বৃহস্পতিবার, ১৮ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

যুগে যুগে লাঞ্ছনার শিকার সৃষ্টিশীল মানুষ

সাইফ ইমন

যুগে যুগে লাঞ্ছনার শিকার সৃষ্টিশীল মানুষ

কাজী নজরুল ইসলাম

সমকালীন অন্য কোনো কবি বা সাহিত্যিকের এত গ্রন্থ একত্রে কখনো বাজেয়াপ্ত হয়নি...

 

বিংশ শতাব্দীর বাংলা মননে কাজী নজরুল ইসলামের মর্যাদা ও গুরুত্ব অপরিসীম। একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সংগীতজ্ঞ, সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ এবং সৈনিক হিসেবে অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে নজরুল সর্বদাই ছিলেন সোচ্চার। তার কবিতা ও গানে এ মনোভাবই প্রতিফলিত হয়েছে।

অগ্নিবীণা হাতে তার প্রবেশ, ধূমকেতুর মতো তার প্রকাশ। যেমন লেখাতে বিদ্রোহী, তেমনই জীবনে। তাইতো তাকে বলা হয় ‘বিদ্রোহী কবি’। কবি কাজী নজরুল ইসলামের সবচেয়ে বড় বৈরীপক্ষ ছিল ব্রিটিশ শাসকপক্ষ। সত্যের পক্ষে ও শোষিত মানুষের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে নজরুল ব্রিটিশরাজের রোষানলে পড়ে জেল খেটেছেন। তার যুগবাণী, বিষের বাঁশি, ভাঙ্গার গান, প্রলয় শিখা ও চন্দ্রবিন্দুসহ মোট পাঁচটি গ্রন্থ ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করে। বাংলা সাহিত্যে সমকালীন অন্য কোনো কবি বা সাহিত্যিকের এত গ্রন্থ একত্রে কখনো বাজেয়াপ্ত হয়নি।

 

সক্রেটিস

হেমলক বিষপানের মাধ্যমে দোষী সাব্যস্ত- সক্রেটিসের মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়...

 

সক্রেটিসকে যুক্তি ও মুক্তচিন্তার জনক বলতে দ্বিধা নেই। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের বাণী শতাব্দী থেকে শতাব্দী মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হচ্ছে। যুক্তিতর্কে, সমাজ, রাষ্ট্র জীবনে তার দর্শন বারবার উল্লিখিত হয় শ্রদ্ধায়। অথচ তার পান্ডিত্য ও জ্ঞানের পরিসীমা উল্টো অপরাধের কাতারে নাম লেখায়। অভিযোগ ওঠে তিনি প্রচলিত দেবতাদের উপেক্ষা করছেন, তরুণদের কুপরামর্শ দিচ্ছেন। তার ভাষণ, জ্ঞান যুবকদের নৈতিক চরিত্র কলুষিত করছে, তারা বিপথগামী হচ্ছে। কিছু ভক্ত জুটলেও তার যুক্তি ও দর্শন মেনে নেয়নি সমাজ-ব্যবস্থার বড় অংশ। যে কারণে তাকে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়। এথেন্সের উন্মুক্ত ময়দানে ৫০০ বিচারকের সামনে তিনি ৬০ ভোটে পরাজিত হন। হেমলক বিষপানের মাধ্যমে দোষী সাব্যস্ত সক্রেটিসের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছিল। এখন তাকে বিশ্ববাসী জ্ঞানী, ন্যায়পরায়ণ বলে স্বীকার করেছে। তার দর্শন প্রশংসিত সর্বত্র। জ্ঞানী-গুণী, মনীষী এ সক্রেটিসের চিন্তা ও যুক্তি কালজয়ী, আজও তার দর্শন সবাইকে প্রভাবিত করছে।

 

ইবনে সিনা

সম্রাট ইবনে সিনাকে নির্বাসন দন্ড দিয়ে অন্য এক স্থানে কারাবন্দী করে রেখেছিলেন...

