সোমবার, ৬ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

বিশ্বজয়ীদের অবিশ্বাস্য গল্প

তানভীর আহমেদ

বিশ্বজয়ীদের অবিশ্বাস্য গল্প

জীবনে শত প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে চলতে হয়। এমন অনেক অনুপ্রেরণীয় ব্যক্তি রয়েছেন যারা খ্যাতি, সম্মান ও অর্থবিত্তে অনন্য। তাদের জীবনের শুরুটা হয়েছিল একেবারেই সাদামাটা। দারিদ্র্য ও সামাজিক অবস্থান তাদের জীবনের সাফল্যকে রুখতে পারেনি। ঠিকই পৌঁছেছেন সফলতার শীর্ষে। স্বপ্নের সোনার হরিণকে করেছেন মুঠোবন্দী। তারা প্রমাণ করে দিয়েছেন কোনো কাজই ছোট নয়। নিষ্ঠা, সততা আর পরিশ্রমের ফসল তুলেছেন তারা। তাদের এই পথচলা জীবন জয়ের গল্প হয়ে প্রেরণা জোগায় বিশ্ববাসীকে-

 

মুচির কাজ করে পেট চলত

আব্রাহাম লিংকন

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রপতি

আব্রাহাম লিংকন। আমেরিকার সাবেক এই রাষ্ট্রপতি বিশ্বের সেরা রাজনীতিবিদদের একজন। তার শৈশব ও কৈশোর কিন্তু প্রাচুর্যে ভরপুর ছিল না। দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত ছিল তার পরিবার। বাবা মুচি ছিলেন। তবু সংসার ঠিকমতো চলত না। তাই নিজেও মুচির কাজ করেন। মুচির ছেলে বলে তাকে খেপাত সবাই। নীচু দৃষ্টিতে দেখত তাকে। উপহাসের পাত্র ছিলেন বন্ধুদের কাছে। কেউ খুব একটা মিশতে চাইত না। নিজের স্বপ্নকে বুকে ধারণ করে জীবনে এগিয়ে চলে স্বপ্ন পূরণ করেন।

 

মাঝির ছেলে হলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি

এ পি জে আবদুল কালাম

ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি

ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালাম। বিশিষ্ট বিজ্ঞানী আবদুল কালামের গবেষণা কর্ম সারা বিশ্বে গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হয়ে আসছে। এ পি জে আবদুল কালাম একজন স্বনামধন্য বিজ্ঞানী, পন্ডিত ও লেখক। কিন্তু তার ছেলেবেলা ও কৈশোর বিত্ত-বৈভবে কাটেনি। বাবা ছিলেন একজন সাধারণ নৌকার মাঝি। বাবা নৌকা চালিয়ে যা আয় করেন তাতে সংসার চলত না। অন্যদিকে সেই নৌকাও নিজের নয়। আরেকজনের কাছ থেকে নৌকা ধার করে বাইতে হতো তাকে। এদিকে আবদুল কালাম নিজের লেখাপড়া চালিয়ে যেতে কোনো কাজ চাই। আবদুল কালাম প্রথমে সংবাদপত্র বিক্রির কাজ নেন। শৈশবে আতশবাজি আকাশে জ্বলতে দেখে ভেবেছিলেন এমন কিছু একদিন বানাবেন যা আকাশ জয় করবে। স্বপ্নকে বাস্তবে নামিয়ে আনা সফল ব্যক্তিদের একজন তিনি। ড. কালাম ভারতের প্রতিরক্ষা গবেষণা ও প্রতিরক্ষা উন্নয়ন পরিকল্পনার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। প্রতিরক্ষা বিজ্ঞানী ও ক্ষেপণাস্ত্র যন্ত্রবিদরূপে তার খ্যাতি অচিরেই প্রতিষ্ঠিত হয়। অগ্নি, পৃথ্বী, আকাশ, ত্রিশূল, নাগা ইত্যাদি ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণে তার অবদান ও কৃতিত্ব অপরিসীম। কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি পেয়েছেন ‘ভারতরতœ’।

 

