সোমবার, ১৭ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

ভালোবাসার মোড়কে মোড়া ৫১ বছর

জোহরা রাহমান

ভালোবাসার মোড়কে মোড়া ৫১ বছর

স্ত্রী জোহরা রাহমানের সঙ্গে কবি

শামসুর রাহমানের কবিতা ধারণ করেছে আমাদের সমাজসত্তার সামগ্রিক বিবর্তন। তিনি আমাদের চেতনার কাব্যিক রূপকার। ভাষা আন্দোলন পূর্ববাংলার কবিতাকে যেভাবে বদলে দিয়েছে, তাঁর কবিতাকেও সেই প্রেক্ষাপটে বিচার করতে হবে। নিভৃত কাব্যলোক থেকে তিনি সমকালের রক্ততে আলোড়িত হয়েছেন, জাতীয় জীবনের মূল কেন্দ্রস্বরকে তাঁর জীবনচেতনায় ভাস্বর করে তুলেছেন। তাঁর স্ত্রী জোহরা রাহমানের স্মৃতিকথায় পারিবারিক জীবনের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে। রচনাটি কলকাতা থেকে প্রকাশিত একটি বইয়ে স্থান পেয়েছিল।

 

আমি তখন নবম শ্রেণিতে পড়তাম, বয়স ১৫/১৬। সে সময় ওনার এক বোনের বিয়েতে আমার সঙ্গে তাঁর প্রথম দেখা হয়। সেদিন আমার সঙ্গে আমার ছোট বোনও ছিল। সে আমাকে শামসুর রাহমানকে দেখিয়ে বলে, ওই ছেলেটা আপনাকে কেমন করে দেখছে। নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। আমি তখন তাকে বকা দিয়ে বলি, তুমি এসব কী বলছ? এরপর আমিও তাঁর দিকে তাকালাম, অমনি সুন্দর একটা হাসি দিলেন। তারপর আমি লক্ষ করলাম আসলেই আমি যেখানে যাচ্ছি, উনিও সেখানে। এ ব্যাপারটা তাঁর আত্মজীবনী ‘কালের ধুলোয় লেখা’তে উনি খুব চমৎকার করে লিখেছেন- ‘আমার এক বোনের বিয়েতে দূরসম্পর্কের একজন আত্মীয়ার সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হলো আমার। ওর চেহারার মাধুর্য, চোখের দৃষ্টি আমাকে অত্যন্ত মুগ্ধ করে। কিন্তু তার সঙ্গে আমার কোনো কথা হয়নি। আমার মেজো ভাবির নিকটাত্মীয়া সে। পরিচয়ের এইটুকুই সূত্র। মাঝে মাঝে আমাদের বাসায় আসত। আমি দূর থেকে ওকে দেখতাম, সে-ও কখনো-সখনো বারান্দায় এসে আমার দিকে তাকাত। মনে হতো, আমি যে ওকে পছন্দ করি, তার জন্য আমার এক ধরনের টান আছে, তা সে বুঝতে পেরেছিল। বেশ পরে জানতে পেরেছিলাম, সে ওর আম্মার সঙ্গে আমাদের আশেক লেনের বাড়িতে আসার জন্য বাহানার আশ্রয় নিত।’

ঘটনাটা আসলেই এরকম ছিল। আমার খালা ছিল তার ভাবি। খালার সঙ্গে তাঁদের বাসাতে আমি আমাদের বিয়ের আগে কয়েকবার গিয়েছি। হয়তো তাকে দেখার জন্যই গিয়েছি। দেখলেই একগাল হাসি। মায়াভরা সে হাসিটা যেন আমার শিরায় শিরায় বয়ে যেত। এভাবে লুকোচুরি, একটু দেখার জন্য দিনের পর দিন ব্যাকুল অপেক্ষা। এভাবেই কেটে গেল আরও অনেক দিন। একপর্যায়ে তিনি তার ওই ভাবির মাধ্যমেই বিয়ের প্রস্তাব দেন। তখন তিনি কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাননি। কোনো কাজকর্মও ছিল না; একরকম বেকার। এরকম ভবঘুরে উদাসীন ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে বাবা-মা-রা আগ্রহী হয় না। কিন্তু আমার স্বল্প-শিক্ষিত বাবার মনে হয়েছিল এক দিন তিনি অনেক বড় কবি হবেন। জীবনে উন্নতি করবেন। এভাবে বাবার আগ্রহে আমাদের বিয়ে হয় ১৯৫৫ সালের ৮ জুলাই। বিয়ের আগে-পরে বাবা তাকে খুবই স্নেহ করতেন। তিনিও বাবাকে অনেক শ্রদ্ধা করতেন।

