হাজার নমুনা পরীক্ষার পর একজনও রোগী খুঁজে পায়নি নিউজিল্যান্ড। করোনা মুক্তির এ খবর পেয়ে ঠিক থাকতে পারেননি নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্ন। নিজের ড্রয়িংরুমে মেয়েকে নিয়ে আনন্দে নাচতে থাকেন তিনি। এরপই ঘোষণা করেন, নিউজিল্যান্ড এখন করোনামুক্ত। এরই মধ্যে দেশটিতে খুলছে দোকানপাট, অফিস-আদালত, শপিং মল, সিনেমা হল। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে করোনার সঙ্গে লড়াই শুরু করে নিউজিল্যান্ড। গত ১৯ মার্চ ২৮ জনের করোনা পজিটিভের খবর পাওয়ার পরই কঠোর সিদ্ধান্ত নেয় দেশটির প্রধানমন্ত্রী। দ্রুত লকডাউন দেওয়ায় নিউজিল্যান্ডে করোনা ছড়িয়ে পড়ার আগেই আটকে ফেলে। ২৫ মার্চ সীমান্ত বন্ধ করে লকডাউন ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী। শুধুমাত্র নিজের দেশে ফেরার অনুমতি দেওয়া হয় নিউজিল্যান্ডের নাগরিকদের। তবে ১৪ দিন  কোয়ারেন্টাইনে থাকা ছিল বাধ্যতামূলক। সেদিন জাসিন্ডা আরডার্ন বলেছিলেন, ‘শুরু থেকেই কঠোর হতে হবে আমাদের।’ তারপর ফার্মেসি, মুদি দোকান, হাসপাতাল আর গ্যাস স্টেশন ছাড়া সব বন্ধ রাখা হয়। করোনামুক্ত হওয়ার পরও সীমান্ত বন্ধ রেখেছে দেশটি। ১০০ জনের বেশি জমায়েতে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। ৪টি স্তরে লকডাউন ঘোষণা করা হয়। ২৩ মার্চ প্রাথমিক সতর্কতা জারি করা হলেও দুই দিন পরই লেভেল ৩ লকডাউন জারি করা হয়। নিত্য প্রয়োজনীয় নয় এমন পণ্যের ব্যবসা-বাণিজ্য, কোনো রকম জমায়েত, অনুষ্ঠান পুরোপুরি বন্ধ করা হয়। স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখা হয়। এরপর লেভেল ৪ লকডাউনের পথে হাঁটে দেশটির সরকার। দেশজুড়ে সম্পূর্ণ লকডাউন ঘোষণা হয়। তখন করোনা আক্রান্তের সংখ্যা মাত্র ২৮৩। উল্লেখ্য, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসতেই ২৭ এপ্রিলে ফের লেভেল ৩ চলে আসে, বেশ কিছু ক্ষেত্রে লকডাউন শিথিল করা হয়। মার্চের শুরুতেই করোনা আক্রান্ত দেশগুলো থেকে আসা নাগরিকদের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। অনেকক্ষেত্রে উপসর্গ থাকলেও নির্ধারিত চেকলিস্টে না থাকায় ছেড়ে দেওয়া হয়। ১০ মে পর্যন্ত ১,৯৪,১৯১ নমুনা পরীক্ষা হয়। পজিটিভের হার ছিল মাত্র ০.৫৯ শতাংশ। ৩০ এপ্রিলে দেখা যায় পাসিফিকা নামে জনগোষ্ঠীর করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এরপর ওই জনগোষ্ঠীর মোট ২.৯ শতাংশ নমুনা পরীক্ষা করা হয়। ১৬ এপ্রিলের পর থেকে গোষ্ঠী সংক্রমণ রুখতে জনবহুল জায়গায় ‘র‌্যান্ডম টেস্টিং’ শুরু হয়। মোট ২,৯৪,৮০০ টেস্ট করা হয়। কিন্তু কীভাবে তারা করোনা যুদ্ধে জয়ী হলো? তার একটাই কারণ কঠোর ‘লকডাউন’।

