রবিবার, ১২ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

অদ্ভুত যত গ্রাম

সাইফ ইমন

অদ্ভুত যত গ্রাম

দড়ি দিয়ে হাঁটেন সবাই সোভক্রাতে

নানা রকম অভুত গ্রামের মধ্যে রয়েছে রাশিয়ার একটি গ্রাম। এখানে মানুষ মাটি নয়, দড়ি দিয়ে হাঁটে। গ্রেটার ককাস পর্বতের কোলে গড়ে উঠেছে রাশিয়ার ছোট্ট গ্রাম সোভক্রা-১। এ গ্রামের সক্ষম ব্যক্তিরা দড়ির উপর দিয়ে হাঁটতে পারেন। তাই একে ‘টাইটরোপ ভিলেজ’ও বলা হয়। এটি একটি শতাব্দীর প্রাচীন প্রথা। কীভাবে এই প্রথা শুরু হলো তা নিয়ে প্রচলিত একটি কাহিনিও রয়েছে। পাশের পাহাড়ি গ্রামে বিয়ে করতে সোভক্রা গ্রামের পুরুষদের ট্রেকিং করে যেতে হতো। এর থেকে মুক্তি পেতে পাহাড়ের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে দড়ি টাঙাতেন। পরে সেই দড়ি বেয়েই তারা যাতায়াত করা শুরু করেন। তারপর থেকে দড়ি বেয়েই তারা হাঁটতে শুরু করেন। এখন ওই গ্রামের স্কুলের শিশুদের ‘টাইটরোপ ওয়াকিং’ শেখানো হয়।

 

শিল্পীর তুলিতে আঁকা

তাইওয়ানে রয়েছে এমন এক গ্রাম যেখানের লোকজন পুরো গ্রামটিকে সাজিয়েছেন অ™ভুত সুন্দরভাবে রং তুলির আঁচড়ে। রং-তুলির এই গ্রাম দেখতে তাইওয়ানের বাসিন্দারা এবং পর্যটকরা নিয়মিতই এসে থাকেন। এক সময় তাইওয়ানের এই গ্রামটিকে প্রোমোটাররা কিনে ফেলার চেষ্টা চালায়। সরকারও গ্রামটি ভেঙে ফেলার হুঁশিয়ারি দেয়। গ্রামটিকে বাঁচানোর জন্য একটা নতুন পন্থা বের করেন বাসিন্দা হুয়াং ইয়ুং ফু। হাতে তুলে নেন রং-তুলি। পুরো গ্রামটিকে রঙিন করে তোলেন ঘরবাড়িতে নানান চিত্র এঁকে। ধীরে ধীরে গ্রামটির নাম ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের এলাকায়। সেখান থেকে গোটা বিশ্বে। এখন এটি একটি পর্যটনস্থল হিসেবে গড়ে উঠেছে। হুয়াং ইয়ুং ফু-র এই রং-তুলিই কিন্তু শেষ পর্যন্ত গ্রামটিকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। এ কারণে গ্রামের নাম রেনবো ফ্যামিলি ভিলেজ।

 