 

ইতিহাসের অত্যন্ত গুণী ব্যক্তি ইবনে সিনা। তাকে বলা হয় ইতিহাসের অন্যতম সেরা চিকিৎসাবিজ্ঞানী, গণিতজ্ঞ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং দার্শনিক। বাধ্য হয়ে একবার ইবনে সিনা পালিয়ে চলে যান ইরানের দিকে। হামাদান শহরে। হামাদানের সুলতান অসুস্থ হলে ইবনে সিনা তার চিকিৎসা করেন। এতে সম্রাট আরোগ্য লাভ করেন। এ চিকিৎসায় খুশি হয়ে সম্রাট তাকে প্রধানমন্ত্রীর পদে নিয়োগ দেন। কিন্তু রাজনীতিতে তিনি বরাবরের মতোই ছিলেন অপরিপক্ব। তাই এ পদপ্রাপ্তি তার জীবনে নতুন বিড়ম্বনার সৃষ্টি করে। তাছাড়া হামাদানের সেনা বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বিদেশি ইবনে সিনাকে সহ্য করতে পারছিলেন না। সেনাধ্যক্ষ সিনাকে গ্রেফতার করার জন্য সম্রাটের কাছে আবেদন জানাতে থাকেন। তাই সম্রাট ইবনে সিনাকে নির্বাসন দ- দিয়ে অন্য এক স্থানে কারাবন্দী করে রেখেছিলেন।

 

গ্যালিলিও

বেঁচে থাকতে তার বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব মেনে নিতে পারেনি সমাজ হয়েছেন লাঞ্ছনার শিকার...

 

ইতালির বিখ্যাত সমুদ্রবন্দর পিসায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন গ্যালিলিও। আধুনিক বিজ্ঞান তাকে ইতিহাসের সেরা গণিতবিদ, পদার্থবিদ, জ্যোতির্বিদ ও দার্শনিক বলে স্বীকার করলেও বেঁচে থাকতে তার বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব মেনে নিতে পারেনি সমাজ ও রাষ্ট্র। পূর্ববর্তী বিজ্ঞানী টলেমি দাবি করেছিলেন, সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে। কিন্তু নিজের উদ্ভাবিত টেলিস্কোপ নিয়ে পরীক্ষা শেষে গ্যালিলিও বললেন না, সূর্য নয়, পৃথিবীই বরং সূর্যের চারদিকে ঘোরে। একই দাবি করেছিলেন কোপার্নিকাসও। এ মতবাদ দেওয়ায় গ্যালিলিও কোপার্নিকাসের মতো চার্চের রোষানলে পড়লেন। তাকে গৃহবন্দী করা হয়। বন্দীদশাতেই তার মৃত্যুর হয়। মূল্যায়ন দূরে থাক মৃত্যুর ৩০০ বছর পরেও তিনি চার্চের চোখে অপরাধীই ছিলেন। অথচ তিনি সঠিক থেকেও তখনকার ধর্মান্ধদের দ্বারা নানাভাবে অত্যাচারের শিকার হয়েছেন অথচ এখন তার বন্দনা বিশ্বজুড়ে। জীবিত অবস্থায় চরম কষ্টকর জীবন কাটিয়েছেন তিনি। শেষ বয়সে প্রায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন গ্যালিলিও। সফল্য দেখে যেতে পারেননি।

 

ডায়োজিনিস

ডায়োজিনিস পোশাক পরতেন যৎসামান্য, থাকতেন রাস্তার ধারে একটা টবে...