 

স্লোভেনিয়া

করোনামুক্ত দেশ স্লোভেনিয়া। দেশটিতে করোনা পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে আসায় এ ঘোষণা দিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী জ্যানেজ জানসা। ২ মাসের প্রচেষ্টায় করোনাকে পরাজিত করতে সক্ষম হয় দেশটি। লকডাউন অনেকটাই শিথিল করা হয়েছে সেখানে। শুধুমাত্র ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর নাগরিকদের জন্য  স্লোভেনিয়ায় প্রবেশের পর ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইন বাধ্যতামূলক নয়। তবে সংক্রমণ রোধে অন্যান্য কিছু নিষেধাজ্ঞা বহাল রয়েছে। করোনার উপসর্গ রয়েছে এমন ব্যক্তিদের দেশে প্রবেশ করতে না দেওয়ার সিদ্ধান্তও নিয়েছে দেশটি। ২০ লাখ মানুষের দেশ স্লোভেনিয়ায় করোনায় মোট ১০৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। দেশটিতে প্রথম সংক্রমণ শনাক্ত হয় ৪ মার্চ। এরপরই কঠোর লকডাউনে যায় দেশটি। করোনা উপসর্গ থাকলেই তাকে আইসোলেশনে নিয়ে যাওয়া হয়। খুঁজে খুুঁজে সন্দেহভাজন মানুষের টেস্ট করা হয়।

 

মন্টিনেগ্রো

১৭ মার্চ প্রথম করোনা আক্রান্তের খবর মেলে বালকানস তীরের দেশ মন্টিনেগ্রো থেকে। তারপর লকডাউনের পথেই হাঁটে তারা। করোনা মোকাবিলার তোড়জোড় শুরু করে প্রশাসন। সাধারণ মানুষ ও প্রশাসনের অক্লান্ত চেষ্টায় করোনা এই দেশে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়নি। ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে মন্টিনেগ্রোতে সবচেয়ে শেষে করোনাভাইরাস পৌঁছেছিল। ইউরোপের সবচেয়ে ছোট দেশগুলোর একটি মন্টিনেগ্রোতে জনসংখ্যা ৬ লাখের সামান্য বেশি। সেখানে মাত্র ৩২৪ জন করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন। মৃত্যু হয়েছিল নয়জনের। তবে ৬৮ দিনের লড়াইয়ের পর দেশকে করোনা মুক্ত বলে ঘোষণা করেছে মন্টিনেগ্রো। অধুনা ইউরোপের এই দেশে কোনো করোনা সংক্রমণ নেই। ইউরোপের প্রথম করোনা মুক্ত দেশ মন্টিনেগ্রো। করোনা মুক্ত ঘোষণা করার পরই দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে কাজে লেগে পড়েছে মন্টিনেগ্রো সরকার। সব অফিস-আদালত খুলে দেওয়া হয়েছে। স্বাভাবিক হয়েছে পরিবহন ব্যবস্থাও। দেশের অভ্যন্তরে মানুষের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতেও নিষেধাজ্ঞা নেই।

পাপুয়া নিউগিনি

ওশিয়ানিয়ার এই দেশের জনসংখ্যা ৮০ লাখ ৯০ হাজার। মার্চ মাসের ২০ তারিখ প্রথম করোনা রোগীর খোঁজ পাওয়া যায়। তারপর থেকে রাতে কারফিউ দেওয়া হয়। বন্ধ করে দেওয়া হয় ইন্দোনেশিয়ার সীমানা। এশিয়া থেকে যাত্রী আসা একেবারে নিষিদ্ধ করে দেয় এই দেশ। কঠোর লকডাউন মেনে চলতে বাধ্য করা হয় সবাইকে। একই সঙ্গে যারা আক্রান্ত হয়েছিলেন তাদের কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং করে সবাইকে কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়। সেখানে মাত্র আটজন করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন।