কোস্টারিকার গ্রামে গাছে গাছে বাড়ি

কোস্টারিকার এক গ্রামই গড়ে উঠেছে জঙ্গলের গাছে গাছে বাড়ি তৈরি করে। সভ্যতার শুরুতে মানুষ এমন গাছে গাছে বাড়ি তৈরির প্রক্রিয়া থাকলেও এ সময়ে এসে শত শত গাছের ওপর বাড়ির গ্রাম সত্যিই বিরল। মধ্য আমেরিকার দেশ কোস্টারিকার একদিকে প্রশান্ত মহাসাগর। অন্যদিকে ক্যারিবিয়ান সাগর। পাহাড়, জঙ্গলে ঘেরা এই দেশে বছরে প্রায় ছয়-সাত মাস ধরে বৃষ্টি হয়। দেশের এমন এক বৃষ্টিস্নাত জঙ্গলে প্রায় ১১ বছর আগে আমেরিকার কলোরাডো প্রদেশ থেকে এক দম্পতি এসে ৬২ একর জমি কিনেন। ইচ্ছা ছিল, পর্যটকদের জন্য জঙ্গল কেটে বাড়িঘর তৈরি করবেন। চাষাবাদ করার পরিকল্পনাও তাদের ছিল। কিন্তু জঙ্গল আর প্রকৃতির ভালোবাসায় পড়ে তাদের ভাবনাটাই গেল বদলে। গাছ কাটার বদলে গাছের মধ্যেই বাড়ি করে থাকতে লাগলেন তারা। তারপর আরও বাড়ি তৈরি হলো। সে সব বাড়ি বিক্রি করলেন বেশ ভালো দামে। এভাবে চলতে চলতে আজ ৬০০ একর জঙ্গলের মালিক সেই দম্পতি।

 

এখানে সবাই দৃষ্টিশক্তিহীন

মেক্সিকোর টিলটেপেক গ্রামটিতে জাপোটেক নামের একটি জাতির তিন শতাধিক মানুষ বাস করে, যাদের সবাই অন্ধ। শুধু মানুষই নয়, গ্রামের গৃহপালিত পশুগুলোও দৃষ্টিশক্তিহীন। বিষয়টি এমন নয় যে, গ্রামের অধিবাসীরা সবাই জন্মগত অন্ধ। এই গ্রামে জন্ম নেওয়া নবজাতকরা আর পাঁচটা নবজাতকের মতোই সুস্থ-সবল অবস্থায় জন্মায়।

কিন্তু এক সপ্তাহ পরই দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলে তারা। বিষয়টি গণমাধ্যমে আসার পর নড়েচড়ে বসেন মেক্সিকোর প্রশাসন ও বিজ্ঞানীরা। কারণ অনুসন্ধানে গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। গ্রামবাসীর দাবি, লাবজুয়েলা নামে একটি গাছই তাদের এই অন্ধত্বের পেছনে দায়ী। তাদের দৃঢ়বিশ্বাস, অভিশপ্ত ওই লাবজুয়েলা গাছই তাদের দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নেয়। তবে গবেষণা করে গাছটি নিয়ে গ্রামবাসীর এমন অভিযোগের সত্যতা মেলেনি। বরং, অনুসন্ধানে চাঞ্চল্যকর তথ্য এসেছে গবেষকদের হাতে। যে ঘন অরণ্য গ্রামটিকে ঘিরে রেখেছে সেখানে বসবাস রয়েছে ‘ব্ল্যাক ফ্লাই’ নামের এক প্রজাতির বিষাক্ত মাছি। টিলটেপেক গ্রামে এই মাছির অবাধ বিচরণ রয়েছে। এই বিষাক্ত মাছির কামড়ে জীবাণু শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। যার ফলে শিশু থেকে বুড়ো এবং পশুরাও ধীরে ধীরে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলে।

 