দূর থেকে আড়চোখে দেখাদেখি দীর্ঘদিন ধরে চললেও বিয়ের আগে তাঁর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়নি। প্রথম কথা হয় আমাদের বাসরঘরে। আমার প্রায়ই মনে পড়ে তাঁর ছোট ভাই সাইফুর রাহমান (ডাকনাম তারা) ওনাকে কোলে তুলে আমাদের বাসরঘরের বিছানার কাছে নিয়ে আসে। বিছানাজুড়ে ফুল ছড়ানো ছিল। পুরো ঘরটা তাজা ফুলের গন্ধে ভরে গিয়েছিল। তিনিই প্রথম কথা বললেন, ‘ঘরটা পছন্দ হয়েছে তোমার? আমি কিছু বলতে পারিনি লজ্জায়। এর আগে আমাদের এক গ্লাস দুধ দেওয়া হলো। তার অর্ধেক তিনি খেলেন এবং বাকিটা আমি। তারপর নামাজ পড়ে তিনি আমাকে আশীর্বাদ করলেন। আমি একটা নথ পরেছিলাম। অদক্ষ হাতে সেটা তিনি খুলতে গেলে আমার একটু ব্যথা লেগেছিল। বিষয়টা বুঝতে পেরে তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন। তারপর ব্যথা কমানোর জন্য তিনি অনেক আদর করলেন। আমাদের বিয়েটা খুব জাঁকজমকপূর্ণ হয়েছিল। অবাক লাগে আমার শ্বশুর তার বেকার ছেলের বিয়েতে প্রায় এক মাসব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। তখন তাদের একটা গাড়ি ছিল খুব সুন্দর। সে গাড়িতে করে আমি শ্বশুরবাড়ি এসেছিলাম। বিয়েতে শ্বশুর বেশ দামি শাড়ি আমাকে দিয়েছিলেন।

বিয়ের আগে শামসুর রাহমান আমাকে একটা চিঠি পাঠিয়েছিলেন। ডাকবিভাগের কল্যাণে সেটা আমার হাতে এসে পৌঁছায়নি। তবে বিয়ের পরপরই তিনি আমায় নিয়ে একটি কবিতা লিখলেন; নাম ছিল ‘জোহরার জন্য’। আরও অনেক কবিতা তিনি আমাকে নিয়ে লিখেছেন। ওনার চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ বিধ্বস্ত নীলিমা প্রকাশ হয় ১৯৬৭ সালে। ওই বইয়ের উৎসর্গ-পত্রটি লিখেছিলেন আমাকে নিয়ে, সেটি ছিল এরকম :- জোহরাকে/ ভীষণ অস্থির আমি, সম্প্রতি/ক্ষমায় অপারগ।/ সদর রাস্তাকে ভয়, ঘোরালো সিঁড়িকে ভয়-। কী যে এই রোগ!/আমার জীবন যেন সীমাহীন অরণ্যে রোদন।...