সিসিলি

করোনায় দুর্দান্ত লড়াই করে সিসিলি। আশ্চর্যজনকভাবে করোনায় সবচেয়ে সফল শুধু নয়, করোনামুক্ত দেশের তালিকায় নাম লিখিয়েছে তারা। ১৪ মার্চ প্রথম দুজনের করোনাভাইরাসে আক্রান্তের কথা জানা যায়। তখনই বন্ধ করা হয় যুদ্ধ জাহাজ। বন্ধ করা হয় চীন, ইতালি, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইরানের সঙ্গে সব যাতায়াত। ৯৭ হাজার ৯৬ জনের এই দেশে করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন মাত্র ১১ জন।

 

তানজানিয়া

পূর্ব আফ্রিকার দেশ তানজানিয়া নিজেদের করোনা মুক্ত ঘোষণা করেছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট জন ম্যাগুফুলি রাজধানী দোদোমার একটি চার্চে দেওয়া ভাষণে বলেন, ‘দেশ মহামারী করোনাভাইরাস থেকে মুক্ত হয়েছে। সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ।’ তানজানিয়ার দেওয়া সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, দেশটিতে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা মোট ৫০৯ জন।

ভ্যাটিকান সিটি

রোমান ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের তীর্থভূমি ভ্যাটিকান সিটিতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী পাওয়ার পর থেকেই কঠোরভাবে সামাজিক দূরত্ব মানা শুরু হয়। ১০৮ একরের ক্ষুদ্র রাষ্ট্র ভ্যাটিকান সিটির যেসব কর্মচারী স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে থাকেন তার বেশিরভাগই ইতালির নাগরিক। ইতালিতে করোনা ছড়ানোর পর ভ্যাটিকানে স্বাস্থ্যবিধি মানায় কঠোরতা দেখা যায়। মাত্র ১২ জন করোনা রোগী পাওয়া যায় এখানে।

 

ইরিত্রিয়া

আফ্রিকার ৬০ লাখ জনগোষ্ঠীর দেশ ইরিত্রিয়া। ২১ মার্চ নরওয়ে ফেরত এক ব্যক্তির দেহে প্রথম ধরা পড়ে করোনাভাইরাস। করোনা যুদ্ধ শুরু করে দেশটি। ছড়িয়ে পড়ার আগেই কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং করে সবাইকে কোয়ারেন্টাইনে নিয়ে নেয় তারা।

একই সঙ্গে গণজমায়েত বন্ধ করে দেয়। এই কঠোর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে ১৫ মে করোনামুক্ত হয় দেশটি। এই দেশে করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন মাত্র ৩৯ জন।

 

হলি সি

রোমান কোর্ট দ্বারা পরিচালিত হয় হলি সি দেশটি। করোনা ধরা পড়ার পর এই দেশে সব ধরনের পর্যটন বন্ধ করা হয়। মাত্র ১২ জন আক্রান্ত হয়েছিলেন এই দেশে। ৬ জুন নিজেদের করোনা মুক্ত বলে দাবি করে এই দেশ। 

 

সেইন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস

ক্যারিবিয়ান এই দেশের জনসংখ্যা ৫২ হাজার ৪৪১। এখানে প্রথম করোনা আক্রান্তে দেখা পাওয়া যায় ২৪ মার্চ। তারপর বন্ধ করা হয় বিমানবন্দর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সব দোকান। জারি করা হয় কারফিউ। কঠোর কারফিউ দিয়ে করোনামুক্তির স্বাদ পায় দেশটি। মাত্র ১৫ জন আক্রান্ত হয়েছিলেন করোনা থাবায়। ১৯ মে নিজেদের করোনা মুক্ত বলে  ঘোষণা করেছে এই দেশ।

 