ভারতের কেরালা রাজ্যে যেখানে সবাই যমজ

ভারতের কেরালা রাজ্যের ছোট্ট গ্রাম কোদিনহী। যেখানে প্রায় দুই হাজার পরিবার রয়েছে। এখানকার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় এ পরিবারগুলোর মধ্যে অন্তত ৪০০ পরিবারে যমজ সন্তান জন্ম নিয়েছে। যদিও ভারতের যমজ শিশু জন্মের হার খুবই কম। দেশটিতে গড়ে এক হাজার শিশু জন্মের মধ্যে সর্বোচ্চ ৯ জন যমজ হিসেবে জন্ম নেয়, কিন্তু কোদিনহীতে এই হার ৪৫। এটি বিশ্বের যে কোনো জায়গা থেকে বেশি! এত পরিমাণ যমজ শিশু জন্মের পিছনের কারণ আজও সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেননি কেউ। যদিও বহুবার বহু গবেষক, বিজ্ঞানী এটি বের করার চেষ্টা করেছেন। এখানকার অধিবাসী নাকি জায়গাটির প্রভাব তারও কোনো কারণ খুঁজে পাননি তারা। কারণ এখানকার মেয়েরা অন্য দেশে বা জায়গায় বিয়ে করলে সেখানেও যমজ শিশু জন্ম দেওয়ার তুলনামূলক আধিক্য দেখা গেছে। গ্রামটির অবস্থান ভারতের কেরালা রাজ্যের মালাপ্পুরম জেলায়। দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ এই দেশটি ভাষা, ধর্ম কিংবা প্রকৃতি সবদিক দিয়েই বৈচিত্র্যে ভরপুর। ভারতের বৈচিত্র্যের বিশেষ এক স্থান দখল করে নিয়েছে কেরালার কোদিনহি গ্রাম। বিশ্বজুড়ে গ্রামটির পরিচিতি ‘টুইন ভিলেজ’ বা ‘যমজ গ্রাম’ নামে। জেলা সদর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে প্রায় বিচ্ছিন্ন এক গ্রাম কোদিনহি। গ্রামের তিন পাশেই পানি। মাত্র একদিকে ভূমি, যেখান দিয়ে নিকটবর্তী তিরুরাঙ্গাদি শহরের সঙ্গে গ্রামের মানুষের যোগাযোগ হয়ে থাকে।

 

দাবা খেলার জন্য বিখ্যাত চেজ ভিলেজ

দাবা খেলার জন্য বিখ্যাত গ্রাম উত্তর কেরলের মারোত্তিচাল গ্রামটি। দাবা খেলার কারণে গ্রামটি এখন সবাই চেনে ‘চেজ ভিলেজ’ নামে। গ্রামের ১০০ ভাগ মানুষই দাবা খেলায় দক্ষ। একটা সময়ে এই গ্রামের বাসিন্দা জুয়া আর মদের মতো খারাপ নেশায় আসক্ত ছিল। তখন এই গ্রামের কোনো বাসিন্দাই দাবা খেলা সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। গ্রামেরই এক যুবক উন্নিকৃষ্ণ কাছেরই ছোট একটি শহরে থাকতেন। সেখানে তিনি দাবা খেলা শেখেন। গ্রামে ফিরে অন্যদেরও তিনি দাবা খেলা শেখান। আস্তে আস্তে গ্রামের লোকজনের মধ্যে দাবা বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। মদ, জুয়া ছেড়ে দাবায় আসক্ত হয়ে পড়েন গ্রামবাসী। দাবার জন্য মারোত্তিচাল গ্রামের খ্যাতি এখন বিশ্বজোড়া। গ্রামের সবাই যেখানে সেখানে বসে দাবা খেলতে থাকেন সব সময়ই। এখানকার স্কুল সিলেবাসেও দাবা আছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেকেই দাবা শিখতে আসেন এই গ্রামে। বিশ্বের আর কোথাও এমন দাবাপাগল গ্রাম একটিও নেই। 

 

জাপানে রয়েছে পুতুলের গ্রাম

পৃথিবীতে একটি গ্রাম আছে শুধু পুতুলের। যেখানে মানুষের পাশাপাশি বাস করছে পুতুলরাও।  এটি জাপানের নাগোরো গ্রাম নামে পরিচিত। এখানে ঘুরতে গেলে মানুষের বদলে দেখা মেলে পুতুলের। গ্রামের নানা জায়গায় মানুষের অভাব পূরণ করছে পুতুল। নিঃসঙ্গতা কাটানোর উপায় হিসেবে একটির পর একটি পুতুল তৈরি করতে করতে গ্রামটি হয়ে উঠেছে পুতুলের। যে অল্প ক’জন বাসিন্দা গ্রামে রয়ে গেছেন, তারা বয়স্ক বলে তেমন কোনো কাজও এখানে কেউ করেন না। এমন একটি দৃশ্য দেখে ভীষণ মন খারাপ হচ্ছিল সুকিমি আইয়ানোর। ২০০৩ সালে সুকিমি প্রথম পুতুলটি তৈরি করেন তার কৃষিজমির জন্য। এরপর প্রতিবেশীদের মুখের আদলে বানান আরও কটি পুতুল। বানানো শেষে পুতুলগুলো এমনভাবে প্রতিবেশীদের বাড়ির সামনে রাখেন যা দেখে মনে হবে সেগুলো একে অন্যের সঙ্গে খোশগল্পে মেতে উঠেছে সেই পুরনো দিনের মতো। হারানো মানুষগুলোর আদলে সুকিমি একের পর এক পুতুল বানিয়ে যেতে লাগলেন। এভাবেই নাগোরো গ্রামটি হয়ে উঠে পুতুলের গ্রাম নামে।