বিয়ের পর অনেক বছর পর্যন্ত তিনি এমন করতেন যে, এক সেকেন্ডের জন্যও আমাকে না দেখে থাকতে পারতেন না। উনি আবার খুব হাসিঠাট্টা প্রিয় ছিলেন, আনন্দে থাকতে এবং অন্যদের আনন্দে রাখতে বেশ পছন্দ করতেন। আমি অন্তর্মুখী হওয়ায় তাঁর সেই ঠাট্টায় তেমন কার্যকর অংশগ্রহণ করতে পারতাম না। তবে আমার ছোট বোন তাঁর সঙ্গে অনেক ঠাট্টা করত। আমার স্বামী আমার সঙ্গে কখনো মুখ কালো করে কথা বলেননি। বাইরে থেকে এলে বা আমি একটু চোখের আড়ালে গেলেই ‘জোহরা জোহরা’ বলে ডাকতেন। আমাকে একটু দেখতে না পেলেই খোঁজ করতেন। আমাকে তিনি রানীর মতো করে রেখেছিলেন। আমার শাশুড়ি, ননদ-দেবররাও আমাকে খুব ভালোবাসতেন। তাই আমার প্রথম সংসার জীবনের স্মৃতি আমি ভুলতে পারি না, যদিও তখন নিদারুণ অর্থকষ্ট ছিল সংসারে। আমরা যখন যৌথ পরিবারে ছিলাম, তখন আমার শাশুড়ি প্রায়ই খাবার সময়ে আমি খেয়েছি কিনা জানতে আসতেন। না খেলে তিনি বলতেন, ‘মা খাও, খেয়ে নাও।’ আমার শ্বশুরও আমাকে খুব স্নেহ করতেন। আমাদের যখন বিয়ে হয়েছিল, তখন তিনি বেকার। তাই সংসারে আর্থিক সচ্ছলতা ছিল না। তারপরও যখনই তিনি কবিতা লিখে কোনো টাকা পেতেন, তা দিয়ে বই নিয়ে আসতেন এবং আমাকে দুঃখ করে বলতেন, ‘তোমাকে তো কখনো কিছুই দিতে পারলাম। তখন আমি বলতাম, আমার কিছু লাগবে না। আপনি আপনার পছন্দের জিনিস বই নিয়ে এসেছেন তাতেই আমি খুশি।’ এরই মধ্যে আমাদের বড় মেয়ে সুমীর জন্ম হলে তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন। ওর দুধের কৌটো থেকে শুরু করে সবকিছু কিনতে তাঁর খুব ভালো লাগত। সুমীকে নিয়ে তিনি ‘আয়না’ নামে ছড়াও লিখেছেন।

পরে চাকরি পাওয়ার পর বেতনের সব টাকা এনে আমার হাতে দিতেন। তিনি প্রায়ই রাতে দেরি করে বাসায় ফিরতেন। আমাদের বাসার সামনের দিকে তখন একটা বড় বারান্দা ছিল। আমি সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাঁর জন্য অপেক্ষা করতাম। এ নিয়ে আমার কখনো রাগ হতো না। অনেক অপেক্ষার পর তিনি যখন ফিরতেন, আমি অভিমান করে বলতাম, ‘প্রতিদিন আপনি এত দেরি করে আসেন, আমার ভালো লাগে না।’ তিনি তখন আমাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বলতেন, ‘সরি’। তিনি সরি বলার সঙ্গে সঙ্গে আমার রাগ শেষ।