ফিজি

ওশিয়ানিয়ার এই দ্বীপে প্রথম করোনা আক্রান্তের খোঁজ পাওয়া যায় ১৯ মার্চ। তারপরই প্রধানমন্ত্রী ফ্রেঙ্ক বেইনিমারামা বন্ধ করে দেন বিমান পরিষেবা। বাইরে থেকে আগত সবার জন্য বাধ্যতামূলক করা হয় ১৫ দিনের কোয়ারেন্টাইন। দেশের ভিতরে গণজমায়েত বন্ধ করে দেন। কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয় সন্দেভাজন সবাইকে। ১৮ জন করোনা রোগীই সুস্থ হয়ে উঠেছেন এই দেশে। ২০ এপ্রিল নিজেদের করোনা মুক্ত বলে ঘোষণা করেছে ফিজি।

 

পূর্ব তিমুর

এই দেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত পাওয়া যায় ২১ মার্চ। যারা চীন ভ্রমণ করেছেন সম্প্রতি তাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয় ১০  ফেব্রুয়ারি। বন্ধ করা হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও জমায়েত। অন্য দেশ থেকে আসা সবার জন্য বাস্তবায়ন করা হয় ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইন। অবশেষে ১৫ মে সুস্থ হয়ে ওঠেন দেশের ২৪তম শেষ করোনা রোগী। করোনা মুক্ত হয় পূর্ব তিমুর।

 

ফারোই দ্বীপপুঞ্জ

 ৪ মার্চ প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগীর দেখা পাওয়া যায় এখানে। তারপরই কঠোর ভূমিকায় নামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। রোগী খুঁজে পেতে মরিয়া স্বাস্থ্যকর্মীরা রীতিমতো চিরুনি অভিযানে নামে। যাকেই করোনা সন্দেহ হয়েছে তাকেই স্বাস্থ্যকর্মীরা পরীক্ষা করেন। ১৮৭ জন রোগী খুঁজে পাওয়া যায়।

 