 

প্রায় দুই হাজার বছর আগে গ্রিসে ডায়োজিনিস নামে এক দার্শনিক ছিলেন। তিনি দিনেরবেলা আলো হাতে রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন, বলতেন একজন সৎ মানুষ খুঁজছেন। তখনকার লোকেরা তাকে নানাভাবে লাঞ্ছিত করত। এমনকি সে সময়ের রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গেও ছিল তার দ্বন্দ্ব, হয়েছেন নিগ্রহের শিকার। তবে জানা যায়, বিভিন্ন মানুষের কাছে ডায়োজিনিসের কথা শুনে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট আগ্রহী হয়েছিলেন খেপাটে এই দার্শনিকের প্রতি। অনেকে দাবি করেন, ডায়োজিনিসের শিষ্য ছিলেন এই ‘আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট’। অদ্ভুত একজন মানুষ ছিলেন ডায়োজিনিস। সত্য বলতে কখনো পিছপা হননি তিনি। পোশাক পরতেন যৎসামান্য, থাকতেন রাস্তার ধারে একটা টবে। আমাদের দেশে ড্রেনের বড় পাইপের ভিতর যেমনটি থাকতে দেখা যায়, খানিকটা সে রকম। নিজের সম্পদ বলতে ছিল শুধু একটা লাঠি, লণ্ঠন, পরনের সামান্য শতছিদ্র কাপড়।

 

 

ফ্রানৎস কাফকা

সমালোচনা ও অসত্য মিথে চাপা পড়েছিলেন কাফকা, নিগ্রহের শিকার হয়েছিলেন সাহিত্যে

 

জার্মান ভাষায় অনবদ্য উপন্যাস ও ছোট গল্পের লেখক ফ্রানৎস কাফকা জীবিত অবস্থায় মূল্যায়ন পাননি, হয়েছেন লাঞ্ছনার শিকার। তাকে নিয়ে নানারকম মিথ্যে কথা প্রচলিত যার সঙ্গে বাস্তবের কোনো সম্পর্ক নেই। তার সাহিত্যকর্মের বৈচিত্র্য মোটেই প্রশংসিত হয়নি। উল্টো তাকে নিয়ে সমালোচনা, অর্ধসত্য ও অসত্য মিথের ছড়াছড়ি রয়েছে। কাফকা একজন আইনজীবী হিসেবে প্রশিক্ষণ নিলেও লেখক হিসেবেই সময় ব্যয় করেছেন। কিন্তু তার লেখা জনসম্মুখে আসেনি। জীবনের নানা সময়ে নানা প্রতিকূলতা তাকে পর্যুদস্ত করেছে। যক্ষ্মা রোগেও তিনি বিছানায় শায়িত ছিলেন জীবনের লম্বা সময়। কাফকা তার সব লেখা ম্যাক্স ব্রডকে তার মৃত্যুর পর পুড়িয়ে ফেলতে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু ম্যাক্স ব্রড তা করেননি। কাফকার মৃত্যুর পর পাঠক তার ছোটগল্পের প্রশংসা করেন। আজ তার সাহিত্যের মূল্যায়ন হয়, বিশ্বজুড়েই তার খ্যাতি।  দেশে দেশে নানা ভাষায় অনূদিত হয় তার লেখা। তার সাহিত্য নিয়ে গবেষকদের উচ্ছ্বাসের শেষ নেই এখন।

 

মায়াকোভস্কি

সম্পর্কের টানাপড়েন তাকে ভীষণরকম বিমর্ষ, অধৈর্য আর বিপর্যস্ত করে তুলেছিল...

 

গত শতকের শুরুতে রুশ বিপ্লবের অন্যতম পথিকৃৎ মায়াকোভস্কিকে বলা হয় রাশিয়ান কবিতার ‘রেগিং বুল’। পুঁজিবাদী সমাজের শোষণ, মানুষে মানুষে অসাম্যের কথা বলেছেন এ কিংবদন্তি কবি তার লেখনিতে। তার কবিতা অনূদিত হয়েছে নানান ভাষায়। সমাদৃত হয়েছে পৃথিবীর নানান দেশে। এ কবির পুরো নাম ভøাদিমির ভøাদিমিরোভিচ মায়াকোভস্কি। ঘটনাক্রমে তার সঙ্গে পরিচয় হয় অভিনেত্রী ভেরোনিকা পোলানস্কায়ার। প্রথম দেখাতেই তিনি ভেরোনিকা পোলানস্কায়ার প্রেমে পড়েন। সম্পর্কের টানাপড়েন তাকে ভীষণ রকম বিমর্ষ, অধৈর্য আর বিপর্যস্ত করে তোলে। এ সম্পর্কের কারণে নানাভাবে লাঞ্ছিতও হতে হয়েছে তাকে। ১৯৩০ সালের শুরুর দিকে স্ত্রী ইয়ানশিনের সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ করেন মায়াকোভস্কি। পোলানস্কায়ারকে বিয়ের করার কথা বলেন মায়াকোভস্কি কিন্তু ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যা করেন।