রেলে পত্রিকা বিক্রি করতেন এডিসন

টমাস আলভা এডিসন

বৈদ্যুতিক বাতির আবিষ্কারক

টমাস আলভা এডিসন। ইলেকট্রিক বাল্ব আবিষ্কারক। দরিদ্র ঘরের সন্তান ছিলেন তিনি। মেধাবী এই তরুণ বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক কাজের জন্য টাকা জোগাড় করতে কত কিছুই না করেছেন। বাবার কাছ থেকে এডিসন যা হাতখরচ পেতেন তাতে তার ল্যাবরেটরির খরচ জোগানো কঠিন হয়ে যেত। তাই তিনি শুরু করলেন ফেরি করা। ট্রেনে ফেরি করে বাদাম, চকোলেট ইত্যাদি বিক্রি করতেন। পরে শুরু করেন সংবাদপত্র বিক্রি করা। তখন চলছিল আমেরিকায় গৃহযুদ্ধ। খবরের চাহিদা বেশি হওয়ায় নিজেই একটি পত্রিকা প্রকাশ করা শুরু করলেন। নাম দিলেন হেরাল্ড। মাত্র ১৪ বছর বয়সে তিনি এ কাজ শুরু করেন। সে সময় কাগজটি খুব বিক্রি হচ্ছিল। অনেক টাকা লাভ হলেও এডিসনের হাত প্রায়ই খালি থাকত। ল্যাবরেটরিতে গবেষণা ও বই কেনার পিছনেই তার বেশির ভাগ টাকা খরচ হয়ে যেত। রেলে খবরের কাগজ বিক্রি করতে গিয়ে তিনি দেখলেন একটি খালি কামরা অব্যবহৃত পড়ে আছে। তখন সেটাকেই তিনি কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে নিজের ল্যাবরেটরিতে রূপান্তর করলেন। এখানে কাজ করতে করতেই তিনি বিদ্যুৎ শক্তি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেন। অথচ শৈশবে এডিসন বন্ধু, শিক্ষক, পরিবারের কাছ থেকে ‘বোকা’ উপাধি পেয়েছিলেন।

 

কোথাও চাকরি হয়নি তার

ব্রাড পিট

হলিউডের জনপ্রিয় ও ধনী অভিনেতা

ব্রাড পিট। হলিউডের জনপ্রিয় অভিনেতা। বক্স অফিস কাঁপানো বহু ছবির নায়ক তিনি। সম্পদশালী হলিউড অভিনেতাদের তালিকায় উপরের সারিতেই রয়েছে তার নাম। কিন্তু যুবক বয়সে হলিউডে অভিনয় করার স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই ছিল। এটা বাস্তব হতে পারে তা নিজেও কল্পনা করেননি। কাজের খোঁজে বিভিন্ন অফিস, কোম্পানিতে দৌড়ঝাঁপ করেছেন।

কোথাও ভালো কিছু হয়নি। অবশেষে একটি রেস্টুরেন্ট তাকে চাকরি দিতে রাজি হলো। তখন যা কাজ পেয়েছেন তাতেই সায় দিলেন তিনি। ব্রাড পিটের কাজ ছিল এক ক্লাউনের। রেস্টুরেন্টের সামনের দিকে বিশাল এক মুরগির পোশাক পরে আগত অতিথিদের আকর্ষণ করাই ছিল তার কাজ। এখান থেকে খুব সামান্যই আয় করতেন তিনি। শৈশবে স্প্রিংফিল্ডের সাউথ হেভেন ব্যাপ্টিস্ট চার্চে ধর্মসংগীত গাইতেন। তখনই সবার নজর পড়ে তার দিকে। সেখানকার পিয়ানোবাদক কুনি বিলয়েও বলতেন, তার দিক থেকে চোখ ফেরানো অসম্ভব। কারণ ওর মুখে দারুণ অভিব্যক্তি। সেই চোখ কিন্তু ভুল বলেনি। কারণ হলিউডের আকর্ষণীয় ও আবেদনময়ী পুরুষ হিসেবে বারবার উঠে আসে তার নাম। টেলিভিশনে অতিথি উপস্থিতির মাধ্যমে অভিনয় জীবন শুরু করেন।

 