১২ দেশের করোনামুক্ত থাকার রহস্য

এখনো করোনামুক্ত রয়েছে ১২টি দেশ ও অঞ্চল। আল জাজিরার সর্বশেষ তালিকায় করোনাকে পুরোপুরি আটকে রাখা দেশগুলো হলো, কিরিবাতি, মার্শাল আইল্যান্ড, মাইক্রোনেশিয়া, নাউরু, উত্তর কোরিয়া, পলাউ, সামোয়া, সলোমন আইল্যান্ড, টঙ্গো, তুর্কেমেনিস্তান, তুভালু ও ভানুয়াতু। সারা পৃথিবী কাঁপছে করোনায়। অনেকের মনেই প্রশ্ন, ঠিক কী কারণে এখনো পুরোপুরি করোনা মুক্ত রয়েছে তারা? এগুলোর বেশির ভাগ বিচ্ছিন্ন দ্বীপরাষ্ট্র। বিশ্বের অন্য দেশগুলোর সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ না থাকায় এ দেশগুলো এখনো করোনা থেকে মুক্ত রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। চীন, তাইওয়ান, হংকং, সিঙ্গাপুর লকডাউনে কঠোর, কোয়ারেন্টাইন পালন করে দারুণ সফলতা পেয়েছে। সে পথই অনুসরণ করেছে এখনো করোনামুক্ত দেশগুলো। এসব দেশে করোনা না পৌঁছানোর কারণ হতে পারে আগে থেকেই জরুরি অবস্থা জারি, ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা ও দ্বীপরাষ্ট্রগুলো দুর্গম অঞ্চলে। পর্যটকদের নিরুৎসাহিত করার পাশাপাশি এসব দেশে যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভ্রমণকারীদের জন্য অসুবিধার। বলা যেতে পারে উত্তর কোরিয়া ও ইয়েমেনের কথা। ইয়েমেনে সৌদি সামরিক জোটের হামলা ও বিদ্রোহীদের যুদ্ধ থাকায় কেউ এ দেশে ভ্রমণ করে না। উত্তর  কোরিয়াও পর্যটক প্রবেশে সর্বোচ্চ সতর্ক। অন্য  দেশগুলো বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। এসব দেশে শৌখিন পর্যটক ছাড়া তেমন কেউ যায় না। ব্যবসা বা অন্যান্য প্রয়োজনে এসব দ্বীপরাষ্ট্রের নাগরিকরা সচরাচর বিশ্বভ্রমণে উৎসাহী নয়। সামাজিকভাবে তারা অনেক বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করে। এ ছাড়া এসব দেশে মানুষের সংখ্যা যেমন কম, তাদের চিকিৎসাসেবা প্রদানের সক্ষমতাও উন্নত দেশগুলোর মতো নয়। তাই তারা সতর্ক করোনা থেকে বাঁচতে। যেমন দ্বীপরাষ্ট্র নাউরুতে কোনো করোনা আক্রান্তের খোঁজ না পাওয়া  গেলেও দেশটিতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। নাউরুর মতো কিরিবাতি, টঙ্গো, ভানুয়াতু ও অন্যান্য ছোট দ্বীপরাষ্ট্রে করোনা আক্রান্ত রোগীর  খোঁজ না পেলেও পূর্ব সতর্কতা হিসেবে তারা জাতীয় জরুরি অবস্থা জারি করে। এসব দেশে কেন করোনা  পৌঁছায়নি- এমন প্রশ্ন সবার মুখে। তারা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রেখে এখন পর্যন্ত করোনামুক্ত বলে মত দিয়েছেন বেশির ভাগ বিশ্লেষক। এ ছাড়া এসব দেশ চীনে করোনা বিস্তারের ঘটনার পর থেকেই কঠোর সামাজিক বিচ্ছিন্নতা মেনে চলে আসছে। সামান্য জ্বরে আক্রান্ত হলেও তাকে দ্রুত আলাদা করে ফেলা হচ্ছে। করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কয়েক মাস আগে থেকেই এই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ায় এখনো করোনাভাইরাস তাদের কাছে পৌঁছাতে পারেনি। তবে কতদিন পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তারা করোনা মুক্ত থাকবে সে নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা হচ্ছে। গবেষকরা বলছেন, দীর্ঘদিন করোনা পৃথিবীর বুকে বর্তমান গতিতে বিস্তার লাভ করতে থাকলে তারা করোনামুক্ত থাকতে পারবে না।

 

করোনা যুদ্ধে দারুণ সফল দেশগুলো

ভিয়েতনাম

নয়  কোটি ৭০ লাখ জনসংখ্যার দেশ ভিয়েতনাম। সেখানে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা তিনশোর কিছু বেশি এবং মৃতের সংখ্যা শূন্য। দেশটিতে সবকিছু ইতিমধ্যেই খুলতে শুরু করেছে। ভিয়েতনাম শুরুর দিকেই সংক্রমণের হার যখন কম ছিল, তখনই দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছে এবং পুরো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে ফেলেছে। জানুয়ারি মাসের শুরুতে যখন দেশটিতে একজনেরও রোগ শনাক্ত হয়নি তখনই ভিয়েতনাম সরকার কঠোরভাবে করোনা মোকাবিলা শুরু করে। শুরু করে দেয় তারা জরুরিকালীন পরিকল্পনার বাস্তবায়ন। ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা, চীনের সঙ্গে সীমান্ত এলাকায় পর্যবেক্ষণ কঠোর করে এবং কিছুদিনের মধ্যে সীমান্ত পথে চলাচল পুরো বন্ধ করে দেয়। সীমান্ত এবং অন্যান্য নাজুক জায়গাগুলোতে স্বাস্থ্য পরীক্ষা বাড়িয়ে দেয়। কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং করে কার সংস্পর্শে কারা কারা এসেছে তা খুঁজে বের করতে ব্যাপক জনশক্তি নিয়োগ করে। বিমানবন্দরে নামার সঙ্গে সঙ্গে আগত যাত্রীদের সোজা বাসে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে। এ ছাড়া রোগের লক্ষণ নেই কিন্তু জীবাণু বহন করছে তাদের থেকে সুরক্ষা পেতে ব্যাপক পরিসরে মানুষকে কোয়ারেন্টাইনে  পাঠানো হয়।