 

হাইপেশিয়া

মুক্তবুদ্ধিচর্চাকারী বলেই তাকে মৌলবাদী সন্ন্যাসী ও চার্চের প্যারাবোলানসরা হত্যা করে...

 

শহরের সব মহিলা যখন সংসার আর সন্তান সামলাতে ব্যস্ত ঠিক সেই সময় এক নারী দর্শন, গণিত, বিজ্ঞানের মতো জটিলতর বিষয়ে জ্ঞান বিলিয়ে  বেড়াতেন রাস্তায় রাস্তায়। শত শত  লোক মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনে যেত তার বক্তৃতা। ৩৭০ খ্রিস্টাব্দে আলেক্সান্দ্রিয়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন হাইপেশিয়া। ইতিহাসবেত্তাদের মতে, হাইপেশিয়া মুক্তবুদ্ধিচর্চাকারীদের মধ্যে ইতিহাসের শেষ প্যাগান সায়েন্টিস্ট। কিন্তু নারী বিজ্ঞানী ও মুক্তবুদ্ধিচর্চাকারী বলে চার্চের চোখে প্রবল সমালোচিত ছিলেন। সুন্দরী হাইপেশিয়া তার গোটা জীবন গণিতের জন্য উৎসর্গ করেন। বিয়ে করেননি। মুক্ত দর্শন ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন তিনি।

গণিত, দর্শন, জ্যোতির্বিদ্যা ও মেকানিক্সের জটিল বিষয়গুলোয় হাইপেশিয়া ছিলেন জনপ্রিয় শিক্ষিকা। আলেক্সান্দ্রিয়ার গভর্নর অরেস্টেসও তার জ্ঞানে মুগ্ধ ছিলেন। রাজনৈতিক কারণ ছাড়াও নারী বিজ্ঞানী, মুক্তবুদ্ধিচর্চাকারী বলেই তাকে মৌলবাদী সন্ন্যাসী ও চার্চের প্যারাবোলানসরা হত্যা করে।

 

অ্যানি সেক্সটন

মানসিক চাপ কমাতে অতিরিক্ত মদপানের দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন এই বিরহী কবি... 

 

নোবেলজয়ী অ্যানি সেক্সটন আধুনিক ব্যতিক্রমধর্মী কবিতা লিখে বিখ্যাত হয়ে আছেন। অন্য কবিরা যে বিষয়গুলো এড়িয়ে যেতেন অ্যানি সেক্সটন সে বিষয়গুলোই তুলে আনতেন কলমে। হস্তমৈথুন, রজঃস্রাব, গর্ভপাত ইত্যাদি বিষয়ও তার লেখায় চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। তাই সে সময় তার সাহসী লেখা সবাই মেনে নিতে পারেনি। হতে হয় লাঞ্ছনার শিকার। প্রায় পুরো জীবনই হতাশাগ্রস্ত ছিলেন এই কবি। মানসিক চাপ কমাতে তিনি মদপানের দিকে ঝুঁকে পড়েন। তিনি ১৯৬৭ সালে পুলিৎজার পুরস্কার লাভ করেন। অতিরিক্ত মদপান করতেন এই কবি। তবে তা কখনো তার সৃষ্টিশীলতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। তিনি বেশ কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। তার সর্বশেষ কবিতার পান্ডুলিপি একজন রিপোর্টারকে দিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এটা যেন প্রকাশিত না হয়।’ ১৯৭৪ সালে অক্টোবরে আত্মহত্যা করেন তিনি।

সর্বশেষ খবর