মুম্বাই এসেছিলেন খালি হাতে

শাহরুখ খান

বলিউড বাদশাহ

শাহরুখ খান। কিং খান বা বলিউড বাদশাহ নামেই তাকে চেনেন সবাই। এখন দুনিয়াজুড়ে তার জনপ্রিয়তা। অর্থবিত্তের কোনো কমতি নেই। ক্ষমতাবান তারকাদের একজন। কিন্তু তাকেও দারিদ্র্যের পথ মাড়িয়ে আজ এখানে আসতে হয়েছে। কাজের খোঁজে যখন মুম্বাই আসেন তখন পকেটে নেই কানাকড়ি। নেই থাকার জায়গা। ঘুমুতে হতো পার্কের বেঞ্চে। কিন্তু পেট যে চালাতে হবে। বন্ধুর কাছ থেকে প্রতিদিন বিশ রুপি ধার নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন কাজের খোঁজে। কিন্তু কাজ তো সহজে মেলে না। দিন শেষে খালি হাতে হতাশ শাহরুখ খান ফিরতেন। পার্কের এক কোনায় বসে স্বপ্ন দেখতেন ভাগ্য ফেরার। এভাবেই অভাবে কাটত দিনগুলো। অবশেষে একদিন পেলেন কাজ। না, অভিনয় শিল্পী হিসেবে নয়, দরিয়াগঞ্জের একটি রেস্টুরেন্টে। মিডিয়াতে আসেন এক্সট্রা শিল্পী হয়ে। তার বেতন ধরা হয় মাত্র ৫০ রুপি। এ ৫০ রুপিই তখন তার কাছে অনেক। বন্ধুর কাছে ধার করে আর কতদিন চলা যায়। শাহরুখ প্রথমে তার নেতিবাচক চরিত্রে অভিনয়ের জন্য প্রশংসা পান। সবাই তাকে তখন ভিলেন চরিত্রেই অভিনয়ের উৎসাহ দিয়েছিলেন। কিন্তু পরে রোমান্টিক ছবি দিয়ে তিনি দর্শকের হুদয়ের সত্যিকারের নায়ক হতে পেরেছিলেন।

 

কুঁড়েঘরে থাকা কার্নেগি হলেন বিশ্বসেরা ধনী

এন্ড্রু কার্নেগি

ধনকুবের শিল্পপতি ও দানবীর

সর্বকালের শীর্ষ ধনকুবেরদের একজন এন্ড্রু কার্নেগি। ২৪ লাখ ৪১ হাজার ২২০ কোটি টাকার মালিক ছিলেন এন্ড্রু কার্নেগি। অনেকেই হয়তো জানেন না, এন্ড্রু কার্নেগি বস্তির ছেলে ছিলেন। ছোট কুঁড়েঘরে থাকতেন। ১২ বছর বয়সে তিনি স্থানীয় পাবলিক পার্কে ঢুকতে চেয়েছিলেন। তার ময়লা-নোংরা পোশাকের জন্য দারোয়ান তাকে ঢুকতে দেয়নি। সেদিনই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন কোনো দিন টাকা হলে এই পার্ক তিনি কিনে নেবেন। তারপর পরিণত বয়সে ব্যবসা শুরু করেন। লৌহশিল্পে তিনি অভাবনীয় সাফল্যের দেখা পান। স্টিলের ব্যবসা থেকে স্রোতের মতো টাকা আসতে শুরু করে। ১৯০১ সালে এক ব্যাংকারের কাছে স্টিল মিলটি বিক্রি করেন ৪৮০ মিলিয়ন ডলারে। এরপর এক বিলিয়ন ডলার মূলধন খরচ করে একটি কারখানা স্থাপন করেন। ৩০ বছর পরে এন্ড্রু কার্নেগি তার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেছিলেন। তিনি সেই পার্কটি কিনেছিলেন। সেখানে একটি নতুন সাইনবোর্ড লাগিয়েছিলেন। সে সাইনবোর্ডে লেখা ছিল ‘আজ থেকে দিনে বা রাতে, সকালে বা বিকালে, যে কোনো বয়সের, যে কোনো মানুষ, যে কোনো পোশাকে এই পার্কে প্রবেশ করতে পারবে।’ তিনি দানশীলতার জন্য খুব বিখ্যাত ছিলেন। তার সময়ে দান করা সম্পদের অর্থমূল্য ১০০ কোটি টাকারও বেশি।