 

 

দক্ষিণ কোরিয়া

দক্ষিণ কোরিয়া কর্তৃপক্ষ ভাইরাস আক্রান্ত বা সন্দেহজনক ব্যক্তিদের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইনে থাকার নিয়ম করে। এ ছাড়া জনগণকে যথাসম্ভব ভিড় এড়িয়ে চলা, অনুষ্ঠান পরিহার, মাস্ক পরিধান এবং পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখায় জোর দেওয়া হয়। এ ছাড়া করোনা ছড়িয়েছে এমন দেশ থেকে আগত যাত্রীদের জন্য বিমানবন্দরে বিশেষ ব্যবস্থায় স্ক্রিনিং করা হয়। কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনায় করোনা টেস্টে দারুণ সফল দক্ষিণ কোরিয়া। বিশ্বের যে কোনো দেশের তুলনায় তাদের গড় পরীক্ষার হার সবচেয়ে বেশি। সন্দেহভাজন করোনা রোগীদের মেডিকেল টেস্ট সম্পূর্ণ ফ্রি করে দেয়। চিকিৎসকরা রেফার্ড করলে সন্দেহভাজন রোগীরা বিনামূল্যেই টেস্ট করাতে পারছেন। বাকিদের জন্যও সাশ্রয়ী মূল্যে মেডিকেল টেস্টের ব্যবস্থা করেছে সেখানকার সরকার।

 

 

তাইওয়ান

করোনায় তাইওয়ানের সাফল্যের পেছনে আছে, দেশের প্রতিটি নাগরিকের স্বাস্থ্যের দিকে নজর আর নিখুঁত পরিকল্পনা। এখন পর্যন্ত তাইওয়ানে করোনায় মারা গেছে মাত্র সাতজন। আর তারা কখনো পুরোপুরি লকডাউনেও যায়নি। এই সাফল্যের জন্য তাইওয়ানের মানুষের মাস্ক পরার প্রবণতাকে কৃতিত্ব দিচ্ছেন। দেশটির প্রতিটি নাগরিককে দেওয়া হয় জাতীয় স্বাস্থ্য বীমা কার্ড, যাতে অতি কম খরচে অত্যাধুনিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার সুবিধা পাওয়া যায়। ২০০৩ সালে সার্স কোভ ছড়িয়ে পড়া থেকেই শিক্ষা নিয়েছে তাইওয়ান। ঢেলে সাজিয়েছিল তার স্বাস্থ্য অবকাঠামো ও কেন্দ্রীয় রোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (সিডিসি)। জানুয়ারির প্রথমেই তাইওয়ানের সিডিসি আগের ১৪ দিনে চীনের উহান ভ্রমণকারী সবার যাদের জ্বর বা শ্বাসনালির সংক্রমণের লক্ষণ ছিল এবং কভিড পজিটিভ ধরা পড়ে, তাদের আলাদা করে রেখে পর্যবেক্ষণ শুরু করেছিল। দ্রুততার সঙ্গে সিডিসি সক্রিয় করেছিল সেন্ট্রাল এপিডেমিক কমান্ড সেন্টার (সিইসিসি)। ফেব্রুয়ারির প্রথমেই দেশব্যাপী মাস্কের রেশনিং শুরু করা হয়, যাতে কেউ তা মজুত না করতে পারে। এ সবই এমন সময়ে, যখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাকে মহামারী হিসেবে ঘোষণাই করেনি। তাইওয়ান এটা করেছিল অত্যন্ত সচেতনভাবে, নাগরিকদের উদ্বুদ্ধ করে। ফেব্রুয়ারি থেকেই তাইওয়ানের প্রতিটি জায়গায় শুরু হয়ে যায় থার্মাল স্ক্যানিং। ২৪ মার্চ থেকে সব আন্তর্জাতিক বিমান ওঠানামা বন্ধ করে দেওয়া হয়।

 

জাপান

মানুষকে ঘরে অবরুদ্ধ রাখা ও যত বেশি সংখ্যক সম্ভব নমুনা পরীক্ষা করাই করোনা মোকাবিলায় কৌশল নিয়ে সফল জাপান। সংক্রমণ ঠেকাতে কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং অ্যাপ ব্যাপক হারে ব্যবহার করেনি জাপান। মহামারী নিয়ন্ত্রণে জাপানের সফলতার মধ্যে মাস্ক পরে চলাফেরা, মানুষের মধ্যে স্থূলতা না থাকা অথবা দ্রুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করার বিষয় উল্লেখযোগ্য। জাপানে মহামারীর বিস্তার কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের অনেকেই কন্ট্রাক্ট ট্রেসিংয়ের ভূমিকাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। জাপান এই কন্ট্রাক্ট ট্রেসিংয়ে জোর না দিলেও তার ছিল সংক্রমণ শনাক্তে প্রশিক্ষিত অর্ধ লাখ নার্স, যা অন্য কোনো দেশের নেই। জাপানে পাবলিক হেলথ সেন্টারে এখন ৫০ হাজার নার্স কাজ করছেন, যারা সংক্রমণ শনাক্তে প্রশিক্ষিত। অন্য সময় ইনফ্লুয়েঞ্জা ও যক্ষ্মার সংক্রমণ শনাক্ত করাই ছিল তাদের কাজ। এপ্রিলে করোনাভাইরাস ছড়ানোর পর থেকে তাদের সবাইকে কাজে লাগাচ্ছে জাপান। জাপানের প্রশিক্ষিত জনবল কোনো লোকালয়ে গুচ্ছ সংক্রমণ অথবা ক্লাব ও হাসপাতাল থেকে কয়েকজনের মাঝে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার তথ্যগুলোর খুঁটিনাটি দিক নিয়ে কাজ করে। সামাজিক দূরত্ব অনুসরণেও এগিয়ে রয়েছে জাপান। জাপানে প্রতি বছর অক্টোবর-নভেম্বরে ফ্লু ভ্যাকসিন নামে একধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের টিকা দেওয়া হয়। এই টিকাটা প্রায় সব কর্মজীবীর জন্য বাধ্যতামূলক। ধারণা করা হচ্ছে এই ভ্যাকসিনটা  দেওয়ার কারণে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধেও একধরনের  রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়।

 

নেপাল ও ভুটান

করোনায় নেপাল ও ভুটানের চিত্র অবাক করবে। দুটি দেশেই গত বছর ডিসেম্বর থেকে করোনার সঙ্গে লড়াই করে দারুণ সফল। এখনো করোনা রোগীর মৃত্যুর সংখ্যাও কম। আক্রান্তের সংখ্যাও অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম। নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় ২৪ জানুয়ারি। চার মাসে দেশটিতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা সাড়ে চার হাজারের কিছু বেশি। করোনায় মৃত্যু হয়েছে মাত্র ১৫ জনের। নেপাল শুরু থেকেই আক্রান্ত ও এর সংশ্লিষ্টদের প্রত্যেককে কড়া নজরদারির মধ্যে কোয়ারেন্টাইনে রেখেছে। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও সীমান্তে গড়ে তোলা হয়েছে হেল্প ডেস্ক। বাতিল রয়েছে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট। বন্ধ রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। লকডাউন করা হয় পুরো দেশকে। আবার চার মাসে করোনা মোকাবিলায় নজির তৈরি করেছে ভুটান। বিশেষত গণস্বাস্থ্য কর্মসূচি ও জীবাণুনাশক ছিটিয়ে ভাইরাস প্রতিরোধে দারুণ সফল ছোট্ট দেশটি। চার মাসে করোনায় ভুটানে ৬২ জন আক্রান্ত হয়েছেন। কোনো মৃত্যু হয়নি করোনায়।

সর্বশেষ খবর