তিনি রাতে ফেরার পর যদি কখনো আবার লাইট জ্বালিয়ে কবিতা লিখতে বসতেন তাতে আমার সমস্যা হলেও আমি কখনো আপত্তি করতাম না। কেননা তার শুধু হাঁটাটা দেখেই আমার মনে হতো তিনি এক দিন অনেক বড় কবি হবেন। ঘরময় হাঁটতেন আর বাতাসে আঙ্গুল চালিয়ে যেন কিছু একটা লিখতেন। তিনি যে কবিতাগুলো লিখতেন আমাকে কাছে ডেকে সেগুলো পড়ে শোনাতেন। তাঁর কবিতা লেখার নির্দিষ্ট কোনো সময় ছিল না। সব সময়েই তিনি কবিতার লাইন ভাবতেন। এমনও হয়েছে তিনি ঘুম থেকে হঠাৎ জেগে লিখতে বসে গিয়েছেন। বুকের মধ্যে বালিশ নিয়ে পা-টা লম্বা করে উপুড় হয়ে লেখা ছিল তাঁর নিয়মিত অভ্যাস। এটা দেখতে আমার কাছে বেশ ভালো লাগত। যুবক বয়সে তিনি খুব সুদর্শন ছিলেন, একটা মেয়ের স্বপ্নের রাজকুমারের মতোই ছিল চলন-বলন। তাই অনেক মেয়েই আকৃষ্ট হতো। এই সুযোগে কেউ কেউ বাসায় ফোন করে আমাকে বলত, ‘আপনার স্বামীকে আজকে অমুক জায়গায় অমুক মেয়ের সঙ্গে দেখেছি।’ আমাদের মধ্যে কলহ সৃষ্টি করতে, সম্পর্কে ফাটল ধরাতে অনেকজন চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আমি কখনো সেগুলোকে গুরুত্ব দিইনি। কেননা আমি জানতাম, কবিদের অনেকেই পছন্দ করেন। তাদের কবিতা পছন্দ করেন। আমি আরও একটা বিষয় খুব স্পষ্ট করে জানতাম, তিনি আমাকে ভালোবাসেন। তাই তাঁর কাছে আমি কখনো এ বিষয়গুলো তুলিইনি। আমার শ্বশুর তার সঙ্গে এসব নিয়ে ঠাট্টা করতেন। উপদেশ দিতেন। কিন্তু আমি কোনো দিন কিছুই বলিনি। উনি বিভিন্ন মেয়েকে নিয়ে কবিতা লিখতেন। কবিতায় সেসব মেয়েদের শারীরিক সৌন্দর্যের বর্ণনাও থাকত। এ ব্যাপারেও কখনো আমার কোনো অভিযোগ ছিল না। আমি তাঁকে আরও উৎসাহ দিতাম। মাঝে মাঝে অভিমান করে বলতাম, ‘আপনি খালি অন্যদের নিয়ে কবিতা লেখেন।’ উনি হাসতেন। বলতেন, ‘জোহরা, তুমি কী যে বল, তুমিই তো আমার সব’। ওনার প্রেমের কবিতাগুলো পড়ে আমার কখনো মনে হয়নি তিনি অন্য কোনো নারীকে উদ্দেশ্য করে এসব লিখেছেন। কেননা আমি পরিপূর্ণ আস্থা নিয়ে বলতে পারি, আমার স্বামী আমার।

একবার এক মেয়ে ওনার হাত ধরার জন্য আমার কাছে অনুমতি চেয়েছিল। আমি অনুমতি দিয়েছিলাম। তার হাতটা ধরার জন্য অনেকে আগ্রহ পোষণ করতেন। তিনি আমার সঙ্গে প্রায়ই আমাদের বিয়ের গল্প করতেন। তিনি মাঝে মধ্যেই বলতেন, ‘তুমি খুব সুন্দর’। রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে দেখতাম তিনি আমার মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে আছেন। আমার ডায়াবেটিস হওয়ার পর তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘তোমার স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যাচ্ছে। খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো কর’। বিয়ের আগে তাঁর লেখা চিঠিটা তো আমি পাইনি। বিয়ের পরে তিনি যখন পশ্চিম বাংলায় ছিলেন তখন আমাকে খুব সুন্দর করে চিঠি লিখতেন। তিনি লিখতেন, ‘ঘুমুতে যাবার সময়ে আমার মুখটা তাঁর চোখে ভেসে ওঠে’। আরও সুন্দর করে অনেক কথা চিঠিতে লিখতেন। দুঃখের বিষয়, একবার খুব বৃষ্টিতে আমাদের নিচতলার ভাড়াবাড়িতে ঘরের মধ্যে পানি উঠে গিয়েছিল। এতে ওনার অনেক বই এবং তার লেখা চিঠিগুলো নষ্ট হয়ে গিয়েছে।

তার লেখা ‘কখনো আমার মাকে’ কবিতাটি আমার সবচেয়ে ভালো লাগে। তিনি যখনই কোনো কবিতা লিখতেন, আমাকে পড়ে শোনাতেন। হয়তো আমি কাজ করতাম। আর তিনি কাগজটা নিয়ে পড়ে শোনাতেন। শুনে আমি বলতাম, ‘খুব সুন্দর হয়েছে। তবে আরও ভালো লিখতে হবে।’

আমরা শ্যামলীতে এসেছি প্রায় ১৫ বছর। তার আগে আমরা তল্লাবাগে ছিলাম। তখন তাঁর জন্য আলাদা কোনো রুম ছিল না। বাচ্চারা বাসায় অনেক হইচই করত। কিন্তু তারপর তিনি কোনোরকম আপত্তি ছাড়াই লিখতেন। আমাদের ছেলেমেয়েদের আমি বলে দিয়েছিলাম যে, যখন তিনি লিখছেন বুঝতে পারবে তখন যেন কেউ তাঁর রুমে না যাও। ওরা আমার কথা শুনত। কারণ আমরা সবাই চাইতাম তিনি অনেক বড় কবি হন। তাঁর পড়াশোনার কোনো নির্দিষ্ট সময় ছিল না। যখনই সময় পেতেন তখনই পড়তেন। কখনো টেবিলে, কখনো শুয়ে শুয়ে পড়তেন।

একবার আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। তখন তিনি পশ্চিম বাংলায় ছিলেন। তিনি আমার অসুস্থতার কথা শুনে সারারাত কেঁদেছেন, কপাল ঠুকেছেন। পরের দিন সকালে প্লেনে চলে এলেন, ওনার সফরসঙ্গীর কাছে শুনেছি অসুস্থতার খবর পাওয়ার পর থেকে পরদিন আমার সঙ্গে দেখা না হওয়া পর্যন্ত পুরোটা সময়ই তিনি কেঁদেছেন।

খাওয়া-দাওয়ার ক্ষেত্রে তিনি অনেক শৌখিন ছিলেন। মাংস, খাসির চাপ ভুনা, লাউয়ের ক্ষীর খুব পছন্দ করতেন। তিনি আমার রান্না খেলেই বুঝতে পারতেন। কোনো দিন হয়তো কোনো কারণে আমি কিছু একটা রান্না করিনি, অন্য কেউ করেছে তিনি ঠিকই সেটা বুঝতে পারতেন।

বিয়ের আগে তিনি বেশ অগোছালো ছিলেন। ঠিকমতো গোসল করতেন না, নখ কাটতেন না, কাপড়-চোপড় পরিষ্কার করতেন না। বিয়ের পর আমি তাঁর নখ কেটে দিতাম। তিনি উহু লাগছে বলে চিৎকার করতেন। আমি কাপড় ধুয়ে দিতাম। তাঁকে বাথরুমে নিয়ে পানি ঢেলে গোসল করিয়ে দিতাম। শীতের মৌসুমে এরকম পানি ঢালতে গেলে তিনি ঠান্ডায় লাফিয়ে উঠতেন। গোসল সেরে এলে চুল আমি আঁচড়ে দিতাম। আমি যেই কাপড়টা দিতাম সেটাই তিনি পরতেন। তিনি নিজের কাপড় তেমন না কিনলেও আমার জন্য মাঝে মাঝে শাড়ি নিয়ে আসতেন। একবার খুব সুন্দর একটা হার নিয়ে এসেছিলেন বিদেশ থেকে। বিয়ের পর তাঁর সঙ্গে আমি অনেক জায়গায় বেড়াতে যেতাম। অনেক রাত পর্যন্তও আমরা বাইরে বেড়িয়েছি। তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে প্রায়ই আমরা রাত ১২টা থেকে ১টার দিকে বাসায় ফিরেছি। সেই আড্ডায় গান, কবিতা হতো, নানা প্রসঙ্গে সবাই কথা বলত। জমিয়ে আড্ডা দিতে তিনি পছন্দ করতেন। তবে আড্ডায় তিনি কথা কম বলতেন, অন্যের কথা শুনতেন আর উপস্থিত লোকদের লক্ষ করতেন। একবার এক আড্ডাতে একজন আমাকে বলল, ‘আপনি কি শামসুর রাহমানের দ্বিতীয়া স্ত্রী?’ আমি অবাক হয়েছিলাম, রেগে গিয়েছিলাম। আমি তখন অনেক স্লিম ছিলাম। বয়স অল্প মনে হতো, তাই হয়তো তিনি এ কথা বলেছিলেন। আমার চোখ-মুখ বসা ছিল। এ ব্যাপারটা আমার স্বামীর ভালো লাগত। আমি এ নিয়ে হাসতাম। তিনি বলতেন, ‘বুঝবে না, বিদেশে এটাকে বিউটি বলে’। আমার ‘বিউটি বোন’ উনি ভীষণ পছন্দ করতেন।

তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘তোমার চোখটা খুব সুন্দর। হাসিটা সুন্দর’। আমি তখন আরও খিলখিলিয়ে হাসতাম। তিনি তখন বলতেন, ‘বেকুবের মতো তুমি হাসছ’। এটা শুনে আমি আরও হাসতাম।

যে ছেলেটা আমাদের মারা গিয়েছে তার মায়া উনি শেষ পর্যন্ত কাটিয়ে উঠতে পারেননি। ওর ব্যাপারে তিনি প্রায়ই কথা বলতেন, ‘এই দ্যাখো, মতিন এসেছে। আমার হাত ধরেছে।’

প্রথমদিকে আমরা আর্থিকভাবে সচ্ছল না থাকলেও যা ছিল তাতে আমরা সবাই সন্তুষ্ট ছিলাম। আমার বড় মেয়ে এবং ছোট মেয়ের মধ্যে তার প্রভাবটা বেশি। ছোট মেয়ে একবার ১২টা খুব সুন্দর কবিতা লিখেছিল। ওনাকে বললাম ওগুলো বেগম পত্রিকায় ছাপিয়ে দিতে। তাতে মেয়েটা উৎসাহ পাবে। উনি বললে অবশ্যই ছাপত, কিন্তু উনি বলেননি। হয়তো উনি ওগুলোকে মানসম্পন্ন কবিতা মনে করেননি। তিনি এমনি ছিলেন, অযাচিত কোনো কিছু পছন্দ করতেন না। অনেকেই কোনো না কোনো বয়সে কবিতা লিখতে চেষ্টা করে, তবে আমি কখনো কবিতা লিখিনি। ওনার সামনে তার কবিতাগুলো আবৃত্তি করার চেষ্টাও করিনি। এক ধরনের সংশয় আমার মধ্যে কাজ করত যে, আমি এত বড় কবির স্ত্রী। ওনার মতো আবৃত্তি না করতে পারলে মানুষ কী বলবে? এটা ভেবে আমি সেসবের দিকে পা বাড়াইনি।

তার অনেক বন্ধু-বান্ধব ছিল। তারা আসত আমাদের বাসায়। মাঝে মাঝে ২৫ জন, কখনো ৪০ বা ৫০ জন। তারা খাওয়া-দাওয়া করে যেত। আমি কখনো বিরক্ত হইনি। বরং তার এত বন্ধু দেখে আমার ভালো লাগত। মাঝে মাঝে এমন হতো তাঁর বন্ধুরা বাসায় আসবে তিনি জানতেন কিন্তু আমাকে বলতে ভুলে গেছেন। আমার কোনো পূর্বপ্রস্তুতি থাকত না। বন্ধুরা আসার পর তাঁর মনে পড়ত। তখন আমার খুব রাগ হতো। তখন তিনি শুধু বলতেন, ‘জোহরা, সরি’। আমার সমস্ত রাগ তখন পানি হয়ে যেত।

উনিশশ একাত্তরে আমরা সবাই পালিয়ে নরসিংদীর গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম। ওখান থেকে তিনি মুক্তিযুদ্ধে চলে যেতে চাইলেন। কিন্তু আমার শাশুড়ি তাঁকে বললেন, ‘তুমি চলে গেলে আমাদের ওপর খুব অত্যাচার হবে’। ভীষণ মা-ভক্ত ছিলেনÑতাই মায়ের কথা তিনি ফেলতে পারেননি। আমি বলতাম, ‘আপনি যেটা ভালো বোঝেন সেটা করেন’। যুদ্ধ চলাকালীন আমরা আবার ঢাকায় ফিরে এলাম। সে সময় আমরা খুব ভয়ে ভয়ে চলাফেরা করছিলাম। এক দিন ইসলামউদ্দিন নামে ওনার এক কলিগ এসে বললেন, আপনারা এ বাড়ি ছেড়ে অন্য জায়গায় দ্রুত চলে যান। আপনাদের ওরা (পাকিস্তানিরা) মেরে ফেলবে। তখন চুলোয় ভাতের পাতিল ছিল। ওই অবস্থায় রেখেই সঙ্গে সঙ্গে আমরা অন্যত্র চলে যাই। যাওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যে পাকিস্তানি আর্মি এসেছিল। আমাদের মহল্লার মানুষেরা খুব ভালো ছিল। তারা সে সময় আমাদের বাজার করে এনেছে, রান্না করে খাইয়েছে।

আমাদের মেয়েদের বিয়ে তার পছন্দেই হয়েছিল। বড় মেয়ের পাত্রের ব্যাপারে আমি বলেছিলাম, ‘ছেলেটা কালো’। কিন্তু তিনি বলেছিলেন, ‘না, কালো না। সুন্দর’। বিয়ের আগে ওই ছেলের বাসায় আমরা গিয়েছিলাম তখন খেতে গিয়ে ওর মায়ের গলায় একটু খাবার আটকে গিয়েছিল, ছেলে উঠে গিয়ে মাকে পানি এনে দেয়। এ ব্যাপারটা আমার স্বামীর খুব ভালো লেগেছিল। বলেছিলেন, ‘যে ছেলে তার মায়ের আদর-যতœ করে সে আমার মেয়েরও করবে।’

মেয়েদের লেখাপড়া, ঘর-সংসার কেমন চলছে এসব নিয়ে তিনি আমার সঙ্গে কথা বলতেন। আমি তাঁর সঙ্গে আমেরিকা, কানাডা ও ভারতের বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছি। আমি আইসক্রিম খুব পছন্দ করতাম। তিনি আইসক্রিম এনে আমায় দিতেন। খাইয়ে দিতেন। এখনো যখন আমি আইসক্রিম খাই তখন তাঁর কথা আমার মনে পড়ে। আমি শাড়ি পরলে তিনি খুব খুশি হতেন। বলতেন, ‘শাড়ি পরলে তোমাকে খুব সুন্দর লাগে’। সবার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক খুব ভালো ছিল। গরিব-ধনী তিনি ভেদাভেদ করতেন না। যে কেউ এলে তিনি পাশে বসিয়ে কথা বলতেন। একসঙ্গে খেতেন। গরিবদের ঘৃণা না করে ভালোবাসার শিক্ষা আমি তাঁর কাছ থেকে পেয়েছি। গরিবদের নিজের কাপড় তিনি দিয়ে দিতেন।

মাঝখানে ভীষণ ব্যস্ততার কারণে সবসময় তিনি আমার পাশে থাকতে পারতেন না। কিন্তু প্রথম বয়সের মতো শেষ বয়সেও তিনি এক সেকেন্ডের জন্যও আমাকে চোখের দূরে যেতে দিতেন না। রান্নাঘরে গেলেও তিনি আমাকে ডেকে পাশে বসিয়ে রাখতেন। আমি চাল বাছছি বা মাছ কাটছি, তিনি গিয়ে পাশে বসতেন। আর নিচু স্বরে আমার সঙ্গে গল্প করতেন।

তিনি কখনো আমার সঙ্গে রেগে কথা বলতেন না। খুব ভালোবাসতেন। আমাদের মেয়েদের বা ছেলের বউ টিয়ার বাসায় ফিরতে একটু দেরি হলেই তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়তেন। দুই মেয়ে সেবা কানাডায় আর ফৌজিয়া আমেরিকায় থাকে; শেষ ক-বছর ওদের কথা খুব মনে করতেন। মেয়েরা বা ওদের স্বামীরা ফোন করলে বলতেন, ‘আর কি তোমাদের সঙ্গে দেখা হবে?’ এসব বলে খুব কাঁদতেন।

তিনি আমাকে কখনো কখনো গেয়ে শোনাতেন, যেমন একটা গানÑ যায় তো যায়ে কাহা...। আর একটা মুকেশের গান গাইতেন। সেটা এখন আমার মনে পড়ছে না।

উনি হঠাৎ চলে গেলেন। কিন্তু আমি ছিলাম তাঁর চেয়েও বেশি রোগা। ওনার বিদায়ে মনের দিক দিয়ে আমি মরে গেছি। কারণ অমন একজন ভালো মানুষ আমার পাশে আর নেই। ঘুরেফিরে কত স্মৃতি মনে পড়ে, ভাবতে ভাবতে আমার চোখ ভিজে যায়...।

সর্বশেষ খবর