 

পপকর্ন বিক্রি করে জীবন চলত

নিকোলাস কেজ

অস্কারজয়ী অভিনেতা

নিকোলাস কেজ জনপ্রিয় মার্কিন অভিনেতা। ১৯৮৯ সালে লিভিং লাস ভেগাস চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেতা বিভাগে ইন্ডিপেনডেন্ট স্পিরিট ও একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। তার অভিনয় গুণ নিয়ে প্রশংসার শেষ নেই। কিন্তু এই জমকালো জীবনের শুরুর গল্প খুব সুখের নয়। অভাবে কাটাতে হয়েছে দিন। কাজের জন্য ঘুরতে হয়েছে শহরের আনাচে-কানাচে। কাজের সন্ধান পাননি। বাধ্য হয়ে পপকর্ন বিক্রি করেন। ফেয়ারফ্যাক্স থিয়েটার তখন বেশ জমজমাট। সমাজের উঁচু শ্রেণির মানুষের আনাগোনা। নিকোলাস কেজ এই থিয়েটারে পপকর্নের প্যাকেট হাতে উপস্থিত থাকতেন। আগত দর্শকদের মিষ্টি কথায় নিজের পপকর্নের স্বাদ ও গুণাগুণের বর্ণনা দিতেন। তার পপকর্ন বেচার প্রক্রিয়াটি ছিল চমকপ্রদ। তিনি সুর করে পপকর্নের স্বাদের কথা বলতেন আর নানা মজার অঙ্গভঙ্গি করে ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন। থিয়েটারে তার উপস্থিতি ছিল আনন্দদায়ক। পপকর্ন বিক্রি করে জীবিকা অর্জনের সে গল্প ভুলে যাওয়ার নয়। হলিউড বদলে দেয় তার ভাগ্য। অনবদ্য অভিনয় সত্তা ছাড়িয়ে যায় সেই দিনগুলোর মলিন কথামালাকেও। এখন অর্থবিত্ত ও সম্মান কোনোটিরই কমতি নেই তার।

 

সাইকেলে গুঁড়ো সাবান ফেরি করতেন

কারসানিভাই পাটেল

শিল্পপতি ও নির্মা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা

নির্মা গ্রুপ। ভারতের বড় বেসরকারি ব্যবসায়িক গ্র“পের একটি। নির্মা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও মালিক কারসানিভাই পাটেল। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে তার জীবন জয়ের গল্প রূপকথাকেও হার মানায়। মানুষ আত্মপ্রত্যয়ী থাকলে, শ্রম ও ধৈর্য সাফল্যের দ্বারে পৌঁছে দেয় সেটার চমকপ্রদ উদাহরণ তিনি। কারসানিভাই প্যাটেলের জীবনে পুরো গল্পটাই কঠোর পরিশ্রম ও গভীর অধ্যবসায়ের। তিনি মাত্র ২১ বছর বয়সে রসায়নে স্নাতক হন। কিন্তু এরপর জীবিকার জন্য ঘুরতে হয় মানুষের দরজায়। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থায় ৩৫ বছর পর্যন্ত চাকরি করেছেন। তবু জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য আসেনি। তাই ১৯৮০ সালে নিজেই কিছু করার জন্য মনস্থির করেন। গুঁড়া সাবানের ব্যবসা শুরু করেন। তখন তার গুঁড়ো সাবানের তেমন জনপ্রিয়তা ছিল না। ক্রেতাদের কাছে নিজেই ছুটে যেতেন। সঙ্গী ছিল তার সাইকেল। সাইকেলে বাড়ি বাড়ি গিয়ে গুঁড়ো সাবান বেচতেন তিনি। মাত্র তিন টাকা কিলো দরে তার এ গুঁড়ো সাবান ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। একই সঙ্গে তার ব্যবসার পরিসর বাড়তে থাকে। গুঁড়া সাবানের জনপ্রিয়তা দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লে তিনি এই সাবানকে একটি কোম্পানির আদলে গড়ে তুলতে শুরু করেন।

সর্বশেষ খবর