 

সবাই দিনরাত শুধু ঘুমায়

ঘুমন্ত মানুষের গ্রাম হলো কাজাখস্তানের এক আজব গ্রাম কালাচি। এই গ্রামের বাসিন্দারা সারাক্ষণ ঘুমিয়ে কাটান। শুনতে অ™ভুত মনে হলেও এটি সত্য। বাসিন্দারা এখানে হঠাৎ করেই ঘুমিয়ে পড়েন। সেই ঘুম অল্প কিছুক্ষণের ঘুম নয়। এই ঘুম একদিন, দুদিন এমনকি কারও কারও এক সপ্তাহ পরে গিয়েও ভাঙে। শিশু থেকে বুড়ো সবার মধ্যেই একই প্রবণতা দেখা যায়। কেউ কাজ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছেন, কেউ বা কথা বলতে বলতে! আর ঘুম থেকে ওঠার পর কারোই কিছুই মনে থাকে না। তারা সব ভুলে যান। শুধু মানুষ নয়, ওই গ্রামের পশু-পাখিও নাকি দীর্ঘ ঘুমে তলিয়ে যায়। গবেষকদের প্রাথমিক ধারণা, নিকটস্থ ইউরেনিয়াম খনির প্রভাব পড়েছে গ্রামবাসীর ওপর। প্রচুর পরিমাণে কার্বন-মনোক্সাইড সৃষ্টি হওয়ার ফলে বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, এ কারণেই যখন তখন ঘুমিয়ে পড়েন কালাচি গ্রামের বাসিন্দা।

 

বিখ্যাত পপাই গ্রাম

পপাই শো নামে রয়েছে বিখ্যাত কার্টুন সিরিজ। পৃথিবীজুড়েই এটি বিখ্যাত। কিন্তু এই পপাইয়ের যে গ্রামও আছে! এটি  মাল্টার সমুদ্রোপকূলের একটি গ্রাম। ১৯৮০ সালে বিখ্যাত কমিক চরিত্র ‘পপাই’ ছবির শুটিং হয়েছিল এ গ্রামে। সেই শুটিংয়ের জন্য মাত্র ৭ মাসের মধ্যে নেদারল্যান্ডস ও কানাডা থেকে কাঠ এবং বিভিন্ন সামগ্রী নিয়ে এসে গ্রামটি তৈরি করা হয়। ছবিতে গ্রামটির নাম রাখা হয়েছিল ‘সুইটহ্যাভেন ভিলেজ’। শুটিংয়ের জন্য তৈরি করা হলেও পরে গ্রামের ওই সেটটি এত মনোমুগ্ধকর হয় যে গ্রামটিকে ভীষণ ভালো লেগে যায় মাল্টার বাসিন্দাদের। ফলে ছবি মুক্তি পাওয়ার পরেও কৃত্রিম গ্রামের ওই সেটটি নষ্ট করতে দেননি তারা। এটাই এখন মাল্টার অন্যতম পর্যটনস্থল। প্রতিদিন অনেক লোকসমাগম হয় এখানে। এমনকি নানা রকম অনুষ্ঠান এবং বিয়ের জন্যও গ্রামটিকে ভাড়া দেওয়া হয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর